হংসেশ্বরী ও অনন্তবাসুদেব মন্দির, বাঁশবেড়িয়া । Hangseshwari & Ananta Basudeba Temple, Bansberia

বাংলা থেকে প্রায় ৬৫০০ কিলোমিটার দূরে রাশিয়ার মস্কো শহরে গড়ে ওঠা সেন্ট বেসিল ক্যাথিড্রাল। রেড স্কোয়ার চত্বরে গড়ে ওঠা সুউচ্চ এই গির্জা একটি রুশ অর্থোডক্স গির্জা, যা পাশ্চাত্য শিল্পকলার এক অপরূপ নিদর্শন। ১৫৬১ খ্রিষ্টাব্দে গড়ে ওঠা এই গির্জা ছিল সে সময়কার শহরের সবচেয়ে উঁচু ভবন। তবে এই গল্প রাশিয়াকে নিয়ে নয়, বাংলাকে নিয়ে।

বাংলা থেকে ঠিক যতটা দূরত্বে যাওয়া হয়েছিল, সময়ের গতিতে আবার সেই মস্কো থেকে ফিরে এলাম বাংলায়। হুগলী জেলার জনপ্রিয় একটি অঞ্চল বাঁশবেড়িয়া, যেখানে গড়ে উঠেছে দুটি অপরূপ মন্দির, একটি হংসেশ্বরী মন্দির অন্যটি অনন্ত বাসুদেব মন্দির। বাঁশবেড়িয়া-র হংসেশ্বরী মন্দির প্রায় ৭০ ফুট উঁচু, এই মন্দিরের স্থাপত্য নির্মাণে রয়েছে মিশ্র পাশ্চাত্য শিল্পকলার অনুপ্রেরণা মস্কোর যে সেন্ট বেলস গির্জার কথা বলছিলাম অনেকটা তার সঙ্গেই মিল পাওয়া যায় বাঁশবেড়িয়ার এই হংসেশ্বরী মন্দিরের অন্যদিকে বাংলার নিজস্ব শিল্পরীতি টেরাকোটার (পোড়ামাটির) শিল্পে গড়ে ওঠা অনন্ত বাসুদেব মন্দির, যা একটি একরত্ন প্রকৃতির। একদিকে পাশ্চাত্য শিল্পকলা অন্যদিকে বাংলার নিজস্ব শিল্পরীতি। আর এসব মন্দির গড়ে তোলার সঙ্গে যে পরিবারের নাম জড়িয়ে রয়েছে তাঁরা হলেন বাঁশবেড়িয়ার সর্বপ্রাচীন রাজবংশ দত্ত বংশ, যাদের হাত ধরেই এই বাঁশবেড়িয়া গ্রামের সূত্রপাত। আজকের এই ব্লগ মূলত এই রাজবংশ ও তাঁদের সৃষ্টি এই দুই মন্দিরকে নিয়ে...

বামদিকে - বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দির, ডানদিকে - মস্কোর সেন্ট বেসিল ক্যাথিড্রাল

বাঁশবেড়িয়ার ইতিহাস 

হাওড়া থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে হুগলী নদীর তীরে গড়ে ওঠা বাঁশবেড়িয়া অঞ্চল বর্তমানে হুগলী জেলার অন্তর্গত। সপ্তগ্রাম বা সাতগাঁও এর সাতটি গ্রামের মধ্যে অন্যতম প্রধান গ্রাম এই বাঁশবেড়িয়া। যদিও পূর্বে এর নাম ছিল "বংশবাটী"। বাঁশবেড়িয়া অর্থাৎ বাঁশের বেড়া। ঐতিহাসিকদের মতে পূর্বে হুগলী নদীর এই অংশে ছিল অনেক বাঁশঝাড় / বাঁশবন। পরবর্তীকালে স্থানীয় জমিদার (রাজামহাশয়) বাঁশবেড়িয়ার নিজের কাছারি বাড়ি তৈরি করার নির্দেশ দিলে, সমস্থ বাঁশঝাড় সাফ করে তৈরি হয় পরিখাবেষ্টিত (যা লোকমুখে গড়বেষ্টিত) এক পেল্লায় রাজবাড়ি। বাঁশ কেটে বাটী অর্থাৎ বাড়ি, তাই জায়গার নাম হয়ে গেল বংশবাটী। বাঁশঝাড় কাটলেও তা সম্পূর্ণরূপে কেটে ফেলা হয়নি, রাজবাড়ি চত্বরের চারিদিকে ইচ্ছা করেই রাখা হয়েছিল বাঁশঝাড়। শুধুমাত্র পরিখা নয়, এই বাঁশঝাড়ের বেড়া বাইরের শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধে দুর্ভেদ্য বূহ্যের কাজ করত। আর এই বাঁশের বেড়া -র সূত্র ধরেই  পরবর্তীকালে "বংশবাটী"-র অপভ্রংশ দাঁড়াল "বাঁশবেড়ে", যা চলতি কথায় এখন "বাঁশবেড়িয়া"এবার প্রশ্ন জাগতেই পারে কে এই এই স্থানীয় জমিদার? আর কেনই বা তিনি এখানে রাজবাড়ি স্থাপন করলেন?

