গুপ্তিপাড়ার গুপ্তমঠ । Guptiparar Guptomath, Hooghly

গুপ্তিপাড়ার গুপ্তমঠ । Guptiparar Guptomath, Hooghly

কলকাতা থেকে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গুপ্তিপাড়া গড়ে উঠেছে হুগলী নদীর তীরে বাংলার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে এই গুপ্তিপাড়া কিন্তু আদতে এক বিশাল ইতিহাসের খনি, যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে জনপ্রিয় হয়ে আসছেএকদিকে যেমন এই অঞ্চলে গড়ে উঠেছে দশনামী শৈবসম্প্রদায়ের মঠ তো অন্যদিকে আবার ভারতীয় শিক্ষা সংস্কৃতির জন্য গড়ে উঠেছিল একাধিক টোল। এছাড়াও বাংলার রথযাত্রার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হল এই গুপ্তিপাড়া, এমনকি বিখ্যাত কবিয়ালি ভোলা ময়রা ও অন্যদিকে বাংলার শেষ নবাব সিরাজদৌলার অন্যতম সেনাপতি মোহনলাল এর জন্মস্থান এই গুপ্তিপাড়াতেই। এমনকি বাংলার প্রথম বারোয়ারি পুজোর সূত্রপাত হয় এই গুপ্তিপাড়া-তেই তাই গুপ্তিপাড়ার ইতিহাস জানতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় ৫০০ বছর আগের বাংলায়।

প্রথমেই বলে রাখি, গুপ্তিপাড়া নিয়ে লিখতে গিয়ে ব্লগটিকে দুটি ভাগে ভাগ করেছি। গুপ্তিপাড়ার এই ব্লগে রইল গুপ্তিপাড়ার উত্থান ও গুপ্তিপাড়ার মঠ এবং মন্দির প্রসঙ্গ। আর গুপ্তিপাড়ার দ্বিতীয় ব্লগে রইল গুপ্তিপাড়ার ঐতিহ্য ও সমাজসংস্কৃতি।  

গুপ্তিপাড়ার ইতিকথাঃ-

বর্তমানে গুপ্তিপাড়া হুগলী নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থান করলেও, ১৪৭০ খ্রিষ্টাব্দে ভূ-পর্যটক জন স্প্লিনটার স্টারভিনাস এর  আঁকা ম্যাপে দেখতে পাওয়া যায় গুপ্তিপাড়া নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থান করছে। কিছু ইতিহাসবিদ এক্ষেত্রে চিহ্নিতকরণের ভুল হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আবার কিছুজন তা মানতে চাননি। এক্ষেত্রে সেই তর্কে না গিয়ে আমরা এটুকু স্থির করতে পারি, যে পূর্বের গঙ্গা (হুগলী নদী) ও বর্তমান গঙ্গার গতিপথ এক নয়; কারণ কালের নিয়মে গঙ্গার গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে, সেক্ষেত্রে আগের গুপ্তিপাড়া গঙ্গার পূর্বদিকে অর্থাৎ বামদিকে অবস্থান করাও অস্বাভাবিক নয়, কারণ বর্তমানে হুগলী নদীর গতিপথ লক্ষ করলে দেখা যাবে বর্ধমানের কালনার পর গুপ্তিপাড়ার কাছে এসে হুগলী নদী পূর্বদিকে অনেকটা U আকৃতি বাঁক নিয়েছে। 

