হুগলী ইমামবাড়া ও দানবীর হাজি মহম্মদ মহসিন ।। Hooghly Imambara and Haji Muhammad Mohsin

কলকাতা থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার উত্তরে হুগলী-চুঁচুড়া পৌরসভার অন্তর্গত এই হুগলী ইমামবাড়া তৈরি হয় বিখ্যাত দানবীর হাজি মহম্মদ মহসিন এর স্মৃতি রক্ষার্থে তাঁরই তহবিল থেকেযা একটি শিয়াপন্থী মুসলিম ধর্মগৃহ অর্থাৎ 'ইমামবাড়া' ইমামবাড়া শব্দটির বুৎপত্তি ফার্সি  শব্দ 'হোসেনিয়া' থেকে (উর্দু - 'আশুরখানা')যা ব্যুৎপত্তিগতভাবে শিয়া ইসলামের তৃতীয় ইমাম 'হোসাইনে ইবনে আলীথেকে এসেছে। অন্যদিকে হোসাইনে ইবনে আলী ছিলেন নবী মুহাম্মাদ -এর নাতিযিনি ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে কারবালার যুদ্ধে নিহত হন এবং তাঁর স্মরণেই মহরমের এই স্মরণ ও শোক পালন করা হয়। ইমামবাড়া শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ইমামের বাড়িকিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে ইমামবাড়া হল শিয়াপন্থীদের মিলনস্থল। প্রথমেই বলে রাখি ইমামবাড়া ও মসজিদ কিন্তু এক জিনিস নয়। মসজিদ সাধারণত ইসলামের সমস্ত সম্প্রদায়ের কাছে উপাসনালয় যেখানে তারা দলবদ্ধভাবে নামাজ পড়তে পারেনঅন্যদিকে ইমামবাড়া শুধুমাত্র শিয়া সম্প্রদায়ের জন্য নির্মিত আনুষ্ঠানিক হল (গৃহ) যা বিশেষত মহরমের স্মৃতিরক্ষার্থে নির্মিত। কিন্তু হুগলীর এই ইমামবাড়া একদিকে মসজিদ ও অন্যদিকে ইমামবাড়া দুটি দায়িত্বই পালন করে আসছে। মোঘল রাজত্বকালে অর্থাৎ ষোড়শ শতকে ইরান (পারস্য) ও ভারতের মধ্যে যে একসময় ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এবং তাতে যে এই বাংলাও অংশগ্রহণ করেছিল তার অন্যতম উদাহরণ এই হুগলী ইমামবাড়া

মধ্য ইরানের ইম্পাহান শহর থেকে আসা এক লবণ ব্যবসায়ী আগা মহম্মদ মোতাহারযার হাত ধরে হুগলীর এই ইরানি সম্প্রদায়ের বসবাস। আর অন্যদিকে ইরান থেকে আসা আর এক চাল ব্যবসায়ী আগা ফয়জুল্লা ইম্পাহানিযার বংশানুক্রমে হাজি মহম্মদ মহসিনের জন্ম ও তউলিয়াতনামা অনুসারে তাঁর জনসেবামূলক একটি ওয়াকফ গঠন। কে এই আগা মহম্মদ মোতাহার ও আগা ফয়জুল্লা ইম্পাহানি?  আর কেনই বা বাংলার ইতিহাসে হাজি মহম্মদ মহসিন একজন দানবীরযার তহবিল থেকে হুগলীর এই ইমামবাড়াকলেজহাসপাতাল ছাড়াও বিভিন্ন দরদীমূলক কাজ স্থাপন হয়েছে এবং বর্তমানেও তা ঘটে চলেছেসেই নিয়েই আজকের এই ব্লগ  হুগলী ইমামবাড়া ও দানবীর হাজি মহম্মদ মহসিন

প্রারম্ভিক উৎস

সুন্নিপন্থী ইরান ও আগা মহম্মদ মোতাহার 

দিল্লির সিংহাসনে যখন মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব তখন থেকেই সুদূর ইরানআরবউজবেক প্রভৃতি দেশ থেকে আসতে শুরু করে অনেক ধনী ব্যবসায়ী। এরা প্রধানত ভারতের বিভিন্ন ঘাঁটিগুলি থেকে মশলাকাপড় কিনে নিয়ে যেত এবং পরিবর্তে তারা নিয়ে আসত বলিষ্ঠ আরবি ঘোড়ামদ ইত্যাদি। যা সেই সময়ে সম্রাটদের কাছে ছিল অতি লোভনীয় বস্তু কিন্তু এইসব বণিকদের মূল উদ্দেশ্য থাকত সম্রাটের সুনজরে পড়া ও দেশীয় জায়গীর লাভ করা। সুন্নিপন্থী ঔরঙ্গজেবের আমলে বেশিরভাগ ইরানীয় মনসবদারই ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ের। ঔরঙ্গজেবের সময়ে তাঁর দরবারে দুইজন বিখ্যাত প্রতিনিধি মীর জুমলা  শায়েস্তা খাঁ ছিলেন ইরানী বংশোদ্ভূত এবং দুজনেই ক্রমান্বয়ে বাংলার সুবেদার পদে নিযুক্ত হন। প্রখ্যাত গবেষক আতাহার আলি তাঁর মুঘল নোবিলিটি আন্ডার ঔরঙ্গজেব গ্রন্থে জানাচ্ছেন ঔরঙ্গজেবের শাসনকালে ১৬৫৮-৭৮ সালের হিসাব অনুযায়ী জাট মনসবদারের যে তালিকা পাওয়া যায় তার মধ্যে মোট ৪৮৬ মনসবদারের মধ্যে ইরানী মনসবদারের সংখ্যা ছিল ১৩৬। সুন্নিপন্থী ঔরঙ্গজেব যে শিয়াপন্থী ইরানীদের প্রতি দুর্বলতা ছিল একথা এই সংখ্যাগুলি থেকে অনুমান করা যেতেই পারে।