রাজপরিবারের বংশতালিকা

বংশবাটী রাজবাড়ি ও বাঁশবেড়িয়া রাজপরিবার 

বাঁশবেড়িয়ার ইতিহাস ঘাঁটলে যে প্রাচীন জমিদার বংশের নাম দেখতে পাওয়া যাবে তা হল দত্ত বংশ। "দ্যা বাঁশবেড়িয়া রাজ" -এর লেখক জানাচ্ছেন, এরা হলেন জাতিতে উত্তররাঢ়ীয় কায়স্থ, আদি পুরুষ দেবদত্ত, কনৌজ ছেড়ে আদিশূরের সময় বাংলাতে আসেন। বাংলায় এসে পৌঁছান মুর্শিদাবাদেগড়ে তোলেন তাঁদের নিজস্ব বাসস্থান দত্তবাটি কিন্তু পরবর্তীকালে বাংলায় মুসলিম শাসনকালের সূত্রপাত হলে এই দত্ত বংশের এক শাখা দ্বারকানাথ দত্ত মুর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে আসেন বর্ধমানের পাটুলি গ্রামে। বাংলায় তখন যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল, সেটাকে বন্ধ করার জন্য সম্রাট আকবর জমিদারি / জমদারী ব্যবস্থা চালু করেন। মোগল দরবার থেকে দ্বারকানাথের পৌত্র সহস্রাক্ষ -কে ১৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম ফরমান জারি করে জমিদারি হিসাবে ঘোষণা করা হয়। পরে সহস্রাক্ষের পুত্র উদয় দত্ত জমিদার স্বরূপ আকবরের কাছ থেকে রায় উপাধি পাওয়ায় উদয় দত্ত হয়ে যায় উদয় রায়। আবার এই উদয় রায়ের পুত্র জয়নন্দ রায় মোগল সম্রাট শাহাজাহানের কাছ থেকে মজুমদার উপাধি ও জায়গীর স্বরূপ পান আরও কিছু জমিজমা।

পূর্বে রাজবাড়ির উত্তরদিকের অংশ (সৈজন্যে - দ্যা বাঁশবেড়িয়া রাজ বইয়ের লেখক)

রাজবাড়ির উত্তরদিকের বর্তমান অবস্থা

উদয় দত্ত (রায়) -এর পুত্র জয়নন্দ রায় মারা গেলে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র রাঘব রায় জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব তুলে নেয় নিজের কাঁধে। আর এখান থেকেই সূত্রপাত হয় বাঁশবেড়িয়ার অধ্যায়। ঠিকমতো জমিদারির দায়িত্ব পালন করায় রাঘব রায় ১৬৪৯ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লীর সম্রাট শাহজাহান এর কাছ থেকে উপহার স্বরূপ করমুক্ত ২১ টি পরগনার জমিদারি ও সঙ্গে চৌধুরী এবং পরবর্তীকালে মজুমদার উপাধি পান। আর এই একুশটি পরগনা পরিচালনা করার জন্য রাঘব রায় চলে আসেন হুগলীর এই স্থানে। হুগলীর এই অঞ্চল তখন মোটামুটি বাঁশঝাড়ে পরিপূর্ণ। কিন্তু কর্তার আদেশ কাছারিবাড়ি বানানো হবে বলে জোর কদমে চলল ঝাড় পরিষ্কার। ওই যে বলেছিলাম বাঁশ ঝাড় কেটে তৈরি হল বাড়ি, রাঘব রায় সেই বাড়ির নাম রাখলেন বংশবাটী। জমিদারি তদারক করার প্রয়োজনে রাঘব রায় থেকে গেলেন বাঁশবেড়িয়াতেই। বর্ধমানের পাটুলির সঙ্গে তখনও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেননি, দুর্গাপুজোর সময় প্রায়ই ঘুরে আসতেন তাঁর পৈতৃক বাড়িতে পরবর্তীকালে রাঘব রায়ের মৃত্যু হলে তাঁর সম্পত্তি ভাগ হয়ে যায় তাঁর দুই ছেলে রামেশ্বর ও বাসুদেবের মধ্যে। ছোট ছেলে বাসুদেব চলে আসে শেওরাফুলি, যেখান থেকে সুত্রপাত হয় শেওরাফুলি রাজবংশ। আর জ্যেষ্ঠপুত্র রামেশ্বর থেকে যায় বংশবাটী, যেখান থেকে শুরু হয় বংশবাটী রাজবংশ

