ওলন্দাজ নগরী চিনসুরা...... চুঁচুড়া, হুগলী ।। The Dutch Colony in Chinsurah, Hooghly

চিনসুরা (বা স্থানীয় ভাষায় চুঁচুড়া), হুগলী নদীর তীরে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের একটি ছোট্ট শহর, যা এককালে "ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি"র বাণিজ্য নগরী হিসাবে পরিচিত ছিল। ব্যান্ডেলে যেমন পর্তুগীজ, চন্দননগরে ফরাসী, শ্রীরামপুরে ড্যানিস ও কলকাতায় যেমন ব্রিটিশদের বসতি গড়ে উঠেছিল, ঠিক তেমনি চুঁচুড়ার এই অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল "ওলন্দাজ" অর্থাৎ "ডাচ" দের বসতি। পর্তুগীজদের পরে মোটামুটি সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিক করে এ দেশে ওলন্দাজদের আনাগোনা শুরু হয়। প্রথমে বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে চুঁচুড়ায় "ফোর্ট গুস্তাভাস" নামে এক কুঠি নির্মাণ এবং ধীরে ধীরে শহরের প্রান্তে গির্জা ও অন্যান্য ভবন। পর্তুগিজদের মতো ওলন্দাজরাও প্রায় ২০০ বছর ধরে চুঁচুড়ায় বসবাস করেছিল। চুঁচুড়ার বিকাশ একপ্রকার শুরু হয় এই ওলন্দাজদের হাত ধরেই। আঠারো শতকের গোড়ার দিকে বাংলায় ডাচ বাণিজ্য এতটাই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে যে চুঁচুড়া-হুগলীকে ডাচ প্রজাতন্ত্রের সাথে সরাসরি বাণিজ্য করার অনুমতি দেওয়া হয়। ওলন্দাজরা চলে যাওয়ার পর চুঁচুড়া চলে আসে ব্রিটিশদের হাতে। তারপর ধীরে ধীরে শহরের সংস্কার-পরিবর্তনের ফলে আজকের এই চুঁচুড়া। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চুঁচুড়ার এই পরিবর্তন মানুষ ভুলে গেলেও ইতিহাসের দরবারে চুঁচুড়া এখনও ডাচ নগরী। প্রায় ৪০০ বছর হতে যায় ডাচরা চুঁচুড়া ছেড়ে চলে গেছে, কিন্তু চুঁচুড়ার ওলিতেগলিতে এখনও ডাচদের ফেলে আসা স্থাপত্যের নমুনা মেলে। আর ডাচদের এই স্থাপত্য শিল্পকলা এখনও চুঁচুড়ার ইতিহাসকে স্মরণ করায়।

ওলন্দাজ নগরী চিনসুরা...... চুঁচুড়া, হুগলী ।। The Dutch Colony in Chinsurah, Hooghly
A View of Chinsura the Dutch settlement in Bengal - William Hodges' 'Select Views in India' 1781/82 (courtesy British Library)

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

ইউরোপীয় শক্তিগুলির মধ্যে ভারতে সর্বপ্রথম বাণিজ্যের জন্য আসে পর্তুগিজ। পর্তুগিজদের আসার আগে ইউরোপীয় দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য মূলত সড়কপথ ও নদীপথই ব্যবহার হত, এক্ষেত্রে সিল্ক রুট ছিল অন্যতম সড়কপথ। কিন্তু ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ভাস্কো-ডা-গামা সমুদ্রপথে ভারতের মালাবার উপকূলের কালিকট বন্দরে আসলে ইউরোপীয় দেশগুলির কাছে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রপথে বাণিজ্যের দ্বার খুলে যায়। আর এভাবেই সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে পর্তুগিজদের অনুসরণ করে ডাচরা ভারতে বাণিজ্যের জন্য আসতে শুরু করে। এখানে বলে রাখা ভালো সপ্তদশ শতাব্দীর এই সময়ে বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে ইউরোপীয় দেশগুলি একপ্রকার উঠেপড়ে লেগেছিল। বিশ্বের বাজারে তাদের একচেটিয়া আধিপত্য বজায় রাখার জন্য তারা নিজেদের মধ্যে কোম্পানি গঠন করতে শুরু করে। আর ঠিক এই কারণেই ১৬০২ খ্রিষ্টাব্দে নেদারল্যান্ডসে গঠন হয় ডাচ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ভেরিনিগ্ড ওস্টইন্ডিশ কম্পাগনি (The Vereenigde Oostindische Compagnie) অর্থাৎ ইউনাইটেড ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (United Dutch East India Company)

এদিকে ভারতে ডাচদের মধ্যে ১৬০৪ খ্রিষ্টাব্দে অ্যাডমিরাল স্টিভেন ভ্যান ডের হেগেন সর্বপ্রথম এসে পৌছান মালাবারে। তারপর সেখানকার স্থানীয় রাজার সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্যচুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ভারত ও ডাচদের (অর্থাৎ নেদারল্যান্ডসের) মধ্যে ব্যবসার সূত্রপাত। ভারতের প্রায় অনেক জায়গাতেই ডাচরা তাদের উপনিবেশ স্থাপন করে। শুরুর দিকে ডাচরা ভারতের উপকূলীয় স্থানগুলিতে ঘাঁটি স্থাপন করলেও পরবর্তীকালে তারা নদীপথে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে থাকে। পুলিকট, মাসুলিপট্টনম, নাগপাটম, সুরাট, আহমেদাবাদ, পাটনা, হায়দ্রাবাদ এবং চিনসুরাহ (চুঁচুড়া) গড়ে ওঠে ডাচ উপনিবেশ।