আর ঠিক এই সময়েই সুদূর ইরানের ইম্পাহান শহর থেকে আসেন লবণ ব্যবসায়ী আগা মহম্মদ মোতাহার। একদিকে ব্যবসায়ী অন্যদিকে ইরানি সুন্নি সম্প্রদায় ফলে দরবারে আসার পরই উপস্থিত বুদ্ধিতে ঔরঙ্গজেবের সুনজরে পড়া ও জায়গীর হিসাবে হুগলীযশোরচিতপুরের বিস্তীর্ণ জমিজমা। আনুমানিক ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দে আগা মোতাহার তাঁর তিন স্ত্রী ও কিছু ভৃত্য পরিচারিকাদের নিয়ে আসেন হুগলীতে বর্তমানে যেখানে ইমামবাড়া গড়ে উঠেছে ঠিক সেই স্থানেই গঠন করেন নিজেদের একতলা বাড়ি। এখানে আসার পরও তাঁর লবণের ব্যবসা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। ক্রমবর্ধমান সম্পত্তি ও ব্যবসার প্রসারের ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আগা মোতাহার হুগলীর অন্যতম ধনী ব্যক্তিদের একজন হয়ে উঠেছিলেন। ধনসম্পদের দিক দিয়ে তিনি ভাগ্যবান হলেও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অসুখী। ক্রমে ১৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তাঁর একমাত্র বাসস্থান সর্বশক্তিমান আল্লাহর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন এবং নাম রাখেন নজারগহ হোসেইন পরবর্তীকালে ১৭৩৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর জামাই মির্জা সালাউদ্দিন এই ভবনের সঙ্গে গড়ে তোলেন তাজিয়াখানা এবং যার ফলে ভবনটি ইমামবাড়া রূপে আত্মপ্রকাশ ঘটে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমানে সেই ইমামবাড়ার কিছুই অবশিষ্ট নেই। পরবর্তীকালে সেই জায়গায় গড়ে ওঠে নতুন ইমামবাড়া। তবে এবিষয়ে আরও একটি মতামত আছে আগা মোতাহার বর্তমান ইমামবাড়ার সামনে যে জমিটি কিনে বসবাস করছিলেন সেখানে নাকি আগে থেকেই মুর্শিদকুলি খাঁয়ের তৈরি একটি পুরনো ইমামবাড়া ছিলআবার অনেকে মনে করছেননা সেখানে যে ইমামবাড়াটি ছিল তা বিবি আনোয়ার নামে এক ধনী মহিলার তৈরি বিবি আনোয়ার ইমামবাড়া। তবে এক্ষেত্রে ইমামবাড়াটি কার সেরকম কোন তথ্যের প্রমাণ না পাওয়ায় অনুমান করা যায় আগা মোতাহার পুরনো কোন ইমামবাড়াকে সংস্কার করেছিলেন বা নতুন স্থাপন করেছিলেন। 

সে যাই হোকবিশাল সম্পত্তির মালিক আগা মোতাহার ৭৮ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন। কিন্তু মোতাহার তাঁর মৃত্যুর আগেই তাঁর সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে যান তাঁর একমাত্র সাত বছরের কন্যা অর্থাৎ তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী জায়নব খানমের কন্যা মরিয়াম খানম কেযিনি পরিচিত মন্নুজান খানম হিসাবে কিন্তু এসবেরও আগে আগা মোতাহারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে আর এক ইরানি ব্যবসায়ী হাজি ফয়জুল্লা ইম্পাহানি

আগা মহম্মদ মোতাহার -এর সমাধি (প্রথম থেকে ২ নং)

