জাফর খান গাজী মসজিদ..... বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ ।। Zafar Khan Ghazi Masjid.... Bengal's Oldest Mosque

জাফর খান গাজী মসজিদ..... বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ ।। Zafar Khan Ghazi Mosque.... Bengal's Oldest Mosque
জাফর খান গাজী মসজিদ

কলকাতা থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে হুগলী জেলার অন্তর্গত ত্রিবেণী নামক শহরে অবস্থিত জাফর খান গাজী মসজিদ ও দরগাহ হল বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ, যা তৈরি হয় ১২৯৮ খ্রিষ্টাব্দে। বাংলায় ইসলামিক স্থাপত্যের সর্বপ্রথম নিদর্শন হল এই মসজিদ। গাজীর এই মসজিদ মূলত দুটি অংশে বিভক্ত। মসজিদ ও দরগাহ এই দুটি নিয়েই তৈরি হয়েছে গাজীর আস্তানা। দরগায় রয়েছে গাজী ও তাঁর পরিবারের সমাধি এবং সামনেই কয়েক গজ দূরে দশগম্বুজ যুক্ত জাফর খান গাজীর মসজিদ, যা বর্তমানে এখনও একটি সক্রিয় ধর্মীয় স্থান হিসাবে পরিচালিত

ত্রিবেণীত্রিবেণী নামকরণের উৎপত্তি সাধারণত তিনটি নদীর মিলনস্থল থেকে। ভারতে এলাহাবাদের প্রয়াগে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী মিলিত হওয়ায় জায়গাটির নামকরণ হয়েছে ত্রিবেণী সঙ্গম, যাকে বলা হয় যুক্তবেণী কিন্তু বাংলাতেও রয়েছে আরও এক ত্রিবেণী, যেখানে ভাগীরথী বা হুগলী নদী তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে হুগলী, সরস্বতী ও যমুনা (বর্তমানে কাঁচরাপাড়া খাল ও তৎসংলগ্ন ডোবা) নদীর সৃষ্টি হয়েছে, তবে একে বলা হয় মুক্তবেণী আর ঠিক এইখানেই হুগলী নদী ও সরস্বতী নদীর বিভক্ত স্থলে বিশাল এক উঁচু স্তূপের উপর গড়ে উঠেছে জাফর খান গাজীর মসজিদ ও দরগাহ। 

সরস্বতী নদী (সঙ্গে হুগলী নদীর মিলনস্থল)

জাফর খান গাজী (জাফর খাঁ গাজী) বাংলার ইতিহাসে এক অদ্ভুত রহস্যময় ব্যক্তি, যার নামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক কাহিনীকিছু ঐতিহাসিকবিদদের মতে তিনি ইসলামিক ধর্মযোদ্ধা তো কারোর কাছে তিনি গঙ্গার উপাসক। আবার কিছু ঐতিহাসিকগণের কাছে তিনি ছিলেন এক সুফি যিনি মাদ্রাসা ও মসজিদ তৈরি করেন। বোঝাই যাচ্ছে একটি মাত্র চরিত্রকে ভিত্তি করে গঠন হয়েছে বিভিন্ন কাহিনী। তাহলে কে এই জাফর খান গাজী?? আর কেনই বা তাঁর নামে তৈরি হল এই মসজিদ?? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে, যখন বাংলায় ধীরে ধীরে ইসলামিক সাম্রাজ্যের সূত্রপাত ঘটতে থাকে।

কে এই জাফর খান গাজী?

এপ্রসঙ্গে প্রথম যে তথ্য পাওয়া যায় তা বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা ও ব্রিটিশ পুরাতত্ত্ববিদ মিস্টার ডি. মানি র কাছ থেকে। যিনি ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম এই গাজীর মসজিদ পরিদর্শন করতে গিয়ে মসজিদের খাদিমদের কাছ থেকে জাফর খান গাজীর একটি কুরসিনামা (বংশতালিকা) সংগ্রহ করেছিলেন। যা অবলম্বন করে মানি সাহেব জাফর খান গাজীর একটি সংক্ষিপ্ত জীবনকাহিনী এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে "An Account of the Temple of Tribeni near Hugli, by D. Money, May 1847" প্রকাশ করেন। আর এই জার্নাল অনুযায়ী জাফর খান সম্বন্ধে মোটামুটি তিনটি কাহিনী উঠে আসে

Zafar Khan Gazi Dargah at Tribeni in West Bengal, taken by Joseph David Beglar 1872 (courtesy British Library)

Zafar Khan Gazi Mosque at Tribeni in West Bengal, taken by Joseph David Beglar 1872 (courtesy British Library)

প্রথম কাহিনী, যেখানে তিনি একজন "ইসলাম ধর্মালম্বী তুর্কি আক্রমণকারী"

মুকসুদাবাদ (যা পরবর্তীকালে মুর্শিদাবাদ নামে পরিচিত) থেকে জাফর মহম্মদ খান ও তাঁর ভাইপো শাহ সুফি বাংলায় ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য সপ্তগ্রামের এই অঞ্চলে আসেন। প্রথমে তিনি স্থানীয় রাজা মান নৃপতি কে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন এবং ক্রমে আরও ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে হুগলীর মহানাদের কাছে আর এক ক্ষমতাশালী রাজা ভূদেব এর সঙ্গে যুদ্ধে নিয়োজিত হন। তবে এক্ষেত্রে জাফর খান যুদ্ধে নিহত হন এবং জানা যায় যুদ্ধে তাঁর মাথা ধর থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়। এরপর গাজীর সেই মস্তকহীন দেহ নিয়ে আসা হয় সপ্তগ্রামের এই ত্রিবেণী অঞ্চলে যেখানে গঙ্গার পাড়েই তাকে গোড় দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে এই গাজীর আর এক সন্তান উগুয়ান খান (উলুগ খান) পিতার এই অসমাপ্ত সংগ্রাম চালিয়েছিলেন এবং তিনি যুদ্ধে ভূদেব কে পরাজিত করেন। শেষে উলুগ খান পরাজিত ভূদেব কে ইসলাম ধর্মে রূপান্তর করে তাঁর কন্যাকে বিয়ে করেন। এবং মৃত্যুর পর উলুগ খান এর স্ত্রীকেও সমাধিস্থ করা হয় এই দরগায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই উলগু খানের আর কোন তথ্য পাওয়া যায়নি, এমনকি তাঁর দেহ শেষ পর্যন্ত কোথায় সমাধিস্থ হয় তাও জানা যায়নি।

জাফর খান গাজী দরগাহ (দক্ষিণ দিক)

দ্বিতীয় কাহিনী অনুযায়ী তিনি একজন "শাস্তিদাতা"

ডি. মানি, জাফর খান গাজীর আরও একটি কাহানী খুঁজে পান যার তথ্য অনুযায়ী ত্রিবেণীর এক মুসলিম সুফি সাধক শাহ সুফিউদ্দিন তাঁর ছেলের সুন্নত (লিঙ্গচর্মচ্ছেদ) অনুষ্ঠান উপলক্ষে অতিথিদের ভোজের জন্য এক গরু কুরবানী (হত্যা) দেন কিন্তু সেসময়ে স্থানীয় রাজার নির্দেশে রাজ্যে গো-হত্যা ছিল এক চরম অপরাধ। রাজা এই হত্যার খবর জানতে পেরে সুফিউদ্দিনের ছেলেকে বন্দী অবস্থায় নিয়ে এসে কালী ঠাকুরের উদ্দেশ্যে বলি দেন। এক্ষেত্রে সেই স্থানীয় রাজা আগের কাহিনীর মতোই রাজা ভূদেব। শেষে মৃত ছেলের দেহ নিয়ে সুফিউদ্দিন ছুটে যান দিল্লির দরবারে, যেখানে সিংহাসনে বসে আছেন সুলতান ফিরোজ শাহ দ্বিতীয় (জালালউদ্দিন খিলজি), যিনি খিলজি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ও দিল্লির প্রথম সুলতান। এদিকে সম্পর্ক অনুযায়ী শাহ সুফিউদ্দিন হলেন ফিরোজ শাহের ভাগ্নে। ফলত মৃত্যুর খবর শোনামাত্র প্রতিশোধের জন্য ফিরোজ শাহ সৈন্যসহ জাফর খান কে পাঠালেন বাংলায়গল্পের এই সংস্করণে জাফর খানের সঙ্গে রাজা ভূদেবের যুদ্ধ হয় সপ্তগ্রামের নিকট মহানাদ নামক স্থানে, যেটি ত্রিবেণী থেকে ৮ মাইল দূরে। আর এই যুদ্ধে জাফর খান জয়ী হন।

তবে মানি সাহেবের এই কাহিনীর সঙ্গে মিল পাওয়া যায় আরও একটি কাহিনীর যার কেন্দ্র হুগলীর পান্ডুয়া। সেই কাহিনীতেও একইভাবে মৃত ছেলের জন্য সুফি সাধক শাহ সুফিউদ্দিন দিল্লির দরবারে গেলে সুলতান ফিরোজ শাহ প্রতিশোধের জন্য জাফর খান কে পাঠালেন। এক্ষেত্রে শাহ সুফিউদ্দিন আবার জাফর খান এরও ভাগ্নে। দিল্লি হয়ে প্রথমে তাঁরা যান পানিপথ, যেখানে দেখা করেন তাঁদের গুরু সুফি সাধক শেখ শরফুদ্দিন বু আলী কালান্দার এর সঙ্গে। এরপর সুফির আশীর্বাদ নিয়ে জাফর খান ও সুফিউদ্দিন এবং সঙ্গে বহরম সাক্কা সৈন্য নিয়ে আসেন সপ্তগ্রামের মহানাদ নামক স্থানে। যেখানে যুদ্ধে রাজা ভূদেব পরাজিত হন। এদিকে শাহ সুফিউদ্দিনও যুদ্ধে মারা যান এবং তাঁকে পান্ডুয়ায় গোড় দেওয়া হয়। তবে এক্ষেত্রে এই পান্ডুয়া বর্তমানে হুগলী জেলার ছোট পান্ডুয়া, যেখানে আজও তাঁর কবর দেখতে পাওয়া যায়। তবে এবিষয়ে একটু মতান্তর রয়েছে হুগলীর পান্ডুয়া, শাহ সুফিউদ্দিন, পান্ডুয়ার মিনার, বাইশ দরওয়াজা মসজিদ নিয়ে আমার আর একটি ব্লগ রয়েছে এবিষয়ে বিস্তারিত জানতে এই লেখাটিতে ক্লিক করতে পারেন। 