Trade lodge of the VOC in Chuchura, Bengal, by Hendrik van Schuylenbergh (ca. 1620–1689) (courtesy Wikipedia)

চুঁচুড়ায় ডাচ

বাংলায় ডাচরা ঘাঁটি স্থাপন করে হুগলী নদীর নিকট চিনসুরা বা চুঁচুড়া নামক এক শহরে। তবে চুঁচুড়ায় আসারও আগে ডাচরা বাংলায় এসেছিল। ১৬২২ খ্রিষ্টাব্দে ডাচ কমান্ডার জন কর্নেলিজ কুস্টকে বাংলা থেকে নুন, চিনি ও কাপড় ক্রয়ের জন্য তিনটি ডাচ জাহাজ (স্কিডিম, মুইস এবং জাগার) পাঠান। তবে সেক্ষেত্রে জাহাজগুলি মুর্শিদাবাদের কাশিমবাজারে এসে উপস্থিত হয় এবং পরবর্তীকালে এই কাশিমবাজারেই ডাচরা স্থাপন করেন কুঠি, যেখানে তৈরি হত বাংলার সিল্ক যা এশিয়ার বাজারে কাশিমবাজার সিল্ক হিসাবে খ্যাতি লাভ করে। প্রথমদিকে বাংলার বাণিজ্যে ডাচরা সেরকমভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারছিলনা, এক্ষেত্রে প্রধান কারণ পর্তুগিজদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা। ডাচদের বাংলায় প্রবেশের অনেক আগে থেকেই পর্তুগিজরা ব্যান্ডেলে তাঁদের ঘাঁটি গেড়েছিল। ফলে হুগলী-চুঁচুড়া তখন পর্তুগিজদের দখলে, আর চুঁচুড়া তখন পর্তুগিজদের কাছে পরিচিত ছিল Tjutjura নামে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মোঘল সম্রাটদের থেকে সাহায্য পাওয়ায় বাংলায় তাঁরা একচেটিয়া আধিপত্য বজায় রাখতে পেরেছিল। কিন্তু মোঘল সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে পর্তুগিজরা সম্রাটের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়ায়, শাহজাহান ১৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজদের বাংলা থেকে বহিষ্কার করে। আর পর্তুগিজদের এই চলে যাওয়া হুগলীতে বাণিজ্যবিস্তারের জন্য ডাচদের কাছে মোক্ষম সুযোগ হয়ে ওঠে। শেষে ১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট শাহজাহানের থেকে পাওয়া ফর্মানের দৌলতে ডাচরা ভারতের হুগলী, বালাসোর, পিপলি এর যেকোনো স্থানে বাণিজ্যের অনুমতি পেলে ডাচরা বাংলায় ঘাঁটি স্থাপন করে হুগলীর নিকট চিনসুরা নামক গ্রামে, যা বর্তমানে চুঁচুড়া।

'The Church & Residence of a Rich Baboo. Chinsurah' - by Marianne Jane 1828 (ছবির ডানদিকে চুঁচুড়ার ডাচ গির্জা ও তার পাশে অবস্থিত ভবন যা এখন হুগলী মহসিন কলেজ)

১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে ফর্মান পেলেও বাংলায় ডাচরা তাদের দপ্তর প্রতিষ্ঠা করে ১৬৫৫ খ্রিষ্টাব্দে। প্রথমে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (ভেরিনিগ্ড ওস্টইন্ডিশ কম্পাগনি বা ভি..সি.)-র বাংলার প্রথম অধিকারিক পিটার স্টেরহেমিনাস (Pieter Sterthemius) মুর্শিদাবাদের কাশিমবাজারকে তাদের সদর দপ্তর হিসাবে নির্বাচিত করেন। কিন্তু বন্যার প্রকোপে সেই সদর দপ্তর স্থানান্তরিত করতে হয় হুগলীর চুঁচুড়ায়।  প্রায় দুশো বছর ধরে ডাচেরা (মূলত ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনি) এই চুঁচুড়া থেকেই সমগ্র এশিয়ায় তাদের বাণিজ্য বিস্তার করত। চুঁচুড়া ছাড়াও ডাচরা কাশিমবাজারে সিল্ক কারখানা, উত্তর কলকাতার বরানগরে গুদামঘর ও ফলতায় নৌঘাঁটি স্থাপন করেছিল। নদীর তীরে অবস্তিত হওয়ায় বাংলার মসলিন (কাপড়), মশলা, নুন, আদা, নীল এমনকি আফিম পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের রাজধানী বাটাভিয়ায় প্রেরণ করত (বাটাভিয়া যা এখন জাকার্তা হিসাবে পরিচিত ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী)। আর এই বাণিজ্যের সুবাদে চুঁচুড়া ছিল তাদের অন্যতম বাসস্থান। ডাচরা চুঁচুড়ায় আসার পর বাণিজ্যের সুবিধার জন্য ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হুগলী নদীর পাড়েই এক কুঠি নির্মাণ করে।  