এবার প্রশ্ন জাগতে পারে এমন নামকরণের কারণটা কী? এক্ষেত্রে উত্তর পেতে হলে হলে আমাদের দেখতে হবে গুপ্তিপাড়ার সূচনা হয়েছিল কবে? ইতিহাসের বিভিন্ন দলিলদস্তাবেজ থেকে অনুমান করা গেছে গুপ্তিপাড়ার সূচনা আনুমানিক ১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই হবে। ইতিহাসবিদদের মতে ১৪১৮ খ্রিষ্টাব্দে যখন পান্ডুরার রাজা গনেশের পুত্র জালালুদ্দিন মুহম্মদ শাহ সিংহাসনে বসেন তখন রাজ্যজুরে হিন্দুদের উপর চলতে থাকে চরম অত্যাচার। আর এই অত্যাচার থেকে মুক্তির আশায় অনেকেই দেশত্যাগ করে সংঘবদ্ধ হতে শুরু করে এবং নিজেদের বসতি শুরু করার জন্য চলে আসে নদীর এই পাড়ের অংশে, আর এভাবেই উত্থান হয় গুপ্তিপাড়ার। পরবর্তীকালে হুসেনশাহি আমলের শুরুর দিকে বাংলার কিছু গ্রাম মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামে পরিণত হয়ে যায়, যার মধ্যে ছিল এই গুপ্তিপাড়া। ফলে এখানেও বসতি শুরু করে বিভিন্ন মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ যাদের মধ্যে ছিল বিভিন্ন মৎস্যজীবী ও মাঝিমাল্লারাএছাড়াও এখানে ছিল চট্টশোভাকর বংশগোপতি অর্থাৎ বৈদ্য সম্প্রদায়। মোগলসাম্রাজ্যের গোড়ার দিকে গুপ্তিপাড়া প্রচার পেয়েছিল তন্ত্রসাধনার গুপ্তস্থল হিসাবে, যেখানে পুজো হত দশমহাবিদ্যার। যদিও বর্তমানে আর সেসব মন্দিরের কোনো অস্তিত্ব নেই। কিন্তু যতদূর জানা যায় গুপ্তিপাড়ার দেশ কালীমাতার মন্দির সেই দশমহাবিদ্যার পরিবর্তিত বর্তমান রূপ।

মঠের প্রবেশপথ

কেমন ছিল তখনকার গুপ্তিপাড়া? সে সন্ধান পাওয়া যায় তখনকারই প্রচলিত এক ছড়ায়

বাঁদর শোভাকর মদের ঘড়া

তিন নিয়ে গুপ্তিপাড়া

এখানে বাঁদর বলার অর্থ একসময়ে গুপ্তিপাড়ায় গাছে গাছে প্রচুর বাঁদর দেখতে পাওয়া যেত, আর শোভাকর অর্থাৎ গুপ্তিপাড়ার চট্টশোভাকর বংশ এবং মদের ঘোড়া বলার কারণ তান্ত্রিকদের সাধনার স্থল।

এবার আসা যাক আমাদের মূল প্রশ্নে গুপ্তিপাড়া নামকরণের কারণ কী? গুপ্তিপাড়ার ইতিহাস ঘেঁটে যতদূর জানা গেল গুপ্ত কথাটির সূত্রপাত গুপ্তপল্লী থেকে যা ছিল বৈদ্যাচার্যদের গুপ্ত তন্ত্রসাধনার কেন্দ্র গুপ্তপল্লী থেকে গুপ্তিপাড়া। আবার অনেকের মতে যেহেতু গুপ্তিপাড়ায় গড়ে উঠেছে বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির তাই জায়গাটি পরিচিত গুপ্ত বৃন্দাবন পল্লী হিসাবেতাদের মতে গুপ্ত বৃন্দাবন পল্লী থেকে গুপ্তপল্লী, আবার গুপ্তপল্লী থেকে গুপ্তিপাড়া। কিন্তু এক্ষেত্রে যে ধারনাটা ভুল তাঁর স্পষ্ট কারণ গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির প্রতিষ্ঠানের সময়কাল আনুমানিক ১৮১০ খ্রিষ্টাব্দ (যদিও মঠের সবচেয়ে পুরনো চৈতন্যদেব মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় আনুমানিক ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে) কিন্তু স্টারভিনাস এর আঁকা ১৪৭০ খ্রিষ্টাব্দের ম্যাপে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায় গুপ্তিপাড়ার নাম। তাই গুপ্তিপাড়ার নাম গুপ্তপল্লী থেকে আসলেও সে পল্লী বৃন্দাবন পল্লী না হয়ে তন্ত্রসাধনার গুপ্তপল্লী থেকে আসাই অর্থপূর্ণ।

