
হাওড়ার অন্যতম এক শিল্পাঞ্চল ঘুসুড়ি। অবস্থানের দিক থেকে গঙ্গার ওপাড়ে কলকাতার বাগবাজার আর গঙ্গার এপাড়ে হাওড়ার ঘুশুড়ী। ব্রিটিশ শাসনকাল থেকে শিল্পাঞ্চল হিসাবে প্রসিদ্ধ হলেও ঘুসুড়ির অন্যতম ঐতিহাসিক নিদর্শন “ভোটবাগান মঠ”। যেখানে ‘ভোট’ শব্দটির আগমন ‘ভোদ’ নামক শব্দ থেকে, যা সাধারণত তিব্বতে বসবাসকারী ভুটিয়া –দের সম্বোধন করা হয়। আর ‘বাগান’ অর্থাৎ উদ্যান এবং ‘মঠ’ অর্থাৎ আশ্রম, অর্থাৎ দাঁড়াল গিয়ে তিব্বতি উদ্যান। যা ভারতের সমভূমিতে তৈরি হওয়া সর্বপ্রথম তিব্বতি মন্দির (তিব্বতি মঠ / বৌদ্ধ বিহার)। আর যার নাম থেকেই এই অঞ্চল ভোটবাগান হিসাবে পরিচিত। পরিযায়ী শ্রমিকদের বসবাস আর কারখানার হট্টগোল এসবের মাঝেই ৫ নং ঘোসাই ঘাট স্ট্রীটে অবস্থিত ভোটবাগান মঠ।
এবার প্রশ্ন হওয়া স্বাভাবিক হিমালয়ের পাদদেশ ছেড়ে তিব্বতিরা এই বাংলায় কেনই বা মঠ স্থাপন করতে গেল? আর করলেই বা তা কলকাতায় না হয়ে গঙ্গার অপর প্রান্তের ঘুশুড়ীতে কেনই বা বানাতে গেল? বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যার অন্যতম নায়ক বাংলার গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস, পান্চেন লামা ও পুরাণ গিরি গোঁসাই। যাদের হাত ধরেই ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে গঙ্গার এই পাড়ে ঘুসুড়ি অঞ্চলে তৈরি হয় ভোটবাগান মঠ।
ভোটবাগান মঠের এই ব্লগটিতে মঠ সংক্রান্ত একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ ও ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। মঠের সম্পূর্ণ ইতিহাস, সেইসময়কার হাওড়া শহর, ঘুসুড়ি অঞ্চল, পুরাণ গিরি ও তিব্বতের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ এবং বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আমরা একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেছি। আদতে এটি একটি পত্রিকা হলেও এর পৃষ্ঠা সংখ্যা প্রায় ৪৫০। গ্রন্থে মঠের বিভিন্ন ছবি, শিলালিপি পাঠোদ্ধার ও মঠের একটি ত্রিমাত্রিক মানচিত্র রয়েছে। আশা করছি এই সমস্তটাই যারা ভোটবাগান মঠ নিয়ে গবেষণা করতে চান সেইসমস্ত আঞ্চলিক ইতিহাসবিদ, ক্ষেত্রসমীক্ষক ও পাঠকদের সমাদর পাবে। ব্লগের শেষে যোগাযোগের মাধ্যম দেওয়া রয়েছে।
![]() |
ভোটবাগান মঠ / শ্রী শঙ্কর মঠ / মহাকাল মঠ |
ঘুসুড়ি-
গঙ্গার এক পাড়ে কলকাতার বাগবাজার ও অন্য
পাড়ে হাওড়ার ঘুসুড়ি। ইতিহাসের দিক থেকে বিচার করলে, ঘুশুড়ী চিরকালই পরিচয়
পেয়েছে শিল্প কারখানার অঞ্চল হিসাবে। ব্রিটিশ সরকারের ঘাঁটি কলকাতা হলেও, ১৭৯৬ খ্রিষ্টাব্দে পাটের গাঁট তৈরির কারখানা তৈরি হয় এই ঘুসুড়িতে। ১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে মনসামঙ্গল কাব্যেও রয়েছে ঘুসুড়ির উল্লেখ। এছাড়াও কলকাতার পুরনো মানচিত্রে দেখা যায় ঘুসুড়ির এই অঞ্চলে ছিল
দড়ি তৈরির কারখানা, চিনি তৈরির কারখানা এমনকি বর্তমানে পাটকল থেকে জাহাজ মেরামতের
কারখানাও গড়ে উঠেছে এই ঘুসুড়িতে। তবে এসব ছাড়াও ইতিহাসের পাতায় ঘুসুড়ির নাম জড়িয়ে
আছে যে কারণে, তা হল ঘুসুড়ির ‘ভোটবাগান মঠ’।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটঃ-
ভোটবাগান মঠের ইতিহাস জানতে হলে আমাদের
পৌঁছে যেতে হবে অষ্টাদশ শতকের তিনটি ক্ষেত্রে ভুটান-কোচবিহার যুদ্ধ, তিব্বত ও
দশনামী সন্ন্যাসী। কারণ সেখান থেকেই সূত্রপাত হয় এই মঠের।
ভুটান-কোচবিহার যুদ্ধ, দীর্ঘদিন ধরেই
ভুটান চাইছিল কোচবিহারের শাসক নিয়োগের ক্ষেত্রে যেন তাঁদের অধিকার থাকে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই ভুটানের দেবরাজা 'ড্রুক দেশী' বা 'দেব জিদার' (অর্থ 'দেবযোদ্ধা')
কোচবিহার আক্রমণ করে এবং ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে ভুটান কোচবিহারের রাজা ধৈর্যেন্দ্রনারায়ণ ও তাঁর দেওয়ান-কে বন্দী করেন। বন্দী অবস্থায় রাজার মৃত্যু হলে কোচবিহারের সিংহাসনে
বসার অধিকার পায় ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণ-এর পুত্র রাজা ধরেন্দ্রনারায়ণ। কিন্তু কিছুদিনের
মধ্যেই ভুটান পুনরায় কোচবিহার দখল করে নিলে, রাজা ধরেন্দ্রনারায়ণ সাহায্যের জন্য
যান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে। কোম্পনির প্রধান তখন ওয়ারেন হেস্টিংস। তিনি কোচবিহারের হয়ে যুদ্ধ করতে রাজি হলেন, তবে একটি শর্তে, কোচবিহারকে
