সাত সাহেবের বিবির কবর, চুঁচুড়া...... সুস্যানা আন্না মারিয়া, ৭ খুন মাফ ।। Tomb of SUSANNA ANNA MARIA, Chinsurah

আচ্ছা বলুন তো হুগলীর চুঁচুড়া আর বিখ্যাত সাহিত্যিক রাস্কিন বন্ড এর মধ্যে যোগসূত্র কোথায়? কিমবা চুঁচুড়ার ওলন্দাজ নগরী আর বলিউডের প্রিয়াঙ্কা চোপড়া অভিনীত সুস্যানা চরিত্রেরই বা যোগসূত্র কোথায়?    

কলকাতা থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে জি টি রোড ধরে চন্দননগর থেকে চুঁচুড়া প্রবেশের মুখেই রাস্তার ডানদিকে দেখতে পাওয়া যাবে ইন্দো-ডাচ স্থাপত্যরীতিতে গড়ে ওঠা দোতলা একটি সৌধ দূর থেকে দেখলে অনেকটা মন্দিরের মতো দেখতে হলেও আসলে এটি একটি সমাধিসৌধ, স্থানীয় নাম সাত সাহেবের বিবির কবর বা মেমসাহেবের কবরডাচ যুগের একটি স্থাপত্য যা এক ডাচ মহিলার স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মিত সমাধিসৌধ। আর এই সৌধ যার স্মৃতি রক্ষার্থে তৈরি তিনিই আজকের ব্লগের মুখ্য চরিত্র সুস্যানা আন্না মারিয়া ভারকার

সাত সাহেবের বিবির কবর, চুঁচুড়া...... সুস্যানা আন্না মারিয়া, ৭ খুন মাফ ।। Tomb of  SUSANNA ANNA MARIA, Chinsurah

গল্পের চরিত্র ও বাস্তবতা

হ্যাঁ! এবার ফিরি গল্পে মনে পড়ছে ২০১১ সালে তৈরি হওয়া সিনেমা ৭ খুন মাফ? যা মূলত রাস্কিন বন্ডের রচিত একটি পাঁচ পাতার ছোটগল্প সুসান্নাস সেভেন হাসবেন্ড এর উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। পরিচালক ভিশাল ভরদ্বাজ যখন গল্পটিকে সিনেমায় রূপান্তরের জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেন তখন তাঁর অনুরোধেই রাস্কিন বন্ড সেই ৫ পাতার গল্পকে রূপান্তর করে ফেলেন আস্ত একটি উপন্যাসে আর সেটার উপর ভিত্তি করেই বিশাল ভরদ্বাজ ও হলিউডের ম্যাথিউ রবিন্স তৈরি করে ফেলেন চিত্রনাট্য এবং সিনেমার মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন প্রিয়াঙ্কা চোপড়া আর এই গল্প ও সিনেমার মুখ্য চরিত্রের নাম হল সুসান্না আন্না মারিয়া হ্যাঁ! চুঁচুড়ার এই সমাধিসৌধও যাকে উদ্দেশ্য করে গঠন করা সেই একই নাম সুসান্না আন্না মারিয়া। যেখানে প্রায় ২১৫ বছর ধরে শুয়ে আছেন এই ডাচ মহিলা। 

তবে কি এই 'সুসান্নাস সেভেন হাসবেন্ড' এর চরিত্র আর সাত বিবির কবর এর সুসান্না কি একই ব্যক্তি?

না! এ প্রশ্নের উত্তর এত চটজলদি দেওয়া মুশকিল আশ্চর্যজনকভাবে হোক বা ইচ্ছাকৃত ভাবে অথবা গল্পের খাতিরে চরিত্রটির অনুপ্রেরণার জন্য রাস্কিন বন্ড চুঁচুড়ার এই ডাচ মহিলার নাম বেছে নিয়েছিলেন। গল্পের প্লটের খাতিরে বন্ড জানাচ্ছেন

“Locally the tomb was known as ‘the grave of the seven times married one’…..…. this was the tomb of Susanna Anna-Maria Yeates, and the inscription (most of it in Latin) stated that she was mourned by all who had benefitted from her generosity, her beneficiaries having included various schools, orphanages and the church across the road. There was no sign of any other grave in the vicinity and presumably her husbands had been interred in the old Rajpur graveyard, below the Delhi Ridge………… The two-storeyed house had looked across the Grand Trunk Road. Now abandoned, feared and shunned, it stood encircled in mystery, reputedly the home of evil spirits.”