এবার ফিরে যাওয়া যাক আমাদের প্রধান গন্তব্য গুপ্তিপাড়ার মঠ প্রাঙ্গনে।

মঠের তোড়নে টেরাকোটার অলংকার

গুপ্তিপাড়ার মঠ

শুরুতেই বলা হয়েছিল গুপ্তিপাড়ার মঠ আসলে দশনামী শৈবসম্প্রদায়ের মঠ, যা তারকেশ্বরের মোহান্তের অধীন দশনামী শৈব সম্প্রদায়ের মঠবাড়িএবার প্রশ্ন উঠতেই পারে এই দশনামী সম্প্রদায় কারা? সে প্রসঙ্গে বলি আনুমানিক ৮০০-৯০০ খ্রিষ্টাব্দে আদিশঙ্করাচার্য তাঁর বেদান্তশাস্ত্র ও তত্ত্বঞ্জান প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতের চারস্থানে (দক্ষিণে কর্ণাটকের শৃঙ্গেরীতে, পশ্চিমে গুজরাটের দ্বারকায়, পূর্বে ওড়িশার পুরীতে এবং উত্তরে উত্তরাখন্ডের জ্যোতির্মঠে) চারটি মঠ স্থাপন করেন (সঙ্গের চিত্রটি রাজা রবিবর্মার আঁকা আদিশঙ্করাচার্য ও তাঁর শিষ্য)।

তাঁর চার প্রধান শিষ্য পদ্মপাদ, হস্তামালক, মণ্ডন ও তোটক বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে তাঁদের উপাসনা প্রচার করতে থাকেন। পরবর্তীকালে আবার এই চার মঠাচার্যের দশজন শিষ্য (পদ্মপাদের দুই শিষ্য তীর্থ ও আশ্রম, হস্তামলকের দুই শিষ্য বন ও অরণ্য; মণ্ডনের তিন শিষ্য গিরি, পর্বত ও সাগর; তোটকের তিন শিষ্য সরস্বতী, ভারতী ও পুরী) থেকে প্রচলিত দশনামী সম্প্রদায়ের উৎপত্তি হয়েছে। এই দশনামী সন্ন্যাসীরা আবার দেশের বিভিন্ন স্থানে মঠ প্রতিষ্ঠা করেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম তীর্থক্ষেত্র তারকেশ্বর শিব মন্দির। অর্থাৎ তারকেশ্বর শিব মন্দির আসলে এই দশনামী শৈব সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠিত মঠ। তারকেশ্বর ছাড়াও হাওড়া-হুগলী জেলার নানাস্থানে যেমন- বৈদ্যবাটি, ভোটবাগান, গড় ভবানীপুর, সন্তোষপুর, চৈপাঠ, নয়নাগড় ও গুপ্তিপাড়া অঞ্চলে বিভিন্ন মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। আর এই সব মঠের এমনকি আমাদের গুপ্তিপাড়া মঠেরও মোহান্তদের মধ্যে প্রধান ছিলেন তারকেশ্বরের মোহান্ত। বহু ইতিহাসবিদদের মতে এইসমস্থ মঠ উত্তর ভারতের সংস্কৃতি, অন্যদিকে বৈষ্ণব ও টেরাকোটার মন্দির হল পূর্ব ভারতের সংস্কৃতি; আর আমাদের গুপ্তিপাড়ার মঠ এই দুই সংস্কৃতিরই মেলবন্ধন।

এই গুপ্তিপাড়া মঠ চত্বরেই গড়ে উঠছে চারটি মন্দির চৈতন্যদেব মন্দির, বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির, রামচন্দ্রের মন্দিরকৃষ্ণচন্দ্রের মন্দির। বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরের অবস্থানের কারণেই বর্তমানে গুপ্তিপাড়ার মঠ আসলে বৃন্দাবনচন্দ্রের মঠ নামেই পরিচিত। গুপ্তিপাড়ার মঠের প্রত্যেকটি মন্দিরই উঁচু বেদীর ওপর অবস্থিত এক মন্দির থেকে অন্য মন্দিরে যাওয়ার জন্যও রয়েছে ইটের তৈরি সাঁকোতাই মন্দিরে প্রবেশ করতে হলে মন্দিরের তোড়ন পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হবে উঁচু বেদীতে এরপর সেই বেদী ধরেই পৌঁছে যাওয়া যাবে বিভিন্ন মন্দিরে।   