পরবর্তীকালে ভি..সি. র তৎকালীন আধিকারিক অ্যালবার্ট সিচারম্যান (Jan Albert Sichterman) কুঠিটিকে বাইরের শত্রুদের থেকে রক্ষার জন্য কুঠির চারপাশে বিশাল পাথরের তৈরি প্রাচীর নির্মাণ করে একটি সম্পূর্ণ দুর্গে পরিবর্তন করেন, আর এই দুর্গই হল ডাচদের তৈরি সেই বিখ্যাত দুর্গ ফোর্ট গুস্তাভাস (Fort Gustavus)। গুস্তাভাস নাম দেওয়া হয় সেই সময়কার বাটাভিয়ার গভর্নর জেনারেল গুস্তাফ উইলেম ভ্যান ইমহফ (Gustaaf Willem van Imhoff) এর নামে। মোটামুটি ১৬৫৫ থেকে ১৬৬৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এই দুর্গ নির্মাণ হয়। কেমন ছিল সেই দুর্গ তার আভাস পাওয়া যায় ১৬৬৫ খ্রিষ্টাব্দে হেনড্রিক ভ্যান শ্যুয়েলেনবার্গ (Hendrik van Schuylenbergh) এর আঁকা তৈলচিত্রে এবং গৌটিয়ের শৌতেন (Gautier Schouten) নামক এক ডাচম্যানের লেখনিতে There is nothing in it (Hooghly) more magnificent than the Dutch factory. It was built on a great space at the distance of a musket shot from the Ganges, for fear that, if it were nearer, some inundation of the waters of the river might endanger it, or cause it to fall. It has indeed more the appearance of a large castle than of a factory of merchants. The walls are also covered with stone. They are furnished with canon, and the factory is surrounded by ditches full of water. It is large and spacious. There are many rooms to accommodate the Director, the other officers who compose the Council, and all the people of the Company. There are large shops built of stone, where goods that are bought in the country, and those that our vessels bring there, are placed.  

The View of the Company's FORT GUSTAVUS at Chinsurah in Bengal in 1770 (courtesy Johannes Rach, Rijksmuseum, Amsterdam)

ফোর্ট গুস্তাভাস দুর্গটি গঠনে আয়তাকার। দুর্গের দীর্ঘতম দিকটি প্রায় ৬৫০ ফুট লম্বা ও প্রস্থে ৩২০ ফুট। দুর্গে প্রবেশের জন্য ছিল তিনটি প্রবেশদ্বার - একটি উত্তরদিকে, একটি দক্ষিণদিকে ও একটি নদীর দিকে। দুর্গের কর্নার গুলিতে অর্থাৎ চারকোণে যুক্ত করা হয়েছিল চারটি বুরূজ (দুর্গের মিনার), যেগুলির নাম রাখা হয়েছিল অ্যামস্টারডাম, মিডলবার্গট, নুরডার্কওয়ারটিয়ার ও দে মাস। দুর্গের অভ্যন্তরে ছিল বিভিন্ন ঘর, যেমন - কোষাগার, পরিচালকের ঘর, কোর্ট, সচিবালয়, কারখানা, জাহাজ তৈরির কারখানা, গুদামঘর, ঔষধঘর। ফোর্ট গুস্তাভাস দুর্গের পরিস্থিতি ও ডাচ সেনাবাহিনী কিরকম ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় একটি ঘটনায় - সময় ১৬৯৫ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিক, মেদিনীপুরের চেতোয়া-বর্দার জমিদার শোভা সিংহ বর্ধমান আক্রমণ করেন এবং বর্ধমানের রাজা কৃষ্ণরাম রায়কে হত্যা করে বর্ধমানের ভূসম্পদ দখল করে নেন। এরপর ১৬৯৬ খ্রিষ্টাব্দে শোভা সিংহ মোগলদের বাংলা থেকে উচ্ছেদ করার উদেশ্যে তার সমস্ত সৈন্য হুগলীর দিকে পাঠাতে থাকেন। কারণ, হুগলী তখন মোগলদের দেওয়া ফরমানের দৌলতে বিদেশী শক্তিদের বাণিজ্যিক ঘাঁটি। এদিকে শোভা সিংহের সৈন্য হুগলীতে এসে পড়লে রাজ্যে হুলুস্থুল বেঁধে যায়। বাংলার সুবেদার ইব্রাহীম খান ও ফৌজদার নুরুল্লা খান ডাচদের শরণাপন্ন হলে ডাচরা তাদের দুর্গ খুলে দেয় এবং তাদের দুর্গে আশ্রয়ের জায়গা করে দেয়। ডাচরা শুধুমাত্র শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়নি বরং শহরবাসীদের অনুরোধে ভি.ও.সি তার সৈন্যবাহিনী পাঠিয়েছিল শোভা সিংহ-কে বিতাড়িত করতে। আর এই প্রথম ডাচরা বাংলার আঞ্চলিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে।

Engraving of the plan of the Dutch factory at Hooghly-Chinsura by an unknown artist and engraver c.1721