আগা ফয়জুল্লা ইম্পাহানি ও হাজি ফয়জুল্লা ইম্পাহানি 

মোতাহারের মতোই ইরান থেকে আসেন আর এক ব্যবসায়ী আগা ফয়জুল্লা ইম্পাহানি। শুরুর দিকে তাঁরা ব্যবসার খাতিরে মুর্শিদাবাদে বসবাস করলেও পরে তাঁর ছেলে হাজি ফয়জুল্লা ইম্পাহানি মুর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে আসেন হুগলীতে। এখানে আসার পর সাক্ষাৎ হয় আগা মোহতারের সঙ্গে ধীরে ধীরে ব্যবসায়িক সম্পর্কে লিপ্ত এবং ব্যবসার খাতিরে হাজি ফয়জুল্লাকে এজেন্ট হিসাবে সুরাটে পাঠানো কিন্তু ঘটনাচক্রে এর কিছুদিনের মধ্যেই আগা মোতহারের মৃত্যু হলে ফয়জুল্লা সুরাট থেকে ফিরে আসেন এবং মোতাহারের তৃতীয় স্ত্রী জায়নব খানমকে বিয়ে করেন অর্থাৎ জায়নব খানমের দ্বিতীয় বিবাহ। এবং এই বিবাহের ফলেই ১৭৩২ খ্রিষ্টাব্দে ১ লা আগষ্ট জন্ম নেয় তাঁদের একমাত্র পুত্রসন্তান মহম্মদ মহসিন ইম্পাহানি

প্রথম পক্ষের সন্তান মন্নুজান ও পুত্র মহম্মদ মহসিনকে নিয়ে দুই দম্পত্তি সুখেই বাস করতে লাগলেন। জমিদারী সামলানোর ক্ষেত্রে মন্নুজানের বয়স ঠিকঠাক না হওয়া পর্যন্ত দেখাশোনা করতে থাকলেন তাঁর পিতা হাজি ফয়জুল্লা ইম্পাহানি
একদম শেষে হাজি মহম্মদ মহসিন-এর সমাধি, তার আগে মির্জা সালাউদ্দিন -এর এবং তারও আগে মন্নুজান খানমের সমাধি

মন্নুজান ও মির্জা সালাউদ্দিন 

হাজি মহসিন ও মন্নুজানের মধ্যে বয়সের অন্তর ৮ বছর (অনেকের মতে ১৪)। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই মন্নুজান ও মহসিন দুজনেই একসঙ্গে শিক্ষাদীক্ষা, বড়ো হয়ে ওঠা ও সাথে বিভিন্ন ভাষার দক্ষতা অর্জন চলতে থাকে শেষে হাজি ফয়জুল্লার মৃত্যু হলে মন্নুজানের বিয়ে হয় মির্জা সালাউদ্দিন নামক এক ব্যাক্তির সঙ্গে, যিনি হুগলীর ফৌজদার পদে নিয়োগ ছিলেন বিবাহের পর দুই দম্পত্তি মিলেই তাঁদের বিশাল জমিদারী দেখাশোনা করতে থাকেন এক্ষেত্রে বলে রাখি মির্জা সালাউদ্দিন বর্তমান ইমামবাড়ার পূর্বদিকে একটি হাট স্থাপন করেন যা মির্জা সালার হাট নামে পরিচিত ছিল, বর্তমানে সেই হাট অঞ্চল ইমামবাজার নামে পরিচিত।

হাজি মহম্মদ মহসিন

ছোটবেলা থেকেই মহসিন আগা সিরাজি নামক এক পণ্ডিতের কাছ থেকে শিক্ষা অর্জন করতে থাকেন। কোরান ছাড়াও চলতে থাকে আরবি ফার্সি ভাষায় শিক্ষা। আগা সিরাজি একদিকে পণ্ডিত অন্যদিকে পরিব্রাজক, হতে পারে সেই থেকেই মহসিনের মনে দেশ ভ্রমণের এই তীব্র আকাঙ্ক্ষার সূত্রপাত ঘটে। পরবর্তীকালে উচ্চশিক্ষার জন্য মহসিন চলে যান মুর্শিদাবাদে এবং কিছু বছর পর পুনরায় ফিরে আসেন হুগলীতে। পিতার মৃত্যু ও মন্নুজানের বিবাহের পর মহম্মদ মহসিন বেড়িয়ে পরেন দেশ ভ্রমণে। দিল্লী, আগ্রা ভ্রমণের পর পাড়ি দেন আরব দেশে। সেখানে গিয়ে মক্কায় হজ, মদিনায় তীর্থযাত্রার পর ঘুরতে থাকেন মধ্য এশিয়ার অনেক দেশ; যার মধ্যে ছিল তুরস্ক, মিশর, ইরাক আরও অনেক। শেষে পার্সিয়া যাওয়ার আগে মহসিন ফিরে যান ইম্পাহানে তাঁর নিজস্ব পিতৃভূমিতে। জীবনের প্রায় ২৭ টা বছর মহসিন কাটিয়েছিলেন দেশভ্রমণে।
হাজি মহম্মদ মহসিন

শেষে ৬০ বছর বয়সে মহম্মদ মহসিন ফিরে আসেন ভারতে। কিন্তু ভারতে এসেই মহসিন হুগলীতে ফিরলেন না। দিল্লি, লখনৌউ, পাটনা হয়ে ফিরলেন মুর্শিদাবাদে। তিনি তাঁর জীবনে বিশ্বের সমস্ত মুসলিম স্থানগুলি পরিদর্শন করেন। আর এই পরিভ্রমণের ফলে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান তাঁর ব্যক্তিত্বকে আরও শীর্ষে নিয়ে যায়। মহসিন তাঁর এই তপস্বী জীবন ও জ্ঞানের ভাণ্ডার থেকে যা কিছু আছে সবই বিভিন্ন জনসেবামূলক কাজে দান করতে থাকেন। ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি মহসিনের আরও একটি পারদর্শিতা হল আরবি ও ফার্সি হরফে ক্যালিগ্রাফি। মহসিন নিজে হাতে লেখা পবিত্র কোরআনের অনুলিপিগুলি তিনি বিভিন্ন দরিদ্রদের মধ্যে দান করতেন। বর্তমানে সেই কোরআনের একটি অনুলিপি হুগলী মহসিন কলেজের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে।   