তার বার্ষিক রাজস্বের অর্ধেক পরিমাণ ও যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর ভরণপোষণ
বাবদ খরচ দিতে হবে। সেইমতো ১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ক্যাপ্টেন জোন্সের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সেনা আক্রমণ করলে ভুটান
পরাজিত হয় এবং কোচবিহারের রাজা হিসাবে বসেন রাজা ধরেন্দ্রনারায়ণ। এদিকে ব্রিটিশ
সেনার কাছে পরাজিত হয়ে ভুটান দ্বারস্থ হয় তিব্বতের কাছে।
![]() |
পাঞ্চেন লামা / লবসাং পালদেন ইয়েসি ( এশিয়া সোসাইটির জার্নালের চিত্র সৌজন্যে উইকিপিডিয়া) |
তিব্বত, হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত পৃথিবীর উচ্চতম অঞ্চল। অষ্টাদশ শতকের সময় সেই উচ্চতায় যাওয়া ছিল এক প্রকার দুঃসাহসিক যাত্রা, যার ফলে ইউরোপীয় দেশগুলির কাছে তিব্বত ছিল এক রহস্যে ঘেরা দেশ, যেখানে তন্ত্রমন্ত্র ছাড়াও রয়েছে বিপুল সোনার খনি। দলাই লামা, তিব্বতের শাসনতন্ত্রের শীর্ষ পদাধিকারী। তিব্বতের রাজধানী লাসা-য় যার বসবাস। বাণিজ্যের ব্যাপারে প্রাচীনকাল থেকেই তিব্বতের সঙ্গে উত্তর ভারতের লেনদেন চলে আসত, এবিষয়ে সাহায্য করত নেপালের বিভিন্ন গিরিপথ। রপ্তানির ব্যাপারে তিব্বত সোনা, নুন, চামড়া, কস্তুরি, গড়ুর লেজ, ভেড়ার মাংস এবং আমদানি করত বিভিন্ন শস্য, তামাক, আফিম, নীল, চিনি, মুক্তো ও কাপড়। তবে ১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দে গোরখা যখন নেপাল আক্রমণ করে তখন নেপালের এইসব গিরিপথ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে তিব্বত-ভারতের এই লেনদেনও একপ্রকার বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থায় তিব্বতের কাছে এই বাণিজ্য চালিয়ে যেতে হলে একমাত্র উপায় ভুটানের মাধ্যমে ভারতে প্রবেশ। ১৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সেনার কাছে পরাজিত হয়ে ভুটান যখন তিব্বতের দ্বারস্থ হয়, তখন তিব্বতের শাসনকার্যে রয়েছে অষ্টম দলাই লামা, জাম্পাই গিয়াৎসু। কিন্তু সেই সময়ে দলাই লামা নাবালক হওয়ায় তিব্বতের রাজকার্য পরিচালনা করছিলেন ষষ্ঠ পাঞ্চেন লামা, লবসাং পালদেন ইয়েসি (১৭৩৮-১৭৮০)। তিনি ভুটানকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন। এবিষয়ে পাঞ্চেন লামা, ওয়ারেন হেস্টিংস –কে একটি চিঠি লেখেন, যার মাধ্যমে তিনি জানান – ভুটান একপ্রকার তিব্বতের-ই অংশ, তাই এবিষয়ে শান্তিপূর্ণ মীমাংসা হলেই দুপক্ষের ভালো। আর এই সন্ধিপত্রসহ পাঞ্চেন লামা তিব্বতের এক স্থানীয় অধিবাসী পাইমা ও এক হিন্দু সন্ন্যাসী, যিনি দশনামী সন্ন্যাসীর অন্তর্ভুক্ত পুরাণ গিরি গোঁসাই –কে রাষ্ট্রদূত হিসাবে পাঠালেন কলকাতায় হেস্টিং-এর কাছে।
![]() |
আদি শঙ্করাচার্য ও তাঁর চার শিষ্য - রাজা রবিবর্মার আঁকা তৈলচিত্র ১৯০৪ (সৌজন্যে উইকিপিডিয়া) |
দশনামী সন্ন্যাসী, আনুমানিক ৭৮০-৮২০ খ্রিষ্টাব্দে আদিশঙ্করাচার্য তাঁর বেদান্তশাস্ত্র ও তত্ত্বঞ্জান প্রচারের উদ্দেশ্যে ভারতের চারস্থানে (দক্ষিণে কর্ণাটকের তুঙ্গভদ্রার তীরে শৃঙ্গেরীমঠ, পশ্চিমে গুজরাটের দ্বারকায় সারদামঠ, পূর্বে ওড়িশার পুরীতে গোবর্ধনমঠ এবং উত্তরে উত্তরাখন্ডের জ্যোতির্মঠ) চারটি মঠ স্থাপন করেন। তাঁর চার প্রধান শিষ্য পদ্মপাদ, হস্তামালক, মণ্ডন ও ত্রোটক বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে তাঁদের উপাসনা প্রচার করতে থাকেন। পরবর্তীকালে আবার এই চার মঠাচার্যের দশজন শিষ্যরা বিভিন্ন উপাধি অর্জন করে (পদ্মপাদের দুই শিষ্য বন ও অরণ্য, হস্তামলকের তিন শিষ্য পুরী, ভারতী ও সরস্বতী; মণ্ডনের দুই শিষ্য তীর্থ ও আশ্রম; ত্রোটকের তিন শিষ্য গিরি, পর্বত ও সাগর) থেকে প্রচলিত দশনামী সম্প্রদায়ের উৎপত্তি হয়েছে। অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে এই দশনামী সন্ন্যাসীর কিছু অংশ বেড়িয়ে পরেন পৃথিবী পর্যটনে আর কিছু দশনামী সন্ন্যাসী দেশের বিভিন্ন স্থানে মঠ প্রতিষ্ঠা করেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পশ্চিমবঙ্গের তীর্থক্ষেত্র তারকেশ্বর (গিরি শিষ্য প্রণালী) শিব মন্দির। অর্থাৎ তারকেশ্বর শিব মন্দির, যা আসলে এই দশনামী শৈব সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠিত মঠ। শৈব সম্প্রদায় বলার কারণ, এদের মূল দেবতা শিব। অষ্টাদশ শতকে এই সমস্থ দশনামী সন্ন্যাসী যা একপ্রকার উত্তর ভারতের সংস্কৃতির প্রভাব বিস্তার করে এই বাংলায়। তারকেশ্বর ছাড়াও হাওড়া-হুগলী জেলার নানাস্থানে যেমন- বৈদ্যবাটি, ভোটবাগান, গড় ভবানীপুর, সন্তোষপুর, চৈপাঠ, নয়নাগড় ও গুপ্তিপাড়া (আশ্রম শিষ্য প্রণালী)। ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস-এর সময় বাংলায় যখন সন্ন্যাসী বিদ্রোহ হয় তখন এই দশনামী সন্ন্যাসীরাও সেই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল। আর আমাদের এই পুরাণ গিরি গোঁসাই হলেন এই দশনামী সম্প্রদায়ের সদস্য, যিনি উত্তরাখণ্ডের জ্যোতির্মঠ (যশীমঠ) –এর শিষ্য। পুরাণ গিরি, ত্রোটকের তিন শিষ্য উপাধির মধ্যে একটি গিরি। তবে এই পুরাণ গিরি গোঁসাই কিন্তু এক অনন্য দশনামী সন্ন্যাসী। অন্যান্য সন্ন্যাসীদের থেকে ধর্মে, দর্শনে, শিক্ষায় ছিল অসীম জ্ঞান।
![]() |
জর্জ বোগ্লে, পুরাণ গিরি গোঁসাই ও পাঞ্চেন লামা (১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে শিল্পী টিলি ক্যাটেল এর তৈলচিত্র সৌজন্নে রয়াল কালেকশন ট্রাস্ট) |
তো এই সন্ন্যাসী গোঁসাই ১৭৭৪
খ্রিষ্টাব্দের ২৯ শে মার্চ পাঞ্চেন লামা-র সন্ধিপত্র নিয়ে হাজির হন হেস্টিং-এর
কাছে। দূরদর্শী হেস্টিং কিন্তু লামার এই পত্রে তিব্বতের প্রতি একপ্রকার প্রভাবিত-ই
হয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন তিব্বতের সাথে ভারতের পুনরায় বাণিজ্য স্থাপনের এই মোক্ষম
সুযোগ ও সাথে উপরিপাওনা হিসাবে চিন-এ বাণিজ্য বিস্তার, কারণ চিনে তখন চিং সাম্রাজ্যের
আধিপত্য, আর সেই সময়ে কোনো বিদেশীর পক্ষে চিনের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে প্রবেশ করা
সম্পূর্ণভাবে বন্ধ। ফলে ইউরোপীয় ব্যবসায়ীদের পক্ষে চিনের ক্যান্টন বন্দরে যাওয়া
অকল্পনীয়। এইদিকে তিব্বত কিন্তু তাদের এলাকায় প্রবেশের জন্য সেরকম কোনো বাঁধা
সৃষ্টি করেনি, তিব্বত সবসময় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছাড়াও সমস্থ মানুষের জন্য তিব্বতের
দরজা খোলা রেখেছিল। আর এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই হেস্টিং পাঞ্চেত লামার এই
সন্ধিপত্রের দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানালেন। ২৫ শে এপ্রিল ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে হেস্টিং
ভুটানের সঙ্গে চুক্তিপত্র সহ শান্তিপূর্ণ মীমাংসা মেনে নিলেন। চুক্তিপত্র অনুযায়ী
ভুটানকে রংপুরে (যা বর্তমানে বাংলাদেশের অংশ) বার্ষিক নিষ্কর বাণিজ্যের অনুমতি দেওয়া
হল।
![]() |
গঙ্গার পাশেই তৈরি হওয়া ভোটবাগান মঠ (বর্তমানে গঙ্গার ঘাটের সামনের অংশে দখল করা জাহাজ মেরামতের কারখানা) |
পরবর্তী কাজ তিব্বতের সাথে সম্পর্ক আরও
গভীর করা। আর এই কূটনৈতিক যোগাযোগ স্থাপনের জন্য হেস্টিং নিজেও লামার কাছে তাঁর প্রতিনিধি
দল পাঠালেন, যার মধ্যে ছিল স্কটিশ অ্যাডভেঞ্চারার জর্জ বোগ্লে, ডঃ অ্যালেকজান্ডার
হ্যামিল্টন ও পুরাণ গিরি গোঁসাই। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে হেস্টিং-এর এই প্রতিনিধি দল
তাঁদের প্রস্তাব জানাতে পেরেছিলেন। লামাও আশ্বাস দিয়েছিলেন যে আসন্ন পিকিং সফরকালে
তিনি মিঃ বোগ্লেকে চিনের সম্রাটের কাছে পৌঁছানোর জন্য যাবতীয় ছাড়পত্রের ব্যবস্থা
করে দেবেন, যার দ্বারা মিঃ বোগ্লে স্বাভাবিক ভাবেই ব্রিটিশ বাণিজ্যের ব্যপারে
সম্রাটকে বর্ণনা দিতে পারবেন। কিন্তু এর পরিবর্তে পাঞ্চেন লামা হেস্টিং-এর কাছে
একটি অনুরোধ রাখলেন। ভারত যা দীর্ঘদিন ধরেই তিব্বতিদের কাছে পবিত্র ভূমি হিসাবে পরিচিত কিন্তু এত
বছরের পরেও ভারতে তিব্বতিদের জন্য কোনও বাসস্থান নেই। তাই লামা জানালেন, হেস্টিং
যেন পবিত্র গঙ্গার (ভাগীরথী) তীরে কলকাতার কাছাকাছি একখানি জমির বন্দোবস্ত করে
দেন, যেখানে দুপক্ষেরই বিশ্বস্ত দূত পুরাণ গিরির তত্ত্বাবধানে তৈরি হবে তিব্বতি
মন্দির আর থাকবে তিব্বত থেকে আসা তীর্থযাত্রী, সন্ন্যাসী ও বণিকদের থাকার জন্য
আশ্রম। ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে হেস্টিং-এর এই প্রতিনিধি দল কলকাতায় ফিরলে মিঃ