ডাচরা মূলত বাংলায় এসেছিল বাণিজ্যের খাতিরে, ব্যবসা-বাণিজ্য করাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য, ব্রিটিশদের মতো কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য তাদের ছিল না। তাই শুরু থেকেই ডাচেরা শান্তিপূর্ণ ভাবেই বাংলায় বসবাস করত। কুঠি নির্মাণ, চার্চ, শহরের বিভিন্ন জায়গায় তাদের আবাস্থল, খাল এমনকি অত্যাধুনিক নিকাশি ব্যবস্থা পর্যন্ত তারা এই শহরকে উপহার দিয়েছিল। ফলে প্রথম থেকেই বাংলার নবাবদের সাথে ডাচদের মধ্যে একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ব্যবসা বাণিজ্য ছাড়াও নবাবের শাসনব্যবস্থার খাতিরে ডাচেরা অনেক সময়ই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত। পরবর্তীকালে ব্রিটিশরা যখন বাংলায় এল তখনও তাদের মধ্যে সেই বন্ধুত্ব বজায় ছিল। কিন্তু ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের পলাশীর যুদ্ধের পর পুরো ঘটনাটাই বদলে যায়। পলাশীর যুদ্ধে সিরাদৌল্লার পরাজয়ের পর বাংলার শাসনব্যবস্থায় নবাব থাকলেও আসল ক্ষমতা চলে আসে ব্রিটিশদের হাতে। এদিকে যুদ্ধে ডাচরা ব্রিটিশদের সমর্থন না করায় তাদের মধ্যে সম্পর্কের ফাটল সৃষ্টি হয়। সিরাজদৌলার হত্যার পর বাংলার সিংহাসনে যখন মিরজাফর তখন তিনিই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ডাচদের পরিচালিত করার জন্য ডাচদেরকে চুঁচুড়ায় নৌসেনা আনার অনুরোধ জানায়। শেষে ১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে যখন বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে সাতটি ডাচ জাহাজ হুগলীতে প্রবেশ করে তখন সেই খবর মীরজাফর ব্রিটিশদের জানিয়ে দেয়। আর এই খবর জানার পর ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে লর্ড ক্লাইভ জাহাজগুলি পরিদর্শনের জন্য পাঠান কর্নেল ফ্রান্সিস ফোর্ড (Colonel Forde) কে। প্রথমে বরানগরের কুঠিতে জাহাজগুলি ঘাঁটি গাড়তে পারে ভেবে ব্রিটিশরা প্রথমে সেই জায়গা নিয়ন্ত্রণে আনে এবং পরে তারা চন্দননগরে অগ্রসর হয়। শেষে কয়েকটি ডাচ জাহাজ চুঁচুড়ায় পৌঁছালে, এর মধ্যে প্রথমে একবার চন্দননগরে নৌযুদ্ধ এবং পরেরদিনই অর্থাৎ ১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ শে নভেম্বর চন্দননগর ও চুঁচুড়ার মধ্যবর্তীস্থানে ডাচ ও ব্রিটিশদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। ব্যাটেল অফ চিনসুরা বা বিদেরার যুদ্ধ হিসাবে পরিচিত এই যুদ্ধে ডাচদের পরাজয় হয়।

'South view of Chinsura' by James Moffat

এদিকে যুদ্ধজয়ের পর চুঁচুড়ার পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে আসে ব্রিটিশদের কাছে, ফলে এখন ডাচদের বাণিজ্য চলতে থাকে ব্রিটিশদের ছত্রছায়ায়। কিন্তু পরবর্তীকালে ডাচ প্রজান্তন্ত্রের সঙ্গে গ্রেট বিটেনের চতুর্থ অ্যাংলো-ডাচ যুদ্ধ শুরু হলে তার প্রভাব এসে পড়ে চুঁচুড়াতেও। ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশরা চুঁচুড়ার এমনকি বাংলার সমস্ত ডাচ সম্পত্তি সাময়িকভাবে বাজেয়াপ্ত করে। এবং সর্বশেষে ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে "অ্যাংলো-ডাচ চুক্তি" (ইঙ্গো-ওলন্দাজ চুক্তি) র মাধ্যমে ডাচরা তাদের ভারতীয় উপমহাদেশের সমস্ত সম্পত্তি ব্রিটিশদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। আর ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দের ৭ ই মে চুঁচুড়া ব্রিটিশদের সম্পত্তি হিসাবে ঘোষিত হয় এবং এর ঠিক পাঁচ বছর পর অর্থাৎ ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশরা চুঁচুড়ার ফোর্ট গুস্তাভাস দুর্গ ও ডাচ সরকারি ভবনগুলিকে ভেঙে ফেলে

বাংলা থেকে ডাচরা পাকাপাকিভাবে ভাবে চলে গেলেও ডাচদের স্থাপত্য-সম্পত্তির নিদর্শন এখনও চুঁচুড়ার কিছু কিছু জায়গায় দেখতে পাওয়া যায়, যাদের মধ্যে

ডাচ গোরস্থান

ডাচ কবরখানা / ওলন্দাজ গোরস্থান

ফুলপুকুর রোড ও জ্যোতিষ চন্দ্র ঘোষ সরণীর সংযোগস্থলের পাশেই অবস্থিত এই ডাচ কবরখানা। তবে ফুলপুকুর রোডের এই ডাচ কবরখানা তৈরির আগেও ডাচদের আরও একটি পুরনো কবরখানা ছিল। আর এই কবরখানাটি গড়ে উঠেছিল ফোর্ট গুস্তাভাস এর পশ্চিমদিকে। পরবর্তীকালে লুই টেইলফের্ট (ভি..সি. র আর এক আধিকারিক) পুরনো কবরখানাটিকে স্থানান্তর করে নিয়ে আসেন বর্তমান স্থানে। প্রায় ২৭০ বছরের পুরনো এই নতুন কবরখানাটির পরিধি প্রায় ৭৪০০ বর্গমিটার। কবরখানাটিতে মোট ৪৫ টি ডাচ নাগরিকের কবর রয়েছে। গোরস্থানে মোটামুটি তিন ধরনের সমাধি দেখা যায় - ওবেলিস্ক, পিরামিড বক্স ও সাধারণ আকৃতির। রেকর্ড অনুযায়ী এই কবরখানাটির মধ্যে প্রাচীনতম কবরটি হল কর্নেলিস ডি জঙ্গ (জং) (Cornelis de Jonge (Jong)) এর যিনি ১৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দে ১০ ই অক্টোবর মারা যান এবং সর্বশেষ কবরটি হল এমা ড্রপার (Emma Draper) নামে এক ডাচ মহিলার যিনি ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ২২ শে নভেম্বর মারা যান। 