এদিকে হুগলীতে মন্নু জানমের স্বামী মির্জা সালাউদ্দিন মারা গেলে, পিতা মহসিন ও প্রয়াত স্বামীর বিশাল সম্পত্তি ও জমিদারীর দায়িত্ব এসে পরে মন্নু জানমের কাঁধে। শিক্ষিত নারী ও উপস্থিত বুদ্ধির দৌলতে হুগলীর এই বিপুল এস্টেট তিনি একা হাতে পরিচালনা করতে থাকেন। কিন্তু ঠিক সেই সময়ে মহসিনের মুর্শিদাবাদ আগমনের কথা জানতে পেরে তাঁকে হুগলীতে ফিরিয়ে আনেন। শেষে ১৮০৩ খ্রিষ্টাব্দে ৮১ বছর বয়সে মন্নু জানমের মৃত্যু হলে তাঁর যাবতীয় সম্পত্তির মালিক হন ৭৩ বছর বয়সি হাজি মহম্মদ মহসিন।

মহসিনের ওয়াকফনামা 

আজীবন ফকির জীবন কাটানো মহসিন উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বিপুল জমিদারীর দায়িত্ব-সম্পত্তির মালিকানা কিছুই তাঁর জীবনদর্শনকে পরিবর্তন করতে পারেনি। পূর্বেও যেমন তিনি দানধ্যানের মধ্য দিয়ে নিজের জীবন অতিবাহিত করে যাচ্ছিলেন, সম্পত্তির মালিকানা পাওয়ার পর তা আরও বেশি পরিমাণে চলতে থাকল। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পরবর্তী সময়েও বাংলার জনজীবন যখন দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত তখনও এই দানবীর মহসিন তাঁর তহবিল থেকে রাজ্যে বহু লঙ্গরখানা চালু করেছিলেন। শেষে সম্পত্তির মালিকানা পাওয়ার তিন বছর পর ১৮০৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এক তউলিয়াতনামা বা ওয়াকফ ডিড তৈরি করলেন, উক্ত দলিল অনুযায়ী তাঁর সমস্ত সম্পত্তি (যার মূল্য ১,৫৬,০০০/- টাকা) নিয়ে গঠন হল একটি ওয়াকফ বা ট্রাস্ট। হাজি মহসিনের সেই আরবি ভাষায় লিখিত ওয়াকফনামা র বঙ্গানুবাদ সাহিত্যিক যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত এর সাহিত্য সাধনা থেকে প্রদান করা হল  

মহসিনের ওয়াকফনামা
আমি হাজি মহম্মদ মহসিন বন্দর হুগলী নিবাসি হাজি ফৈজুল্লার পুত্র এবং আগা ফৈজুল্লার পৌত্র স্বজ্ঞানে স্ববুদ্ধিতে স্বেচ্ছাক্রমে নিম্নলিখিত সত্য এবং ন্যায্য কথা লিপিবদ্ধ করিতেছি। যশোহর জিলার সংলগ্ন কিসমত সৈয়দপুর এবং হুগলী অবস্থিত ইমামবাড়া নামক বিখ্যাত বাড়ি ইমামবাজার এবং হাট ও স্বতন্ত্র তালিকাভুক্ত ইমামবাড়া সংলগ্ন সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তি ও দ্রব্যাদি যে সকল আমি উত্তরাধিকারী-সূত্রে প্রাপ্ত হইয়াছি এবং ইহার দখল স্বত্ব বর্তমান সময় পর্যন্ত ভোগ করিয়া আসিতেছি, আমার কোন পুত্র, পৌত্র এমন কি ন্যায্য আইনসংগত কোন উত্তরাধিকারী পর্যন্ত না থাকায় এবং আমাদের বংশের চিরপ্রচলিত প্রথানুসারে হজরতের ফতে ইত্যাদি পরব উপলক্ষে দানকার্য ও অন্যান্য রীতিনীতি রক্ষা করিবার আমার সম্পূর্ণ ইচ্ছা থাকায় আমি পূর্বোক্ত সমুদয় সম্পত্তি সর্ববিধ অধিকার সহ নিম্নশর্তানুরূপ ব্যয়নির্ব্বাহার্থ খোদার নামে স্থায়ী ভাবে দান করিয়া যাইতেছি।