দরগাহ'র পশ্চিম কক্ষে যাওয়ার প্রবেশদ্বার

দরগাহ'র পূর্বদিকের কক্ষে যাওয়ার প্রবেশদ্বার ও প্রবেশদ্বারের খিলানে থাকা হিন্দু স্থাপত্য

তৃতীয় কাহিনী অনুযায়ী তিনি এক বুজুর "দরাপ খান গাজী"

হ্যাঁ! এই কাহিনীতে তিনি দরাপ খান গাজী। প্রখ্যাত বাঙালি ভাষাবিজ্ঞানী সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় এই দরাপ খান গাজী কেই জাফর খান গাজী রূপে চিহ্নিত করেছেন। যেখানে জাফর খান গাজীর আরও একটি চরিত্র ফুটে ওঠে যখন জানা যায় স্থানীয় লোকেরা তাঁকে বুজুর বলে সম্বোধন করতেন। যেখানে স্থানীয়দের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সুপরিচিত এক সুফি সাধক, যিনি সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শী এবং গঙ্গার সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে হুগলীর কাছেই গঙ্গার তীরে বসতি স্থাপন করেন। আর কাহিনী অনুযায়ী এই সিংহবিক্রম জাফর খান গঙ্গা দর্শনে মুগ্ধ হয়ে কোরানের বদলে গঙ্গাস্তব আবৃত্তি করেছিলেন। মনি সাহেবের মতে তিনি এই শ্লোক নিজে রচনা করেন। এছাড়াও বাংলায় গঙ্গাস্তব এর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় এই দরাপ খানের গঙ্গাশ্লোক মোট অষ্টশ্লোকে রচিত। সে যাই হোক, যিনি এই শ্লোক রচনা করেন তিনি হলেন দরাপ খান গাজী, আর মনি সাহেবের মতেও দরাপ খান গাজী হল আমাদের জাফর খান গাজী একজন মুসলমানের পক্ষে ফার্সি শ্লোকের পরিবর্তে সংস্কৃত শ্লোক আবৃত্তি থেকেই বোঝা যায় তাঁর গঙ্গাভক্তি ও হিন্দু ধর্মের প্রতি নিষ্ঠা তবে এই অষ্টশ্লোকের মধ্যে মনিসাহেব লিপিবদ্ধ করে অষ্টম বা শেষের শ্লোকটিই   

सुरधुनि मुनिकन्ये तारयेः पुण्यवन्तं तरति निजपुण्यैस्तत्र किन्ते महत्त्वं
यदि गतिविहीनं तारयेः पापिनं मां तदपि तव महत्त्वं तन्महत्त्वं महत्त्वं।

হে স্বর্ণদী জহ্নু মুনিকন্যা গঙ্গা, তুমি পুণ্যবান্-কে তারণ করো, কিন্তু তাতে তোমার কি মহত্ত্ব? সে নিজ পুণ্যে তরে। কিন্তু যদি গতিবিহীন পাপী আমাকে তারণ করো, তবেই পৃথিবীতে তোমার মহত্ত্ব আর সেই মহত্ত্বই মহত্ত্ব।

জাফর খান গাজী দরগাহ'র পশ্চিম কক্ষ

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে কাহিনী অনুযায়ী একদিকে তিনি একজন ইসলাম ধর্মযোদ্ধা যিনি শাহাসুফির পুত্রহত্যার প্রতিশোধ নিতে সপ্তগ্রামে আসেন এবং সেখানকার স্থানীয় রাজাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন। পরবর্তীকালে গঙ্গার সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে ত্রিবেণীতে বসবাস শুরু করেন এবং পরে পুনরায় সেখানকার হিন্দু স্থানীয় রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন, তবে এই যুদ্ধে মৃত্যু হলে তাঁকে ত্রিবেণীতে কবর দেওয়া হয়। তবে এসবই মনিসাহেবের সংগ্রহ করা কুর্সিনামা ও স্থানীয় মানুষদের দেওয়া কাহিনী অনুযায়ী প্রাপ্ত তথ্য কিন্তু আসল প্রমাণ পাওয়া যায় মসজিদের পাথুরে প্রমাণে অর্থাৎ মসজিদের শিলালিপি থেকেএক্ষেত্রে মনিসাহেব তাঁর ত্রিবেণী পরিভ্রমণে মসজিদের তথ্য জোগাড় করলেও, মসজিদ ও দরগাহ'র অভ্যন্তরে থাকা শিলালিপি গুলি সম্বন্ধে কিছুই জানাতে পারেননি। তিনি যখন এই মসজিদ পরিভ্রমণে আসেন তখন চতুর্দিক জঙ্গলে পরিপূর্ণ, হতে পারে সেইসময় শিলালিপি গুলি তাঁর চোখ এড়িয়ে যায়। তবে এরও তেইশ বছর পর কলকাতা মাদ্রাসার অধ্যাপক হায়েনরিখ ব্লকম্যান সর্বপ্রথম এই জাফর খান মসজিদ ও সমাধির আরবি শিলালিপি গুলির (প্রস্তরলিপির) তর্জমা করেন এবং ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে এই বিষয়গুলির উপর ভিত্তি করে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নাল Notes of the Arabic and Persian Inscriptions in the Hugli District – by Heinrich Blochman 1870 প্রকাশ করেন।

জাফর খান গাজী মসজিদের প্রার্থনা কক্ষ

জাফর খান গাজী মসজিদের আইল

মসজিদ ও দরগাহ'র প্রস্তরফলক

ব্লকম্যান সাহেবের তথ্য অনুযায়ী মসজিদ ও দরগাহ মিলিয়ে মোট সাতটি শিলালিপি রয়েছে, যার মধ্যে মসজিদে রয়েছে পাঁচটি ও দরগায় দু'টি। কিন্তু বর্তমানে ক্ষেত্রসমীক্ষায় গেলে মসজিদের অভ্যন্তরে যে শিলালিপিগুলি চোখে পড়ে তা ব্লকম্যান সাহেবের জার্নাল মতে দুটি। তথ্য অনুযায়ী বাকি তিনটি শিলালিপি দেখতে পাওয়া যায়নি, বরং সময়ের সাথে অন্য আরও দুটি শিলালিপি এখানে অর্থাৎ  মসজিদের দেওয়ালে যুক্ত হয়েছে। তবে সেপ্রসঙ্গে পরে আলোচনা করছি। প্রথমে জার্নাল অনুযায়ী মসজিদের পশ্চিম দেওয়ালের দক্ষিণ দিকের মিহরাবের চতুর্দিকে ব্যাসাল্ট শিলায় রয়েছে একটি শিলালিপি। কিন্তু শিলালিপির মাঝের কিছু অংশ সময়ের সাথে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। তাই সেই অংশগুলি ছাড়া ব্লকম্যান সাহেব বাকি অংশের তর্জমা তাঁর জার্নালে প্রকাশ করেন। 

মসজিদের মিহরাবকে বেষ্টন করে থাকা শিলালিপি

মিহরাবের এই শিলালিপিটি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে শিলালিপিটি শুরু হয়েছে ডানদিকের উলম্ব শিলালিপির প্যানেল থেকে, এরপর ধীরে ধীরে মিহরাবের উপরের অনুভূমিক শিলালিপি ও শেষে বামদিকের উলম্ব শিলালিপিতে এসে শেষ হয়েছে। ব্লকম্যান সাহেবের তর্জমা করা শিলালিপিটির মর্মার্থ হলঃ

এবং আমি (জাফর খান) আশা করি ধার্মিক শুভেচ্ছা যেমন শরীয়তে শেখা হয় যাতে আমি কবরে থাকাকালীন ঈশ্বর আমার বিশ্বাসকে আরও শক্তিশালী করতে পারেনভগবান আমাকে পুরস্কৃত করুন; তিনি সত্যই করুণাময় এবং উদার এবং দয়ালু এবং আমি মনে করি তিনি আমাকে কদর করবেন

এরপর উপরের শিলালিপির অংশে...  

শিলালিপির ৭, ৮, ১৫, ১৬ ও ২৪ নং লাইনগুলি অস্পষ্ট হওয়ায় ব্লমম্যান সাহেব সেগুলির পাঠোদ্ধার করতে পারেন নি। উপরের বাকি অংশ গুলি...

 _________তুর্ক সিংহবিক্রম জাফর খান_________ জনহিতকর ইমারত নির্মাতাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, প্রাচীন যোদ্ধাদের পরেই, কাফেরদিগকে তরবারী ও বর্শা দ্বারা আঘাত করিয়া, ও প্রত্যেককে প্রচুর পরিমাণে ধনসম্পদ বিতরণ করিয়া________________

 এরপর বামদিকের অংশে...