কে এই সুসান্না আনা মারিয়া? আর কেনই বা তার সমাধিকে সাত সাহেবের বিবির কবর বলা হয় সে নিয়েই আজকের এই ব্লগ। তবে এই ডাচ মহিলার প্রসঙ্গ শুরু করার আগে দেখে নিতে হবে চুঁচুড়ার এই ডাচদের বসবাস শুরু হল কীভাবে...

ডাচ বাণিজ্য নগরী চুঁচুড়া

পর্তুগীজদের পরে মোটামুটি সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিক করে এ দেশে ডাচ বা ওলন্দাজদের আনাগোনা শুরু হয়। ভারতে আসার আগে সমগ্র এশিয়া জুড়েই ডাচ কোম্পানি তাদের মশলার বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে শুরু করে। সপ্তদশ শতাব্দীর এই সময়ে বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে ইউরোপীয় দেশগুলিও একপ্রকার উঠেপড়ে লেগেছিল, বিশ্বের বাজারে তাদের একচেটি আধিপত্য বজায় রাখার জন্য তারা নিজেদের মধ্যে কোম্পানি গঠন করতে শুরু করে। আর ঠিক এই কারণেই ১৬০২ খ্রিষ্টাব্দে নেদারল্যান্ডসে গঠন হয় ডাচ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ভেরিনিগ্ড ওস্টইন্ডিশ কম্পাগনি অর্থাৎ ইউনাইটেড ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৬০৪ খ্রিষ্টাব্দে অ্যাডমিরাল স্টিভেন ভ্যান ডের হেগেন সর্বপ্রথম এসে পৌছান মালাবারে। তারপর ধীরে ধীরে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্যচুক্তি স্বাক্ষর এবং ব্যবসার প্রসার। সর্বপ্রথম ১৬২২ খ্রিষ্টাব্দে ডাচ কমান্ডার জন কর্নেলিজ কুস্টকে বাংলা থেকে নুন, চিনি ও কাপড় ক্রয়ের জন্য মুর্শিদাবাদের কাশিমবাজারে তিনটি ডাচ জাহাজ পাঠান এবং সেই থেকেই মোটামুটি ডাচরা বাংলায় আসতে শুরু করে। কিন্তু ১৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট শাহজাহান যখন পর্তুগীজদের বাংলা থেকে বিতাড়িত করে তখন হুগলীতে বাণিজ্যবিস্তারের জন্য ডাচদের কাছে মোক্ষম সুযোগ হয়ে ওঠেশেষে ১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট শাহজাহানের থেকে পাওয়া ফর্মানের দৌলতে ডাচরা বাংলায় তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে হুগলীর নিকট চিনসুরা নামক গ্রামে, যা বর্তমানে চুঁচুড়া। এখানে আসার পর ডাচরা লবণ, আফিম, মসলিন এবং মশলার বাণিজ্য করতে থাকে। পরবর্তীকালে ১৬৫৫-১৬৬৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ফ্যাক্টরি পরিচালনার জন্য চুঁচুড়ায় ফোর্ট গুস্তাভিয়াস নামক একটি কুঠি গঠন এবং ধীরে ধীরে গির্জা ও শহরের ভবন নির্মাণ। আর এরপর থেকেই আগামী দুশো বছর পর্যন্ত চুঁচুড়ায় ডাচ বাণিজ্য ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকেআঠারো শতকের গোড়ার দিকে বাংলায় ডাচ বাণিজ্য এতটাই সমৃদ্ধ হয়েছিল যে চুঁচুড়া-হুগলীকে ডাচ প্রজাতন্ত্রের সাথে সরাসরি বাণিজ্য করার অনুমতি দেওয়া হয় কিন্তু ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজদৌল্লার পরাজয়ের পর বাংলার শাসনক্ষমতা চলে যায় ব্রিটিশদের কাছে, যার প্রভাবে বাংলায় ডাচদের প্রভাব প্রতিপত্তি একটি সামান্য ক্ষমতায় পরিণত হয়। শেষে ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে চুঁচুড়ার ডাচ ও ব্রিটিশদের মধ্যে বিদেরার যুদ্ধে ডাচদের পরাজয় এবং ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশদের দৌলতে চুঁচুড়ার এমনকি বাংলার সমস্ত ডাচ সম্পত্তি সাময়িকভাবে বাজেয়াপ্ত হয়সর্বশেষে ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে অ্যাংলো-ডাচ চুক্তি (ইঙ্গো-ওলন্দাজ চুক্তি) র মাধ্যমে ডাচরা তাদের ভারতীয় উপমহাদেশের সমস্ত সম্পত্তি ব্রিটিশদের কাছে আত্মসমর্পণ করে চলে যায় তবে এই ব্লগটিতে ডাচদের চুঁচুড়া আগমন এই পর্যন্তই। চুঁচুড়ার ডাচ আগমন ও তাঁদের স্থপত্যের বিষয় নিয়ে বিস্তারিতভাবে লেখা থাকবে পরবর্তী ব্লগটিতে। 

