পান্ডুয়ার মসজিদ ও মিনার, হুগলী । Pandua Mosque & Minar, Hooghly

পান্ডুয়া...! হাওড়া থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত হুগলী জেলার এক প্রাচীন জনপদ ও ঐতিহাসিক অঞ্চল হল পান্ডুয়া এখানে অবস্থিত বাইস দরওয়াজ মসজিদ (বাইস দরওয়াজা মসজিদ) ও পান্ডুয়া মিনার প্রত্নতত্ত্ব হিসাবে, বিশেষ করে বাংলার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য স্থান। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিক করে বাংলায় মুসলিম রাজ্য সর্বাধিক বিস্তার লাভ করতে শুরু করে। এইসময় বাংলার চতুর্দিকে ইসলামের সামাজিক প্রতিষ্ঠার অভিযান ছড়িয়ে পড়েধিরে ধিরে হিন্দু রাজত্বের অবসানের পর প্রতিষ্ঠা হয় মুসলিম সাম্রাজ্য আর পান্ডুয়ায় অবস্থিত এই মসজিদ ও মিনার সেইসব ইতিহাসেরই অন্যতম সাক্ষী। 
পান্ডুয়ার মসজিদ ও মিনার, হুগলী ।  Pandua Mosque & Minar, Hooghly
পান্ডুয়া মসজিদ ও মিনার

তবে এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, পান্ডুয়া শুনলেই আমাদের প্রথম যে জায়গাটির কথা মাথায় আসে তা হল মালদা-গৌড়। কিন্তু না এই পান্ডুয়া সেই পান্ডুয়া নয়। মালদা জেলায় যে পান্ডুয়া রয়েছে তা গড়ে উঠেছিল সুলতানি আমলেঅন্যদিকে হুগলী জেলার এই পান্ডুয়ার সূত্রপাত হয় হিন্দু রাজা পান্ডুদাসের হাত ধরে। তাই অনেকের কাছে হুগলীর এই পান্ডুয়া ছোট পান্ডুয়া হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে, যা একসময় আঞ্চলিক স্তরে ছোট পেঁড়ো হিসাবেও পরিচিত ছিল। আজকের ব্লগ পান্ডুয়ার সেই ইতিহাসগুলি নিয়েই, কীভাবে সামন্ত রাজাকে হারিয়ে পান্ডুয়ার এই মসজিদ ও মিনার গড়ে উঠল সেই নিয়েই আজকের গল্প। 

পান্ডুয়া মসজিদের অভ্যন্তর (সৌজন্যে Journal of the Asiatic Society of Bengal. Vol XXXIX)

পান্ডুয়ার ইতিহাস

কথিত আছে পান্ডুয়া পূর্বে পন্ডুনগর বা পান্ডুনগর নামে পরিচিত ছিল। পান্ডুয়া রাজ্যের সূত্রপাত হয় রাজা পান্ডুদাসের হাত ধরে। প্রবাদ এইরূপ যে, গৌতম বুদ্ধের পিতৃব্য-পুত্র পান্ডুশাক্য বঙ্গদেশে এসে প্রাচীন সপ্তগ্রাম মহানগরীর পাঁচ ক্রোশ উত্তরে দামোদর নদের তীরে এক ক্ষুদ্র রাজ্য স্থাপন করেন এবং রাজা নিজের নামানুসারে সেই স্থানের নাম দেন পান্ডুয়া। তবে এই পান্ডুরাজার ইতিহাস কতটা নির্ভরযোগ্য তা কিন্তু জানা যায়নি। পান্ডুরাজার বংশপরিচয়, রাজ্য, সময়কাল কিছুই ইতিহাসের কোনও বইতে পাওয়া যায় না। ইতিহাসের বইতে শুধুমাত্র হুগলীর এই অঞ্চলে পান্ডুরাজা হিসাবে এক রাজা ছিল সে তথ্যই জানা যায়। তবে হাওড়া-হুগলী জেলার সীমান্তে প্রাচীন ভূরিশ্রেষ্ঠী বা ভূরশূটে পান্ডু নামে এক রাজা ছিলেন। সে রাজারও নাম ছিল পান্ডুদাস, যিনি আমতার অধীন পেঁড়োবসন্তপুরে নিজ রাজ্য স্থাপন করেন। তাহলে কি পান্ডুয়ার পান্ডুরাজার সঙ্গে এই ভূরশূটের পান্ডুরাজার কি কোন সামঞ্জস্য থাকতে পারে? তাও শুধুমাত্র অনুমানতবে ত্রয়োদশ শতাব্দীর আগেও যে এই অঞ্চলে, এমনকি এর পার্শ্ববর্তী এলাকাতে (যেমন মহানাদ, সপ্তগ্রাম, ত্রিবেণী) হিন্দু রাজারা রাজত্ব করে গেছিল তার প্রমাণ কিন্তু ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায়। হিন্দু রাজার অধীনে থাকায় এইসমস্ত রাজ্যের চতুর্দিকে গড়ে উঠেছিল প্রাসাদপ্রমাণ অট্টালিকা কিমবা সুদৃশ্য দেব-দেউলকিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেইসব হিন্দু স্থাপত্যের কিছুই অবশিষ্ট নেই। পরবর্তীকালে এইসব অঞ্চলে মুসলমান বিজয়ের পর রাজ্যের স্থাপত্যগুলিতে বিরাট পরিবর্তন আসে। মুসলমান শাসকগণ কর্তৃক শাসিত হয়েছিল বলেই সেইসব নিদর্শন আর দেখতে পাওয়া যায় না। আর এর প্রভাবেই সময়ের সাথে সাথে এইসব অঞ্চলের অনেক মন্দিরই রুপান্তরিত হতে শুরু করে মসজিদে (যেমনটি ত্রিবেণীর জাফর খাঁ গাজী মসজিদও দরগা)। 