বর্তমান রাজবাড়ি

রাজা রামেশ্বর রায় মহাশয় 

যেহেতু সেই সময় বাঁশবেড়িয়ায় তেমন কোন বসতি ছিল না, সেহেতু রামেশ্বর বিভিন্ন জায়গা থেকে নানা সম্প্রদায়ের মানুষদের আহ্বান জানালেন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, কায়স্থ একে একে সবাই বসবাস স্থাপন করতে থাকলে গড়ে ওঠে এক একটি পাড়া। বিভিন্ন সম্প্রদায় ছাড়াও রামেশ্বর নিয়ে এসেছিলেন বেশকিছু পাঠান যোদ্ধা, যাদের উপর ছিল প্রতিরক্ষার দায়িত্ব। শিক্ষার প্রসারের জন্য রামেশ্বর শুরু করল একাধিক টোল ও চতুষ্পাঠী তথ্য অনুযায়ী তিনি ৪৫ টি টোল ও চতুষ্পাঠী স্থাপন করেন। বেনারস থেকে নিয়ে আসা হয় একধিক পণ্ডিত। সংস্কৃত শিক্ষার পাশাপাশি চলতে লাগল সাহিত্য, বেদ, দর্শন, ন্যায়-শাস্ত্র। বেনারসের প্রসিদ্ধ পণ্ডিত রামশরন তর্কবাগীশ ছিলেন রামেশ্বরের সভাপণ্ডিত। তর্কবাগীশ ছাড়াও বাঁশবেড়িয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় সেইসব চতুষ্পাঠীগুলির পণ্ডিতদের মধ্যে ছিল রামভদ্র সিদ্ধান্ত, রামচন্দ্র বাচস্পতি, আত্মারাম ন্যায়লঙ্কার প্রমুখ। তবে পরবর্তীকালে ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে ন্যায়শাস্ত্রে পণ্ডিত  শ্রীনাথ তর্কলঙ্কারের মৃত্যুর সাথে সাথে বাঁশবেড়িয়ার এই অধ্যায়ের অবসান ঘটে।

সনদ

সময় ১৬৭৩ খ্রিষ্টাব্দ, বাংলায় তখন মুসলমান রাজত্বের প্রভাবে চরম বিশৃঙ্খলা। দিল্লীর সিংহাসনে তখন সম্রাট ঔরঙ্গজেব। সম্রাটের কাছে খবর গেল বাংলার জমিদার-রা তাদের বকেয়া রাজস্ব দিল্লীতে পাঠাতে চায় না, আর এই নিয়েই চলতে থাকে অরাজকতা। তবে এদের বিরুদ্ধে গিয়ে আর এক জমিদার, সে আর কেউ নয় আমাদের রামেশ্বর রায় সম্রাটের বিশ্বাস অর্জন করে ফেলে। রামেশ্বর অন্যন্য জমিদারদের বিরুদ্ধে সৈন্য চালনা করে তাদের জমিদারি দস্তগত করেন এবং যথাসময়ে রাজ দরবারে রাজস্ব প্রেরণ করেন। রামেশ্বরের এই রাজভক্তিতে খুশি হয়ে সম্রাট ঔরঙ্গজেব ১৬৭৩ খ্রিষ্টাব্দে রামেশ্বর-কে সম্মানস্বরূপ পঞ্জ-পর্চা খেলাৎ ও বংশানুক্রমে রাজা মহাশয় উপাধিতে ভূষিত করেন। আর সেই থেকেই রামেশ্বর রায় হয়ে যান রাজা রামেশ্বর রায় মহাশয়। রামেশ্বরের এই রাজ উপাধি বংশানুক্রমে রক্ষা করার জন্য সম্রাট আরও একটি সনদ পাঠান, যার দ্বারা রামেশ্বর বংশবাটীর ৪০১ বিঘা নিস্কর জমি ও ১২ টি পরগণার জমিদারিত্ব লাভ করেন। এই বারোটি পরগণার মধ্যে ছিল আমাদের কলিকাতা। অবশ্য সে জমি হাতছাড়া হয়ে যায়, ১৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে রামেশ্বরের জীবৎকালেই মুঘল সম্রাট মারফৎ কলিকাতা চলে যায় ইংরেজদের কাছে, আর এই কলিকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুর নিয়েই গড়ে ওঠে এখনকার কলকাতা বংশবাটী রাজবংশের যে অগ্রগতির সূত্রপাত হয়েছিল তা রাজা রামেশ্বর রায় মহাশয়ের হাত ধরেই। বাইরের আক্রমণ থেকে সুরক্ষার জন্য রামেশ্বর বংশবাটীর চতুর্দিকে এক বিশাল পরিখা খনন করে গড়ে তোলেন দুর্গ, যার চতুর্দিকে ছিল বাঁশের বেড়া। দুর্গের সুরক্ষার দায়িত্বে ছিল পাঠান যোদ্ধা, যাদেরকে রামেশ্বরই গ্রামে বসবাস করার সুযোগ করে দেয়। আর এই দুর্গ থাকার ফলেই লোকমুখে সেটি গড়বাটী হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিল। দুর্গের চিহ্ন যদিও বর্তমানে কিছুই নেই, তবে রাজবাড়ির এক তোরণ কিন্তু এখনও দেখতে পাওয়া যায়, যা সম্ভবত অতীতে দুর্গের কোন প্রবেশদ্বার। 