বাংলা থেকে ডাচরা পাকাপাকিভাবে ভাবে চলে গেলেও ডাচদের স্থাপত্য-সম্পত্তির নিদর্শন এখনও চুঁচুড়ার সর্বত্রই দেখতে পাওয়া যায়। আর ডাচদের এই স্থাপত্যের মধ্যে অন্যতম নিদর্শন হল সুস্যানা আন্না মারিয়া-র স্মৃতিসৌধ।  

কে এই সুস্যানা আন্না মারিয়া?

সুস্যানা অ্যানা মারিয়া (সুসান্না আন্না মারিয়া) হলেন এক ডাচ মহিলা, যিনি ১৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দে ৫ ই অক্টোবর নেদারল্যান্ডসের গেল্ডারল্যান্ড নামক প্রদেশের তিয়েল নামক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে কীভাবে তিনি হুগলীতে এসে উপস্থিত হলেন তার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দে ১৬ ই অক্টোবর সুস্যানা প্রথম বিবাহ করেন পিটার ব্রুইস নামক এক ডাচ ব্যবসায়ী কে তাদের চার সন্তান (মতান্তরে তিন) দুই কন্যা ও দুই পুত্র। ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে তাদের প্রথম কন্যা সন্তান সুসান্না জ্যাকোবা এবং পরবর্তীতে ১৭৬২ তে জোহানেস অ্যাড্রিয়ান ব্রুইস, ১৭৬৪ তে লুই অ্যাড্রিয়ান দে ব্রুইস ও ১৭৬৫ তে মারিয়া আনা দে ব্রুইস জন্মগ্রহণ করেন। প্রশাসনিক কাজে স্বামী পিটার ব্রুইস দক্ষতার পরিচয় দেন। প্রথমে ১৭৬৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ডাচদের কাশিমবাজার কুঠির প্রধান পদে এবং পরবর্তীকালে চুঁচুড়ার মুখ্য প্রশাসক পদে নিযুক্ত ছিলেন। চুঁচুড়াতেই থাকাকালীন ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে পিটার ব্রুইস মারা যান এবং মৃত্যুর পর তাঁকে চুঁচুড়ার কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়। এখনও চুঁচুড়ার ডাচ সেমিট্রিতে (যা এখন চুঁচুড়ার ফুলপুকুর রোডের নিকট) দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে তাঁর সমাধিসৌধটি দেখতে পাওয়া যায়।

এদিকে পিটার ব্রুইস মারা গেলে ১৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ শে মার্চ সুস্যানা দ্বিতীয় বিবাহ করেন থমাস ইয়েটসে নামক এক সুপ্রতিষ্ঠিত ইংরেজ ব্যবসায়ীকে। আর এই বিবাহের পরই তার নাম হয় সুসান্না আনা মারিয়া ইয়েটস। যদিও এই বিয়ে সুখকর হয়নি, হয়তো থমাস ইয়েটস বেশিদিন বাঁচেননি, কিন্তু কী ঘটেছিল তা জানা যায়নি।

চুঁচুড়ার ডাচ গোরস্থান - উঁচু ওবেলিস্ক আকৃতির সমাধিসৌধটি পিটার ব্রুইস-এর

সুসান্না তাঁর জীবনে দুই সমৃদ্ধিশালী ব্যক্তির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ায় উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি বিশাল সম্পত্তির অধিকারী হয়েছিলেন, যার মধ্যে একটি ছিল হুগলী নদীর তীরে ডাচ কারখানা সংলগ্ন, ও অন্যটি জি টি রোডের ধারে চুঁচুড়ার ডাচ কুঠি ও চন্দননগরে মাঝামাঝি অংশে তালডাঙা নামক জায়গায়। এই তালডাঙা অঞ্চলে প্রায় ৬০ বিঘা জমির উপর সুসান্নার একটি প্রকাণ্ড বাগানবাড়ি ছিল, যার নাম আয়েশবাগ তাঁর ইচ্ছা ছিল যে মৃত্যুর পর তাঁকে যেন এই আয়েশবাগেই সমাধিস্থ করা হয় এবং আয়েশবাগের এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল যেন ডাচ ও ইংরেজদের কবরস্থান হিসেবেই ব্যবহার করা হয়। শেষে ১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দের ১২ ই মে সুস্যানার মৃত্যু হলে তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁকে আয়েশবাগেরই উত্তর-পশ্চিম কোণে সমাধিস্থ করা হয়কিন্তু তাঁর দ্বিতীয় ইচ্ছা সম্পূর্ণ হয়নি। 