ডাচ গোরস্থান (চিত্র ২)

ডাচ গোরস্থান (চিত্র ৩)

সুস্যানা অ্যানা মারিয়া-র সমাধি, চুঁচুড়া

সুস্যানা অ্যানা মারিয়া-র সমাধি

চুঁচুড়ার এই ডাচদের কবরগুলির মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত সমাধি হল সুসান্না আন্না মারিয়ার সমাধি, যা ডাচ গোরস্থান থেকে আড়াই কিলোমিটার মিটার দূরে অবস্থিত। চন্দননগর থেকে চুঁচুড়া প্রবেশের মুখেই রাস্তার ডানদিকে দেখতে পাওয়া যাবে ইন্দো-ডাচ স্থাপত্যরীতিতে গড়ে ওঠা দোতলা একটি সৌধ। বাইরে থেকে দেখলে একটি মন্দিরের আদলে দেখতে হলেও আসলে এটি একটি ডাচ সমাধিসৌধ, যেখানে সমাধিস্থ রয়েছে সুস্যানা অ্যানা মারিয়া ভারকার নামে এক ডাচ মহিলা। তবে এই সমাধি অঞ্চলটি স্থানীয়দের কাছে সাত সাহেবের বিবির কবর বা মেমসাহেবের কবর হিসাবেই পরিচিত, যেটি আশ্চর্যজনকভাবে হোক বা ইচ্ছাকৃত ভাবে বিখ্যাত সাহিত্যিক রাস্কিন বন্ডের সুসান্নাস সেভেন হাসবেন্ড  গল্প ও বলিউডের ৭ খুন মাফ চলচিত্রের সঙ্গে মিলে যায়।

চুঁচুড়ার এই সুস্যানা অ্যানা মারিয়ার সমাধির উপর ভিত্তি করে আমার আরও একটি ব্লগ রয়েছে, এই সমাধির বিষয়ে বিস্তারিত জানতে হলে ক্লিক করুন এই লেখাটিতে - সাত সাহেবের বিবির কবর

A hand-coloured print of the Old DUTCH CHURCH, Chinsura, from the Fiebig Collection 1851 (courtesy British Library)

বর্তমান ডাচ গির্জার স্থানে গড়ে ওঠা চুঁচুড়ার সার্কিট হাউস

চুঁচুড়ার ডাচ গির্জা

চন্দননগরে যেমন ফরাসীদের তৈরি চার্চ, ব্যন্ডেলে যেমন পর্তুগিজদের চার্চ গড়ে উঠেছিল ঠিক তেমনি চুঁচুড়াতেও ডাচরা তৈরি করেছিল তাদের চার্চ (গির্জা)। হুগলী নদীর তীরেই ছিল ডাচদের এই চার্চ, ছিল বলছি কারণ বর্তমানে তা আর নেই। মোটামুটি চুঁচুড়াতে বসতি স্থাপনের সময়েই ডাচরা এই চার্চ তৈরি করে। পরবর্তীকালে ১৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দে এই চার্চের মিনার (মূলত ঘন্টাঘড়ি) নির্মাণ করেন ভি..সি. র অন্যতম আধিকারিক স্যার আলবার্ট সিচারম্যান (Jan Albert Sichterman)। আর ১৭৬৮ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরে চার্চটির বাইরের কাঠামো পুনর্নির্মাণ করেন স্যার জর্জ লুই ভার্নেট (George Lodewijk Vernet)। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ঘূর্ণিঝড়ে চার্চের মিনার অর্থাৎ ঘন্টাঘড়ি ভেঙে পড়ে। তবে ১৮৫১ সালের ফ্রেড্রিক ফিবিগের Views of Calcutta and Surrounding Districts অ্যালবামে সেই চার্চটির একটি সম্পূর্ণ ছবি দেখতে পাওয়া যায়। গঠনে অষ্টকোণাকৃতি এই চার্চ উত্তর দিকে খানিকটা বিস্তৃত ছিল। মূলত চুঁচুড়ার ঘণ্টা ঘাটের সামনেই ছিল এই চার্চ। ঘন্টা ঘাট, নদীর তীরবর্তী এই চার্চের ঘন্টাঘড়ি থেকেই এই নামকরণ। আর ডাচদের সময় এই ঘন্টাঘাট-ই ছিল অঞ্চলের প্রধান ঘাট। তবে এখন সেই চার্চের অবস্থান খুঁজতে গেলে পাওয়া যাবে না। কারণ, বর্তমানে চার্চের সেই জায়গাতেই গড়ে উঠেছে চুঁচুড়ার সার্কিট হাউস। তবে চুঁচুড়ার এই ডাচ চার্চ পরবর্তীকালে ইংরেজদের প্রটেস্ট্যান্ট চার্চ হিসাবে ব্যবহৃত হত। আর ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে গির্জাটি সম্পূর্ণরূপে ভেঙে ফেলা হয়।

A Hand-coloured print of Hooghly College, from the Fiebig Collection 1851 (courtesy British Library) - বর্তমানে হুগলী মহসিন কলেজ

A Hand-coloured print of HOOGHLY COLLEGE and GHAT, from the Fiebig Collection 1851 (courtesy British Library) - বর্তমানে হুগলী মহসিন কলেজ