এবং সত্যধর্মের শিক্ষিত ব্যাক্তিগণকে সন্মান করা এবং ঈশ্বরের ধ্বজা উন্নীত করার জন্য নির্মিত হইল

শিলালিপির শেষ অংশে রয়েছে wafq শব্দে মসজিদ প্রতিষ্ঠার তারিখ বিশিষ্ট তিনটি সংখ্যা ৮, ৯০ ও ৬০০। যা গণনা অনুযায়ী ৮+৯০+৬০০ = ৬৯৮ আল হিজরি অর্থাৎ ইংরাজিতে ১২৯৮ খ্রিষ্টাব্দ। আর এই শিলালিপি থেকেই প্রমাণ হয় এই জাফর খান গাজীর মসজিদ প্রতিষ্টা হয় ১২৯৮ খ্রিষ্টাব্দে, যা এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত বাংলার সর্ব প্রাচীন মসজিদ

দরগাহ'র পশ্চিম দিকের সমাধি কক্ষের শিলালিপি

এবার আসছি মসজিদের দ্বিতীয় শিলালিপিতে, যেটি দরগাহ'র অর্থাৎ পশ্চিমদিকের দ্বিতীয় সমাধিকক্ষে (যে কক্ষে জাফর খান গাজীর সমাধি রয়েছে) সমাধির নীচের দিক করে অবস্থিত। পাশাপাশি অনুভূমিক ভাবে অবস্থান করা দুটি কালো ব্যাসাল্ট পাথরের শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, সাতগাঁও (সপ্তগ্রাম) শাসনকর্তা সাহাবুদ্দিন জাফর খান, খান্-ই-জাহান ত্রিবেণীতে একটি মাদ্রাসা তৈরি করেছিলেন। এই মাদ্রাসাকে বলা হত দার-উল্-খয়রাৎ। শিলালিপিটি ব্লকম্যান সাহেব তর্জমা করলেও নীচের এই অনুবাদটি বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকার ১৫তম বর্ষে অনুবাদ করেন। যার মর্ম  

যিনি প্রশংসার পাত্র তাঁহার প্রশংসা হউক। দানের কর্তা, মুকুট ও শিলমোহরের অধিকারী, পৃথিবীতে ঈশ্বরের ছায়াস্বরূপ, দাতা, সদাশয়, মহানুভব, সকল জাতির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, পৃথিবী ও ধর্মের সূর্যস্বরূপ জগতের পালনকর্তা, ঈশ্বরের দয়ার বিশেষ পাত্র, সুলেমানের রাজ্যের উত্তরাধিকারী রাজা আবুল মুজঃফর ফিরোজ শাহ সুলতান, ঈশ্বর সর্বদা তাঁহার রাজ্য রক্ষা করুন। তাঁহার রাজত্বকালে দয়ার গৃহ নামক এই বিদ্যালয় মহানুভব খাঁ, সন্মাতিত দাতা, প্রশংসাযোগ্য দানবীর সদাশয়, ইসলামধর্মের ও মানবজাতির সাহায্যকারী, সত্য ও ধর্মের ধূমকেতুস্বরূপ, রাজা ও রাজ্যাধিকারিগণের সহায়স্বরূপ, সত্যবিশ্বাসীগণের অভিভাবকস্বরূপ খাঁ মহম্মদ জাফর খাঁ, ঈশ্বর তাহাকে শত্রুগণ কর্তৃক জয়ী করিলেন (অর্থাৎ শত্রুগণ পরাভূত হইয়া তাঁহার জয়ের কারণ হইল) ও তাঁহাকে তাঁহার আত্মীয়স্বজনের নিকট ফিরাইয়া আনিলেন...... তাঁহার আদেশে নির্মিত হইল।। তারিখ প্রথম মহরম হিজরি ৭১৩। 

ইংরাজির ২৮ শে এপ্রিল ১৩১৩ খ্রিষ্টাব্দ। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে তারিখ অনুসারে মসজিদের প্রথম শিলালিপি ১২৯৮ খ্রিষ্টাব্দ ও দরগাহ'র এই দ্বিতীয় শিলালিপি ১৩১৩ খ্রিষ্টাব্দ। তাহলে প্রথম শিলালিপি অনুযায়ী সিংহবিক্রম জাফর খান এবং দ্বিতীয় শিলালিপি অনুযায়ী খান মহম্মদ জাফর খান কি একই ব্যক্তি?

দরগাহ'র পূর্ব দিকে লোহার গ্রিল দ্বারা বন্ধ করা অতীতের কোন মন্দিরের প্রবেশপথ

দরগাহ'র দক্ষিণ দিকের ভিত্তিমূলে মুখ সম্বলিত প্যানেল

আজ পর্যন্ত সকলেই এই দুই শিলালিপিতে উল্লিখিত দুই জাফর খানকে একই ব্যক্তি, অর্থাৎ জাফর খান গাজী বলেই মনে করেছেন। এমনকি মনিসাহেব ও ব্লকম্যান সাহেব তাদের এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে, হুগলী ডিসট্রিক্ট গেজেটসের ওমালি সাহেব, হুগলী জেলার কাহিনী রচয়িতা সকলেই দুই জাফর খানকে অভিন্ন মনে করেছেন। কিন্তু না! এই দুই জাফর খান একই ব্যক্তি নন। আচার্য যদুনাথ সরকার সর্বপ্রথম এই দুই জাফর খাঁর রহস্য ভেদ করেন তাঁর History of Bengal Vol II গ্রন্থে তাঁর মতে এই দুই জাফর খাঁ সম্পূর্ণরূপে আলাদা, দ্বিতীয় জাফর খান হলেন এক সেনাপতি, যিনি বাংলার স্বাধীন সুলতান রুকনউদ্দীন কায়কাউস (১২৯১১৩০০) এর সেনাপতি এবং কাউকাউসের জন্যই সপ্তগ্রাম জয় করতে আসেন তবে এবিষয়ে আরও একটি নাম উঠে আসে মুসলিম শাসনকর্তা ফিরোজ শাহ। কায়কাউসের পরে এই ফিরোজ শাহ রাজ্য দখল করেন। কে এই ফিরোজ শাহ? এক্ষেত্রে মসজিদ প্রতিষ্ঠার সাল বিশ্লেষণ করলে সেই সময়ে দুটি ফিরোজ শাহের নাম উঠে আসে। তবে স্থানের দিক দিয়ে দুই ফিরোজ শাহ দুটি জায়গায়, এক বাংলায় আর দুই দিল্লিতে। দিল্লির ফিরোজ শাহ হলেন জালালউদ্দিন ফিরোজ খিলজি যিনি খিলজি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম সুলতান (শাসনকাল ১২৯০ ১২৯৬ সাল) আর অন্যদিকে বাংলার ফিরোজ শাহ হলেন সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ (শাসনকাল ১৩০১১৩২২ সাল) যিনি লখনৌতি (গৌড়ের) স্বাধীন শাসকঅর্থাৎ সময়ের দিক থেকে দেখতে গেলে এই জাফর খান মসজিদ তৈরি হয় ১২৯৮ সালে যা সম্ভবত দিল্লির সুলতান জালালউদ্দিন খিলজির শাসনকালের সময়কার জাফর খান, যিনি কুর্সিনামার প্রথম কাহিনী অনুযায়ী সুলতানের আদেশে বাংলায় আসেন। তবে স্যার যদুনাথ সরকারের মতে গাজী জাফর খান-ই-জাহান প্রথম ত্রিবেণী অঞ্চল জয় করেন এবং তাঁর সঙ্গেই মান ও ভূদেব নৃপতির যুদ্ধ হয়। ঘটানাটি সম্ভবত শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের পূর্বসূরি রুকনউদ্দীন কায়কাউসের সময়কাল। আর এই যুদ্ধেই জাফর খান নিহত হন। কায়কাউসের পরে শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ রাজ্য দখল করেন। এরপর শামসুদ্দিন মুঙ্গের থেকে উলুগ খানকে (কুরশিনামা অনুযায়ী জাফর খানের পুত্র) সপ্তগ্রামে পাঠালেন জাফর খানের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার জন্য। উলুগ খান সেখানকার হিন্দু রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করেন এবং পরবর্তীকালে ত্রিবেণীতে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ সাতগাঁও-র শাসনভার তুলে দেন শাহাবুদ্দিন জাফর খানকেএই জাফর খান কায়কাউসের রাজত্বকালে দেবকোর্টের (দিনাজপুর) শাসনকর্তা ছিলেন, যিনি সম্ভবত যুদ্ধের আগে দিল্লির সুলতান তাঁকে নিয়োগ করেছিলেন। উত্তরবঙ্গের দিনাজপুরের গঙ্গরামপুর গ্রামের এক মসজিদ থেকে আরও একটি আরবি ভাষার শিলালিপি পাওয়া যায় যেখানে জাফর খানের সম্পূর্ণ নাম উলুঘ-ই-আজম্ হুমায়ূন জাফর খান বাহরাম ইতগিন আর ইনিই খান্-ই-জাহান্ উপাধি পান এবং ৭১৩ হিজরি অর্থাৎ ১৩১৩ খ্রিষ্টাব্দে ত্রিবেণীতে মাদ্রাসা দর-উল্-খয়রাৎ নির্মাণ করেন। সেইজন্যেই সমাধির শিলালিপিতে তাঁকে রাজা ও রাজ্যাধিকারীগণের সহায়স্বরূপ বলা হয়েছে।

তবে প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বাঙ্গলার ইতিহাস (দ্বিতীয় খণ্ড) বইতে একটি ভিন্ন মত প্রকাশ করেন। তাঁর মতে কায়কাউসের রাজত্বকালের শেষভাগে জাফর খান বাহরাম ইতগিন সপ্তগ্রাম জয় করেন। এরপর জাফর খাঁ গঙ্গা ও সরস্বতী নদীর মিলনস্থলে একটি মসজিদ তৈরি করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে সেই মসজিদ বিনষ্ট হয় এবং পুনরায় সেই মসজিদ পুনঃনির্মাণ করা হয়। বর্তমানে মসজিদের যে মিহরাবটি থেকে ১২৯৮ সালের তথ্য পাওয়া যায়, সেই মিহরাবটি আগের মসজিদের মিহরাব। কারণ তাঁর মতে মসজিদের এই মিহরাবটির গঠনপ্রণালী অন্যান্য মিহরাবের মতো নয়। পরবর্তীকালে নতুন মসজিদ তৈরি হলে সেই মিহরাবটি নতুন মসজিদের মিহরাবে পরিণত হয়।

অর্থাৎ জাফর খান গাজী আসলে কে ছিলেন, কার জন্যই বা এই দরগাহটি তৈরি করা হয়েছিল এবং দরগায় যে জাফর খান গাজী -কে সমাধিস্থ করা হয়েছে তিনি আসলেই বা কে ছিলেন... তা বর্তমানে একপ্রকার ধাঁধাঁ। এর প্রধান কারণ, অনেকগুলি কিংবদন্তী কাহিনী এর ওর ঘাড়ে চাপিয়ে ফেলা হয়েছে।