বোগ্লে লামার প্রস্তাবটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে জানান। লামার এই প্রস্তাবে খুশি
হয়ে হেস্টিং সম্মতি জানালেন। আর এভাবেই দুপক্ষের স্বার্থের বিনিময়ে তৈরি হল
ভোটবাগান মঠ।
![]() |
ভোটবাগান মঠের মধ্যেকার উঠোনে গঠন করা উদ্যান |
ভোটবাগান মঠের প্রতিষ্ঠাঃ-
লামার ইচ্ছা অনুযায়ী ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দের
ডিসেম্বরে, মঠ তৈরির জন্য ওয়ারেন হেস্টিংস গঙ্গার পাড়ে হাওড়া জেলার ঘুসুড়ি অঞ্চলে
১০০ বিঘা ৮ কাঠা জমি পাঞ্চেন লামাকে ভাড়ায় দেন, যা ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে আইনতভাবে
পাঞ্চেন লামার করমুক্ত জমি হিসাবে বিবেচিত হয়। এবং এরও পরে ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে আরও
৫০ বিঘা জমি (যা একসময়ে শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণের ও আন্দুলের রাজা রাজচন্দ্র ও রামলোচনের জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত ছিল) সম্প্রসারিত হয়, যা চারটি সনদের মাধ্যমে
পাঞ্চেন লামাকে ও পরবর্তীকালে তা পুরাণ গিরিকে বন্দোবস্ত করে দেন। এভাবেই গঙ্গার
পাড়ে প্রায় ১৫০ বিঘা জমির ওপর পাঞ্চেন লামার নির্দেশে ও পুরাণ গিরির তত্ত্বাবধানে
শুরু হল বৌদ্ধ মঠ তৈরির কাজ। মঠের পুরো পরিকল্পনা করেন স্বয়ং পাঞ্চেন লামা। গঠনে প্রায় চতুষ্কোণ এই মঠের মধ্যেকার উন্মুক্ত
প্রাঙ্গণে গঠন করা হয়েছিল এক সুন্দর উদ্যান (বাগান), যা থেকেই নামকরণ ভোটবাগান মঠ
বা তিব্বত উদ্যান। মঠের প্রধান প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকে উন্মুক্ত প্রাঙ্গনের বিপরীত
অংশে দালান-রীতির গঠনে তৈরি হওয়া মঠের মন্দির, যেখানে এখনও পুরাণ গিরির সংগৃহীত
সেইসব তিব্বতি মূর্তিগুলি শোভা পাচ্ছে। প্রাঙ্গনের বামদিকে গঠন করা হয়েছে দ্বিতল
ভবন, যেখানে মঠের বিভিন্ন মোহান্ত মহারাজদের থাকার জায়গা। আর মঠের ডানদিকের অংশে
ছিল নদীর ঘাটে যাওয়ার রাস্তা, যেখানে মঠের সন্ন্যাসীদের জন্যই গঠন করা হয়েছিল ঘাট।
![]() |
১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের কলকাতার ম্যাপে ভোটবাগান ঘাট ও মঠের মধ্যেকার ৬ টি মন্দির (যা আসলে সমাধিসৌধ) সৌজন্যে হাভার্ড লাইব্রেরী |
![]() |
ভোটবাগান মঠের দালান রীতিতে তৈরি হওয়া তিব্বতি মন্দির |
![]() |
মঠের পাশেই ঠিক এই জায়গায় ছিল ভোটবাগান মঠের নিজস্ব ঘাট |
বৌদ্ধ ধর্মের ছায়ায় ভোটবাগান মঠ তৈরি
হলেও, ভোটবাগান কিন্তু মিশ্র ধর্মাবলীর মঠ। যেখানে বৌদ্ধ দেব-দেবীর সাথেও রয়েছে
হিন্দু দেব-দেবী, এর প্রধান কারণ পুরাণ গিরি, যিনি দশনামী শৈব সন্ন্যাসী। ১৭৭৫
খ্রিষ্টাব্দে মিঃ বোগ্লে যখন সন্ধির জন্য তিব্বতে যান, পাঞ্চেন লামা সেই সময়েই মঠ
তৈরির জন্য বেশ কিছু তিব্বতি দেব-দেবীর মূর্তি বোগ্লে কে দিয়েছিলেন। সাথে মঠকে
সুন্দরভাবে পরিবেশনের জন্য পাঠিয়েছিলেন ১০০ টি সোনার পাত, ধ্বজা ও গালিচা। এরপর
১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে যখন ঘুশুড়ীতে সেই মঠ সম্পূর্ণ হল তখন তিব্বত থেকে আনা সেইসব
বৌদ্ধ মূর্তি ভোটবাগানের এই মঠে প্রতিষ্ঠা হল।
![]() |
মঠের পাশেই গড়ে ওঠা দ্বিতল ভবন, যেখানে ছিল মোহান্তদের বসবাস |
বৌদ্ধ ধর্মে বেশিরভাগ দেবদেবী-ই বৌদ্ধ তান্ত্রিক
মতে প্রতিষ্ঠিত, আর আমাদের এই ভোটবাগান মঠেও রয়েছে সেরকমই তিব্বত থেকে আসা ছয়টি বৌদ্ধ দেবদেবীর মূর্তি – মহাকাল ভৈরব, আর্য তারা, সম্বরচক্র, গুহ্যসমাজা, বজ্রভৃকুটী ও পদ্মপাণি। ভোটবাগান মঠের এই
পাঁচটি তিব্বতি দেবদেবীর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন ইন্দো-তিব্বতিয় পণ্ডিত শরৎচন্দ্র দাস
ও গৌর দাস বসাক তাঁর ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে।
মহাকাল ভৈরব –
মঠের প্রধান বিগ্রহ মহাকাল ভৈরব
(মহাকালা)। হিন্দু ধর্মে যা শিব হিসাবে পরিচিত, তাই বৌদ্ধ ধর্মে মহাকাল ভৈরব। তবে তিব্বতিরা যে মহাকালের চিত্র গঠন করেছিল তা
অত্যন্তই ভয়ঙ্কর। এই মহাকাল হল ষড়ভুজ মহাকাল, যার নয়টি মাথা, ষোলটি পা ও চৌত্রিশটি বাহু, যার প্রত্যেকটিতে রয়েছে একটি করে অস্ত্র এবং গলায় ঝুলছে নরমুণ্ডের
মালা ও সঙ্গে আলিঙ্গন করে রেখেছেন তার সহধর্মিণীকে। আর মহাকাল ভৈরব হলেন তিব্বতি লামার
অভিভাবক অর্থাৎ রক্ষক।