পান্ডুয়া মসজিদের অভ্যন্তরে কিবলার দিকের মিহরাব (সৌজন্যে Journal of the Asiatic Society of Bengal. Vol XXXIX)

পান্ডূয়ার প্রথম কবে মুসলিম আক্রমণ হয় তার সঠিক সময় কিন্তু কোন ইতিহাসবিদ জানাতে পারেনি। এবিষয়ে পান্ডুয়ার মসজিদ-মিনারেও সেরকম কোন শিলালিপি নেই। তবে বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র ধরে যে সময়কালটা পাওয়া গেছে তা আনুমানিক ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুর দিক থেকে অর্থাৎ ১২৯০-১৩২২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। আর পান্ডুয়ার এই সংগ্রামের সঙ্গে যে নামটি জড়িয়ে রয়েছে তিনি হলেন মুসলিম সুফি সাধক শাহ্‌ সুফিউদ্দিন (শাহ সফিউদ্দিন)

কাহিনীর প্রেক্ষাপট নিয়ে রয়েছে অনেক মতান্তর। একই গল্পে দেখা গেছে দুই রাজাকেপান্ডুয়ার কাহিনী প্রথম প্রকাশ পায় ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত Calcutta Asiatic Observer প্রবন্ধে, যেখানে হিন্দু রাজাটি হলেন পুন্ডরাজা (পান্ডুরাজা)। পরবর্তীকালে একই গল্প ভোলানাথ চন্দ্র তাঁর The Travel of Hindu ইংরেজি গ্রন্থে এবং সেখান থেকে ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে W.W. Huner তাঁর Statistical Account of Bengal Vol III  গ্রন্থে তুলে ধরেন এবং সর্বশেষ ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে Bengal Past & Present (Journal of the Calcutta Historical Society) জার্নালে স্থান পাওয়া। অন্যদিকে ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশ পাওয়া Asiatic Society of Bengal জার্নালে D. Money এরকমই এক কাহিনী তুলে ধরেন, তবে এক্ষত্রে রাজা পান্ডুয়ার পাশেই মহানাদ অঞ্চলের রাজা ভূদেব ইতিহাসের প্রেক্ষাপট ছাড়াও মূল কাহিনীতে রয়েছে কিছু অলৌকিক ঘটনা (যেমন- জিয়ত কুণ্ড) তবে সেইসব দিকগুলি বাদ রেখেই পান্ডুয়ার গল্প এগোতে থাকে......

মিহরাবের অলঙ্করণ

শাহ সুফিউদ্দিন

সময়টা আনুমানিক ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকপান্ডুয়া তখনও হিন্দু রাজার অধীন। রাজ্যে মুসলিম সম্প্রদায় একেবারে নেই বললেই চলে। হিন্দুদের মধ্যে মাত্র খান পাঁচেক মুসলিম পরিবার বাস করত রাজ্যে তাঁদের মধ্যে ছিল এক মুসলিম ফকির শাহ্‌ সুফিউদ্দিন, যিনি সেই সময়ে পান্ডুয়ার ইসলাম ধর্মযাজক। একে তো কয়েকঘর মুসলিম, তার ওপর রাজার কঠোর শাসন ব্যবস্থা। এরই মধ্যে একদিন ফকির শাহ সুফিউদ্দিন তাঁর পুত্রের লিঙ্গচর্মছেদ (সুন্নত / খৎনা) অনুষ্ঠান উপলক্ষে অতিথিদের ভোজের জন্য এক গরু কুরবানী দেন। কিন্তু সেসময়ে স্থানীয় রাজার নির্দেশে রাজ্যে গো হত্যা ছিল চরম অপরাধ। রাজা এই হত্যার খবর জানতে পেরে সুফিউদ্দিনের ছেলেকে বন্দী অবস্থায় নিয়ে এসে কালী ঠাকুরের উদ্দেশ্যে বলি দেন। কিছু ঠাহর করতে না পারা সুফিউদ্দিন মৃত ছেলের দেহ নিয়ে ছুটে যান দিল্লীর দরবারে। সিংহাসনে তখন সুলতান ফিরোজ শাহ দ্বিতীয় (জালালউদ্দিন খিলজি, যিনি খিলজি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ও দিল্লীর প্রথম সুলতান)এদিকে সম্পর্ক অনুযায়ী শাহ সুফিউদ্দিন ফিরোজ শাহের ভাগ্নে। ফলত মৃত্যুর খবর শোনামাত্র প্রতিশোধের জন্য সুলতান সৈন্যসমেত জাফর খান গাজী-কে পাঠালেন পান্ডুয়ায়। এদিকে জাফর খান গাজী সম্পর্কে শাহ সুফিউদ্দিনের কাকা। দিল্লী হয়ে প্রথমে তাঁরা যান পানিপথ, সেখানে দেখা করেন তাঁদের গুরু সুফি সাধক শেফ-শরফুদ্দিন-বু-আলী-কালান্দার এর সাথে। এরপর সুফির আশীর্বাদ নিয়ে জাফর খান ও সুফিউদ্দিন এবং সঙ্গে বহরম সাক্কা সৈন্য নিয়ে আসেন পান্ডুয়ার কাছেই মহানাদ নামক স্থানে (পান্ডুয়া থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে) যুদ্ধে তুর্কি সেনার জয় হয় এবং স্থানীয় রাজা, লোকমতে পান্ডুরাজা (ভিন্নমতে রাজা মান নৃপতি) আত্মহত্যা করেন।

পান্ডুয়া মিনার - সংস্কারের আগের পরিস্থিতি (সোজন্যে Bengal Past & Present (Vol.2) 1908)

পান্ডুয়া মিনার সংস্কারের পর

এখান থেকে কাহিনী দুদিকে মোড় নেয় ......