তোরণদ্বার

তোরণদ্বারের পিছনদিকের অংশ

মন্দির ও রাজবাড়ি চত্বরের চতুর্দিকে পরিখা (ডানদিকে হুগলী নদী)

রাজবাড়ির চারিপাশে এখনও একটি পরিখা দেখতে পাওয়া যায়। তবে এবিষয়ে আরও একটি মতবাদ রয়েছে। বিভিন্ন সূত্র ধরে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তা হল রাজবাড়ির চারিপাশে এখন যে পরিখাটি দেখতে পাওয়া যায় সেটি তৈরি করেন রামেশ্বরের পুত্র রঘুদেব রায়। পরবর্তীকালে রামেশ্বরের মৃত্যুর পর জমিদারি দেখাশোনার ভার যখন তাঁর বড় ছেলে রঘুদেব রায় -এর উপর এসে পড়ে, তখন রাজা রঘুদেব বংশবাটী কে আরও ভালোভাবে সুরক্ষিত করার জন্য রাজবাড়ির চারিপাশে আরও একটি পরিখা খনন করেন। বাংলায় যখন বর্গী আক্রমণ হল তখন এই পরিখার কারণেই বাঁশবেড়িয়ার রাজা মারাঠাদের পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। আর এই পরিখাই বর্তমানে মন্দির ও রাজবাড়ি চত্বরের চারিপাশে দেখতে পাওয়া যায় সম্ভবত রামেশ্বরের খনন করা পরিখা সময়ের সাথে বিলুপ্ত হয়েছিল। তবে আদেও সে পরিখা কাটা হয়েছিল কিনা তা নিয়েও সংশয় আছে। The Bansberia Raj – গ্রন্থের লেখক Shumboo Chunder Dey মহাশয়ের মতে বাংলায় যখন বর্গী আক্রমণ হল, তখন রামেশ্বরের তৈরি পরিখা ও বাঁশের বেড়া এক দুর্ভেদ্য বূহ্যের কাজ করেছিল। কিন্তু গণ্ডগোলটা এখানেই। কারণ বাংলায় প্রথম বর্গী বা মারাঠা আক্রমণ হয় ১৭৪১ খ্রিষ্টাব্দে, আর রামেশ্বর মারা যান অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে। তাই রামেশ্বরের পরিখা আর বর্গী আক্রমণ তত্ত্বটা একটু গোলমেলে। হতে পারে রামেশ্বর পরিখা খনন করেছিল, তবে তা মারাঠা আক্রমণ প্রতিরোধে নয় বরং ডাকাতিদের হাত থেকে রক্ষা পেতে। কারণ, যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সে সময়ে নদীর সীমান্ত এবং জঙ্গল এলাকায় লুঠপাঠ, ডাকাতি ছিল সাধারণ ঘটনা।