![]() |
আর্য তারা |
আর্য তারা –
বর্তমানে মঠের প্রধান বিগ্রহ আর্য তারা।
যিনি নেপালের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে প্রজ্ঞাপারমিতা নামে পরিচিত। উত্তরের
বিভিন্ন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর তান্ত্রিক বিদ্যালয় অনুযায়ী তিনি অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত
সমস্থ সময়েরই বুদ্ধের স্ত্রী। অন্যদিকে এই আর্য তারা, মহাযান বৌদ্ধধর্মের একজন
নারী বোধিসত্ত্ব, যিনি বজ্রযান বৌদ্ধ ধর্মে একজন নারী বুদ্ধের মর্যাদা পেয়েছেন। বৌদ্ধ ধর্মে দুইটি তারা দেবীর মধ্যে ইনি হলেন শ্বেতবর্ণ তারা বা হোয়াইট তারা। তিব্বতি
বৌদ্ধধর্ম অনুযায়ী তারা হল দয়া ও কার্যের দেবী সেক্ষেত্রে তিনি নারী শক্তি যা
ভারতীয় তান্ত্রিকদের কাছেও শক্তি হিসাবে পরিচিত। চিন থেকে নিয়ে আসা ভোটবাগানের
অসম্ভব সুন্দর এই তারা মূর্তিটি সম্পূর্ণ ব্রোঞ্জের তৈরি যেখানে তার উপরে করা
হয়েছে সোনার গিল্ট।
সম্বরচক্র –
তিব্বতি তান্ত্রিকদের দেবদেবীর মধ্যে
প্রধান হলেন সম্বরচক্র (চক্রসম্ভার)। বজ্রযান বৌদ্ধধর্মে একপ্রকার তন্ত্র হল চক্রসম্বরতন্ত্র,
আর সেই তন্ত্রের প্রধান ইষ্টদেবতা হলেন সম্বর। এই সম্বরচক্রের চারটি মাথা ও
বারোটি বাহু এবং তিনিও আলিঙ্গন করে রেখেছেন তার সহধর্মিণী কে। সম্বরের বাম পদতলে রয়েছে দেবতা 'যম' ও বাম পদতলে দেবী 'কালরাত্রি'।
![]() |
মঠের বৌদ্ধ দেবদেবীর মূর্তি সম্বরচক্র, মহাকাল ভৈরব, গুহ্যসমাজা |
গুহ্যসমাজা –
বজ্রযান বৌদ্ধতন্ত্রের অন্যতম একটি
তন্ত্র গুহ্যসমাজতন্ত্র। যোগিনীতন্ত্রের মূল দেবতা হলেন 'সম্বরচক্র' ও অন্যদিকে মহাযোগ তন্ত্রের মূল দেবতা হলেন গুহ্যসমাজ (গুহ্যসমাজা)। যার তিনটি মাথা ও
ছয়টি বাহু। ইনিও আলিঙ্গন করে রেখেছেন তার সহধর্মিণী কে।
বজ্রভৃকুটী –
নেপালের লিচ্ছবি রাজ্যের রাজা অংশুবর্মার কন্যা হলেন এই বজ্রভৃকুটী। পরবর্তীকালে তিব্বতের সম্রাট সংগেতসেন গাম্পোর সাথে বিবাহ হলে তিনি তিব্বতের রাণী হিসাবে পরিচয় পান। তবে তিব্বতিরা বিশ্বাস করেন বজ্রভৃকুটী বা ভৃকুটি দেবী হলেন তারার অবতার। ইনি হরিদ্বর্ণ তারা বা গ্রিন তারা।
পদ্মপাণি (অবলোকিতেশ্বর) -
প্রায় ৭ ইঞ্চি উচ্চতা বিশিষ্ট। দীর্ঘদিন অব্যবহারের ফলে অনেকাংশই অস্পষ্ট। অনেকটা মিল পাওয়া যায় 'হরিহরিবাহনোদ্ভব অবলোকিতেশ্বরের' সঙ্গে।
এই হল ভোটবাগান মঠের বৌদ্ধ দেবদেবী। এছাড়াও মঠের মন্দিরে রয়েছে বিভিন্ন হিন্দু দেবদেবী, যেমন – বিষ্ণু, বিন্ধ্যবাসিনী, গণেশ, শিবলিঙ্গ, শালগ্রাম শিলা, বিভিন্ন দেবদেবীর পটচিত্র; আর এদের প্রধান কারণই হল পুরাণ গিরির উপস্থিতি।
পরবর্তীকালে ভোটবাগান মঠ প্রতিষ্ঠার পর ১৭৭৯ খ্রিষ্টাব্দে হেস্টিং, পাঞ্চেন লামার সাথে পুনরায় যোগাযোগের জন্য মিঃ বোগ্লের সাথে চেষ্টা চালিয়েছিলেন। পুরাণ গিরি এব্যাপারে সাহায্য করলেও সে সুযোগ হয়নি। ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে পিকিং –এ থাকাকালীন গুটিবসন্ত রোগে পাঞ্চেন লামার মৃত্যু হয়। আর এদিকে ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় থাকাকালীন মিঃ বোগ্লে –এরও মৃত্যু হয়।
![]() |
শিবলিঙ্গ, কালী ও রাজা রবিবর্মার আঁকা আদি শঙ্করাচার্য -এর চিত্র |
আমাদের মনে রাখতে হবে ভোটবাগান মঠ যখন
তৈরি হয় তখন কিন্তু ঘুসুড়ি একপ্রকার গ্রাম; আর জনবসতি কলকারখানা সেসব তৈরি হয়েছে
অনেক পরে, আইন-কানুনের ব্যাপারেও তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি, যার ফলে তখনকার দিনে এই
অঞ্চলে ডাকাতদের উপদ্রব লেগেই থাকত। যার ফলে ১৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দের (মঠ প্রতিষ্ঠার
প্রায় পনেরো বছর পর) সময় একদিন রাতের অন্ধকারে ভোটবাগান মঠে আক্রমণ হল ডাকাতের।
তাঁদের মূল উদ্দেশ্য মঠের যাবতীয় ধনসম্পদ লুঠ করা, কারণ আগেই জেনেছি তিব্বতের সাথে ভারতের লেনদেন হত সোনার মত মূল্যবান ধাতুর, আর সেসময়ে এই মঠের সন্ন্যাসীরা-ই তিব্বতের মাধ্যম হিসাবে পরিচালিত হত, ফলত ডাকতদের উদ্দেশ্য মঠের সেই সমস্থ ধনসম্পদ ও মূল্যবান বিগ্রহ লুঠ করা। কিন্তু এমন সময়ে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন পুরাণ গিরি। আগেই বলেছি পুরাণ গিরির প্রতিভার কথা। এক্ষত্রেও তিনি ডাকাতদের কাছ থেকে মঠকে রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন, দীর্ঘক্ষণ ডাকাতদের প্রতিরোধ করলেও শেষে এক ডাকতের ছোঁড়া বর্শায় পুরাণ গিরির মৃত্যু হয়। তবে শেষমেশ ডাকাতদের ধরা হয়েছিল এবং মঠেরই প্রাঙ্গণে তাদের ফাঁসি দেওয়া হয়।