কিছু ইতিহাসবিদদের মতে যুদ্ধ চলাকালীন সুফিউদ্দিন মারা যান এবং তাঁকে হুগলীর পান্ডুয়াতেই সমাধিস্থ করা হয়। যুদ্ধে মৃত্যু হওয়ায় তিনি শহীদ উপাধিতে পরিচয় লাভ করেনএদিকে যুদ্ধে রওনা দেওয়ার আগে তিনি পানিপথে বিখ্যাত সুফি গুরু বু-আলি-কালান্দারের আশীর্বাদ নিতে গিয়েছিলেন; ফলে যুদ্ধে শাহাদাতের (শহিদ) পর তাঁর অনুগামীরা তাঁকে শাহ্‌ উপাধি দেন এবং এখান থেকেই বু-আলির একটি নতুন সুফি বংশের সূত্রপাত ঘটে

আবার, ‘Bengal Past & Present জার্নালে D.G. Crawford সাহেব, Hunter সাহেব, পান্ডুয়ার কেচ্ছা কাব্যের রচয়িতা মহীউদ্দিন ওস্তাগার এমনকি হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ গ্রন্থের রচয়িতা সুধীরকুমার মিত্র কিন্তু শাহ সুফিউদ্দিনের মৃত্যু নিয়ে কিছু বলেননি। তাদের মতে পান্ডুয়ার যুদ্ধে সুফিউদ্দিনের জয়লাভ করেন এবং সময়টা প্রায় ১৩৪০ খ্রিষ্টাব্দ শাহ সুফিউদ্দিন পান্ডুয়ার শাসনভার গ্রহণ করার পর রাজ্যের সমস্ত প্রাচীন মন্দির ধ্বংস করতে থাকেন এবং সেইসব জায়গায় মন্দিরের উপকরণ দিয়ে গড়ে তোলেন বিভিন্ন মসজিদ।

তবে গণ্ডগোলটা এখানেই, পান্ডুয়ায় শাহ সুফিউদ্দিনের নামাঙ্কিত কোন শিলালিপি এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নিএমনকি শাহ সুফিউদ্দিন চরিত্রটি নিয়েও রয়েছে ভিন্ন মতামত সময়কাল হিসাবে সুফিউদ্দিন চরিত্রটি দুটি ভিন্ন সময়ে পাওয়া যায় এবং দুটি ক্ষেত্রেই সুফিউদ্দিন, শাহ উপাধি পেয়েছেন। Biographical Encyclopedia of Sufis in South Asia গ্রন্থের লেখক N. Hanif এর মতে, প্রথম সফিউদ্দিন শহিদ শাহ হলেন ফিরোজ শাহ খিলজির ভাগ্নে যিনি পান্ডুয়ায় থাকতেন। এবং উপরের কাহিনীর মতই মৃত পুত্রকে নিয়ে দিল্লী অভিযান ও জাফর খান গাজী কে নিয়ে পান্ডুয়া আক্রমণ, যুদ্ধে সুফিউদ্দনের মৃত্যু ও পান্ডুয়ায় গোড় দেওয়া। আর এই সুফিউদ্দিনের সময়কাল ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে, ১২৯০ বা ১২৯৫ খ্রিষ্টাব্দ। অন্যদিকে, Hanif আরও একটি সফিউদ্দিনের কথা জানাচ্ছেন, কিন্তু সেখানে সময়টা চতুর্দশ শতাব্দী। এক্ষেত্রেও সেই একই পান্ডুয়া আক্রমণতবে এক্ষেত্রে সুফিউদ্দিন জয়লাভ করে এবং পরবর্তী সময়ে এখানে তাঁর ভালোই প্রভাব বিস্তার ঘটে। আর এই পান্ডুয়াতেও তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।