বর্তমান হুগলী মহসিন কলেজের প্রবেশদ্বার

হুগলী মহসিন কলেজ ও হুগলী কলেজিয়েট স্কুল

চুঁচুড়া এমনকি হুগলীর অন্যতম প্রসিদ্ধ একটি কলেজ হল হুগলী মহসিন কলেজ, যা দানবীর হাজী মহম্মদ মহসিনের নামে তাঁরই অর্থানুকূল্যে পরিচালিত হয়েছিল। তবে এই মহসিন কলেজ যে বাড়িটিতে গড়ে উঠেছে তা কিন্তু চুঁচুড়ার ডাচ স্থাপত্যের আর এক নিদর্শন। তবে শুধুমাত্র ডাচ নয়, বাড়িটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে চন্দননগরের ফরাসীরাও। চুঁচুড়ার ভি..সি. র অন্যতম আধিকারিক জ্যান আলবার্ট সিচারম্যান (Jan Albert Sichterman) হুগলী নদীর তীরে তৈরি করেন এক বাগানবাড়ি, নাম দেন ওয়েলগিলিগেন অর্থাৎ ভালোভাবে অবস্থিত। অন্যদিকে মিস্টার সিচারম্যানের তৈরি হওয়া এই বাগানবাড়িটি ১৮০৩-১৮০৫ খ্রিষ্টাব্দে পুনর্নির্মাণ করে সেটিকে একটি প্যালেডিয়ান ম্যানশনে পরিণত করেন ফরাসী জেনারেল এম. পেরোন। মিস্টার পেরোন সিন্ধিয়া সেনাবাহিনীর একজন ফরাসী জেনারেল যিনি ১৮০৩ খ্রিষ্টাব্দে অ্যাংলো-মারাঠা যুদ্ধে লর্ড লেকের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন এবং ফ্রান্সে ফিরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি চুঁচুড়ার এই বাড়িটিতেই বসবাস করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই বাড়িটি কিনে নেন প্রখ্যাত বাঙালি ব্যবসায়ী প্রাণকৃষ্ণ হালদার। কিন্তু প্রাণকৃষ্ণবাবু খুব বেশীদিন তাঁর দখলে বাড়িটি রাখতে পারেননি। আমোদপ্রিয় প্রাণকৃষ্ণবাবু সাধের বাড়িটি চুঁচুড়ার শীল পরিবারের জগমোহন শীলের কাছে বন্ধক রেখে টাকা ধার দেন। তবে সেই ধার কখনোই প্রাণকৃষ্ণবাবু শোধ করতে পারেননি। অন্য আরও দেনায় জর্জরিত থাকায় প্রাণকৃষ্ণবাবুর সমস্ত সম্পত্তি নিলামে ওঠে। শেষে ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দে অনেক কোর্টকাছারির পর তাঁর এই বাড়িটিও ঋণ পরিশোধের জন্য কোর্টের দ্বারস্থ হয়। এবং বাড়িটি শীল পরিবারের কাছে বন্ধক থাকায় তাঁরা ২০,০০০/- টাকায় সরকারকে বিক্রি করে দেয়। শেষে ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দে চুঁচুড়ার এই বাড়িটি হুগলী মহসিন কলেজ হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং বর্তমান সময় পর্যন্ত এখনও এটি কলেজ হিসাবেই পরিচালিত হচ্ছে (যদিও প্রথম দিকে কলেজের নাম ছিল নিউ হুগলী কলেজ)। নদীর দিকে মুখ করে থাকা বাড়িটির মাঝখানে অর্ধ-বৃত্তাকার বারান্দা। বাড়িটিতে রয়েছে একটি বিশাল ঘর যা একসময়ে ছিল বলরুম। আইকনিক অর্ডারে সাজানো ঘরের কলামগুলি এক ডাচ শিল্পের অন্যতম উদাহরণ।

হুগলী কলেজিয়েট স্কুল
হুগলী কলেজিয়েট স্কুলের ভিতরে কারুকার্য সম্বলিত আর্চ

প্রাণকৃষ্ণ বাবু মহসিন কলেজের ঠিক পাশেই আরও একটি বাড়ি কিনেছিলেন যেটি একসময় ডাচ আধিকারিকদের বাগানবাড়ির অংশ ছিল। বাড়িটি কেনার পর প্রাণকৃষ্ণ বাবু সেই বাড়িটিতেই এক ঠাকুরদালান গড়ে তোলেন যেখানে তিনি দুর্গা পুজো শুরু করেন। আর এই বাড়িটিই এখন চুঁচুড়ার হুগলী কলেজিয়েট স্কুল হিসাবে পরিচিত। বর্তমানে স্কুল হিসাবে পরিচালিত হওয়ায় বাড়িটি অনেকবারই সংস্কার করা হয়েছে। ফলে প্রাণকৃষ্ণবাবু যে ঠাকুরদালান তৈরি করেছিলেন তা সম্প্রতি ভেঙে ফেলা হয়েছে এবং সেই জায়গায় গড়ে উঠেছে ছাত্রদের সাইকেল রাখার স্ট্যান্ড। তবে বাড়িটির বেশ কিছু স্থাপত্যে এখনও চোখে পড়ে ডাচ স্থাপত্য শিল্প। জটিল কারুকার্যে সম্বলিত আর্চ, বড় বড় গ্রীক শিল্পরীতিতে গড়ে ওঠা স্তম্ভ, খাঁজ কাটা কার্নিশ, বড় গারদের খড়খড়ি বিশিষ্ট দরজা-জানলা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিমবা আমোদপ্রমোদে সেজে উঠত এই বাড়ি। তবে নদীর ধারে দুটি বাড়িই প্রাণকৃষ্ণবাবু নিজের দখলে রাখতে পারেননি। দেনায় জর্জরিত হওয়ায় তার প্রথম বাড়িটির মতো এটিও তাঁর হাতের বাইরে বেরিয়ে যায়।