চৈতন্যদেব মন্দির-

মঠ চত্বরের সবকটি মন্দিরের মধ্যে সবথেকে প্রাচীন মন্দির হল এই চৈতন্যদেব মন্দির, যা মঠের একদম দক্ষিণ কোণে গড়ে উঠেছে 

চৈতন্যদেব মন্দির

আনুমানিক ১৬৯৬ - ১৭০৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে চৈতন্যদেব মন্দির নির্মাণ হয়। শুরুর দিকে রাজা বিশ্বেশ্বর রায় এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলার জোড় বাংলা শিল্পরীতির অনুকরণে তৈরি এই মন্দিরের প্রবেশপথ ছিল পূর্বদিকে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মন্দির সংস্কারের পর বর্তমানে মন্দিরটি পশ্চিমমুখী হিসাবে ব্যবহৃত হয়। একসময়ে মন্দিরের দেওয়ালে টেরাকোটার শিল্পকলা থাকলেও দীর্ঘসময় ধরে অপটু সংস্কারের ফলে বর্তমানে শুধুমাত্র প্রবেশদ্বারের খিলানে সামান্য টেরাকটার ফলক দেখতে পাওয়া যায়। মন্দিরের বিগ্রহ শ্রী চৈতন্য ও নিত্যানন্দ। জানা যায় সর্বপ্রথমে এটিই বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে এই মন্দিরের পাশেই বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির তৈরি হলে চৈতন্যদেব মন্দিরের বিগ্রহ বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং চৈতন্যদেব মন্দিরে প্রতিষ্ঠা পায় শ্রী চৈতন্যদেব ও শ্রী নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর দারু নির্মিত বিগ্রহ। মঠের অন্যান্য মন্দিরগুলির মধ্যে এই চৈতন্যদেব মন্দিরটিই আয়তনে সবথেকে ছোট। মন্দিরের ভিত্তি চত্বর বাদ দিয়ে মন্দিরের দৈর্ঘ্য প্রায় ২২ ফুট ৯ ইঞ্চি এবং প্রস্থ ২২ ফুট ৬ ইঞ্চি।

চৈতন্যদেব মন্দিরের সামনে সাজানো রাসপুতুল

বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির-

মঠ চত্বরে প্রবেশ করার সম্মুখে ও চৈতন্যদেব মন্দিরের পাশেই অবস্থিত সুউচ্চ আটচালা বিশিষ্ট বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির। মাটি থেকে চূড়া পর্যন্ত মন্দিরের উচ্চতা আনুমানিক ৭৭ ফুট। চত্বর বাদ দিয়ে মন্দিরের দৈর্ঘ্য ৪৩ ফুট ৬ ইঞ্চি ও প্রস্থ ৩৯ ফুট ৬ ইঞ্চি। মাটি থেকে চত্বরের উচ্চতা ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি। মন্দির প্রতিষ্ঠার ব্যপারেও রয়েছে এক কাহিনী। শোনা যায়, সেই সময়কার দশনামী সন্ন্যাসী সত্যদেব সরস্বতী ( প্রকৃত নাম সত্যানন্দ সরস্বতী) শান্তিপুর থেকে বৃন্দাবনচন্দ্রের বিগ্রহ এনে গুপ্তিপাড়ার কৃষ্ণবাটি জঙ্গলে প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে রাজা বিশ্বেশ্বর রায় জোড়বাংলা মন্দির (উপরে উল্লিখিত চৈতন্যদেব মন্দির) তৈরি করে বৃন্দাবনচন্দ্রের বিগ্রহ কে প্রতিষ্ঠা করেন এবং ঠাকুরের সেবার জন্য সোমড়া অঞ্চলের বেশ কিছু সম্পত্তি জমিজমা দান করে যান। কিন্তু এবিষয়ে একটু মতবিরোধ রয়েছে, ১৭৯১ খ্রিষ্টাব্দের একটি মোকদ্দমা থেকে জানা যায় সোমড়া অঞ্চলের জমদারি দান করেন বর্ধমান রাজা।

বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির

জানা যায় পরবর্তীকালে মন্দিরটি ভেঙে গেলে মঠের দণ্ডী মোহান্ত বীরভদ্রানন্দ আশ্রমের মঠাধিকারে বাগবাজারের বিখ্যাত ধনী কায়স্থ গঙ্গানারায়ণ সরকার পুনরায় মন্দিরটি তৈরি করে দেন। বাংলার আটচালা শিল্পরীতিতে গড়ে ওঠা এই মন্দিরের দক্ষিণদিকে রয়েছে ত্রিখিলানযুক্ত প্রবেশদ্বার। বর্তমানে প্রবেশদ্বারের খিলানের উপর সামান্য কিছু টেরাকোটার অংশ আছে, যা বেশিরভাগই টেরাকোটার শিবালয় ও শিবলিঙ্গ এবং ফুলের প্রতীকী। কিন্তু মন্দিরের ভিতরের বারান্দা ও গর্ভগৃহের দেওয়াল ও ছাদ জুড়ে রয়েছে অসংখ্য ফ্রেসকো পেন্টিং যা দর্শনার্থীদের হতবাক করতে বাধ্য। বেশিরভাগ ফ্রেসকো পেন্টিং এর বিষয়বস্তু পৌরানিক কাহিনী ও ফুল লতাপাতার কারুকার্য।

মন্দিরের ভিতরের বারান্দার ফ্রেসকো পেন্টিং

ফ্রেসকো পেন্টিং ১

মন্দিরের বিগ্রহ ও গর্ভগৃহের ফ্রেসকো পেন্টিং

বর্তমানে কিন্তু মন্দিরের বিগ্রহ শুধুমাত্র বৃন্দাবনচন্দ্র নয়, নীল দারুনির্মিত শ্রী বৃন্দাবনচন্দ্রের বাম পাশে রয়েছে শ্রী রাধিকা ও সামনে নতজানু অবস্থায় বাহন গুড়ুর এবং এদের ঠিক পিছনেই উঁচু বেদীতে রয়েছে জগন্নাথ বলরাম শুভদ্রা। গুপ্তিপাড়ার অন্যতম আকর্ষণ রথযাত্রায় এই জগন্নাথ-বলরাম-শুভদ্রা বিগ্রহ রথে বসিয়ে গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।

ফ্রেসকো পেন্টিং ২

মন্দিরের বিগ্রহ (বৃন্দাবনচন্দ্র রাধিকা গুড়ুর ও জগন্নাথ বলরাম শুভদ্রা)


রামচন্দ্রের মন্দিরঃ-

মঠ চত্বরের অন্যান্য মন্দির গুলির তুলনায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় এই রামচন্দ্রের মন্দির। প্রসিদ্ধ হওয়ার কারণ যেখানে অন্যান্য মন্দিরগুলি কালের নিয়মে ক্ষতিগ্রস্থ সেখানে একমাত্র রামচন্দ্রের মন্দির তার অপরূপ টেরাকোটার শিল্প অটুট রেখেছে। মাটি থেকে চূড়া পর্যন্ত রামচন্দ্র মন্দিরের উচ্চতা আনুমানিক ৬৩ ফুট। চত্বর বাদ দিয়ে মন্দিরের দৈর্ঘ্য ৪১ ফুট ৩ ইঞ্চি ও প্রস্থ ৩৮ ফুট ৬ ইঞ্চি। মাটি থেকে চত্বরের উচ্চতা ৪ ফুট ৯ ইঞ্চি।

রামচন্দ্র মন্দির

মন্দিরের টেরাকোটার ফলকে মহিষাসুরমর্দিনী ও ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর-কল্কি