মসজিদের খিলান ও মিনার

ফলে এই দুটি সুফিউদ্দিনের মধ্যে কোনটি পান্ডুয়া বিজয়ের সুফিউদ্দিন তা ইতিহাসেই অনেকটা ধোঁয়াশা। আর এর ফলেই সৃষ্টি হয়েছে বিভ্রান্তি। অর্থাৎ সময়ের দিক দিয়ে দেখতে গেলে একটি ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিক ও অন্যটি চতুর্দশ শতাব্দী। পান্ডুয়া মিনারের ঠিক বিপরীতেই জি.টি.রোডের ধারেই রয়েছে একটি মাজার, নাম হজরত শাহ সুফি সুলতান (রঃ) মাজার। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে সুফিউদ্দিনকে এখানেই সমাধিস্থ করা হয়। তবে ওই একই বিষয়, এক্ষেত্রেও মাজার স্থাপনের কোন শিলালিপি নেই। একইরকম ভাবে সুলতান ফিরোজ শাহ, যার কাছে সুফিউদ্দিন সাহায্যের জন্য যান। সময়ের নিরিখে দেখতে গেলে ঠিক ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিক করে দুটি ফিরোজ শাহের নাম উঠে আসে। তবে স্থানের দিক দিয়ে দুই ফিরোজ শাহ দুটি জায়গায়, এক বাংলায় আর দুই দিল্লীতে। দিল্লীর ফিরোজ শাহ হলেন জালালউদ্দিন খিলজি (খিলজি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা, ১২৯০-১২৯৬ খ্রিষ্টাব্দ), অন্যদিকে বাংলার ফিরোজ শাহ হলেন সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ (১৩০১-১৩২২ খ্রিষ্টাব্দ) পান্ডুয়ার ঘটনাটি যদি ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে হয় তাহলে ফিরোজ শাহ হলেন দিল্লীর সুলতান, আর চতুর্দশ শতাব্দী হলে, হবে বাংলার স্বাধীন শাসনকর্তা সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ। আবার কাহিনী অনুযায়ী যুদ্ধের আগে শাহ সুফিউদ্দিন পানিপথের সুফি গুরু বু-আলি-কালান্দারের (১২০৯-১৩২৪ খ্রিষ্টাব্দ) সঙ্গে দেখা করেন। অর্থাৎ সময়ের দিক দিয়ে বু-আলি-কালান্দার দুই ফিরোজ শাহের সমসাময়িক ব্যক্তি।

সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ, গোহত্যা আর যুদ্ধ; ঠিক এই একই অনুরূপ গল্প দেখতে পাওয়া যায় বাংলাদেশের সিলেট জেলায়, সময়কাল ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দ। পান্ডুয়ার যুদ্ধে যেমন পান্ডুয়ার রাজা, শাহ সুফিউদ্দিন, জাফর খান গাজী ও ফিরোজ শাহের নাম যুক্ত, ঠিক তেমনি সিলেট বিজয়ের সঙ্গেও রাজা গৌর গোবিন্দ, শাহ জালাল, সিকান্দার খান গাজী ও ফিরোজ শাহের নাম জড়িত। একইভাবে পান্ডুয়ার মতোই সিলেটে রয়েছে হজরত শাহ জালাল (রঃ) এর সমাধি। 

পান্ডুয়া মিনার

শাহ সুফিউদ্দিন যে পান্ডুয়া আক্রমণ করেছিল সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। পান্ডুয়া, সপ্তগ্রাম, ত্রিবেণী প্রভৃতি অঞ্চলে মুসলমান বিজয়ের আগে যে একাধিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হিন্দু রাজা ছিলেন, তা ইতিহাসেই প্রমাণ পাওয়া যায় (যেমন- মান নৃপতি, ভূদেব)। তবে এক্ষেত্রে, বাংলায় ইসলাম প্রচারে সুফিদের ভূমিকা আলোচনা করলে দেখা যায় যে, সুফিরা প্রথমে ধর্ম প্রচারে বের হতেন। তাঁরা হিন্দুদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হলে সুলতানের সাহায্য প্রার্থনা করতেন। মুসলমান গাজীরাও ঠিক একইভাবে, বলা যায় এইসব সুফি ফকিরদের উপর অত্যাচারের সুযোগ নিয়েই রাজ্যে প্রবেশ করত এবং শাসকদলের সৈন্য নিয়ে স্থানীয় রাজার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হত। পান্ডুয়ার ক্ষেত্রেও সুফির ভূমিকায় ছিলেন শাহ সুফিউদ্দিন ও গাজীর ভূমিকায় জাফর খাঁ গাজী।

সিলেট যেমন শাহজালাল এর হাত ধরে মুসলমানদের অধিকারে আসে এবং মৃত্যু অবধি সিলেটে অবস্থান করে শাহজালাল যেমন ইসলাম বিস্তারের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে; হয়তো হুগলীর এই পান্ডুয়া সপ্তগ্রাম জুড়েও তেমনই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল, যেখানে মুখ্য ভূমিকায় ছিল শাহ সুফিউদ্দিন......


পান্ডুয়ার মিনার

পান্ডুয়ার মিনার ঠিক কত খ্রিষ্টাব্দে তৈরি হয়, তার কোন প্রমাণ বা শিলালিপি নেই। তবে পান্ডুয়ায় মুসলিম বিজয়ের পরই এই মিনার তৈরি হয়। অনেক ঐতিহাসিকদের মতেই শাহ সুফিউদ্দিন এখানকার হিন্দু রাজাকে পরাজিত করে জয়স্তম্ভের নিদর্শন স্বরূপ এই মিনারটি তৈরি করেন। আবার হিন্দুদের মতে, পূর্বে এই স্তম্ভ বা মিনারটি দেবমন্দির ছিল, যা এখানকার স্থানীয় রাজা নির্মাণ করেন। মন্দিরের চতুর্দিকে এরকম অনেক মিনার ছিল, সেকালের রাজারা প্রাতঃকালে সূর্যদেবকে দেখার জন্য এরকম মিনার তৈরি করত। পরবর্তীকালে যুদ্ধে মুসলিম বিজয়ের পর, শাহ সুফিউদ্দিন রাজ্যের এরকম ছোট ছোট স্তম্ভগুলিকে বিনষ্ট করে কেবলমাত্র বৃহৎ স্তম্ভটিকে বিজয়স্বরূপ রেখে দেন। আবার অনেকের মতে, পূর্বে এই জায়গাটিতে হিন্দুমন্দির ছিল, শাহ সুফিউদ্দদিন রাজ্যের দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই মন্দিরের উপরেই এই বিজয়স্তম্ভটি নির্মাণ করেন। মুসলিমদের কাছে বিজয়স্তম্ভটি অনেকটা মিনারের কাজ করত, অর্থাৎ ইসলামধর্ম বিশ্বাসীগণকে প্রার্থনায় আহ্বানের জন্য ব্যবহৃত হত। সাধারণত এই মিনারগুলি বিজয় মিনার হিসাবে তৈরি হলেও ব্যবহার হত মাজিনা বা নামাজের আহ্বানের জন্য। আজানের শব্দ যাতে অনেকটা দূর পর্যন্ত পৌছাতে পারে তার জন্য মিনারগুলি অনেকটা উঁচু হত