মৃত্যুর চার বছর আগে ১৮০৫ খ্রিষ্টাব্দে সুস্যানা তাঁর সমস্ত সম্পত্তি তাঁর ছেলে লুই অ্যাড্রিয়ানের নামে একটি উইল করে যান। এবং তার সঙ্গে সুস্যানা ৪০০০/- টাকা দিয়ে একটি ট্রাস্ট গঠন করেন, যার সুদের টাকা ব্যবহার হয় তাঁর নিজের এবং তাঁর দুই স্বামীর সমাধিক্ষেত্র রক্ষণাবেক্ষণে।  

এদিকে সুস্যানার মৃত্যুর পর ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ ও ডাচদের মধ্যে অ্যাংলো-ডাচ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে, ডাচরা ভারতের যাবতীয় সম্পত্তি ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিয়ে চলে যায়। আর এভাবেই চুঁচুড়ায় থাকা ডাচদের যাবতীয় সম্পত্তির মালিকানা ব্রিটিশদের হাতে চলে আসায় ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে আয়েশবাগের সমস্ত জমিজমা ব্রিটিশরা বিক্রি করে দেয়।   

সুসান্না আনা মারিয়ার সমাধি

১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দে সুসান্নার মৃত্যুর পর তাঁকে আয়েশবাগের জমিতেই সমাধিস্থ করা হয় এবং সমাধির পর তাঁর কবরের উপরই নির্মিত হয় এক সমাধিসৌধ। ধবধবে সাদা রঙের অষ্টভুজাকৃতি এই সৌধ ইন্দো-ডাচ স্থাপত্যের একটি আদর্শ নিদর্শন। দ্বিতল বিশিষ্ট এই সমাধিসৌধটির নিচের তলায় চারটি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ এবং অনুরূপভাবে উপরের তলাটিতেও। প্রতিটি প্রবেশপথের দুপাশে রয়েছে গ্রীক রীতিতে গড়ে ওঠা দুটি করে সরু থাম এবং এই থাম গুলি একইভাবে উপরের তলাটিতেও লক্ষ্য করা যায়একদম উপরে সমাধিস্তম্ভের ছাদ বেষ্টন করে রয়েছে একটি অপরূপ সুন্দর গম্বুজ (ডোম)তবে সমাধির কোন জায়গাতেই কোন সমাধিলিপি বা স্মারক নেই, শুধুমাত্র গম্বুজের বেষ্টনীতে রয়েছে সুসান্নার নাম "SUSANNA ANNA MARIA YEATS REBOORE VERKERK OBiIT 12 MAY ANNO 1809"

তবে এখানে বিশেষ উল্লেখযোগ্য, চুঁচুড়ার এই সমাধিসৌধটির সঙ্গে হুবহু মিল পাওয়া যায় মুর্শিদাবাদের কাশিমবাজারের একটি সমাধিসৌধের সাথেকাশিমবাজারের এই সমাধিসৌধটি টামেরাস ক্যান্টার ভিসকার নামক এক ডাচ নাগরিকের, যিনি ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান। অর্থাৎ সময়ের নিরিখে দেখতে গেলে চুঁচুড়ার এই সৌধটি কাশিমবাজারের সৌধটি তৈরি হওয়ার অনেক পরে গঠন হয়। তাহলে ধরে নেওয়াই যায় সুসান্নার এই সমাধিসৌধ কাশিমবাজারের সৌধটির অনুকরণে নির্মাণ হয়েছিল।

বামদিকে - চুঁচুড়ার সুস্যানা আন্না মারিয়ার-র স্মৃতিসৌধ এবং ডানদিকে মুর্শিদাবাদের কাশিমবাজারের গোরস্থানে টামেরাস ক্যান্টার ভিসকার স্মৃতিসৌধ (সৌজন্যে -  দীপাঞ্জন ঘোষ)