অনন্ত বাসুদেব মন্দির, বাঁশবেড়িয়া

অনন্ত বাসুদেব মন্দির 

রাজা রামেশ্বর একদিকে ছিলেন যেমন জ্ঞানী, সাহসী; অন্যদিকে হিন্দুধর্ম ও দেবদেবীদের উপরও ছিল তাঁর চরম আস্থা। এই বাঁশবেড়িয়াতেই তাঁর বংশবাটীর পাশে তৈরি করলেন বিষ্ণু মন্দির, যা আনন্ত বাসুদেব মন্দির বা বাসুদেব মন্দির নামে পরিচিত। মন্দিরটির বৈশিষ্ট্য হল মন্দিরটি একরত্ন ও পোড়ামাটির অর্থাৎ টেরাকোটার অলংকরণে গঠিত। ঠিক যেমন গুপ্তপাড়ার রামচন্দ্রের মন্দির। তবে বাঁশবেড়িয়ার এই বাসুদেব মন্দিরের দেবতা স্বয়ং বিষ্ণু। রাজা রামেশ্বর কবে এই মন্দির তৈরি করেন সে প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে মন্দিরের গায়েই কষ্টিপাথরের একটি ফলকে। যেখানে খোদাই করা আছে প্রাচীন বাংলায় একটি শ্লোক 

"মহীব্যোমাঙ্গ শীতাংশু গণিতে শকবৎসরে।

শ্রীরামেশ্বর দত্তেন নির্মমে বিষ্ণুমন্দিরং।।"

বাসুদেব মন্দির প্রতিষ্ঠার ফলক

মহীব্যোমাঙ্গ শীতাংসু, শব্দগুচ্ছকে যদি ভাঙা যায় তাহলে পাওয়া যাবে মহী ব্যোম অঙ্গ শীতাংসু। এবারে মনে করা যাক ছোটবেলা্য সেই অক্ষরমালা শেখা। যেখানে ছিল এক এ চন্দ্র, দুই এ পক্ষ ইত্যাদি। এবারে সেই অক্ষরমালা হিসাবেই এখানে সংখ্যা পাওয়া যাবে। যেমন মহী অর্থাৎ পৃথিবী। যেহেতু পৃথিবী একটি তাই এখানে = ১। বোম অর্থাৎ আকাশ অর্থাৎ =০। অঙ্গ (পুরাণ মতে মানুষের অঙ্গ ছয়টি) =৬। শীতাংশু অর্থাৎ চন্দ্র =১। তাহলে দাঁড়াল গিয়ে ১০৬১। কিন্তু নাঃ, এই সংখ্যার অবস্থান ভুল, কারণ প্রাচীনকালে মুনিঋষিরা যে নীতি ব্যবহার করত তা হল অঙ্কস্য বামাগতি। এই নীতি অনুযায়ী সংখ্যাটি পড়তে হবে ডানদিক থেকে বামদিকে। অর্থাৎ এখানে সংখ্যাটি হবে ১৬০১ শকাব্দ। যেহেতু শকাব্দ ও খ্রিষ্টাব্দের সময়কালের অন্তর ৭৮, তাই এখানে সালটি হবে ১৬৭৯। অর্থাৎ শ্লোকটির মানে হল - ১৬০১ শকাব্দে শ্রী রামেশ্বর দত্ত কর্তৃক এই বিষ্ণু মন্দির নির্মাণ হল। লক্ষ করলে খেয়াল করবেন সম্রাট কর্তৃক মজুমদার, রায়, রাজা মহাশয় এতগুলি উপাধি পাওয়ার পরও মন্দিরের প্রস্তরলিপিতে রামেশ্বর কিন্তু তাঁর পারাবারিক পদবি ব্যবহার করেছেন।

মন্দিরে বিগ্রহ - বাসুদেব (ডানকোণে - বিষ্ণু, বামকোণে লক্ষ্মী)