কোনটি ঠিক আর কোনটি ভুল... কি ঘটেছিল না ঘটেছিল... এখন তা আর জানার উপায় নেই। তবে এরকমই স্তম্ভ বা মিনার দেখা যায় ভারতের অনেক স্থানে। যেমন- মালদা জেলার গৌড়ের ফিরোজ মিনার, যেটি ১৪৮৯ সালে তৈরি করেন বাংলার সুলতান সাইফুদ্দিন ফিরোজ শাহ। উদ্দেশ্য একই, বিজয়স্তম্ভ ও নামাজের আহ্বান। এবং একইভাবে পান্ডুয়ার মিনারের মতোই পাঁচতলা বিশিষ্ট। আবার পুরনো মালদার মিনাসরাইয়ের (নিমাসরাই) মিনারের ধ্বংসাবশেষ বা দিল্লীর কুতুব মিনার; সবগুলি পান্ডুয়ার মত পাঁচতলা বিশিষ্ট মিনার। হয়তো পান্ডুয়ার এই মিনারও শাহ সুফিউদ্দিন অথবা সেরকমই কোন মুসলিম শাসনকর্তার তৈরি।

মিনারের প্রবেশদ্বার  (সৌজন্যে Journal of the Asiatic Society of Bengal. Vol XXXIX)
মিনারের প্রবেশদ্বারের দু'পাশে পাথরের স্তম্ভ ও পাথরের বেদী

আকৃতিগত দিক দিয়ে পান্ডুয়ার মিনার পাঁচটি তলায় বিভক্ত। চূড়া সমেত মিনারটির উচ্চতা ছিল ১২৫ ফুট। কিন্তু ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দের ভূমিকম্পে মিনারের পঞ্চম তলা অর্থাৎ সর্বোচ্চ অংশটি চূড়া সমেত ভেঙে পড়ে। পরবর্তীকালে ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে মিনারটি Ancient Monuments Preservation  Act,1904 অনুযায়ী Protected Monuments এর তালিকাভুক্ত হলে মিনারের সংস্কার শুরু হয় এবং মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে মিনারের সংস্কারের কাজ শেষ হয়। সংস্কারের পর মিনারের উচ্চতা দাঁড়ায় ১২৭ ফুট এবং বর্তমানে সেই উচ্চতাতেই মিনারটি রয়েছে। মিনারের পাঁচটা তলের মধ্যে সবচেয়ে নিচের অর্থাৎ প্রথম তলার ব্যাস ৬০ ফুট, এবং ক্রমশ উপরের দিকের তলাগুলি সরু হয়ে পঞ্চম তলে ১২ ফুট উচ্চতায় ঠেকেছে। প্রথম তলাটির ব্যাস নিচে ৬০ ফুট এবং উপরে ৫৮ ফুট ২ ইঞ্চি, দ্বিতীয় তলাটি নিচে ৪৮ ফুট ১ ইঞ্চি এবং উপরে ৪৭ ফুট ৬ ইঞ্চি, তৃতীয় তলাটি নিচে ৩৭ ফুট ৫ ইঞ্চি এবং উপরে ৩৪ ফুট ৮ ইঞ্চি, চতুর্থ তলাটি নিচে ৩৭ ফুট ৫ ইঞ্চি এবং উপরে ২৩ ফুট ১০ ইঞ্চি, সবচেয়ে উপরের অর্থাৎ পঞ্চম তলার ব্যাস নিচে ১৫ ফুট এবং উপরে ১২ ফুট মিনারের অভ্যন্তরে সর্বোচ্চ অংশে ওঠার জন্য রয়েছে ঘোরানো সিঁড়ি, মোট ধাপ সংখ্যা ১৬১ টি । প্রত্যেক তলাতে রয়েছে একটি করে চাতাল এবং কয়েকটি করে ঘুলঘুলি মিনারের অভ্যন্তরে ওই ঘুলঘুলি ছাড়া আলো বাতাস আসার তেমন কোনও যায়গা নেই, ফলে ভিতরটা দিনের বেলাতেও থাকে অস্বাভাবিক অন্ধকার। আগে মিনারের উপরে উঠতে দিলেও পরবর্তী সময়ে তা বন্ধ করে দেয়। মিনারের প্রবেশদ্বারের দুপাশে রয়েছে পাথরের দুই স্তম্ভ ও একটি পাথরের বেদী। আর এই পাথরগুলির অলঙ্করণ পূর্বের কোন হিন্দু মন্দিরের সাথে মিল পাওয়া যায়।

পান্ডুয়ার বাইশ দরওয়াজ মসজিদের ধ্বংসাবশেষ

পান্ডুয়ার বাইশ দরওয়াজ মসজিদ (বড়ী মসজিদ)