গল্পকথা ও বাস্তবতা

এতটা পর্যন্ত সবই ঠিকঠাক ছিল। চুঁচুড়ায় ডাচ আগমন, সুসান্না আনা মারিয়া, তাঁর মৃত্যু, সমাধিসৌধ গঠন সবই। কিন্তু প্রশ্ন উঠে আসে সুসান্না সমাধিসৌধটির নামটি নিয়ে। প্রায় ২০০ বছর পেড়িয়ে গেলেও স্থানীয়দের কাছে এই সৌধটি সাত বিবির কবর বা সাত সাহেবের বিবির কবর বা মেমসাহেবের কবর হিসেবেই পরিচিত। এবার প্রশ্ন হওয়া স্বাভাবিক, সুসান্নার জীবনে দুটি বিবাহ হলে এই সাতজন সাহেব এল কোথা থেকে? প্রথমেই বলি এই সাত সাহেবের বিবির নামকরণ কিন্তু কোন ঐতিহাসিক বইতে লেখা নেই, এই নাম শুধুমাত্র স্থানীয়দের মধ্যেই প্রচলিত, যা এখনও সময়ের সাথে সাথে চলে আসছে। কিন্তু এক্ষেত্রে এটিও দেখতে হবে কোন নামকরণ কখনোই হঠাৎ করে সৃষ্টি হয় না, প্রতিটি নামের এমনকি সে জনশ্রুতি গড়ে ওঠা নাম হলেও তার পেছনে কোন অর্থপূর্ণ কারণ থাকবেই। সুসান্না যে দুটির বেশি বিয়ে করেনি তা আগেই জেনেছি। ১৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ৫২ বছর বয়সে সুসান্না দ্বিতীয় বিবাহ করেন এবং ১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দে সুসান্না মারা যান। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিবাহ এবং মৃত্যুর মধ্যে সময়ের অন্তর ১৪ বছর, অন্যদিকে সুসান্না উইল করে যান ১৮০৫ খ্রিষ্টাব্দে। অর্থাৎ এই দশ বছর বা চোদ্দ বছরের মধ্যে সুসান্নার আরও পাঁচটি বিবাহ করা অনেকটাই যুক্তিহীন। তাহলে সাত বিবির নামকরণ কীভাবে?

এক্ষেত্রে একটি তথ্য দেওয়া যায় তবে তথ্যটি কতটা যুক্তিপূর্ণ তা বলা মুশকিল। পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি গ্রন্থের রচয়িতা বিনয় ঘোষ জানাচ্ছেন অতীতে এইসব অঞ্চলে রক্ষিণী নামক স্থানীয় বনদেবীর পুজো হতো। রক্ষিণী দেবী মূলত রোগজ্বালা উপশমকারী লৌকিক দেবী, রোগব্যাধি দূর করা বিপদ থেকে রক্ষা করা মঙ্গল কামনা এইসব। তবে এই রক্ষিণী দেবীর এক এক জায়গায় এক এক নাম। এই পুজোয় যে নরবলি হতো তা ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দের সমাচার দর্পণ পত্রিকা থেকেও জানা যায়। চমকিনী, সমকিনী, রণকিনী ইত্যাদি হল বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন বনদেবী। অন্যদিকে অঞ্চল হিসাবে চণ্ডী, বিলাসিনী, বাশুলি, জামমালা ইত্যাদি সেই একই বনদেবীর বিভিন্ন রূপ আবার এই সমস্থ বনদেবীদের একসঙ্গে সাতবোন রূপে কল্পনা করে সাতবউনি নামেও বনদেবীর পুজো হত। এই বনদেবীরাই মুসলমান প্রভাবে বনবিবি নামে পরিচয় পায় এবং এভাবেই বনদেবীর সাতবোন সাতবিবি বলে পুজো হতে শুরু করে আর এই থেকেই দক্ষিণ ২৪ পরগণা ও সুন্দরবন এলাকায় গড়ে উঠতে থাকে সাত বিবির থান বা সাত বোনের থান আগেই বলেছি এই সাত বিবি মূলত রোগজ্বালা উপশমকারী গ্রামীণ লৌকিক দেবী। এদের মধ্যে প্রধান হলেন ওলাবিবি (হিন্দু ওলাইচন্ডী) যিনি কলেরা উপসমকারী দেবী। আর বাকি দেবীদের মধ্যে আসানবিবি (বিপত্তারিনী), জোলা বিবি বা ঝোলাইবিবি (হাম বা বসন্ত রোগের দেবী), ঝেঁটুনিবিবি (ভুতে ধরা), মড়িবিবি (জ্বর বিকার), আজগৈবিবি, চাঁদবিবি বিনয় ঘোষ জানাচ্ছেন দক্ষিণ চব্বিশপরগণা ছাড়াও বর্ধমানের অনেক গ্রামেই এই সাতবিবির পুজো হত।