![]() |
মঠের আবাসস্থলের অংশ |
![]() |
যমজ রঙিন বেলজিয়াম গ্লাসের অবশিষ্ট কিছু |
পুরাণ গিরির মৃত্যুর পর ১৭৯৫
খ্রিষ্টাব্দে মঠের দ্বিতীয় মোহান্ত হন দলজিৎ গিরি গোঁসাই, যিনি দলজিৎ গিরি নামে পরিচিত। তথ্য অনুযায়ী তিনিও একাধিকবার তিব্বতে যাতায়াত
করতেন। পুরাণ গিরির মতো তাঁরও ছিল তিব্বতি পাসপোর্ট। কিন্তু দলজিৎ গিরির মৃত্যুর
পর তিব্বতের সাথে ভোটবাগানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর প্রধান কারণ চিং
সাম্রাজ্য, কারণ ভোটবাগানের আর কোনও মোহান্ত যাতে তিব্বতে আসতে না পারে সেবিষয়ে
চিং আধিকারিক সমস্থ পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। তাই পরবর্তীকালে যারা ভোট গোঁসাই বা ভোট
মোহান্ত হল তারা কিন্তু তাদের পূর্বপুরুষদের মতো তিব্বতে যেতে পারল না। দলজিৎ
গিরির মৃত্যুর পর ক্রমে মোহান্ত হন জগন্নাথ গিরি, জয় এন গিরি, গঙ্গা গিরি ও কালী
গিরি। ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে কালী গিরি মারা গেলে তাঁর দুই শিষ্য বিলাস গিরি, উমরাও
গিরি পরবর্তী মোহান্ত হন। ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে বিলাস গিরি ও তারও ষোলো বছর পর ১৯০৫
খ্রিষ্টাব্দে উমরাও গিরি মারা গেলে ভোটবাগানের ভোট মহন্তদের আদি বংশের অবসান ঘটে,
কারণ উমরাও গিরির কোনও ব্যক্তিগত শিষ্য ছিল না। ফলে মঠ পরিচালনার কোনো মোহান্ত না
থাকায় মঠের কার্যভার চলে যায় আদালতের কাছে এবং আদালত এবিষয়ে সেই বছরেই
ত্রিলোকচন্দ্র গিরি নামে এক দশনামী সন্ন্যাসীকে মঠের মোহান্ত হিসাবে নিয়োগ করেন।
দীর্ঘ ত্রিশ বছর ত্রিলোকচন্দ্র গিরি মঠ পরিচালনা করলেও শেষের দিকে তাঁর বিরুদ্ধে আর্থিক
অনর্থকতার (তছরুপির) অভিযোগ আনা হয়, যার দরুন ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পদত্যাগ করতে
বাধ্য হন। আর এভাবেই পুনরায় মঠের মোহান্ত না থাকায় ভোটবাগানের নিয়ন্ত্রণ চলে যায়
আদালতের কাছে, আর সেই থেকে আজও পর্যন্ত মঠের দায়িত্বে রয়েছে হাওড়া আদালত। বর্তমানে
মঠের পরিচালকের ভূমিকায় রয়েছে হাওড়ার জেলা ও দায়রা জজ ইন্দ্রজিৎ চ্যাটার্জী, আর মঠ
দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছে তিওয়ারি পরিবার এবং মঠের পুরোহিত অজয় চক্রবর্তী।
![]() |
ভোটবাগান মঠের নয়টি সমাধিসৌধের মধ্যে চারটি |
ভোটবাগানের সমাধিসৌধঃ-
এবার আসি মঠের চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকা কিছু মন্দিরের প্রসঙ্গে। প্রথমেই বলি এগুলি মন্দির হিসাবে দেখতে হলেও আসলে কিন্তু মন্দির নয়, এগুলি এক-একটা সমাধি সৌধ। হ্যাঁ! সমাধি সৌধ। হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসীদের মৃত্যুর পর দেহ দাহ করা হলেও, দশনামী রীতি অনুযায়ী সন্ন্যাসীর দেহ দাহ না করে তা সমাধিস্থ করাই রীতি। সেইমতো ১৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দে পুরাণ গিরির মৃত্যুর পরও তাঁর দেহ ভোটবাগান মঠ চত্বরেই গোর (কবর) দেওয়া হয় (সমাধিস্থ) এবং সেই সমাধির উপরেই বাংলার আটচালা শিল্পরীতিতে গঠন করা হয় সমাধিসৌধ। মঠ চত্বরে এরকম ৯ টি সমাধি সৌধ আছে যার মধ্যে আটটি সমাধিসৌধ আটচালা রীতির এবং একটি আধুনিক রীতির (পিরামিড)। প্রত্যেকটি সমাধি সৌধেই ভোটবাগানের বিভিন্ন প্রজন্মের মোহান্ত সমাধিস্থ রয়েছে। লক্ষ করলে দেখা যায় প্রতিটি সৌধের ভেতরে রয়েছে একএকটি শিবলিঙ্গ, এক্ষেত্রেও দশনামী রীতি অনুযায়ী মোহান্তের গোড়ের ওপর স্থাপন করা হয়ে থাকে একএকটি শিবলিঙ্গ। আগে প্রতিটি শিবলিঙ্গই নিত্যপূজা হলেও বর্তমানে শুধুমাত্র একটি সৌধের শিবলিঙ্গ নিয়মিত পুজো হয়। বাকি শিবলিঙ্গ গুলির অবস্থা আশঙ্কাজনক, হয় কোনোটিতে শিবলিঙ্গ ভেঙে পড়েছে তো কোথাও শিবলিঙ্গের চিহ্ন নেই।
![]() |
ভোটবাগান মঠের নয়টি সমাধিসৌধের মধ্যে তিনটি |
![]() |
ভোটবাগান মঠের নয়টি সমাধিসৌধের মধ্যে দুটি (বাঁদিকের সৌধের শিবলিঙ্গ নিত্যপুজো হয়) |