পশ্চিম কক্ষের আরও একটি শিলালিপি

এছাড়াও ব্লকম্যান সাহেব দরগায় অবস্থিত আরও একটি শিলালিপির কথা বলেছেন, যেটি এখনও আগের মতোই দরগাহ'র পশ্চিম কক্ষের মেঝেতে দাঁড়ানো অবস্থায় রয়েছে। তবে শিলালিপি থেকে যে তথ্য উঠে আসে তা এই দরগাহ বা মসজিদের সাক্ষ্য বহন করে না। শিলালিপি অনুযায়ী

"এই মসজিদটি নির্মাণ করেন মহান খান, বিশিষ্ট ব্যক্তি উলুগ আজমল খান ভগবান তাঁকে উভয় জগতে রক্ষা করুক উন্নত আভিজাত্য সেনাবাহিনীর সেনাপতি, ইকরার খান, যিনি রাজকীয় হারেমের একজন সন্মানীয় অভিভাবক, এবং সজলা মানখবাদ জেলা ও লাওবলা শহরের সেনাপতি ও ওয়াজির তাঁর গৌরবান্বিত গুণাবলী চিরকালের জন্য সহনশীল হোক, উদার, জ্ঞানী, সম্পূর্ণরূপে নিপুণ রাজা বারবাক শাহের রাজত্বকালে, যিনি সুলতান মাহমুদ শাহের পুত্র।। তারিখ ৮৬০ আল হিজরি

অর্থাৎ ইংরাজিতে ১৪৫৬ খ্রিষ্টাব্দ। তবে এই শিলালিপিটি এই মসজিদের নয় এবং এখানে যে রাজা বারবাক শাহের কথা বলা হয়েছে তিনি সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের (শাসনকাল ১৪৩৫১৪৫৯) পুত্র রুকনউদ্দিন বারবাক শাহ (শাসনকাল ১৪৫৯১৪৭৪), যিনি পিতার রাজত্বকালে সাতগাঁও (সপ্তগ্রাম) এর গভর্নর ছিলেন এবং পিতার মৃত্যুর পর রাজত্বলাভ করেন।

মসজিদের অন্যন্য ফলক / প্রস্তরলিপি - ১

মসজিদের অন্যন্য ফলক / প্রস্তরলিপি -২

মসজিদের অন্যন্য ফলক / প্রস্তরলিপি -৩

আগেই বলেছি ক্ষেত্রসমীক্ষায় গেলে জার্নাল অনুযায়ী মসজিদে দুটি শিলালিপি দেখতে পাওয়া যায়। তার মধ্যে দক্ষিণদিকের মিহরাবের শিলালিপির কথা আগেই জানিয়েছি। এছাড়াও মধ্যবর্তী মিহরাবের (সম্ভবত প্রধান মিহরাব) ডানদিকে একটি লম্বা ব্যাসাল্ট শিলার প্রস্তরফলক দেখতে পাওয়া যায় চিত্র - (মসজিদের অন্যান্য ফলক / প্রস্তরলিপি -২)। ব্লকম্যান সাহেব তাঁর জার্নালে এই শিলালিপির-ও তর্জমা করেছেন। শিলাগুলিতে যা লেখা রয়েছে তা সম্পূর্ণই কোরান থেকে নেওয়া উদ্ধৃতি, ব্লকম্যান সাহেবের মতে এটি এই মসজিদের নয়। এছাড়াও ব্লকম্যান সাহেব আরও তিনটি শিলালিপির কথা বলেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে মসজিদে সেইগুলি দেখতে পাওয়া যায়না। তবে দুটি মিহরাবের বামদিকে ঠিক শিলালিপির মতোই দুটি ফাঁকা জায়গা দেখতে পাওয়া যায়, হতে পারে পূর্বে সেই জায়গাগুলিতে শিলালিপিগুলি ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে সেগুলি কে বা কোথায় সরিয়েছে তার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

সেগুলি ছাড়াও বর্তমানে মসজিদের দক্ষিণদিকের মিহরাবের বামদিকে একটি লম্বা ব্যাসাল্ট প্রস্তরফলক এবং এই মিহরাবেরই ডানদিকে একটি চতুষ্কোণ ব্যাসাল্ট প্রস্তরফলক দেখতে পাওয়া যায়। তবে ঐতিহাসিক দিক দিয়ে এগুলিরও সেরকম গুরুত্ব নেই, কারণ এই শিলাগুলিতে যা লেখা রয়েছে তা সম্পূর্ণই কোরান থেকে নেওয়া উদ্ধৃতি যা বেশিরভাগ মসজিদেই দেখতে পাওয়া যায় এবং এগুলির সঙ্গে এই মসজিদের কোনো সম্পর্ক নেই। সম্ভবত এগুলিও বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করে এনে এখানে গাঁথা হয়েছে। আর এজন্যেই বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে জাফর খান গাজী মসজিদ মোটামুটি একটি শিলালিপির মিউজিয়ামে পরিণত হয়েছে

দরগাহ'র পূর্বদিকের দেওয়ালে ব্যবহৃত মন্দিরের ফ্রেম, উল্লেখ্য ফ্রেমগুলিতে খোদাই করা ক্ষুদ্র দেউল মন্দির

মসজিদ ও দরগাহ'র গঠনশৈল

ত্রিবেণীতে হুগলী নদীর তীরে প্রায় দশ-বারো ফুট উঁচু এক ঢিবির উপর গড়ে উঠেছে এই মসজিদ। এবার অনেকেই বলবেন যেহেতু এই মসজিদ হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে তার ধ্বংসাবশেষ নিয়ে তৈরি হয়েছে তাই এই মসজিদ গঠনের কোনো স্থাপত্য নেই। না এই ধারণা ভুল, মসজিদ গঠনে স্থাপত্য রয়েছে এবং মন্দির ধ্বংসের ব্যাপারে পরে আলোচনা করেছি

গঙ্গার ধারে রাস্তা থেকে এক সিঁড়ি ভেঙে উঠলে তবেই আস্তানা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করা যায়। মূলত আস্তানাটি দুটি ভাগে বিভক্ত। প্রবেশের পরই ডানদিকে রয়েছে দরগাহ এবং আস্তানার প্রবেশপথের শেষপ্রান্তে রয়েছে মসজিদ। দুটি আয়তকার কক্ষ মিলে একটি সম্পূর্ণ দরগাহ তৈরি হয়েছে। বর্তমানে দরগাহ'র কোনো ছাদ নেই, পূর্বেও ছিল কিনা তা জানা যায়না। পুরো দরগাহটিই পাথর, ইঁট ও ক্ল্যাডিং দিয়ে তৈরি হয়েছে। তবে আস্তানায় প্রবেশের আগে দরগাহ'র পূর্বদিকের অংশের কথা প্রথমে বলতে হয়। রাস্তার ধারেই গঙ্গার মুখোমুখি এই অংশে একটি জালি বিশিষ্ট কালো পাথরে তৈরি জানলা দেখতে পাওয়া যায়, যেটি সম্ভবত পূর্বে কোন হিন্দু মন্দিরের প্রবেশদ্বার ছিল, যা পরবর্তীকালে লোহার গ্রিল দ্বারা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে জানলাটির সামনে গেলে একটি ছোট্ট সিঁড়ি দেখতে পাওয়া যায়, যার উপরে উঠলে জানলাটির একদম নীচে দুটি লোহার দণ্ড বেড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এই দণ্ডদুটি হাত দিয়ে নাড়ানো যায়, তবে বের করা যায় না। স্থানীয়দের মতে এটি জাফর খান গাজীর যুদ্ধের কুড়ুল, এবিষয়ে মানিসাহেবও তাঁর জার্নালে এটিই লিখেছেন। জনশ্রুতি অনুসারে এবিষয়ে একটি প্রবাদ রয়েছে "গাজীর কুড়ুল নড়ে চড়ে কিন্তু পরে না"

লোহার হাতল দুটি বেড়িয়ে থাকা - গাজীর কুড়ুল

পূর্বদিকের কক্ষের সমাধি - একটি জাফর খান গাজীর পুত্র বরখান গাজী ও তাঁর দুই পুত্র রহিম খান গাজী ও করিম খান গাজী-র এবং মাজখানে উচ্চতায় কম ও সমতল সমাধিটি কোন এক মহিলার (নাম অজানা)

এবার প্রবেশ করছি মূল আস্তানায়। প্রবেশের পর ডানদিকে রয়েছে কিছু ফুলের বাগান ও দরগাহ লাগোয়া বাইরের উঁচু একটি ভিত্তির উপর একটি কবর তবে এই কবরের বিষয়ে কিছুই জানা যায়নি সম্ভবত এটি অনেক আগের এই মসজিদের খাদিম বা কেয়ারটেকারের ১৮৭২ সালে জোসেফ ডেভিড বেগলারের তোলা চিত্রটিতেও আস্তানার সামনে এই কবরটি দেখতে পাওয়া যায়। কবরের ঠিক দুপাশে রয়েছে দুটি প্রবেশপথ যেটি দরগাহ'র দুটি কক্ষের পৃথক প্রবেশপথ। মাটি থেকে প্রায় তিন ফুট উপরে দরগায় প্রবেশের জন্য রয়েছে পৃথক সিঁড়ি। ডানদিকের অর্থাৎ পূর্বদিকের কক্ষের প্রবেশদ্বার লক্ষ করলেই বোঝা যায় এটিও কোন হিন্দু মন্দিরের অংশ, কারণ প্রবেশদ্বারের খিলানেই রয়েছে অসংখ্য হিন্দু স্থাপত্যের ভাস্কর্য। কক্ষের ভিতরে চারটি সমাধি দেখতে পাওয়া যায়, এর মধ্যে একটি জাফর খান গাজীর পুত্র বরখান গাজী ও অন্যদুটি বরখান গাজীর দুই পুত্র রহিম খান গাজী ও করিম খান গাজী-র। তবে মাঝখানের অবশিষ্ট একটি সমাধি কার সেটি জানা যায়নি, তবে সেটি যে কোন মহিলার তা বোঝার উপায় অন্যান্য সমাধি গুলির থেকে উচ্চতায় এটি কম এবং সমাধির শীর্ষ সমতল। পূর্বদিকের কক্ষ থেকে পশ্চিমদিকের কক্ষে যাওয়ার প্রবেশপথ থাকলেও তা অনেকদিন আগেই লোহার গ্রিল দ্বারা আলাদা করা হয়েছে, তাই পশ্চিমকক্ষে যেতে গেলে প্রথমকক্ষের মতোই দ্বিতীয় কক্ষের মূলপ্রবেশপথ দিয়েই প্রবেশ করতে হবে। দ্বিতীয় কক্ষেও রয়েছে চারটি সমাধি। তাঁর মধ্যে প্রথম সমাধিটি আমাদের আলোচ্য জাফর খান গাজী-র ও বাকি তিনটির মধ্যে দুটি গাজীর পুত্র অইয়ন খান গাজী ও ঘইয়ন খান গাজি-র এবং অবশিষ্ট সমধিটি উগুয়ান খান গাজীর স্ত্রীর