বনবিবি (সৌজন্যে Wikipedia)

এবার আমাদের বর্ধমান থেকে চুঁচুড়া প্রায় ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিতএককালে চুঁচুড়ার এই অঞ্চলে যে মুসলমানদের বসবাস ছিল তা আয়েশবাগের কাছাকাছি কিছু জায়গা যেমন কাজী পাড়া, খাদিনা মোড় এছাড়াও কিছু প্রাচীন মসজিদ থেকে অনুমান করা যায়। হতে পারে সেই সমস্থ বনদেবী এখানেও পূজিত হতআর মুসলমান প্রভাবে সেই বনদেবী সাতবিবি রূপে পরিচয় পায় আর হয়তো বর্তমানের এই সুসান্নার কবর অর্থাৎ সাতবিবির কবর অতীতের কোন সাতবিবি বনদেবীর স্মৃতি বহন করে চলেছে।

তবে এই তথ্যই যে একমাত্র সঠিক তা কিন্তু নয়, শুধুমাত্র এই সাতবিবি শব্দটির সঙ্গে একটি যোগসূত্র থাকতে পারে এটাই অনুমান। হতে পারে সেই সাতবিবির সঙ্গেই চুঁচুড়ার সুসান্না আনা মারিয়া, রাস্কিন বন্ডের সেই সাত স্বামী খুন করা সুসান্না সবই এর ওর ঘাড়ে চেপে অতিকথনে পরিণত হয়েছে। তবে বলে রাখি এসবই অনুমান......

******************************************************

লেখা, গবেষণা ও ছবি - প্রীতম নস্কর  

ই-মেল - pritamnaskar.pn@gmail.com

ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে ব্লগের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, তবে পূর্বানুমতি ছাড়া আমার তোলা আলোকচিত্রগুলি এবং ব্লগের রচনাগুলি অন্য কোথাও কপি-পেস্ট বা বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করা চলবে না।

******************************************************

গুগল ম্যাপ / কোঅরডিনেট 

22°53'00.6"N 88°22'48.0"E

প্রবেশমূল্য ও সময়সূচী

সমাধিসৌধে প্রবেশের জন্য কোনরকম প্রবেশমূল্য নেই। রাস্তার ধারেই এই সৌধটি থাকায় দিনের প্রায় সবসময়ই সর্বসাধারণের জন্য খোলা।

কীভাবে যাবেন

  • ট্রেনপথে হাওড়া থেকে মেনলাইনগামী বর্ধমান, ব্যান্ডেল বা কাটোয়ার যে কোন ট্রেন ধরে চলে আসতে হবে চুঁচুড়া স্টেশনস্টেশন থেকেই টোটো বা অটো ধরে পৌঁছে যেতে হবে খাদিনার মোড়। আর সেখান থেকে মাত্র ৫ মিনিটের হাঁটা রাস্তায় পৌঁছে যাওয়া যাবে সুসান্নার সমাধিসৌধে। স্টেশন থেকেও সরাসরি টোটো বা অটো পাওয়া যাবে কিন্তু সেক্ষেত্রে জায়গাটির পরিচয় দিতে হবে 'স্টেডিয়াম' নামে, যেহেতু স্থানীয়দের কাছে জায়গাটি সেই নামেই পরিচিত।

  • সড়কপথে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড (জি টি রোড) ধরে পৌঁছে যেতে হবে চন্দননগর। সেখান থেকে  তালডাঙা পার করে চুঁচুড়া প্রবেশের মুখে খাদিনা মোড়ের আগেই রাস্তার ডানদিকে দেখতে পাওয়া যাবে এই সৌধ।

তথ্যসূত্র

  • Susanna’s Seven Husbands’ by Ruskin Bond
  • The Dutch in India & Chinsurah by Dr Oeendrila Lahiri 
  • Family Tree of Susanna Anna Maria Verkerk in Geni.com
  • Bengal District Gazetteers Hooghly - O’Malley, L.S.S.
  • Website of Dutch Cemetery of Bengal
  • Soham Chandra Blog - Wanderlust Blogspot
  • Hooghly Heritage
  • পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি বিনয় ঘোষ

Comments