অষ্টদশ শতাব্দীর শেষে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন শেওড়াফুলির রাজা হরিশ্চন্দ্র রায়। হ্যাঁ! হুগলীর ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়রে কিন্তু ঠিক এই হরিশ্চন্দ্রের নামই দেওয়া রয়েছে। কিন্তু ইতিহাসবিদ ও পুরাণ বিশেষজ্ঞ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী জানাচ্ছেন এই তথ্য ভুল। হরিশচন্দ্র রায় শেওড়াফুলিরাজ মনোহর রায়ের পৌত্র। মনোহর রায়ের মৃত্যু হয় ১৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দে। তারপর তাঁর পুত্র রাজচন্দ্র এবং তারও পরে রাজচন্দ্রের পুত্র হরিশচন্দ্র। অর্থাৎ হরিশ্চন্দ্র রায় কখনোই অষ্টদশ শতাব্দীর সময়কার রাজা হতে পারেন না। এদিকে হুগলী জেলার ইতিহাস রচয়িতা সুধীর কুমার মিত্র জানাচ্ছেন মন্দিরটি তৈরি হয় ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দে এবং তৈরি করেন শেওড়াফুলিরাজ মনোহর রায়। এখানেও সময়ের ভুলভ্রান্তি, কারণ ১৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দে মনোহর রায়ের মৃত্যু হয়। গুপ্তিপাড়ার প্রখ্যাত পণ্ডিত বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার ১৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দে "চিত্রচম্পুঃ" নামে যে গ্রন্থ রচনা করেন সেখান থেকে এই মন্দির সম্বন্ধে একটি শ্লোক পাওয়া যায়। অর্থাৎ অনুমান করা যায় মন্দিরটি ১৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দের আগে নির্মাণ হয়েছিল। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী আরও জানাচ্ছেন পরবর্তীকালে বিজয়রাম সেন যে "তীর্থমঙ্গল" কাব্য রচনা করেন সেখান থেকে জানা যায় এই রামচন্দ্রের মন্দির নির্মাণ করেন রামশঙ্কর রায় নামে কোন এক ব্যক্তি। কিন্তু এনার সঙ্গে শেওড়াফুলিরাজ -এর কোন যোগাযোগ আছে কিনা তা জানা যায় না, কারণ শেওড়াফুলি রাজার মধ্যে রামশঙ্কর রায়ের কোন নাম নেই। এসব থেকেই অনুমান করা যায় গুপ্তিপাড়ার এই রামচন্দ্র মন্দির নির্মাণ হয় ১৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দের আগে হয়তো ১৭৪২ এর আগেও, কারণ সেই সময় বাংলায় বর্গী আক্রমণ হয়; আর এইটুকু সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় যে কেউই সেই সময়কালে কোন মন্দির নির্মাণে সাহসী হবেন না।       

এবার আসি মন্দিরের স্থাপত্যের ব্যাপারে। বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দিরের পূর্বদিকে বা মন্দির চত্বরে প্রবেশ করলে ডানদিকের মন্দিরটিই হল রামচন্দ্র মন্দির। বাংলার আর এক মন্দির স্থাপত্য একরত্ন বিশিষ্ট এই রামচন্দ্র মন্দিরের প্রবেশপথ দক্ষিণমুখী। মন্দিরের বিগ্রহ দারুনির্মিত শ্রী রাম, সীতা, লক্ষণ ও নতজানু অবস্থায় মহাবীর হনুমান। ত্রিখিলান যুক্ত মন্দিরের সমগ্র দেওয়াল জুড়ে রয়েছে অসংখ্য টেরাকোটার ফলক। যার মধ্যে কোথাও রয়েছে রাসনৃত্য, রাসমণ্ডল তো কোথাও রাম রাবণের যুদ্ধ। অন্যদিকে আবার টেরাকোটার ফলকে ফুটে উঠেছে দেবী দুর্গার বিভিন্ন রূপএছাড়াও মন্দিরময় জুড়ে রয়েছে অসংখ্য পশুপাখি ও ফুলের টেরাকোটার সাজ। 

রামচন্দ্র  মন্দিরের বিগ্রহ (রাম লক্ষণ সীতা ও হনুমান)