পশ্চিম দিকের কক্ষের সমাধি - জাফর খান গাজী ও তাঁর দুই পুত্র অইয়ন খান গাজী ও ঘইয়ন খান গাজি-র এবং অবশিষ্ট সমতল সমধিটি উগুয়ান খান গাজীর স্ত্রীর

মসজিদের সামনের দিক অর্থাৎ পূর্বদিকের পাঁচটি গম্বুজ

মসজিদের পশ্চিম দিকের অবশিষ্ট একটি গম্বুজ

সমাধিকক্ষ থেকে বেরিয়ে রাস্তাটি ধরে আরও পশ্চিমে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে জাফর খান গাজীর মসজিদ। এটিও যে দরগাহ'র মতো পূর্বের কোন মন্দিরের উপকরণ দিয়ে তৈরি হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় মসজিদের বিভিন্ন অংশে। মসজিদের পূর্বদিকে রয়েছে পাঁচটি প্রবেশপথ এবং উত্তর ও দক্ষিণদিকে একটি করে প্রবেশপথ। মসজিদটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ৭৬ ফুট ৯ ইঞ্চি ও প্রস্থে প্রায় ৩৪ ফুট ৭ ইঞ্চি। স্থাপত্যের দিক দিয়ে দেখতে গেলে পুরো মসজিদটিতে রয়েছে দুটি আইল (প্যাসেজ / করিডোর) বিশিষ্ট প্রার্থনা কক্ষ, যাকে আচ্ছাদন করে ছিল ১০ টি ছোট ছোট গম্বুজপাঁচটি মসজিদের সামনের দিক অর্থাৎ পূর্বদিকে ও পাঁচটি পিছনের দিক অর্থাৎ পশ্চিমদিকে। ছিল বলছি কারণ বর্তমানে ছয়টি গম্বুজ দেখতে পাওয়া যায়। অতীতের কোন এক সময়ে পশ্চিমদিকের চারটি গম্বুজ ভেঙে যায়, তবে তা কোন সময়ে সেটি জানা যায়নি এই গম্বুজগুলির ভার নিয়ে আছে দুটি সারিতে ভাগ করা পাথরের পিলার (স্তম্ভ)।

মসজিদের প্রার্থনা কক্ষের সম্মুখে থাকা প্রধান মিহরাব (সম্প্রতি সাদা রঙ করা)

প্রধান মিহরাবের ডানদিকে থাকা আরও একটি মিহরাব (মিহরাবের বামদিকে থাকা অতীতের কোন শিলালিপির চিহ্ন)

মসজিদের অভ্যন্তরে প্রথম সারিতে রয়েছে ৪ টি ষড়ভুজাকৃতি বিশাল আকারের পাথরের স্তম্ভ এবং দ্বিতীয় সারিতে আকারে সরু ২ টি ষড়ভুজ আকৃতির পাথরের স্তম্ভ। তবে দ্বিতীয় সারিতে উত্তর ও দক্ষিণদিকে আরও যে দুটি স্তম্ভ দেখতে পাওয়া যায় তা ইঁটের তৈরি চতুর্ভুজ আকৃতির, মনে হয় পূর্বেও এটি পাথরের তৈরি ছিল। দুটি করিডোরে ভাগ করা প্যাসেজগুলির মধ্যে মসজিদের প্রবেশের দিকে রয়েছে ৫ টি খিলান। এই পাঁচটি খিলান ও দুটি করিডোরে ভাগ করার ফলেই সৃষ্টি হয়েছে পাঁচটি বর্গক্ষেত্র, যাকে বেষ্টন করে গড়ে উঠেছে দশটি ছোট ছোট গম্বুজ। গম্বুজগুলি তৈরি হয়েছে ইঁট ও পাথরের মাধ্যমে। মসজিদের কিবলার দিকে (যে দিকে মুসলিমরা নামাজের সময় প্রার্থনা করে) রয়েছে ৩ টি মিহরাব। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মজিদের মিহরাবের সংখ্যা ৫ টি, উত্তরদিকে এবং দক্ষিণদিকে যে আরও ২ টি মিহরাব ছিল তা বর্তমানে কিছু ধ্বংসাবশেষ দেখে অনুমান করা যায়

মসজিদে ব্যবহৃত টেরাকোটার অলংকরণে সজ্জিত কুলুঙ্গি

দূরে পশ্চিম দেওয়ালে আয়তকারা অংশ, যা অতীতের কোন এক মিহরাবের ভগ্নাংশ স্থল

মসজিদটি তৈরি হয়েছে পাথর ও ইঁট দিয়ে। ইতিহাসবিদের মতে পাথরগুলি আনা হয়েছে বিভিন্ন মন্দির থেকে। ভারতীয় শিল্পরীতিতে যেভাবে পাথরের উপর পাথর চাপিয়ে মন্দির গঠন হয়, ঠিক সেই প্রযুক্তিতেই মসজিদের পিলারগুলি একের পর এক পাথরের সারিগুলি সাজিয়ে তৈরি হয়েছে। মসজিদের মধ্যবর্তী প্রবেশ পথের উপরে একটি অনুভূমিক প্যানেল, পশ্চিমর দেওয়ালে দুটি উলম্ব উদ্ভিজ প্যানেল গাঁথা দেখতে পাওয়া যায় যা জাফর খান গাজী দরগাহ-তেও চতুর্দিকে দেখতে পাওয়া গেছে এবং এগুলি যে কোনও মন্দিরের অংশ তা তার গঠনপ্রকৃতি দেখেই অনুমান করা যায়। মসজিদের তিনটি মিহরাবের মধ্যে মাঝের অর্থাৎ প্রধান মিহরাবটি পুরোটাই পাথরের তৈরি এবং সম্প্রতি তা সাদা রং করা হয়েছে, তবে উত্তর ও দক্ষিণদিকের মিহরাবগুলিতে পাথরের সঙ্গেও ব্যবহার হয়েছে ইঁটের কারুকার্য। মিহরাবগুলির গঠনপ্রকৃতি দেখে আন্দাজ করা যায় এগুলি কোন মন্দিরের প্রবেশদ্বারের ফ্রেম। মসজিদের প্রথম সারিতে অর্থাৎ প্রবেশের পর প্রথম করিডোরটি মধ্যবর্তী আইলের উত্তরদিক ও দক্ষিণদিকে অংশে বিস্তৃত। দক্ষিণদিকের অংশে বিস্তৃত দেওয়ালে পোড়ামাটির বিভিন্ন অলংকরণ দেখতে পাওয়া যায়, এছাড়াও দেওয়ালের মধ্যিখানে ইঁটের তৈরি একটি কুলঙ্গি চোখে পড়ে। দক্ষিণদিকের দেওয়াল কিন্তু আংশিকভাবে ভেঙে পড়েছে এবং টেরাকোটার কাজও সেরকম চোখে পড়ে না।      

ইতিহাসবিদের মতে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে গড়ে ওঠা ত্রিবেণীর এই জাফর খান গাজী মসজিদ হল বাংলার মসজিদ রীতির নমুনা বা প্রোটোটাইপ। মুঘল মসজিদ ও মুঘল পূর্ব মসজিদ দুটি আলাদা অধ্যায়। মুঘল মসজিদের ক্ষেত্রে যে বড় বড় উল্টানো পেঁয়াজের মত গম্বুজ দেখা যায় (তিনটি অথবা পাঁচটি), মুঘল পূর্বে কিন্তু তেমনটা দেখা যেত না। মুঘল পূর্ব মসজিদ গুলিতে বড় বড় গম্বুজের বদলে থাকতো ছোট ছোট একাধিক গম্বুজ, তাও আবার গোলাকার। মসজিদগুলি তৈরি হত মূলত ইট ও পাথর দিয়ে। আর এই জাফর খান মসজিদ সেইসমস্থ বহুগম্বুজ যুক্ত মসজিদের প্রোটোটাইপ হিসাবে কাজ করেছিল যা দেখে পরবর্তীকালে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় মসজিদ গড়ে ওঠে, যেমন - হুগলীর পান্ডুয়ার বড়ী মসজিদ, গৌড়ের তাঁতিপাড়া মসজিদ 

দরগাহ'র প্রবেশদ্বারের উপরে থাকা চেইন ও ল্যাম্প মোটিফ

তাহলে কি জাফর খান গাজীর মসজিদ কোন হিন্দু মন্দিরের অংশ?