কিছু পুরনো স্থাপত্য - হুগলী কলেজিয়েট স্কুল
পুরনো স্থাপত্যে রঙের প্রলেপ - হুগলী কলেজিয়েট স্কুল

কমিশনার হাউস / বর্ধমান ডিভিশনাল কমিশনার বাংলো

চুঁচুড়া কোর্টের দক্ষিণ দিকে গঙ্গার ঘাটে যেতে গেলে নদীর পাড়েই রয়েছে কমিশনার হাউস যা এখন বর্ধমান ডিভিশনাল কমিশনারের বাংলো। পূর্বে এই ভবনটি ছিল চুঁচুড়ার ডাচ গভর্নরের বাসভবন। পরবর্তীকালে ব্রিটিশরা এই ভবনটির পুনর্নবীকরণ করায় এবং কমিশনার হাউস হিসাবে পরিচালিত হয়, যা এখন বর্ধমানের বিভাগীয় কমিশনারের বাসভবন। ভবনটির ভিতরে উপরের তলায় যেতে গেলে বারান্দায় একটি ডাচ শিলালিপি চোখে পড়ে, যেখানে লেখা রয়েছে VOC 1687 অর্থাৎ  The Vereenigde Oostindische Compagnie  বা The Dutch East India Company। এছাড়াও ভবনটির প্রাঙ্গনে রয়েছে ভি..সি. র লোগো খোদাই করা দুটি কামান।  

কমিশনার হাউসের ভিতর বারান্দায় ডাচ শিলালিপি "VOC 1687" (সৌজন্যে dutchinchinsurah.com)

চুঁচুড়া কোর্ট ও হুগলী মাদ্রাসা

চুঁচুড়া ঘড়ির মোড়ের দক্ষিণে অবস্থিত চুঁচুড়া কোর্ট (জেলা জজ আদালত, হুগলী)। বর্তমানে এই ভবনে রয়েছে কোর্টের অফিস, আর.টি.ও এবং জেলা জজের বাসস্থান। কোর্টবিল্ডিং এর স্থাপত্য দেখলেই বোঝা যায় এটি কোন পাশ্চাত্য রীতির স্থাপত্য। হ্যাঁ! ১৮২৭ - ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশরা তৈরি করে এই ভবন। তবে ব্রিটিশদের তৈরি এই ভবনের সঙ্গেও রয়েছে ডাচদের যোগাযোগ। কীভাবে? তাহলে বলি... ডাচদের পর ব্রিটিশরা যখন চুঁচুড়ায় আসে তখন তারা ডাচদের ফোর্ট গুস্তাভাস দুর্গটি ভেঙে ফেলে। আর এই দুর্গের ধ্বংসাবশেষের উপরই তৈরি হয় বিভিন্ন ভবন, যার মধ্যে ছিল চুঁচুড়ার এই কোর্ট। ১৮২৭ খ্রিষ্টাব্দে লেফটেন্যান্ট জে.এ.সি.ক্রমেলিন নামে এক এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার তত্ত্বাবধানে ভবনের কাজ শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে আর্টিলারি এক্সিকিউটিভ অফিসার ক্যাপ্টেন উইলিয়াম বেল এর তত্ত্বাবধানে। ব্রিটিশরা এই ভবনটি মূলত তাদের সেনানিবাসের (ছাউনি / ব্যারাক) জন্যই ব্যবহার করত। পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত প্রায় ২৬৬ মিটার লম্বা এই কোর্টের বারান্দা সম্ভবত ভারতের দীর্ঘতম কোর্ট করিডোর। 

চুঁচুড়া কোর্ট
চুঁচুড়া পুলিশ লাইন

কোর্টের ঠিক পাশেই উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত হুগলী মাদ্রাসা। ডাচদের ফোর্ট গুস্তাভাস দুর্গের সাক্ষী চুঁচুড়া কোর্ট ও এই হুগলী মাদ্রাসা। হ্যাঁ! কোর্টের মতোই হুগলী মাদ্রাসার ভবনও সেই দুর্গের ধ্বংসাবশেষের উপর তৈরি। দুর্গের পাথর, ইঁট অনেককিছুই ব্রিটিশরা ব্যবহার করেছিল তাদের এই ভবনগুলি নির্মাণে। কোর্টের মতো এই ভবনটিও ব্রিটিশরা সেনানিবাসের জন্যই ব্যবহার করত। অন্য ব্যারাকগুলির মধ্যে এই ব্যারাকটি ছিল সবথেকে পুরাতন, আর এই জনেই কোর্ট ও মাদ্রাসার স্থাপত্যরীতি হুবহু একইরকম। কোর্টের মতোই মাদ্রাসা ভবন চত্বরের ভিতরে একটি ফলক ও চারটি কামান এখনও দেখতে পাওয়া যায়। আর এগুলি এখনও চুঁচুড়ার সেই ডাচ স্থাপত্যের কথা স্মরণ করায়। ডাচদের পর চুঁচুড়ায় ব্রিটিশরা মোটামুটি তিনটি ব্যারাক বা সেনাছাউনি তৈরি করে। এক, বর্তমানে যা চুঁচুড়া কোর্ট হিসাবে পরিচিত; দুই, হুগলী মাদ্রাসা ও অন্যটি কোর্টের ঠিক পশ্চিমদিকে অবস্থিত চুঁচুড়া পুলিশ লাইন। এই তিনটি ভবনের গঠন প্রকৃতি লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে এগুলি একই স্থাপত্যরীতিতে গড়ে উঠেছে। 