সেখ মহম্মদ সাদিকের পুত্র রাজবউলিখাঁ ও আমার খাঁর পুত্র সকিরউলি খাঁর বিদ্যা বুদ্ধি ধর্ম-প্রবণতা এবং সাধুতা দেখিয়া আমি ইহা দ্বারা তাহাদিগকে উক্ত কার্যনির্বাহের জন্য আমার সম্পত্তির মাতোয়ালি বা তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করিতেছি। তাঁহারা পরস্পরের উপদেশ এবং সাহায্য গ্রহণান্তর পরামর্শ করিয়া ও একমত হইয়া উক্ত কার্য একত্রে নিম্নলিখিত ভাবে সুচারুরূপে নিষ্পন্ন করিবেন। পূর্বোক্ত মতোয়ালিগণ রাজস্ব প্রদানপূর্বক অবশিষ্ট উপস্বত্ব নয়ভাগে (৯) বিভক্ত করিবেন। তাহা হইতে 

তিন ভাগ (৩/৯) সর্বশ্রেষ্ঠ ঈশ্বরানুগৃহীত ব্যক্তি হজরত সৈয়দ ইকায়ুনত এবং নিষ্পাপ ইমামগণের ফতের জন্য মহরম উলহরাম, ঊস্রা ও অন্যান্য পরব, পরবদিন উপলক্ষে এবং ইমামবাড়া ও সমাধি স্থান সংস্কারের জন্য ব্যয় করিবেন!

দুইভাগ (২/৯) সমভাবে বিভক্ত করিয়া মাতোয়ালিগণ নিজ নিজ খরচের জন্য রাখিবেন।

অবশিষ্ট চারভাগ (৪/৯) কর্মচারীগণের মাহিনা তৎসংক্রান্ত নানাবিধ খরচাদি এবং যাহাদের নাম আমার স্বাক্ষরিত ও মোহরাঙ্কিত করিয়া ভিন্ন তালিকাভুক্ত করা হইয়াছে, তাহাদের জন্য প্রদান করিবেন।

দৈনিক ব্যয় ও মাসিক বৃত্তি বা বেতন বিষয়ে সর্ত রহিল যে উক্ত বৃত্তি বা বেতুনধারী সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ, পেয়াদাগণ ও অন্যান্য নিযুক্ত ব্যক্তিগণের যোগ্যতা ও উপযুক্ত বিবেচনা করিয়া উক্ত মাতোয়ালীগণ স্বেচ্ছামত তাহাদিগকে কর্মে বহাল কিমবা কর্মচ্যুত করিবার সম্পূর্ণ ক্ষমতা প্রাপ্ত হইবেন। আমি সর্ব জনসম্মুখে এই অধিকার উক্ত ব্যক্তিদ্বয়ের হস্তে প্রদান করিয়াছি। যদি কোন সময়ে কোন মাতোয়ালী এই দলিলোক্ত কার্য করিতে অক্ষম বোধ করেন তাহা হইলে তিনি একজন উপযুক্ত এবং সুদক্ষ ব্যক্তি নির্বাচন করিয়া তাহার পক্ষ হইতে মাতোয়ালীর কার্যে নিযুক্ত করিতে পারিবেন। উল্লিখিত শর্তগুলি আজ হিজরা ১১২১, বাংলা ১২১৩ সনের বৈশাখ মাসের ১৯ শে তারিখে এই দলিল লিখিয়া দেওয়া গেল এবং প্রয়োজন হইলে উক্ত দলিলই আমার ন্যায়ানুমোদিত কার্যের যথার্থতা সপ্রমাণ করিবে

হাজি মহম্মদ মহসিন -এর মকবরা ( মহসিন ও তাঁর পারিবারিক সমাধিক্ষেত্র)

পরবর্তীকালে মহসিনের এই ট্রাস্ট থেকে প্রাপ্ত বার্ষিক আয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়ে ছিল দেড় লক্ষ টাকা। মহসিনের এই ফান্ড থেকে পরবর্তীকালে হুগলী-চুঁচুড়ার মহসিন কলেজ, ইমামবাড়া হাসপাতাল, হুগলী ইমামবাড়া ছাড়াও অনেক সেবামূলক কাজ সম্পন্ন হয়ে আসছে এপার বাংলা ও ওপার বাংলা দুই ক্ষেত্রেই মহসিনের ওয়াকফনামা ব্যবহৃত অর্থে গড়ে উঠেছে অসংখ্য মাদ্রাসা, বিদ্যালয়, কলেজ ও ইমামবাড়া। বাংলাদেশ চট্টগ্রামের সরকারি হাজী মুহম্মদ মহসিন কলেজ ও হাজী মুহম্মদ মহসিন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মহসিনের এই ট্রাস্ট থেকেই নির্মিত। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হল তাঁরই স্মরণে রাখা হয়েছে। যশোরে মহসিনের স্মরণে রয়েছে একটি ইমামবাড়া, এমনকি বাংলাদেশের ঢাকায় অবস্থিত নৌবাহিনীর ঘাঁটির নাম রাখা হয়েছে বিএনএস হাজি মহসিন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এসব জনসেবামূলক কাজ মহসিন দেখে যেতে পারেননি। তউলিয়াতনামা তৈরির ছয় বছর পর ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ শে নভেম্বর হুগলীর এই দানবীর মহাত্মা হাজি মহম্মদ মহসিন ৮০ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।