এপ্রসঙ্গে আলোচনার আগে আমাদের দেখতে হবে মুসলিম আধিপত্যের পূর্বে ত্রিবেণীতে কারা শাসন করে গেছে। সময়ের হিসাবে যদি দেখা যায় তাহলে বাংলায় মুসলিম সূচনার আগে রাজত্ব করত সেন বংশীয় রাজারা। তবে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এই অঞ্চলে কিছুদিন উড়িশ্যার রাজবংশও আধিপত্য বিস্তার করেছিল এবং স্থানীয় হিন্দু রাজারা তাতে বাধা দেননি, কারণ মুসলমান অভিযান তখন কাছেই আরম্ভ হয়েছিল। লক্ষণ সেনের রাজত্বকালে ১২০৩ খ্রিষ্টাব্দে (৬০০ হিজরিতে, সাল নিয়ে মতভেদ রয়েছে) সর্বপ্রথম বখতিয়ার খিলজী (ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী) মাত্র ১৮ জন ঘোড়সওয়ার নিয়ে সেন বংশের রাজধানী নবদ্বীপ আক্রমণ করেন যা ত্রিবেণী থেকে ষাট কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। যদিও খলজী তাঁর রাজধানী স্থাপন করে লক্ষণাবতীতে (গৌড়ে)। তাই হতে পারে সেন আমলের শেষের দিকে লক্ষণ সেন নদীয়া ছেড়ে চলে যাবার পরে অনেক স্বাধীন রাজাই এই দিককার বিস্তৃত অঞ্চল দখল করে রাজত্ব চালাচ্ছিল। তাঁদের মধ্যে মান নৃপতি ও ভূদেব নৃপতির নাম পাওয়া যায়। যদিও জাফর খানের সঙ্গে যুদ্ধে ভূদেব নৃপতি যে রীতিমত প্রতিশোধ করেছিলেন তা কুর্সিনামা ও শিলালিপি থেকে বোঝা যায়। কিন্তু কে এই ভূদেব নৃপতি? বা তাঁর অন্য পরিচয় কি? তা জানা যায় না। এবিষয়ে কোন ঐতিহাসিকগণ কিছুই জানাতে পারেননি। তবে মনিসাহেব তাঁর জার্নালে বলছেন এই মান নৃপতি ও ভূদেব নৃপতি হয়তো কোন উড়িয়া রাজা বা জমিদার যারা কিনা উড়িষ্যার রাজপরিবারের সঙ্গে যুক্ত উড়িষ্যার রাজা যে অনেকদিন ধরেই বাংলায় তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছিল তার প্রমাণ হিসাবে দুটি ঘটনা লক্ষ করা যায়। উড়িষ্যার শেষ রাজা মুকুন্দদেব এই ত্রিবেণীতেই তীর্থযাত্রীদের জন্য ঘাট ও মন্দির নির্মাণ করেছিলেন, যা এই মসজিদ থেকে এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, বর্তমান নাম মুকুন্দদেব ঘাট। এছাড়াও ত্রিবেণী থেকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরে শ্রীরামপুরের বিখ্যাত মাহেশের রথযাত্রা (ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীন রথযাত্রা) যা উড়িয়া রাজাদের প্রভাবেই শুরু হয়েছিল। তাহলে অনুমান করা যাচ্ছে মুসলিম আধিপত্যের পূর্বে এই ত্রিবেণী অঞ্চল সেন ও কিছুটা উড়িষ্যা রাজার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এপ্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো মসজিদ ছাড়াও ত্রিবেণীতে বেশ কয়েকটি দেবদেবীর মূর্তি পাওয়া গেছে যার মধ্যে রয়েছে গঙ্গামূর্তি, হরগৌরী মূর্তি, ব্রম্ভামুর, গণেশমূর্তি। মূর্তিগুলি বর্তমানে ত্রিবেণীর মুকুন্দদেব ঘাটে রয়েছে এবং এখনও সেগুলি নিত্য পুজো হয়। এই মূর্তিগুলির গঠন দেখে অনুমান করা যায় এগুলি সেন আমলে তৈরি। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ও চতুর্দশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ত্রিবেণী-সপ্তগ্রাম-পান্ডুয়া-মহানাদ অঞ্চলে যখন প্রথম মুসলমান অভিযান হয় তখন গাজী সাহেবরাই তাতে অংশগ্রহণ করেন। আর এদের মধ্যে জাফর খান গাজী হলেন আদি ও অন্যতম।

ত্রিবেণীর মুকুন্দদেব ঘাটে থাকা গঙ্গামূর্তি, হরগৌরী মূর্তি, ব্রম্ভামুর, গণেশমূর্তি

জাফর খান গাজী দরগাহ'র উত্তর দিকের প্রাচীর - অতীতের পাথরের দরজাটিকে লোহার গ্রিল দ্বারা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে

পাথরের দরজার ফ্রেমে খোদাই করা ক্ষুদ্র দেউল মন্দির। উল্লেখ্য দেবতাদের মুখগুলি ক্ষয়প্রাপ্ত

একসময়ে বাংলার অন্যতম প্রধান তীর্থস্থান 'ত্রিবেণী'-তে হিন্দুরাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি বহু দেবালয় ছিল। তবে এখন সেইসব দেবালয় ও দেবদেবীর বিশেষ কোন অস্তিত্ব নেইজাফর খান গাজী ও তাঁর পরবর্তী যোদ্ধাদের যুদ্ধের সময় সেই সব দেবালয় ও দেবমূর্তি ধ্বংস হয়ে যায়, এবং সেই সব মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের অংশ নিয়ে তৈরি হয় জাফর খান গাজীর মসজিদ ও দরগাহ। যেমনটা তৈরি হয়েছে হুগলীর পান্ডুয়ায় বাইশদরয়াজা মসজিদ এবার যদি আমরা মসজিদ ও দরগাহ'র স্থাপত্যশিল্পের ব্যাপারে দেখি দেখতে পাব আস্তানা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অনেক হিন্দু স্থাপত্য। জাফর খানের সমাধিগৃহগুলির (দরগাহ) প্রবেশদ্বারের দুপাশে এবং পূর্বদিকের দরজাটিতেও (যা বর্তমানে লোহার গ্রিল দ্বারা আবদ্ধ) যে সমস্থ ভাস্কর্যের নিদর্শন খোদাই করা রয়েছে যেমন- যক্ষসহ মন্দিরমধ্যে বিভিন্ন দেবীমূর্তি ও ছোট ছোট রেখা দেউলের মোটিফ সেগুলি সবই কোন হিন্দু মন্দিরের অংশ। এবার যদি আমরা দরগাহ'র ভিতরে প্রবেশ করি তাহলে ব্যাসাল্ট শিলায় তৈরি পশ্চিম কক্ষের দেওয়ালের কয়েকটি অংশে কিছু প্রাচীন শিলালিপি খোদাই করা দেখতে পাব, আর ঠিক এমনই শিলালিপি রয়েছে দরগাহ'র বাইরে উত্তরদিকের অংশেও। এই শিলালিপিগুলি প্রথমে মনিসাহেব পাঠোদ্ধার করেন এবং পরবর্তীকালে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এই পাঠের কিছু সংশোধন করে প্রকাশ করেন। শিলালিপি গুলি একেকটি সংস্কৃত শব্দবন্ধ, তবে লেখার ক্ষেত্রে যে ফন্টটি ব্যবহার করা হয়েছে তা সম্ভবত প্রাক বঙ্গাক্ষর বা প্রোটো-বাংলা (প্রোটো অর্থাৎ প্রায়, পাল ও সেন আমলের সময় এই ভাষায় লিপি লেখা হত)। লিপিগুলি হল

  • সীতাবিবাহঃ
  • খরত্রিশিরয়োর্ব্বধঃ
  • শ্রী রামেন রাবণ বধঃ
  • ভরতাভিষেকঃ
  • শ্রীসীতা নির্বাসঃ
  • শ্রীরামাভিষেকঃ
  • শ্রীকৃষ্ণবাণাসুরয়োর্য
  • ধৃষ্টদ্যুম্ন দুঃশাসনয়োর্ষুদ্ধম্ 
  • চাণুরবধঃ 
  • কংসবধ    

দরগাহ'র পশ্চিম কক্ষের দেওয়ালে থাকা শিলালিপি, উল্লেখ্য কিছু লিপি দেওয়ালে আটকানো হয়েছে উল্টানো অবস্থায়

দরগাহ'র বাইরে উত্তর দিকের দেওয়ালে থাকা আরও শিলালিপি

এইসব টুকরো টুকরো লিপিগুলি দেখে বোঝা যায় যে এগুলি রামায়ণ ও মহাভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এবং আস্তানায় ব্যবহৃত এই শিলাগুলি সম্ভবত কোন হিন্দু মন্দিরের অংশ। মানিসাহেবের মতে এগুলি বিষ্ণু মন্দিরের অংশ। এছাড়াও আস্তানার উত্তর ও পশ্চিম দেওয়ালের বাইরের অংশে অসংখ্য দেবদেবীর মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়, বড় বড় পাথরের খণ্ডের উপরে খোদাই করা হয়েছে গদাধারী বিষ্ণুমূর্তি, নারদ, রাম, কৃষ্ণ-রাধিকা, লক্ষ্মী ইত্যাদি অবতার ও দেবদেবীর মূর্তি। তবে দরগাহ'র উত্তরদিকের দেওয়ালে কল্পলতা, নবগ্রহ / দশাবতার মূর্তিগুলি বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পাথরগুলি যেভাবে গাঁথা হয়েছে তাও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। পাথরগুলি কোন স্থাপত্যের নিয়মানুযায়ী সাজানো বা গাঁথাও হয়নি, বেশিরভাগ মূর্তির প্যানেল উল্টো করে লাগানো হয়েছে। অর্থাৎ বোঝা যাছে যেমন হাতের কাছে পাওয়া গেছে ঠিক তেমনি তাড়াহুড়ো করে কোনরকমে সাজিয়ে গেঁথে দেওয়া হয়েছে এবং এগুলি কখনোই এই মসজিদের অংশ হতে পারে না। কারণ ইসলাম ধর্মে কোন জীবন্ত জিনিসের চিত্রকে হারাম হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ

দরগাহ'র পশ্চিম কক্ষে থাকা পাথরের শিলালিপি যা পূর্বের কোন মন্দিরের খোদাই করা পাথর, উল্লেখ্য শিলালিপির পিছন দিকে খোদাই করা মঙ্গল ঘট, চেন