হুগলী মাদ্রাসা

হুগলী মাদ্রাসায় প্রতিষ্ঠিত প্রস্তরলিপি ও দুটি কামান - ফোর্ট গুস্তাভাস
মাদ্রাসা চত্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এরকমই দুটি কামান

সরকারী স্থাপত্যগুলি ছাড়াও রয়েছে কিছু আবাসিক ভবন যেগুলির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ডাচেরা। চুঁচুড়ায় রয়েছে বেশ কিছু বণিক পরিবারের বসবাস, যারা একসময়য় ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত ছিল।  এই বণিক পরিবারগুলি ডাচ সময়কালে তাদের প্রাসাদপ্রমাণ বাড়ি তৈরি করেন। সময়টা যেহেতু ডাচদের তাই এখনও সেই বাড়িগুলিতে ইন্দো-ডাচ স্থাপত্যরীতি লক্ষ্য করা যায়। প্রথমেই বলি শোম পরিবারের কথা। এদের মধ্যে সোম পরিবার (আদি বাসস্থান চন্দননগর) ডাচদের সময়কালে চুঁচুড়ায় এসে বসতি স্থাপন করেন। সোম পরিবারের অন্যতম পূর্বপুরুষ বাবু শ্যামরাম সোম ছিলেন তৎকালীন ভি.ও.সি -এর দেওয়ান। পরবর্তীকালে ঘনশ্যাম সোম যুক্ত হন ডাচ কোম্পানির মুখ্য প্রতিনিধি হিসাবে। বাবু শ্যামরাম সোম নদীর পাড়েই তৈরি করেন তাঁর বিশাল বাগানবাড়ি। ডাচ স্থাপত্যরীতিতে গড়ে ওঠা এই ভবন এখন শিবচন্দ্র সোম ট্রেনিং অ্যাকাডেমি নামে বিদ্যালয় হিসাবে পরিচালিত হচ্ছে। আর এই বাগানবাড়ি ও শ্যামরাম সোমের নামেই সেখানে রয়েছে শ্যামবাবুর ঘাট। সেখান থেকে কিছুটা এগোলেই রয়েছে সুউচ্চ সন্ডেশ্বর মন্দির, যেখানে রয়েছে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শেষ গভর্নর ড্যানিয়েল ওভারবেক (Daniel Overbeck)  এর দেওয়া দুটি পিতলের ঢাঁক। চুঁচুড়ার আর এক বণিক পরিবার শীল পরিবার। শীলরা একসময় কারেন্সি এক্সচেঞ্জের কাজ করত, হয়তো সেই থেকেই ডাচদের সঙ্গে যোগাযোগ। এই শীলদের মধ্যে নীলাম্বর শীল ১৭৬৩ খ্রিষ্টান্দে তৈরি করেন রাজকীয় এক অট্টালিকা। মূলত শীল উদ্যানবাটী হিসাবে পরিচিত এই বাড়িটি বর্তমানে বড়ো শীলবাড়ি অন্যতম পরিচিত। চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকা করিন্থিয়ান স্টাইলের স্তম্ভ, কারুকার্যখচিত বিশাল ঠাকুরদালান, খড়খড়িযুক্ত জানলা এসবই ইন্দো-ডাচ স্থপত্যের অন্যতম নিদর্শন। অন্যদিকে ঘন্টাঘাটের মোড়েই সার্কিট হাউসের সামনে রাজেন্দ্র ভিলা

রাজেন্দ্র ভিলা, চুঁচুড়া
শীলবাড়ির ঠাকুরদালান
শীলবাড়ি, চুঁচুড়া

ডাচ নগরী চুঁচুড়া আপাতত এই পর্যন্তই। ডাচদের পর চুঁচুড়ায় ব্রিটিশরাও ছিল। চুঁচুড়ার ঘন্টার মোড় সেই ব্রিটিশ ইতিহাসের সাক্ষী, তবে সে গল্প আর একদিন আপাতত চুঁচুড়া থাক ডাচ নগরী হিসাবে......

******************************************************

লেখা, গবেষণা ও ছবি - প্রীতম নস্কর  

ই-মেল - pritamnaskar.pn@gmail.com

ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে ব্লগের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, তবে পূর্বানুমতি ছাড়া আমার তোলা আলোকচিত্রগুলি এবং ব্লগের রচনাগুলি অন্য কোথাও কপি-পেস্ট বা বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করা চলবে না।

******************************************************

চুঁচুড়া-র নিকটবর্তী কিছু দর্শনীয় স্থান

তথ্যসূত্র -

  • A Brief History of the Hughli District - by Lieut. Col. D.G.Crawford
  • A Sketch of the Administration of the Hooghly District from 1795 to 1845 - by George Toynbee
  • International Journal - Ancient Dutch Colony Chinsurah - by Subrata Pal
  • George Toynbee, A Sketch of Administration of the Hooghly District
  • Bengal District Gazetteers Hooghly - OMalley, L.S.S.
  • Dutch in Chinsurah - A Digital Resource for Histories Between  The  17th  -19th  Century  in  Chinsurah
  • The Dutch in India & Chinsurah - by Oeendrila Lahiri

Comments