বর্তমান ইমামবাড়ার পূর্বদিকে পার্শ্ববর্তী উদ্যানের মধ্যে এক গম্বুজযুক্ত কাঠামো বা মকবরা রয়েছে, যেটি মহসিন ও তাঁর পারিবারিক সমাধিক্ষেত্র। যেখানে হাজি মহম্মদ মহসিন ইম্পাহানি, পিতা আগা মহম্মদ মোতাহার, বোন মন্নুজান খানম ও শ্যালক মির্জা সালাউদ্দিন এর কবর রয়েছে।
A Hand-coloured print of the Imambara at Hooghly, from the Fiebig Collection Views of Calcutta (courtsey British Library)

A Hand-coloured print of the Imambara 2 at Hooghly, from the Fiebig Collection Views of Calcutta (courtsey British Library)

হুগলী ইমামবাড়া 

তউলিয়াতনামা অনুযায়ী হুগলী ইমামবাড়া নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য মহসিন এক মোতাওয়াল্লি (মুসলিম আইন অনুসারে ওয়াকফ সম্পত্তি বা মাজার দেখাশোনা ও পরিচালনার জন্য নিয়োগ করা এক ট্রাস্ট বা ব্যক্তি) নিয়োগ করেছিলেন। তবে দুঃখের বিষয় বর্তমান ইমামবাড়া তৈরি হওয়ার আগেই তিনি পরলোকগমন করেন। মহসিনের মৃত্যুর পর ১৮১৫ সালে তৎকালীন মোতওয়াল্লির বিরুদ্ধে তহবিল তছরুপের অভিযোগ ওঠে এবং সে সময়ে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারকে এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয়। শেষে ইংরেজ আদালত অভিযুক্ত মোতাওয়াল্লিকে সরিয়ে দিয়ে ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে মহসিনের ট্রাস্ট ও ইমামবাড়া দেখাশোনার জন্য মোতাওয়াল্লি পদে নিযুক্ত করেন ষষ্ঠ মোতাওয়াল্লি মৌলবি সৈয়দ কেরামত আলীরাজস্থানের জৌনপুরের বাসিন্দা সৈয়দ কেরামত আলী শুরু থেকেই জ্যামিতি, বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয়ে দক্ষ পারদর্শী। মূলত তাঁরই তত্ত্বাবধানে ১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান ইমামবাড়া নির্মাণ শুরু হয় এবং নির্মাণকার্য শেষ হয় ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ইমামবাড়া নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল ২,১৭,৪১৩/- টাকা।

প্রবেশদ্বারের দুপাশের দুই ঘর- বামদিকে 'তাজিয়াখানা' ডানদিকে 'সরবতখানা'

উঠোনের দুপাশে লম্বা করিডোর

বর্তমান ইমামবাড়ার প্রবেশের মুখেই রয়েছে এক প্রশস্ত রাজকীয় তোরণদ্বার যার দুপাশে দুটি ঘর তাজিয়াখানা ও সরবতখানা, যেখান থেকে পবিত্র মহরম অনুষ্ঠানে তাজিয়া সাজিয়ে জুলুশ বার করা হয়। মূল ফটক দিয়ে প্রবেশের পর আমরা পৌঁছব এক বিস্তীর্ণ উঠোনে। উঠোনের মধ্যিখানে আয়তকার জলাধার ও তার মাঝখানে একটি চমৎকার ফোয়ারা। একসময়ে এই জলাধারে রঙিন মাছ ঘোরাফেরা করত এবং ফোয়ারাও নিজস্ব জলধারায় তার শোভা বৃদ্ধি করত। কিন্তু বর্তমানে তা আর কোনও কাজ করে না এবং জলাধারের স্বচ্ছ জল আজ সবুজ শ্যাওলায় পরিপূর্ণ। উঠোনের দুপাশে লম্বা করিডোরযুক্ত দ্বিতল ভবন, যেখানে একসময় গড়ে উঠেছিল মাদ্রাসা। কিন্তু বর্তমানে এই অংশ খানিকটা ছাত্রাবাস ও অফিসিয়াল কাজে ব্যবহৃত হয়।

জ্যামিতিক বিন্যাস

আয়তাকার জলাধারের মাঝখানে ফোয়ারা ও দূরে জারিদালান অর্থাৎ প্রার্থনাকক্ষ

জারিদালানের প্রবেশপথ (উপরে রঙবেরঙের বেলজিয়াম গ্লাসের কারুকার্য)

উঠোনের উত্তরপূর্ব দিকে উঁচু একটি ভিত্তির উপর রয়েছে এক অপরূপ সুন্দর জারিদালান, যা মূলত প্রার্থনাকক্ষ। কারুকার্যখচিত এই অপরূপ জারিদালানের প্রবেশপথে রয়েছে ছয়টি স্তম্ভ ও সাতটি প্রবেশদ্বার। জালিদালানের প্রবেশের পরই যে বিষয়টি চোখে পড়বে তা হল সমগ্র দেওয়াল জুড়ে অপরূপ ফার্সি ক্যালিগ্রাফি, যা মূলত হাদিস থেকে নেওয়া পবিত্র ইসালামের শেষ বাণীবাহকের বাণী ও জীবনাচরণ। এছাড়াও জারিদালানের অভ্যন্তরে শোভা পাচ্ছে সুন্দর বেলজিয়াম কাঁচের লন্ঠন, ঝাড়বাতি এবং মেঝেতে সাদা-কালো চেকার্ড প্যাটার্নের মার্বেল। জারিদালানের অভ্যন্তরে মূল প্রার্থনাকক্ষে রয়েছে ৫ টি সুরুচিপূর্ণ তাজিয়া, যা মূলত নবী মহম্মদ, সৈয়দা ফাতিমা, হজরত আলী, ইমাম হাসান ও ইমাম হুসেন এর স্মৃতিতে।