ত্রিখিলান যুক্ত প্রবেশদ্বার

মন্দিরের গঠন প্রকৃতি নিয়ে বলতে গেলে, মন্দিরটি একরত্ন ও টেরাকোটার অলংকরণে সমৃদ্ধ। মন্দিরটি তৈরি হয়েছে উঁচু একটি ভিত্তিবেদীর উপর। মন্দিরটি দৈর্ঘ্য ৩৫ ফুট ৮ ইঞ্চি ও প্রস্থ ৩২ ফুট ৪ ইঞ্চি। গর্ভগৃহে ঢোকার দুটি প্রবেশদ্বার হলেও মন্দিরের তিনদিকে রয়েছে তিনটি খিলানযুক্ত অলিন্দ। গর্ভগৃহে রয়েছে পাথরের বাসুদেব / বিষ্ণু মূর্তি। মন্দিরের গায়ে রয়েছে অসংখ্য টেরাকোটার ফলক। যার মধ্যে দেখা যায় বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি ও পৌরাণিক কাহিনী। কালী, শিব, মহিষাসুরমর্দিনী রূপে দেবী দুর্গা, রাধাকৃষ্ণের রাসলীলা ইত্যাদি পৌরাণিক কাহিনী যেমন ফুটে উঠেছে, ঠিক তেমনি তখনকার সামাজিক চিত্রগুলি, যেমন  নৌকাবিলাস, সমুদ্রযাত্রা, অশ্বারোহী সৈন্য, যুদ্ধের চিত্র, পালকি বোঝাই লাঠিয়াল আরও অনেক ফলকচিত্র। মন্দিরের এই পোড়ামাটির ফলকগুলির কারুকার্য এতোটাই অপরূপ ছিল যে ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার তৎকালীন ছোটলাট স্যার জন উডবার্ন মন্দিরটি দেখে খুবই প্রশংসা করেছিলেন। আচ্ছা ছিল বলছি কারণ, বর্তমানে মন্দিরের অনেক টেরাকোটার ফলক-ই কালের নিয়মে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। মন্দিরের পশ্চিমদিকের অংশ একসময় যে এই পোড়ামাটির অলংকরণে সমৃদ্ধ ছিল তা এখন বিন্দুমাত্র বোঝার উপায় নেই। শোনা যায় নব্বইয়ের দশকে শুরুর দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বাসুদেব মন্দিরের টেরাকোটার অলংকরণ দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁর ছাত্র নন্দলাল বসুকে পাঠান। সহজপাঠ বইতে যার আঁকার সাথে আমাদের প্রথম পরিচয় সেই নন্দলাল বসু প্রায় এক মাস বংশবাটীতে থেকে মন্দিরের প্রত্যেকটি টেরাকোটার ফলকগুলি নিজে হাতে এঁকে নিয়ে যান।

টেরাকোটার ফলকে উপরে কৃষ্ণলীলা ও নীচে যুদ্ধের দৃশ্য

টেরাকোটার ফলকে রাধাকৃষ্ণের লীলা

টেরাকোটার ফলকে দেবাসুরের যুদ্ধ, বিষ্ণুর আগমন ও কার্তিক (বামদিক থেকে)

এবারে পুনরায় ফিরে আসা যাক রাজ পরিবারের অংশে......

অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে রামেশ্বরের মৃত্যুর পর পুনরায় জমিদারি ভাগ হয়ে যায় তাঁর তিন পুত্র, দুই ভাগ্নে ও এক আশ্রিত ব্রাহ্মণ এর মধ্যে। যদিও বড় ছেলে রঘুদেব-ই জমিদারির সবচেয়ে বড় অংশ পেয়ে সেই খেতাব ধরে রেখেছিলেন। এই রঘুদেব রায় তৎকালীন বাংলার নিজাম মুর্শিদকুলি খাঁ এর কাছ থেকে তিনি সুদ্রমণি উপাধি লাভ করেন।

রাজা নৃসিংহদেব রায় মহাশয় 

পরবর্তী ঘটনা ১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দ, বাংলার নবাব তখন আলীবর্দি খাঁ। রাজা রঘুদেবের পুত্র রাজা গোবিন্দদেব রায় মহাশয় যখন মারা গেলেন তখনও নৃসিংহদেবের জন্মগ্রহণ হয়নি। এদিকে বর্ধমান রাজের দেওয়ান মানিকচাঁদ, রাজাকে খবর দিলেন বাঁশবেড়িয়ার জমিদারি দেখাশোনার জন্য রাজবংশের আর কোন উত্তরাধিকার নেই। এই সুযোগে বর্ধমানের রাজা চিত্রসেন ও নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বাঁশবেড়িয়ার অনেক অংশ দখল করে নেয়।

রাজা নৃসিংহদেব

যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে বাংলায় তখন সর্বত্রই অরাজকতা। মারাঠাদের অত্যাচার ও ইংরেজ বণিকদের সাথে মনোমালিন্য নবাব আলীবর্দি খাঁ কে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। এরপরেই ১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সিংহাসনে বসেন নবাব সিরাজদৌল্লা। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পরাজয় আর বাংলার ক্ষমতায় ব্রিটিশ সরকারের প্রবর্তন। পলাশীর যুদ্ধের পরই বাংলার দেওয়ানি হস্তান্তরিত হয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়ার কাছে। কোম্পানির লোকেরা খাজনা আদায়ের নাম করে অবাধ লুণ্ঠন ও অত্যাচার শুরু করে দেয়। আর এই সময়েই সমগ্র বাংলায় দেখা দেয় সেই বিধ্বংসী যা ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (১১৭৬ বঙ্গাব্দ) হিসাবে পরিচিত। দুর্ভিক্ষের প্রতিক্রিয়া হিসাবে এবং ১৭৭৩ এর রেগুলেটিং অ্যাক্ট অনুযায়ী নিযুক্ত হলেন প্রথম গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিং।