টেরাকোটার অলংকরণ

টেরাকোটার অলংকরণ

দক্ষিণ দিকের খিলানের উপর টেরাকোটার অলংকরণ

দক্ষিণ দিকের টেরাকোটার অলংকরণে নকল দরজা

কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরঃ-

রামচন্দ্র মন্দিরের বিপরীত দিকে অর্থাৎ মন্দির চত্বরে প্রবেশ করলে বামদিকের মন্দিরটি হল কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির। এই মন্দিরও বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরের মতো আটচালা বিশিষ্ট ত্রিখিলানযুক্ত। মন্দিরের প্রবেশপথ উত্তরদিকে। মাটি থেকে চূড়া পর্যন্ত কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরের উচ্চতা আনুমানিক ৫৫ ফুট। চত্বর বাদ দিয়ে মন্দিরের দৈর্ঘ্য ৪১ ফুট ৬ ইঞ্চি ও প্রস্থ ৩৯ ফুট ৬ ইঞ্চি। মাটি থেকে চত্বরের উচ্চতা ৪ ফুট ৩ ইঞ্চি।

কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির 

এককালে মন্দিরের দেওয়ালে টেরাকোটার ফলক থাকলেও বর্তমানে সেসব ইতিহাসের পাতায়। কারণ ওই একই, দীর্ঘদিন অপটু সংস্কারের ফলে সবই নষ্ট হয়ে গেছে। মন্দিরের বিগ্রহ শ্রী কৃষ্ণ ও রাধিকা। মন্দিরের প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যে তথ্য পাওয়া যায় তাও খানিকটা ভুলভ্রান্তি। গেজেটিয়ারের মতে গুপ্তিপাড়ার কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির নবাব আলীবর্দি খাঁ -এর (১৭৪০-৫৬) সময়কালে এই বৃন্দাবন চন্দ্র মঠের দণ্ডী মধুসুদানন্দ আশ্রম কর্তৃক নির্মিত হয়। কিন্তু এই মত গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ দণ্ডী মধুসুদানন্দ ১৭৯০ থেকে ১৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মঠের মোহান্ত ছিলেন। অর্থাৎ তিনি আলীবর্দি খাঁর সমসাময়িক নন। কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দির তৈরি করেন মঠের নবম দণ্ডী পীতাম্বরানন্দ আশ্রম (আনুমানিক ১৭৪০ - ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দ) কৃষ্ণচন্দ্রের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে, - বঙ্গে বর্গী আক্রমণের সময় নবাব আলীবর্দি খাঁ কে খাজনা দিতে না পারায় নবাব সমস্ত জমিদারকে মুর্শিদাবাদে তলব করতে লাগল। সেসময়ে রাজস্ব বাকি পড়লে শাস্তির দরুন জমিদারদের কারাবাস করতে হত। এদিকে নবাবের পরোয়ানা পেয়ে মঠের দণ্ডী পীতাম্বরানন্দ ধর্ম সংকটে পড়েন। কারণ এখানে জমিদার বৃন্দাবনচন্দ্র মানুষ নন, তিনি হিন্দুর দেবতা বৃন্দাবনচন্দ্র। তাই বৃন্দাবনচন্দ্রের বিগ্রহকে নিয়ে তিনি কি করে মুসলমান নবাবের দরবারে হাজির করবেন...? কিন্তু নবাবের আদেশ অমান্য করাও বেআইনি। শেষমেশ গুণীজনের পরামর্শে তিনি বৃন্দাবনচন্দ্র বিগ্রহের অনুরূপ নিমকাঠের তৈরি কৃষ্ণমূর্তি তৈরি করে নিয়ে গেলেন মুর্শিদাবাদে। গুপ্তিপাড়ার পণ্ডিত বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কর ছিলেন সেইসময় আলীবর্দি খাঁর সভাসদ। সম্ভবত তাঁরই সহায়তায় আলীবর্দি খাঁ জানতে পারেন গুপ্তিপাড়ার জমিদার হলেন এক হিন্দু দেবতা। শেষে নবাব বৃন্দাবনচন্দ্রের বকেয়া রাজস্ব কিস্তি মারফত পরিশোধের নির্দেশ দিলেন এবং দণ্ডীকে নিষ্কৃতি দিলেন। এদিকে পীতাম্বরানন্দ সেই নকল বৃন্দাবনচন্দ্রের বিগ্রহটি অর্থাৎ কৃষ্ণমূর্তিটিকে গুপ্তিপাড়ায় ফেরত নিয়ে এসে নাম রাখলেন কৃষ্ণচন্দ্র, সঙ্গে তৈরি করলেন অষ্টধাতুর রাধামূর্তি। কিন্তু বাধ সাধলো মন্দির প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, কারণ জমিদারের ভাণ্ডারে তখন কিছুই নেই। তাহলে উপায়...? অর্থ সাহায্য। মঠের দণ্ডী বিভিন্ন ধনী ব্যক্তিদের এমনকি প্রজাদের কাছে অর্থ সাহায্যের আবেদন করলেন। শেষমেশ প্রায় ১০ বছর পর তৈরি হল কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দির। আর এই থেকেই অনুমান করা যায় কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দির মোটামুটি ১৭৫৫ কিমবা ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে হয়েছিল। কারণ বাংলায় শেষ বর্গী আক্রমণ ১৭৪৪ + নবাবের মুর্শিদাবাদ তলন + ১০ বছর। 