প্রার্থনাকক্ষ

প্রার্থনাকক্ষের দেওয়াল জুড়ে ফার্সি ক্যালিগ্রাফি

ফার্সি ক্যালিগ্রাফি ও রঙবেরঙের বেলজিয়াম গ্লাসের ঝাড়লন্ঠন

প্রার্থনাকক্ষের দেওয়াল জুড়ে ফার্সি ক্যালিগ্রাফি - ২

ইমামবাড়ার উত্তরদিকে জারিদালানের পাশ দিয়ে একটি সরু রাস্তা চলে গেছে নদীর দিকে, যা ইমামবাড়ার পিছনের দিকে নিয়ে যায়। সেখান থেকেই লক্ষ করা যায় ইমামবাড়ার পিছনের দিকে অর্থাৎ পূর্বদিকের দেওয়ালের উপরের অংশে স্টাকো শিল্পকলায় সুসজ্জিত ফার্সি ও ইংরাজি ভাষায় খোদাই করা মহসিনের সেই তউলিয়াতনামা অর্থাৎ উইল।

এছাড়াও গঙ্গার ঘাটের সম্মুখে রয়েছে ইমামবাড়ার আরও একটি দর্শনীয় বস্তু সূর্যঘড়ি। যা মূলত ৩ ফুট উঁচু সিমেন্টের তৈরি এক সূর্যঘড়ি। পূর্বে সূর্যঘড়ির ডায়ালটি পিতলের ছিল কিন্তু পরবর্তীকালে সেটি চুড়ি যাওয়ায় বর্তমানে তা সিমেন্টে তৈরি করা হয়েছে।

সূর্যঘড়ি

দেওয়ালে খোদাই করা মহসিনের তউলিয়াতনামা (অর্থাৎ উইল)

দেওয়ালে খোদাই করা মহসিনের তউলিয়াতনামা (অর্থাৎ উইল) - চিত্র ২

ইমামবাড়ার জোড়া টাওয়ার - 

তবে হুগলী ইমামবাড়ার প্রধান আকর্ষণ হল এর মূল প্রবেশদ্বারের উপরে ৮০ ফুট লম্বা জোড়া টাওয়ার, যা মূলত ক্লকটাওয়ারসুউচ্চ এই টাওয়ার দুটির মাঝে রয়েছে ফার্সি হরফযুক্ত এক প্রকাণ্ড ঘড়ি। ঘড়ির দুটি ডায়াল অর্থাৎ দুটি মুখ, একটি রাস্তার দিকে ও অন্যটি ইমামবাড়ার ভিতরের অংশে। ১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দে সৈয়দ কেরামত আলী ১১,৭২১/- টাকায় লন্ডন থেকে ঘড়িটি নিয়ে আসেন। ঘড়িটি তৈরি করেছিলেন লন্ডনের বিখ্যাত সংস্থা 'মেসার্স ব্ল্যাক অ্যান্ড মুরে কোম্পানি'টাওয়ারে সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে ঘড়িটির ঘণ্টাঘর যার মধ্যে রয়েছে তিনটি প্রকাণ্ড ঘণ্টা; যার ওজন যথাক্রমে ৩০ মণ, ৪০ মণ ও ৮০ মণ অর্থাৎ কিলোগ্রামে রূপান্তর করলে দাঁড়াবে ১১২০ কেজি, ১৪৯৩ কেজি ও ২৯৮৬ কেজিএদের মধ্যে ৩০ ও ৪০ মণের ঘণ্টা দুটি প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর ও ৮০ মণের ঘন্টাটি প্রতি এক ঘণ্টা পর বেজে ওঠে। আর এই প্রকাণ্ড ঘড়িটিকে সচল রাখতে ২০ কেজি ওজনের এক চাবির সাহায্যে প্রতি সপ্তাহে ঘড়িটিতে দম দিতে দুজন কর্মঠ মানুষের সময় লাগে প্রায় আধ ঘণ্টা। দুটি টাওয়ারেরই উপরে ওঠার জন্য রয়েছে দুটি সিঁড়ি, যার মধ্যে একটি পুরুষদের ও অন্যটি মহিলাদের জন্য। ১৫২ টি সিঁড়ি ভেঙে যদি আপনি টাওয়ারের শীর্ষে উঠতে পারেন তাহলে এটা বলতে পারি আপনি সুন্দর কিছু দৃশ্যের সম্মুখীন হবেন; যেখানে থাকবে সবুজে ঘেরা হুগলীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল, বয়ে চলা অপরূপ হুগলী নদী (গঙ্গা) আর ১৩৫ বছরের পুরনো জুবিলি ব্রিজ, যা ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়ার রাজত্বের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে ব্রিটিশদের দেওয়া এই নাম।