সময় ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দ, বাঁশবেড়িয়ার রাজা নৃসিংহদেব গেলেন ব্রিটিশদের কাছে। তাঁর পৈত্রিক সম্পত্তির বিষয়ে যাবতীয় তথ্য দিয়ে তা পুনরুদ্ধারের জন্য দরখাস্ত করলেন ওয়ারেং হেস্টিং কে হেস্টিং এর সঙ্গে নৃসিংহদেবের আলাপ ঘটেছে আগেই। হেস্টিং যখন বাংলার মানচিত্র তৈরি করার জন্য একজন ইংরেজী জানা জমিদার খুঁজছিলেন, সেই কাজে যোগ দিয়েছিলেন রাজা নৃসিংহদেব রাজার পিটিশনের উপর ভিত্তি করে হেস্টিং তদন্ত করেন এবং ১৭৭৯ খ্রিষ্টাব্দে চব্বিশ পরগণার অধীনে থাকা বাঁশবেড়িয়ার অর্থাৎ নৃসিংহদেবের জমিদারির অধীনে থাকা সম্পত্তি ফেরত দেন। এদিকে নৃসিংহদেব বাকি জমিগুলির বিষয়ে যখন জানাতে গেলেন, তখন ব্রিটিশ সরকারের গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস জানালেন  এবিষয়ে মামলা মোকদম্মার জন্য নৃসিংহদেবকে লন্ডনের কোর্ট অফ ডিরেক্টরের কাছে আর্জি জানাতে হবে কিন্তু নৃসিংহদেব এই কোটকাচারির চক্করে যেতে রাজি হলেন না, জমিদারীর বিষয়ে এই ঘোরপ্যাঁচের মধ্যে পড়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন। 

১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে বংশবাটীতে স্বয়ম্ভবা মন্দির (বর্তমানে সেই মন্দির না থাকলেও মন্দিরের বিগ্রহ মহিষমর্দিনী -র মূর্তিটি হংসেশ্বরী মন্দিরে রয়েছে) গঠন করলেও জমিদারীর কার্যকলাপে তাঁর মন টিকলো না। শেষে ১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দে বাঁশবেড়িয়ার সমস্ত জমিদারিত্ব ছেড়ে তিনি চলে গেলেন বারাণসী (কাশী)। সেখানে নৃসিংহদেব সাধু সন্ন্যাসীদের সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করতে লাগলেন। বেশিরভাগ সাধু সন্ন্যাসী তন্ত্র সাধনায় দীক্ষিত। নৃসিংহদেব সেই সমস্থ সন্ন্যাসীদের সাহায্যে তান্ত্রিক মতে যোগশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করলেন। বারাণসীতে থাকাকালীন কাশীবাসী খিদিরপুর ভূ-কৈলাসের রাজা জয়নারায়ণ ঘোষাল অনেকদিন ধরেই মনস্থ করেছিলেন তাঁর সংস্কৃত গ্রন্থ কাশীখন্ড এর বঙ্গানুবাদ করবেন। কিন্তু তাঁর এই কাব্যরচনার সামর্থ্য ছিল না। এদিকে সংস্কৃত ও পারসী ভাষায় সুপণ্ডিত নৃসিংহদেবকে দেখতে পেয়ে তাঁর সাহায্য চাইলে নৃসিংহদেব কাশীখন্ডের বঙ্গানুবাদ করেন। এছাড়াও তিনি সংস্কৃতে লেখা উদ্ধিসতন্ত্র এর বঙ্গানুবাদ করেন।

এমন সময়ে বাঁশবেড়িয়া থেকে এলো এক চিঠি। চিঠির বৃত্তান্ত পড়ে নৃসিংহদেব জানতে পারলেন লন্ডনে কোর্ট অফ ডিরেক্টরের কাছে জমি পুনরুদ্ধারের মামলার জন্য বেশ কিছু টাকা জোগাড় করা গেছে। শেষে ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে নৃসিংহদেব কাশীধাম (বারাণসী) থেকে ফিরে এলেন বাঁশবেড়িয়ায়। কিন্তু বাঁশবেড়িয়ায় ফিরে তিনি জমি পুনরুদ্ধারের জন্য গেলেন না, সে নিয়ে তিনি কোনও বাক্যব্যায়ও করলেন না। বিলেতে গিয়ে সম্পত্তি উদ্ধারের পরিবর্তে তিনি তাঁর বিবেক বুদ্ধি সমস্তটাই উৎসর্গ করলেন মন্দির গঠনে।