পান্ডুয়া মিনারের ঠিক পশ্চিম দিকে রয়েছে পান্ডুয়ার বড়ী মসজিদ। যদিও বর্তমানে শুধুমাত্র মসজিদের ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না মসজিদের সম্বন্ধে শুরু করার আগে একবার দেখে নেওয়া যাক বাংলার মসজিদ স্থাপনের সময়কাল। বাংলায় মুসলমান শাসনের সূত্রপাত বখতিয়ার খিলজির হাত ধরে হলেও, বাংলায় কিন্তু ইসলাম ধর্ম এসেছে তারও আগে। লক্ষন সেনের সঙ্গে বখতিয়ারের যুদ্ধের আগেই বাংলায় ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে এসেছিলেন শেখ জালাল উদ্দীন তাবরিজি (শাহ্‌ জালাল)। শোনা যায় লক্ষন সেন নিজেই জালালুদ্দীন কে ধর্মপ্রচারের অনুমতি দেন। ফলে বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের পরে বাংলায় যেসব মসজিদ তৈরি হয় সেগুলির স্থাপত্যরীতি মুঘল আমলের মসজিদের থেকে অনেকটাই আলাদা। ইতিহাসবিদদের কাছে তাই মুগল মসজিদ ও মুঘল পূর্ব মসজিদ দুটি আলাদা অধ্যায়। মুঘল মসজিদের ক্ষেত্রে যে বড় বড় উল্টানো পেঁয়াজের মত গম্বুজ দেখা যায় (তিনটি অথবা পাঁচটি), মুঘল পূর্বে কিন্তু তেমনটা দেখা যেত না। মুঘল পূর্ব মসজিদ গুলিতে বড় বড় গম্বুজের বদলে থাকতো ছোট ছোট একাধিক গম্বুজ, তাও আবার গোলাকার। মসজিদগুলি তৈরি হত মূলত ইট দিয়ে। বাংলায় পাথরের অভাব দীর্ঘদিনের, এর প্রধান কারণ ভৌগলিক পরিস্থিতি। ফলে পাথরের বদলে পোড়ামাটির (টেরাকোটা) প্রচলন, যা অনেক আগে থেকেই বাংলার মন্দিরগুলিতে স্থান পেয়েছে স্বাভাবিকভাবেই বাংলায় মুসলমান শাসকরা এই শিল্পকলাকেই মসজিদ তৈরিতে কাজে লাগাল। এমনকি সুলতানি আমলে মুসলিম শাসকরা বাংলার এই টেরাকোটা শিল্পরীতিকে চরম উৎকর্ষতার এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। তবে ইসলাম ধর্মে মানুষ ও প্রাণীর ছবি অঙ্কনে নিষেধ থাকায় টেরাকোটার অলঙ্করণে জায়গা পেয়েছিল ফুল-লতাপাতার কারুকার্য বা বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশা।

তিনটি প্যাসেজে / করিডোরে ভাগকরা খিলান
Bolchman সাহেবের মতে চিল্লাখানা। অথবা মহিলাদের জন্য পৃথক প্রার্থনাকক্ষ

পান্ডুয়ার এই বড়ী মসজিদও সেরকমই এক টেরাকোটা মসজিদ। পান্ডুয়ার এই মসজিদ বড়ী মসজিদ হিসাবে পরিচিত হলেও কিছু ইতিহাসবিদদের কাছে এটি বাইশ দরওয়াজ মসজিদ নামে পরিচিত। অর্থাৎ বাইশটি খিলানের উপর নির্মিত মসজিদ। কিন্তু এই বাইশ সংখ্যাটির সঙ্গে একটু মতবিরোধ রয়েছে। ক্ষেত্র সমীক্ষায় গেলে দেখা যাবে মসজিদের সম্মুখে অর্থাৎ মসজিদের পূর্বদিকে রয়েছে ২১ টি প্রবেশদ্বার ও উত্তরদিকে ১ টি প্রবেশদ্বার (বলাবাহুল্য দক্ষিণদিকে প্রবেশদ্বারের মতোই দেখতে যে একটি খিলান রয়েছে তা প্রবেশদ্বার নয়, সম্ভবত মসজিদ তৈরি থেকেই ইট দিয়ে বন্ধ একটি কুলুঙ্গি) কিন্তু মসজিদের বাইরে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ববিদদের যে ফলকটি রয়েছে সেখানে উল্লেখ আছে মসজিদের প্রবেশপথ ২৪ টি (২১ টি সামনের দিকে ও ৩ টি পাশে), কিন্তু কীভাবে এটা সম্ভব হল তার ব্যাখ্যা কিন্তু আমি পাইনি। মসজিদের স্থাপত্যের বিষয়ে বিষদভাবে জানা যায় Mosque Architecture of Pre-Mughal Bengal গ্রন্থের লেখক Syed Mahmudul Hasan এর কাছ থেকে। তাঁর মতে পান্ডুয়ার এই মসজিদটি দৈর্ঘ্যে ২৩১ ফুট ও প্রস্থে ৪২ ফুট। স্থাপত্যের দিক দিয়ে দেখতে গেলে পুরো মসজিদটিতে রয়েছে তিনটি আইল (প্যাসেজ / করিডোর) বিশিষ্ট প্রার্থনা কক্ষ, যাকে আচ্ছাদন করে ছিল ৬৩ টি ছোট ছোট গম্বুজ। ছিল বলছি কারণ বর্তমানে একটিও গম্বুজ নেই, বহুদিন আগেই সেইসব গম্বুজ ভেঙে পড়েছে। Blochmann সাহেবের মতে এই গম্বুজগুলির ভার নিয়েছিল দুটি সারিতে ভাগ করা মোট ৪২ টি ব্যাসাল্ট পাথরের পিলার (স্তম্ভ)। স্তম্ভগুলির উচ্চতা প্রায় ৬ ফুট। আর এই স্তম্ভগুলি দুটি সারিতে ভাগ করার ফলে তৈরি হয়েছিল ধনুকাকৃতির খিলান। তিনটি করিডোরে ভাগ করা প্যাসেজগুলির প্রতিটি প্যাসেজে ছিল একুশটি খিলান। মসজিদের কিবলার দিকে (যে দিকে মুসলিমরা নামাজের সময় প্রার্থনা করে) রয়েছে ২১ টি মিহরাব, যার মধ্যে মাঝের মিহরাব একটু উঁচু বেদীর উপর স্থাপন করা। যতদূর সম্ভব পাথরের এই সিংহাসনটি ইমামের বসার জায়গা, যেখান থেকে ইমাম দিনের নামাজ আদায় করত। মসজিদের উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে একটি আয়তাকার উঁচু ভিত্তিবেদী, একসময়ে এই বেদীর উপর ছিল একটি ঘর (যদিও বর্তমানে ঘরটি নেই, আছে শুধু বেদী)। Blochmann সাহেবের মতে এটি ছিল সাহা সুফির চিল্লাখানা (চল্লিশ দিন নির্জনে তপস্যা করার স্থান)। তবে লেখক Hasan এর মতে Blochmann সাহেবের এই চিল্লাখানা হয়তো মহিলাদের জন্য পৃথক প্রার্থনাকক্ষ। লক্ষ করলে দেখা যায় বেদীর লাগোয়া রয়েছে তিনটি মিহরাব। 