৮০ ফুট লম্বা জোড়া ক্লক টাওয়ার

তিনটি প্রকাণ্ড ঘণ্টা - ওজন (৮০ মণ, ৪০ মণ ও ৩০ মণ)

ঘড়ির যন্ত্রপাতি (দম দেওয়ার ঘর)

বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে শহরের অন্যান্য স্থাপত্যের মতোই হুগলী ইমামবাড়াও তার জৌলুস হারাতে বসেছে। দীর্ঘ সময় ধরে এই হুগলী ইমামবাড়া অনাদরে পড়ে থাকায় অবহেলা ও ক্ষয়ের লক্ষণ রয়েছে সর্বত্র সুন্দর রংবেরঙের বেলজিয়াম গ্লাসের তৈরি ঝাড়বাতি, জানলাগুলি দীর্ঘদিন অপরিষ্কারের ফলে তার জৌলুস হারাতে বসেছে। বেশিরভাগ জায়গাতেই দেওয়ালের প্লাস্টার উঠে এসেছে। জারিদালানের ক্যালিগ্রাফিগুলিও কিছু কিছু জায়গায় ঝাপসা হতে শুরু করেছে। দেওয়ালের স্টাকো শিল্পকলাগুলিও রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে খসে পড়েছে। লম্বা করিডোরের নিচের অংশের ঘরগুলিও অব্যবহারের ফলে মলিন।  

তবে সাম্প্রতিক ইমামবাড়ার সংস্কার ও সৌন্দর্যায়নের কাজ শুরু হয়েছে। জারিদালান ও ক্লক টাওয়ার দুটি সংস্কার হয়েছে। তবে জানিনা সিমেন্টের প্রলেপ আর রঙের মারপ্যাঁচ সে সৌন্দর্যায়নকে কতটা ইতিহাস বহন করবে। সে যাইহোক হাজি মহসিনের এই কর্মকাণ্ড ও তাঁর এই হুগলী ইমামবাড়া বাংলার ইতিহাসে এক অন্যতম নিদর্শন।

******************************************************

লেখা, গবেষণা ও ছবি - প্রীতম নস্কর  

ই-মেল - pritamnaskar.pn@gmail.com

ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে ব্লগের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, তবে পূর্বানুমতি ছাড়া আমার তোলা আলোকচিত্রগুলি এবং ব্লগের রচনাগুলি অন্য কোথাও কপি-পেস্ট বা বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করা চলবে না।

******************************************************

টাওয়ার থেকে দেখা যায় - চুঁচুড়া শহর, হুগলী নদী ও জুবিলি ব্রিজ

কোঅরডিনেট / গুগল ম্যাপ 

22°54'30.0"N 88°23'59.5"E

সময়সূচী ও প্রবেশমূল্য 

এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস সকাল ৮ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা, সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ মাস সকাল ৮ টা থেকে সন্ধ্যা ৫ টা পর্যন্ত হুগলী ইমামবাড়া সর্বসাধারণের জন্য খোলা থাকে। প্রবেশমূল্য ১০ টাকা।

কীভাবে যাবেন 

রেলপথে- হাওড়া-বর্ধমান মেনলাইন শাখার যে কোনও লোকাল ট্রেন ধরে পৌঁছাতে হবে হুগলি অথবা ব্যান্ডেল স্টেশনস্টেশনে নেমে যেকোনো অটো বা টোটোতে পৌঁছে যাওয়া যাবে হুগলি ইমামবাড়া

সড়কপথে- গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড (জি. টি. রোড) ধরে সোজা হুগলি মোড়। সেখান থেকে পিপুলপাতি হয়ে হুগলী ইমামবাড়া।

কাছাকাছি দ্রষ্টব্য স্থান / হুগলী-চুঁচুড়া নিয়ে কিছু ব্লগ -  

সাত সাহেবের বিবির কবর, চুঁচুড়া...... সুস্যানা আন্না মারিয়া, ৭ খুন মাফ

হুগলী ইমামবাড়া-র আরও কিছু ছবি -

ইমামবাড়া (সড়কপথ থেকে)

লম্বা করিডোর ১
লম্বা করিডোর ২ (সাদা কালো)
ঘাট থেকে ইমামবাড়ার পূর্বদিকের অংশ
জারিদালান
রঙবেরঙের বেলজিয়াম কাঁচ
প্রার্থনা কক্ষের বাইরের অংশ

তথ্যসূত্র 

  •  হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ (দ্বিতীয় খণ্ড)  সুধীরকুমার মিত্র
  • যশোহর খুলনার ইতিহাস  শ্রী সতীশচন্দ্র মিত্র
  • Hooghly Past and Present – by Shambhoo Chunder Dey
  • Bengal District Gazetteers Hooghly - O’Malley, L.S.S.
  • History of Hooghly College – by K. Zachariah
  • The Central Structure of the Mughal Empire. By Ibn Hasan
  • Website of Imambarah Hooghly Committee of Management
  • Sreecheta Mukherjee's article on Hooghly Imambara in Chitrolekha International Magazine

Comments