তবে এক্ষেত্রে কোনটি পুরাণ গিরির সৌধ তা কিন্তু কোনোভাবেই জানা যায়নি। কারণ অবশিষ্ট সৌধগুলির বেশিরভাগ অংশই খসে পড়ছে। পূর্বে যে সৌধগুলির চতুর্দিকে স্টাকো আর্টের (শিল্প) নকশা ছিল তা কয়েকটি জায়গায় ভালোভাবে লক্ষ করলে বোঝা যায়। তবে অনুমান করা যায় মঠের সবথেকে বড় সৌধটি পুরাণ গিরি গোঁসাইয়ের, তবে এক্ষেত্রে কোনো প্রমাণ না থাকায় শুধু অনুমান করা যায়। বর্তমানে শুধুমাত্র দুটি সৌধের প্রতিষ্ঠার ফলক এখনও পড়া যায়, বাকি সৌধগুলির কোনো ফলক নেই। (শিলালিপির পাঠোদ্ধার ভোটবাগান গ্রন্থে রয়েছে) এমনকি প্রশাসন কোনপ্রকার হস্তক্ষেপ না করায়, রাতের অন্ধকারে এইসব সৌধগুলি বিভিন্ন অসামাজিক কাজের আস্তানা হয়ে ওঠে।
![]() |
বাকি সৌধগুলির শিবলিঙ্গের অবস্থা |
সাবেক ১৫০ বিঘা জমির মধ্যে বর্তমানে মঠের
অধীনে রয়েছে মাত্র সাড়ে ছয় (৬.৫) বিঘা জমি। আর এর অন্যতম প্রধান কারণ এই অঞ্চলে
দ্রুত শিল্পপ্রসার, যা বিভিন্ন সময়ে মঠের বিভিন্ন জমি হস্তান্তরিত হতে হয়েছে।
এদিকে বিভিন্ন সময়ে মঠের বিভিন্ন সংস্কার হওয়ার ফলে পুরনো সেই স্থাপত্যের কিছু অংশ দেখা মেলে। একসময় মঠের উঠোনে যে বাগান গড়ে উঠেছিল তা শুধুমাত্র বর্তমানে কয়েকটি ফুলগাছ দেখেই অনুমান করা যায়। অন্যদিকে মঠের বামদিকের ভবনে, যেখানে মঠের বিভিন্ন মোহান্তের থাকার জায়গা, সেই স্থানগুলিরও অবস্থা আশঙ্কাজনক কারণ কিছু কিছু যায়গায় রয়ে গেছে শুধুমাত্র ভবনের স্তম্ভ। পলেস্তার খসে পরা ঘরগুলির চতুর্দিকে ছড়িয়ে রয়েছে মঠের বিভিন্ন আসবাবপত্র এমনকি মঠ পরিচালনার নথিপত্র, হিসাব জাতীয় মুল্যবান তথ্য। একসময়ে উপরের এই ভবনটির পুনরদ্ধার কার্য শুরু হলেও মাঝপথে তা আটকে গেছে।
![]() |
মঠের আবাসস্থলে এভাবেই নষ্ট হচ্ছে মঠের মুল্যবান তথ্য, চিত্র ১ |
![]() |
মঠের আবাসস্থলে এভাবেই নষ্ট হচ্ছে মঠের মুল্যবান তথ্য, চিত্র ২ |
![]() |
এমনভাবেই মঠের দেওয়াল ভেদ করে জন্ম নিয়েছে প্রকাণ্ড এক বৃক্ষ |
মঠের বাইরেও যা একসময় উদ্যান ছিল তা এখন স্থানীয় ছেলেদের কাছে ক্রিকেট মাঠ। বর্তমানে মঠের প্রবেশদ্বারের পাশেই একটি প্রস্তরফলক দেখা যায়, যার সারমর্ম অনুযায়ী ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে মুকুল কুমার চ্যাটার্জী ও দীপক কুমার চ্যাটার্জী তাদের পিতামাতার স্মৃতি রক্ষার্থে ভোটবাগান মঠ পুননির্মাণ করেছেন। এমনকি ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে ভোটবাগান মঠের নিজস্ব ভোজনশালা গঠন করা হয়। ফলক অনুযায়ী মঠ পরিচালনার জন্য একটি পরিচালকমণ্ডলীও রয়েছে।
কিন্তু এত কিছুর পরেও মঠের জৌলুস দিনে দিনে ক্ষয় হতে থাকছে। বর্তমানে খুব কম সংখ্যক মানুষই আছেন যারা এই মঠের ব্যাপারে জানেন। কারণ বাকিদের কাছে এই মঠ ‘শঙ্কর মঠ’ কিমবা ‘শঙ্কর মন্দির’ নামেই পরিচয় পাবে, যেহেতু মঠের ভবনেই লেখা আছে ‘শ্রী শঙ্কর মঠ’। তবে স্থানীয়দের কাছে এটি পরিচিত ‘মহাকাল মঠ’ নামে।
![]() |
পড়ে থাকা মঠের বিভিন্ন আসবাবপত্র, চিত্র ১ |
![]() |
পড়ে থাকা মঠের বিভিন্ন আসবাবপত্র, চিত্র ২ |
ভোটবাগান মঠ যে মূলত প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ধর্মের আবরণে ব্রিটিশ-তিব্বতের বাণিজ্য ও রাজনৈতিক স্বার্থে তা ভোটবাগান মঠের ইতিহাস ঘাঁটলেই বোঝা যায়, তবে এক্ষেত্রে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মঠের ইতিহাস তুলে ধরার দায়িত্ব নিতে হবে প্রশাসনকে। তাই এই বিষয়ে যতদিন না ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের হস্তক্ষেপ করছে ততদিনে ঠিক এভাবেই ধীরে ধীরে ঘুশুড়ীর বুকে হারিয়ে যাবে ভারতের প্রথম তিব্বতি মন্দির ‘ভোটবাগান মঠ’।
![]() |
ভোটবাগান |
লেখা, গবেষণা ও ছবি - প্রীতম নস্কর
ই-মেল - pritamnaskar.pn@gmail.com
ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে ব্লগের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, তবে পূর্বানুমতি ছাড়া আমার তোলা
আলোকচিত্রগুলি এবং ব্লগের রচনাগুলি অন্য কোথাও কপি-পেস্ট বা বাণিজ্যিক ভাবে
ব্যবহার করা চলবে না।
******************************************************
ভোটবাগান মঠ একটি পুরাতাত্ত্বিক নিরীক্ষণ ও ক্ষেত্রসমীক্ষা –
প্রকাশক – কল্যাণ দাস (যোগাযোগ – ৯৮৩০৬৬৮১৮১)।
প্রীতম নস্কর - ৮৭৭৭০৬০৬৩৭।
******************************************************
গুগল ম্যাপ / কোঅর্ডিনেটঃ-