দরগাহ'র পশ্চিম দেওয়ালের ভিত্তিমূলে - নবগ্রহ / দশাবতার প্যানেল

নবগ্রহ / দশাবতার প্যানেলের পরিষ্কার চিত্র

তবে এসব ছাড়াও দরগাহ'র বাইরের দেওয়ালের নীচের অংশে মুদ্রাবিশিষ্ট / ধ্যানরত্ন বুদ্ধমূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। এবিষয়ে অনেক ঐতিহাসিকগণই এগুলিকে কোন জৈন মন্দিরের অংশ বলে মেনে নিয়েছে। প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এগুলির ব্যাপারে মনে করছেন এগুলি জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের মন্দিরের অংশ দরগাহ'র গঠনপ্রকৃতি দেখে তিনি মনে করেন পূর্বে এটি একটি হিন্দু মন্দির ছিল, যার পূর্বদিকের কক্ষটি ছিল নাটমন্দির বা জগমোহন ও পশ্চিমের কক্ষটি ছিল গর্ভগৃহ। মসজিদের ক্ষেত্রেও এরকম অনেক নিদর্শনই রয়েছে। মিহরাবগুলির গঠনপ্রকৃতি দেখে অনেক ঐতিহাসিকগণই মনে করেন মিহরাবের খিলানের ফ্রেমগুলি কোন মন্দির থেকে নিয়ে আসা। মসজিদের অভ্যন্তরে যে চারটি বিশাল স্তম্ভ রয়েছে সেগুলিও কোন মন্দিরের অংশ, কারণ পিলার গঠনের এই প্রযুক্তি প্রাচীন ভারতীয় মন্দির স্থাপনে ব্যবহার করা হতএছাড়াও মসজিদে আরও কিছু স্তম্ভ দেখতে পাওয়া যায় যেগুলির স্থাপত্যশিল্প দেখেই বোঝা যায় এগুলি মন্দিরের অংশ। আর ঠিক এরকমই অনেক পাথরের স্তম্ভ মসজিদ চত্বরের চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকতেও দেখা যায়। মসজিদের উত্তরদিকের দেওয়ালে খোদাই করা রয়েছে একটি উলম্ব প্যানেল যাতে রয়েছে বিভিন্ন উদ্ভিজ অলংকরণ। আর ঠিক এমনই অনেক প্যানেল রয়েছে দরগাহ'র দেওয়ালে, যা পুনরায় মন্দিরের অংশ এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন টেরাকোটা প্যানেল যা বাংলার নিজস্ব ঘরানার স্থাপত্য।

কল্পলতা প্যানেল  (দরগাহ'র পশ্চিম দেওয়ালে)

দরগাহ'র পশ্চিম দেওয়ালের স্তম্ভমূলে - হিন্দু দেবদেবী

হিন্দু দেবদেবী - দরগাহ'র পশ্চিম দেওয়ালের স্তম্ভমূল

দরগাহ'র পশ্চিম দেওয়ালের একটি প্যানেল - সম্ভবত কৃষ্ণ-রাধিকা

তাহলে সত্যিই কি জাফর খান মসজিদ গড়ে ওঠার আগে সেই জায়গায় কোন হিন্দু মন্দির ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মুশকিল কিছু ঐতিহাসিকগণ স্বীকার করছেন সেখানে মসজিদ স্থাপনের পূর্বে হিন্দু মন্দির ছিল তো কিছু ঐতিহাসিকগণ কয়েকটি প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন। এপ্রসঙ্গে প্রধান যে প্রশ্নটি উঠে আসে তা হল জাফর খান মসজিদ কি কোনও একটি মন্দিরের ভগ্নাংশ নিয়ে গড়ে উঠেছে? তাহলে উত্তর না। কারণ  

প্রথম প্রশ্ন উঠে আসে মসজিদে ব্যবহৃত বিশালাকার পাথর নিয়ে। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে বাংলায় সবসময়ই পাথরের অভাব লক্ষ করা যায়। মন্দির নির্মাণের উপকরণ, আকৃতি, স্থায়িত্ব সবটাই প্রকৃতি নির্ভর। বাংলার বেশিরভাগ অঞ্চলই পলিমাটি অধ্যুষিত। আর সেই কারণেই বাংলার মন্দির নির্মাণে পাথরের পরিবর্তে ইটের ব্যবহার দেখা যায়। যদিও বর্ধমান বা দুর্গাপুর এলাকায় কিছু পাথরের মন্দির রয়েছে। তবে সেক্ষেত্রে একমাত্র উৎস রাজমহল পর্বতমালা যা প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় পাথর জোগানের একমাত্র উৎস, শুধুমাত্র রাজমহল থেকেই এই পাথর বাংলায় আসত। তাই ত্রিবেণীর এই মসজিদ তৈরির ক্ষেত্রে অহেতুক সময়নষ্ট করে সেখান থেকে পাথর নিয়ে আসা অনেকটাই ভিত্তিহীন। এদিকে মসজিদ ও দরগায় ব্যবহৃত পাথরগুলির ধরনও এক নয়। বৈচিত্রের নিরিখে পাথরের ধরনগুলি আলাদা। তাহলে মসজিদ ও দরগায় ব্যবহৃত এই পাথরগুলি এলো কোথা থেকে?

দ্বিতীয়, মসজিদ ও দরগায় ব্যবহৃত মন্দিরের অংশগুলি কোন একটি মন্দিরের নয়, এক্ষেত্রে অনেকেই স্বীকার করেছেন ব্যবহৃত অংশগুলির কিছু বিষ্ণু তো কোথাও জৈন ও বৌদ্ধ মন্দিরের। তাহলে মসজিদ তৈরি হওয়ার পূর্বে এখানে কোন একটি মন্দির থাকা সম্ভব নয়। তাহলে কি এই অঞ্চলে অনেকগুলি মন্দির ছিল?  

দরগাহ'র উত্তর দেওয়ালের একদম শেষের দিকের একটি ব্লক, সম্ভবত নারদ -এর চিত্র

কল্পলতা প্যানেল ( (দরগাহ'র পশ্চিম দেওয়ালে)

দরগাহ কক্ষের একটি কোণে পাথরের ব্লকে খোদাই করা মন্দিরের প্যাটার্ন

তৃতীয়, দরগাহ'র গঠনপ্রকৃতি। কোন মন্দির ধ্বংস করে যদি এই দরগাহ গঠন হয় তাহলে সেখানে শুধুমাত্র একরকম উপাদানই ব্যবহৃত হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে দরগায় পাথর ছাড়াও ব্যবহৃত হয়েছে ইঁট ও পাথরের ক্ল্যাডিং। তাহলে আগেরমতই যে প্রশ্ন উঠে আসে ত্রিবেণীর এই অঞ্চলে কি অনেকগুলি মন্দির ছিল?

চতুর্থ, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করছেন দরগার কক্ষগুলি পূর্বে নাটমন্দির ও গর্ভগৃহ ছিল। এক্ষেত্রে ধরে নেওয়া গেল এই মন্তব্যটি ঠিক। কিন্তু এক্ষত্রে একটি কৌতূহল উঠে আসে তা মন্দিরের ভিত্তিকে কেন্দ্র করে। ব্লগার দীপাঞ্জন ঘোষ সেই প্রশ্নই তুলে ধরেছেন, যদি মন্দিরেই সমাধি দিতে হয় তাহলে সমাধি দেওয়ার আগে অন্তত সেই পাথরে নির্মিত কক্ষের মেঝের পাথরগুলি উঠিয়ে মন্দিরের প্রায় তিন ফুট স্তম্ভমূল ভিত্তি খনন করতে হবে এবং এর পরেও আরও কয়েকফুট খুঁড়ে মাটি বের করতে হবে, তারপর সেই মাটিতে দাফন করে পুনরায় সেই পাথর বসাতে হবে অর্থাৎ যার পুরো কাজটাই কষ্টসাধ্য এবং অহেতুক সময়সাপেক্ষ।

দরগায় ব্যবহৃত পাথরের ভিন্ন ধরন

দরগাহ'র পশ্চিম দেওয়ালে থাকা চেইন এবং ফুল মোটিফ

মসজিদের উত্তর-পূর্ব কোণে থাকা পাথরের স্তম্ভ, যা কোন মন্দিরের অংশ

তবে এক্ষেত্রে প্রথম তিনটি প্রশ্নের উত্তর খানিকটা পাওয়া যায় বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের কাছ থেকে। তাঁদের মতে পূর্বে এই ত্রিবেণী ছিল বাংলার অন্যতম তীর্থস্থান যেখানে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য মন্দির, একদিকে যেমন বিষ্ণু মন্দির ঠিক তেমনই অন্যদিকে ছিল জৈন মন্দির। অতীতে ত্রিবেণী-র সঙ্গে ওড়িষ্যার রাজাদের যোগাযোগ গড়ে ওঠায় তাদের তৈরি মন্দির থাকাও অস্বাভাবিক নয়। মুসলিম অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকেই সেইসব মন্দিরগুলি ধ্বংস হতে শুরু করে এবং বর্তমানে এই মন্দিরগুলির কিছুই অবশিষ্ট নেই, ত্রিবেণী ঘাটে যে মূর্তিগুলির কথা বলেছিলাম সেগুলি হয়তো এইসব মন্দিরেরই অংশ। তবে এটিকে শুধু অনুমান হিসাবেই ধরতে হবে। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে ত্রিবেণীর এই মসজিদ ও দরগাহ তৈরি হওয়ার আগে এখানে একটি মন্দির থাকতে পারে না। আর যদিও বা থাকে সেক্ষেত্রে মসজিদ নির্মাণে শুধুমাত্র একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ব্যবহার হয়নি। এক্ষেত্রে এরূপ পরিকল্পনা করা যেতে পারে যে জাফর খান গাজীর মসজিদ ও দরগাহ তৈরি হওয়ার পূর্বেই অনেক মন্দির ধ্বংস হয়েছিল। মসজিদ ও দরগাহ স্থাপনের সময় সেইসব ধ্বংসগুলি একত্রীকরণ করা হয় এবং সেই অংশগুলি দিয়েই মসজিদ ও দরগাহ স্থাপন করা হয়। যার ফলে এই মসজিদ ও দরগায় এতগুলি মন্দিরের চিহ্ন পাওয়া যায়। এবিষয়ে আচার্য যদুনাথ সরকার ত্রিবেণীর এই জাফর খানের কীর্তিস্তম্ভকে বলেছেন a museum of Muslim Epigraphyএবং তাঁর এই কথার সঙ্গে বিশিষ্ট লেখক বিনয় ঘোষ মহাশয় আরও একটু যুক্ত করে বলেছেন and of Hindu Sculptureআর সত্যই জাফর খান মসজিদ ও দরগাহ মুসলিম শিলালিপি এবং হিন্দু মন্দির ও মূর্তি-ভাস্কর্যের মিউজিয়াম।