মন্দিরের বিগ্রহ (কৃষ্ণ রাধিকা)

কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির

******************************************************

লেখা, গবেষণা ও ছবি - প্রীতম নস্কর  

ই-মেল - pritamnaskar.pn@gmail.com

ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে ব্লগের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, তবে পূর্বানুমতি ছাড়া আমার তোলা আলোকচিত্রগুলি এবং ব্লগের রচনাগুলি অন্য কোথাও কপি-পেস্ট বা বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করা চলবে না।

******************************************************

কীভাবে যাবেন গুপ্তিপাড়া -

গুপ্তিপাড়া যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় ট্রেনে করে। হাওড়া-কাটোয়া লাইনেই অবস্থিত গুপ্তিপাড়া স্টেশন। হাওড়া থেকে কাটোয়াগামি (মেনলাইন) / ব্যান্ডেল থেকে কাটোয়া / শিয়ালদহ থেকে কাটোয়া যাওয়ার যে কোন ট্রেনে উঠে নামতে হবে গুপ্তিপাড়া স্টেশন। স্টেশন থেকে বাইরে বেরলেই দেখা মিলবে সারি সারি টোটো / রিকশার, তাতে করে অনায়াসেই পৌছে যাওয়া যাবে বৃন্দাবনচন্দ্র মঠ অথবা গুপ্তিপাড়ার মঠ।

গুগল ম্যাপ / কোঅরডিনেট -

23.196993, 88.440984

তথ্যসুত্রঃ-

  • হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ (দ্বিতীয় খণ্ড) সুধীরকুমার মিত্র
  • পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি বিনয় ঘোষ
  • পশ্চিমবঙ্গের মন্দির শম্ভু ভট্টাচার্য
  • গুপ্তিপাড়ার বাংলা মন্দির সমূহের নির্মাণকাল - শ্রী নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী (সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা)
  • Bengal District Gazetteers - Hooghly

রামচন্দ্র মন্দিরের আরও কিছু ছবিঃ-

টেরাকোটার ফলকে রাসনৃত্য

টেরাকোটার ফলকে শ্রী কৃষ্ণ

টেরাকোটার ফলকে পশুপাখি ১

টেরাকোটার ফলকে পশুপাখি ২

রামচন্দ্র মন্দিরের সম্মুখভাগ (কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির থেকে তোলা ছবি)

টেরাকোটার ফলকে কৃষ্ণরাধিকা

টেরাকোটার ফলকে বিভিন্ন দেবদেবী ১

টেরাকোটার ফলকে বিভিন্ন দেবদেবী ২

মন্দিরের বারান্দার ভেতর টেরাকোটার অলংকরণ

Comments