কালো ব্যাসাল্ট পাথরের তৈরি সিংহাসন (অতীতের কোন মন্দিরের অংশ)
মিহরাবে টেরাকোটার অলঙ্করণ

Blochmann সাহেবের মতে সম্পূর্ণ মসজিদটি তৈরি হয়েছে small light red brick অর্থাৎ ইট দিয়ে। এছাড়াও মসজিদের মিহরাবগুলি ও কিবলার দেওয়াল সাজানো হয়েছে বিভিন্ন টেরাকোটার অলঙ্করণে। তবে সবচেয়ে বিতর্কমূলক তথ্য, মসজিদগুলিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন মন্দিরের উপাদান। ধর্ম-যুদ্ধ-ধ্বংস-প্রতিষ্ঠা এই যদি ইতিহাস হয়, তাহলে তার অন্যতম সাক্ষী পান্ডুয়ার এই মসজিদ। কি পাথর? কোথা থেকে এসেছে? আগে কি ছিল? এসবই এখন অনুমান। Blochmann সাহেব যেমন বলছেন মসজিদের এই স্তম্ভ বা পিলারগুলি কোন বৌদ্ধ মন্দিরের, অন্যদিকে Bengal District Gazetteers এর O’Malley সাহেব, সুধীরকুমার মিত্র মহাশয় জানাচ্ছেন স্তম্ভগুলি কোন হিন্দু মন্দিরের। মসজিদের কিবলার দিকে মাঝখানে যে কালো ব্যাসাল্ট পাথরের তৈরি সিংহাসনটি রয়েছে পূর্বে তা কোন হিন্দু মন্দিরের অংশ ছিল। এবিষয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদ Alexander Cunningham জানাচ্ছেন, পান্ডুয়ার মসজিদ যে ঢিবি বা স্তূপের উপর গড়ে উঠেছে একসময় সেই জায়গায় ছিল হিন্দু মন্দির, আর এই পিলারগুলি যার উপর মসজিদটি গড়ে উঠেছে সেগুলি সেইসব মন্দিরকেই সমর্থন করছে।

মসজিদে কোনও প্রস্তরফলক নেই। তবুও মসজিদের গঠন, পাথরের স্তম্ভ, নিচু গোলাকার গম্ভুজ, নিচু খিলানযুক্ত দরজা, ব্যবহৃত অমুসলিম নির্মাণ সামগ্রী এই সবগুলির সাপেক্ষে ইতিহাসবিদরা ঠিক করেছে মসজিদটি গড়ে উঠেছে চোদ্দশ শতকের মাঝের কোন এক সময়ে। মসজিদটি কে তৈরি করেছে তার কিন্তু কোন প্রমাণ নেই...... তবে অনেকের মতে শাহ সুফিউদ্দিন তৈরি করেছিলেন এই মসজিদ...... কি জানি হতেও পারে হয়তো বা নয়। চোদ্দশ শতকেই যে এই মসজিদ গড়ে উঠেছিল তা অনেক ইতিহাসবিদরাই মেনে নিয়েছেন, তাদের মতে হুগলীর পান্ডুয়ার এই বড়ী মসজিদ বহুগম্বুজ যুক্ত মসজিদের প্রোটোটাইপ হিসাবে কাজ করেছিল যা দেখে পরবর্তীকালে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় মসজিদ গড়ে ওঠে, যেমন মালদা পান্ডুয়ার আদিনা মসজিদ, বাংলাদেশ খুলনার ষাট গম্বুজ মসজিদ 