কীভাবে যাবেন / ভোটবাগান মঠের ঠিকানাঃ-
ট্রেনে - ভোটবাগানের নিকটতম রেলস্টেশন
লিলুয়া স্টেশন। তাই যেকোন স্টেশন থেকে আসতে হবে লিলুয়া স্টেশন। স্টেশন থেকে নেমেই
১ নং প্ল্যাটফর্ম লাগোয়ায় দেখা মিলবে রিকশা / টোটো। সেখান থেকেই সরাসরি পৌঁছে
যাওয়া যাবে ভোটবাগান মঠ।
বাসে / নিজস্ব গাড়িতে - হাওড়া অথবা বালী থেকে পৌঁছাতে হবে ঘুসুড়ি বাজার (অটোস্ট্যান্ড)। অটোস্ট্যান্ডের পাশ দিয়েই একটি সরু রাস্তা গেছে (এটি বাজার) তার কিছুটা যাওয়ার পরেই ডানদিকে পড়বে গোঁসাই ঘাট রোড এই রাস্তাটি সোজা চলে গেছে গঙ্গার ঘাটে। তবে গঙ্গার ঘাটে ওঠার কিছুটা আগেই ডানদিকে পড়বে এই “ভোটবাগান মঠ”। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে এটা “শঙ্কর মঠ” বা “মহাকাল মঠ” হিসাবেই পরিচিত।
** তবে মনে রাখতে হবে এই জায়গাটি খুবই ঘনবসতিপূর্ণ, যেখানে বিহারী-মুসলিম সম্প্রদায়ের বসবাস। তাই নিজস্ব গাড়ির ক্ষেত্রে পার্কিং –এর জন্য চলে যেতে হবে একদম গোঁসাই ঘাটে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ-
- প্রথমত ধন্যবাদ জানাই আমার বন্ধু সান্তুনু সাহা-কে, যিনি মঠ চত্বরেরই স্থানীয় বাসিন্দা এবং যার সাহায্য ছাড়া এই ভ্রমণ প্রায় অসম্ভব।
- আর ধন্যবাদ জানাই আমার আর এক বন্ধু শুভ পণ্ডিত কে, যিনি এই মঠের পুরো ভ্রমণে আমার সঙ্গে ছিলেন।
তথ্যসূত্রঃ-
- Buddhist Monastery at Bhot Bagan in Howrah - Gour Das Bysack (Journal of the Asiatic Society of Bengal.)
- The Holy Land Reborn: Pilgrimage and the Tibetan
Reinvention of Buddhist India By Toni Huber
- Bengal District Gazetteers – Howrah
- হাওড়া জেলার পুরাকীর্তি – তারাপদ সাঁতরা (পুরাতত্ত্ব বিভাগ – পশ্চিমবঙ্গ সরকার)
- পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি
– বিনয় ঘোষ
- কোচবিহারের ইতিহাস – খান চৌধুরী আমানাতুল্লা আহমেদ।
- buddhanet.net
ভোটবাগান মঠের আরও কিছু চিত্রঃ-
![]() |
খুব ভালো কাজ হয়েছে।
ReplyDeleteধন্যবাদ।
Deleteবিষয়- "মঠ প্রতিষ্ঠার প্রায় পনেরো বছর পর.... ভোটবাগান মঠে আক্রমণ হল ডাকাতের।....তবে শেষমেশ ডাকাতদের ধরা হয়েছিল এবং মঠেরই প্রাঙ্গণে তাদের ফাঁসি দেওয়া হয়।"
ReplyDeleteপ্রশ্ন- অহিংস বৌদ্ধধর্মী মঠে অপরাধ করার জন্য ডাকাতদের ফাঁসি দেওয়া হল, তাও আবার মঠেরই মধ্যে?
হ্যাঁ প্রশ্নটা স্বাভাবিক - অহিংস বৌদ্ধধর্মী মঠে ডাকতদের ফাঁসি কীভাবে দেওয়া হল? উত্তরে এটা বলতে পারি ফাঁসির ব্যাপারে মঠের মোহান্তদের কোন ভূমিকা নেই। সময়টা যেহেতু ১৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দ অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসনের সময়, অনুমান করা যায় মঠ চত্বরে এই চুরি যাওয়া ধনসম্পদের পুনরুদ্ধার করা ও বাকি ডাকাতদের ধরে ফেলা এবং শাস্তি হিসাবে তাদের ফাঁসি দেওয়া - এই সমস্তটাই ব্রিটিশ পুলিশের কীর্তিকলাপ।
Deleteযাবার খুব ইচ্ছা রইলো।
ReplyDeleteঅবশ্যই ঘুরে যাবেন। জানিনা মঠের এই সমাধি সৌধগুলি আর কতদিন টিকে থাকবে। আধুনিকরনের চাপে এই ইতিহাস আজ হারাতে বসেছে।
Deleteমঠের ইতিবৃত্ত জেনে ভাল লাগল। তেমনি অতীত ইতিহাসের এমন দুর্দশাগ্রস্ত চিত্র দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। সরকারি উদ্যোগ খুব দরকার। কিছু করা যায় না?
ReplyDeleteউদ্যোগের ব্যাপারে বলি, মঠের যে পরিচালকমণ্ডলী গড়ে উঠেছে তাদের মধ্যে সরকারি আমলারাও রয়েছে। তাই সরকারের কাছে যে দৃষ্টিগোচর হয়নি একথা ভাবাও ভুল।
DeleteKakhon r kota prayanta khola thake moth ti?
ReplyDeleteসাধারণত প্রত্যেকদিনই মঠ খোলা থাকে। তবে সকালে ১০-১ টার মধ্যে যাওয়াই সুবিধাজনক হবে, কারণ সেই সময়ে স্থানীয় পুরোহিত মন্দিরে আসে। আর যদি আপনি মঠের দরজা বন্ধ দেখেন, অসুবিধা নেই মঠ চত্বরের বিপরীতেই তিওয়ারি পরিবারের বসবাস। স্থানীয়দের জিজ্ঞাসা করলেই তারা আপনাকে চিনিয়ে দেবে। সেই পরিবারের যে কাউকে আপনি যদি বলেন মঠ ঘুরে দেখতে চান, তারা আপনাকে স্বাদর আমন্ত্রণ জানাবে এবং আন্তরিকতার সঙ্গে আপনাকে পুরো চত্বর ঘুরিয়ে দেখাবে।
Deleteখুব সুন্দর সংগ্রহ। বাংলার ইতিহাস লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
ReplyDelete