মসজিদের পশ্চিম দেওয়ালে চেইন এবং ফুলের মোটিফ

দরগাহ'র পশ্চিম কক্ষের দরজার ফ্রেমে খোদাই করা মঙ্গলঘট

দরগাহ'র পশ্চিম দিকের দেওয়ালের ভিত্তিমূলে যুদ্ধের দৃশ্য ও তার উপরে লেখা সংস্কৃত শ্লোক

সত্যই জাফর খান গাজী কে? এবং কীভাবে তিনি এই মসজিদ তৈরি করলেন? তা কিন্তু পুরোপুরি এখনও জানা সম্ভব হয়নি। শুধুমাত্র অনুমানের ভিত্তিতে কিছু মতামত উঠে আসে। শুরুর দিকে জাফর খান গাজী যে একজন ধর্মযোদ্ধা ছিলেন তার প্রমাণ কিছু পাওয়া যায়, কিন্তু তার সাথে জড়িয়ে থাকা বিভিন্ন কীর্তিকলাপ যে কতটা সত্য তা জানা যায়না। সময়ের সাথে সাথে ইতিহাসও পরিবর্তন হতে থাকে, এর একমাত্র কারণ তথ্যের বিকৃতি। সাধারণত যে অনুমান সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য তাই ইতিহাসে স্থান পায়। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এই তথ্যের সত্যতা যাচাইকরণের জন্য কিছুই অবশিষ্ট নেই। সময়ের সাথে সাথে জাফর খান গাজীর মসজিদ যে একটি সম্পূর্ণরূপে মিউজিয়ামে পরিণত হয়েছে তা মসজিদে স্থাপন করা শিলালিপিগুলি দেখেই অনুমান করা যায়, কারণ অনেক শিলালিপি এই মসজিদের নয়। মসজিদ তৈরি হওয়ারও বহু বছর পর এগুলি স্থাপন করা হয়েছে। কে করেছে? কীভাবে করেছে? তাও জানা যায়নি এবং ক্রমেই সেই তথ্যের বিকৃতি ঘটতে থাকছে।

জন্মিলে মরিতে হবে / অমর কে কোথা কবে

সৃষ্টির সময় থেকেই দেখা গেছে পুরনো যা কিছু স্থাপত্য আছে নতুনের আগমনে তা ধ্বংস হয়েছে। সাধারণত রণক্ষেত্রে বিজেতারা তাদের আধিপত্য স্থাপন করতে চান। তিনি যে পুরাতন রাজতন্ত্রের থেকে বেশি ক্ষমতাশালী তা বিশ্ব কে দেখিয়ে দিতে চান। দেখা গেছে এসব ক্ষেত্রে তারা পুরাতন শাসনকর্তার যা কিছু স্থাপত্যশৈল পাবে সবকিছুরই ধূলিসাৎ করে নতুন বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করবে। এক্ষেত্রে মন্দির কিন্তু প্রথম তালিকায় থাকে, এর অন্যতম কারণ মন্দিরে সঞ্চিত ধনসম্পদ। সেই সুদূর কাল থেকেই মানুষ দেবদেবীদের উদ্দেশ্যে মুক্ত হস্তে দান করেন, আর এই ধনসম্পদ গুলিই সঞ্চিত থাকে মন্দিরের কুঠুরিতে। তাই প্রাচীনকাল থেকেই মন্দিরের ধনসম্পদ লুঠ বা মন্দিরে ডাকাত পরা সাধারণ ব্যাপার। ঠিক যেমনটি ঘটেছিল হাওড়ার ঘুশুড়ীর ভোটবাগান মঠে। তবে এইসব লুঠপাঠ, মন্দির ধ্বংস কিন্তু ইসলামে নতুন নয়। এক্ষেত্রে ত্রিবেণীর এই জাফর খান গাজীর মসজিদ ও দরগাতেও তাই ঘটেছে। কিন্তু এসবই এখন ইতিহাস। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে অতীতের এই মন্দির-মসজিদ-দরগাহ পুনর্নির্মাণের কারণ অনুসন্ধানে না গিয়ে একে ঐতিহাসিক গুরুত্বের দিক দিয়ে দেখাই আমাদের উচিত। সময়ের দিক দিয়ে দেখতে গেলে ৭২৩ বছর পেরিয়ে গেছে এই মসজিদ তৈরি হয়েছে, কিন্তু বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়েও এটি এখনও একটি সক্রিয় ধর্মীয়স্থল। যেখানে নামাজ পড়তে আসা মুসলিম ও প্রার্থনা জানাতে আসা হিন্দু পাশাপাশি অবস্থান করে। ধর্ম যে মানুষকে একত্রিত করতে চায় তার একমাত্র উদাহরণ এই জাফর খান গাজীর মসজিদ ও দরগাহ। যেখানে এখনও বাংলার দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসেন শুধুমাত্র গাজীকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে। বর্তমান কালে গাজীর মসজিদ ও দরগাহ হিসাবে পরিচিতি পেলেও স্থানীয়দের কাছে কিন্তু এটি গাজী সাহেব কা আস্তানা নামেই পরিচিত।

দরগাহ'র বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথরের স্তম্ভ, সম্ভবত মন্দিরের অংশ

আস্তানায় থাকা দুটি সমাধি, অতীতের কোন খাদেমদের

আস্তানায় থাকা আরও দুটি সমাধি

আস্তানার বাইরে গাছপালার আড়ালে থাকা সমাধি

জাফর খান গাজী দরগাহ'র সামনে হুগলী নদী (গঙ্গা)

** ব্লগটি লিখতে গিয়ে যে সমস্থ বই থেকে তথ্যের সাহায্য নিয়েছি সেই সমস্তটাই নিচে উল্লেখ করলাম। পাঠকদের অনুরোধ করব ব্লগটি পড়ে কোনোরূপ ধর্মীও ভেদাভেদ যেন সৃষ্টি না হয়। অনুরোধ করব এটিকে যেন শুধুমাত্র ঐতিহাসিক তাৎপর্যের দিক দিয়ে দেখা হয়

******************************************************

লেখা, গবেষণা ও ছবি - প্রীতম নস্কর  

ই-মেল - pritamnaskar.pn@gmail.com

ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে ব্লগের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, তবে পূর্বানুমতি ছাড়া আমার তোলা আলোকচিত্রগুলি এবং ব্লগের রচনাগুলি অন্য কোথাও কপি-পেস্ট বা বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করা চলবে না।

******************************************************

সময়সূচী

যেহেতু এটি একটি সক্রিয় ধর্মীয় স্থান তাই বছরের প্রায় সমস্ত দিনই সকাল থেক সন্ধ্যে মসজিদ ও দরগাহ খোলা থাকে। মনে রাখবেন যেহেতু এটি সক্রিয় ধর্মীয় স্থান তাই মসজিদ ও দরগায় প্রবেশের আগে অবশ্যই জুতো খুলে প্রবেশ করবেন।

কীভাবে যাবেন

  • ট্রেনযাত্রা - হাওড়া থেকে মেনলাইনগামী কাটোয়া যাওয়ার ট্রেনে উঠে নামতে হবে ত্রিবেণী স্টেশন, সময় লাগবে প্রায় ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট। স্টেশন থেকে নেমেই বাইরে দেখা মিলবে টোটো / রিকশা। যেকোনো একটিতে উঠে বলতে হবে গাজী সাহেবের আস্তানা যেতে চান। টোটোতে সময় লাগবে মিনিট পাঁচেক। আর স্টেশন থেকে হেঁটে গেলে সময় লাগবে প্রায় ১৫ মিনিট
  • সড়কপথে - প্রথমে হাওড়া থেকে বালি। সেখান থেকে দিল্লী রোড ধরে প্রথমে মগরা। মগরা ফ্লাইওভার ধরে বাঁশবেড়িয়ার ঝুলনিয়া মোড়। সেখান থেকে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে রাস্তা ধরে ঈশ্বর গুপ্ত সেতুতে ওঠার আগে ডানদিকে পাবেন হংসেশ্বরী মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা। তবে ডান দিকের রাস্তায় না গিয়ে আপনাকে যেতে হবে বামদিকের রাস্তায়। রাস্তার নাম বাঁশবেড়িয়া রোড / ত্রিবেণী-শিবপুর রোড, হুগলী নদীর ধার ধরে সেই রাস্তাটিই সোজা চলে গেছে ত্রিবেণী ঘাট। তবে গঙ্গার ঘাটে পৌঁছানোর কিছুটা আগেই বামদিকে পরবে জাফর খান গাজী মসজিদ ও দরগাহ।

গুগল ম্যাপ / কোঅরডিনেট -

তথসূত্র 

  • Notes on Arabic and Persian inscriptions in the Hugli district. Journal of the Asiatic Society of Bengal - Blochmann, H. (1870)
  • An account of the temple of Tribeni near Hugli. Journal of the Asiatic Society of Bengal - Money, D.(1847)
  • Mosque Architecture of Pre-Mughal Bengal – by Syed Mahmudul Hasan
  • The Many Lives of Zafar Khan, Ghazi of Tribeni – Sudipta Sen (University of California, DAVIS)
  • Biographical Encyclopaedia of Sufis in South Asia – N. Hanif
  • History of Bengal Vol. II – Sir Jadunath Sarkar (Ed.)
  • Bengal District Gazetteers Hooghly - O’Malley, L.S.S.
  • দরাপ খাঁ গাজী সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
  • বাঙ্গলার ইতিহাস (দ্বিতীয় খন্ড) - শ্রী রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
  • হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ সুধীরকুমার মিত্র
  • পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি বিনয় ঘোষ
  • The Concrete Paparazzi

ত্রিবেণী ও চুঁচুড়া-র নিকটবর্তী কিছু দর্শনীয় স্থান

Comments