পাথরের অলঙ্করণের নকশা (সৌজন্যে Journal of the Asiatic Society of Bengal. Vol XXXIX)

পাথরের স্তম্ভগুলিতে অলঙ্করণ (ইতিহাসবিদদের মতে এগুলি হিন্দু মন্দিরের)

মিনার একবার সংস্কার হলেও মসজিদ কিন্তু কখনোই সংস্কার হয়নি। আজ থেকে ঠিক এক বছর আগেও মসজিদ চত্বর ও মিনার প্রাঙ্গনে সাধারণের প্রবেশ ছিল। ইতিহাসপ্রেমীরা ছুঁয়ে দেখতে পারত পান্ডুয়ার এই ঐতিহ্যকে। কিন্তু এখন পুরো চত্বরই ঘিরে ফেলা হয়েছে। প্রবেশ এখন কোনওভাবেই সম্ভব নয়। মাঘ মাসের প্রথম দিন (জানুয়ারি) ও নববর্ষের প্রথম দিন (এপ্রিল) বিরাট মেলা বসত এই চত্বরে। মেলার বয়স শতাব্দী প্রাচীন। কেন? কি জন্য? মেলা বসে তার কোনও উত্তর নেই। তবে বাংলার যে প্রাচীন মেলাগুলি এখনও টিকে রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম পান্ডুয়ার মেলা। বর্তমানে সেই মেলাও এই চত্বর থেকে সরিয়ে নিয়ে পাশেই এক মাঠে হয়। মাঘ মাসে প্রায় এক মাস ব্যাপী চলে মেলা। যেখানে হিন্দু-মুসলমান ধর্ম নির্বিশেষে আসে মানুষজন।

মসজিদ চত্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথরের স্তম্ভগুলি

******************************************************

লেখা, গবেষণা ও ছবি - প্রীতম নস্কর  

ই-মেল - pritamnaskar.pn@gmail.com

ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে ব্লগের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, তবে পূর্বানুমতি ছাড়া আমার তোলা আলোকচিত্রগুলি এবং ব্লগের রচনাগুলি অন্য কোথাও কপি-পেস্ট বা বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করা চলবে না।

******************************************************

কীভাবে যাবেন

ট্রেনযাত্রা - হাওড়া থেকে মেনলাইনগামী বর্ধমান যাওয়ার ট্রেনে উঠে নামতে হবে পান্ডুয়া স্টেশন, সময় লাগবে প্রায় ১ ঘণ্টা। স্টেশন থেকে নেমেই বাইরে দেখা মিলবে টোটো / রিকশা, যেতে হবে পান্ডুয়া মেলাতলা। হেঁটে ২০ মিনিট ও গাড়িতে মিনিট পাঁচেক।

সড়কপথে - প্রথমে হাওড়া থেকে বালি। সেখান থেকে দিল্লী রোড (স্টেট হাইওয়ে ১৩) ধরে প্রথমে মগরা তারপর খন্নান পেড়িয়ে পান্ডুয়া। স্টেট হাইওয়ে ১৩ ধরেই পান্ডুয়া চৌমাথা প্রবেশের আগেই ডানদিকে দেখতে পাওয়া যাবে পান্ডুয়া মিনার।

গুগল ম্যাপ / কোঅরডিনেট

23°04'27.4"N 88°17'06.8"E

23°04'26.9"N 88°17'04.5"E

তথ্যসূত্র -

  • Biographical Encyclopedia of Sufis in South Asia – by N. HANIF
  • Bengal Past & Present (Vol.2) 1908 – Journal of the Calcutta Historical Society
  • Bengal District Gazetteers Hooghly
  • Mosque Architecture of Pre-Mughal Bengal – by Syed Mahmudul Hasan
  • The Travel of a Hindoo to the various pasrt of Bengal and Upper India (Vol.I) – by BHOLANAUTH CHUNDER
  • A Statistical Account of Bengal (Vol.III) – by W W Hunter
  • The Calcutta Review Vol XIII - 1850
  • History of Bengal Vol.2 – by JADUNATH SARAKR
  • Notes on Arabic and Persian Inscriptions in the Hugli District By H. Blochmann -  Journal of the Asiatic Society of Bengal. Vol XXXIX
  • হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ (দ্বিতীয় খন্ড) সুধীরকুমার মিত্র
  • পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি বিনয় ঘোষ
  • পান্ডুয়া মুণীন্দ্রদেব রায় মহাশয়

Comments

  1. অনেক তথ্য বিস্তারিত জানতে পারলাম, ঘুরতে তো গেছি, তবে এত কিছু গল্প জানা ছিল না, Thanks for sharing the story behind this history and the other details as well.. Keep going, waiting for next... 😊

    ReplyDelete
  2. চমৎকার লেখা! 👍

    ReplyDelete
  3. Snehasish Bhattacharya15 May 2022 at 14:32

    Bishnu putra Pundra teke Pundua name hoyeche bole sona jai.
    onar ma chilen Rukshini...jonmer porei Som name rakhos kidnapped kore ...pore se boro hoye Som k hatya kore o taka hoi. nijer Ma er smritite ek Mondir kore Bishnu putra name dei Srikhonla debit .mondir.
    Sankracharjyya er 18 to moha pith er modhe ektu ei Pundua shloker biborone pawa jai.
    kub sombob Son jehetu anarjya chilo Adibasira punduar mela te jog pawa jabe.
    R shrinkokala debit pujo bortoman Shimlaghar e Kali rupe hoi.

    ReplyDelete

Post a Comment