হংসেশ্বরী মন্দির

হংসেশ্বরী মন্দির 

হংসেশ্বরী মন্দিরের গঠন নৃসিংহদেবের নিজস্ব। লন্ডনে যাওয়ার উদ্দেশ্যে জমানো অর্থ দিয়ে তিনি তন্ত্রমতে মন্দির বানানোর পরিকল্পনা করেন। যোগশাস্ত্র মতে মানবদেহের ষটচক্রভেদের ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, বজ্রাক্ষ ও চিত্রিণী নামে পাঁচটি নাড়ী রয়েছে সুষুন্মাকান্ডকে কেন্দ্র করে। এই সুষুন্মাকান্ড বরাবর বিভিন্ন স্থানে রয়েছে সাতটি চক্র (মতান্তর ছয়টি)। আর এই চক্রগুলির একদম নীচে যে চক্র রয়েছে তা হল মূলাধার চক্র, যেখানে সকল শক্তির আধার বিদ্যমান থাকে, যেখানে রয়েছে সর্পাকৃতি কুলকুণ্ডলিনী। রাজা নৃসিংহদেব মানবদেহের এই কুলকুণ্ডলিনী তত্ত্বকেই মন্দিরের স্থাপত্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে চাইলেন। আগেই জেনেছি তিনি উদ্ধিসতন্ত্র ও কাশীখন্ডের বঙ্গানুবাদ করেন। ফলে হিন্দুধর্মে তন্তসাধনা বা যোগসাধনা নিয়ে জ্ঞানের পরিপূর্ণতা লাভ করেন এই লেখালেখির মাধ্যমেই। মানবদেহের পাঁচটি নাড়ীর প্রতীক হিসাবে পাঁচতলা ও তেরোটি মিনার বিশিষ্ট মন্দিরের পরিকল্পনা করেন। মন্দিরের গর্ভগৃহে অর্থাৎ মূলাধারে কুণ্ডলিনী শক্তিরূপে দেবী হংসেশ্বরীর বিগ্রহও তাঁর পরিকল্পনা ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপন হয় মন্দিরের ভিত্তি-প্রস্তর। শোনা যায় মন্দির তৈরির জন্য পাথর আনা হয়েছিল উত্তরপ্রদেশের চুনার শহর থেকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় মন্দিরের দ্বিতল তৈরি হওয়ার সময়েই নৃসিংহদেব পরলোকগমন করেন। মন্দিরের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের দিকে প্রথম ধাপ এগোলেও তিনি সম্পূর্ণ মন্দির তৈরি দেখে যেতে পারেননি। মৃত্যুর সময় তাঁর প্রথম পক্ষের স্ত্রী রাণী ভবানন্দময়ী সহমরণে (সতীদাহ প্রথা অনুযায়ী) যান।

পূর্বদিকের পরিখা থেকে হংসেশ্বরী মন্দির (পদ্মকোর রূপে ১৩ টি শিখর)

কিন্তু হংসেশ্বরী মন্দিরের কাজ থেমে থাকল না। মৃত্যুর পর তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী রাণী শঙ্করী (যার নামে কলকাতার ভবানীপুরে রাণী শঙ্করী লেন রাস্তা আছে) স্বামীর আরদ্ধ কাজ শেষ করেন আর এভাবেই ১৮১৪ খ্রিষ্টাব্দে নৃসিংহদেবের পরিকল্পিত হংসেশ্বরী মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। মন্দির নির্মাণে খরচ হয় প্রায় ৫ লক্ষ টাকা। আর প্রতিষ্ঠাদিবসের দিন রাণী শঙ্করী ভারতের প্রায় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্রাহ্মণ, পণ্ডিতদের আহ্বান জানান; পূজার্চনা, খাওয়াদাওয়া, উপহার বিনিময়ের মাধ্যমে শুরু হয় হংসেশ্বরী মন্দিরের পথচলা।

মন্দিরের প্রবেশদ্বারের একদম উপরে রয়েছে মন্দিরের প্রতিষ্ঠালিপি 

"শাকাব্দে রস-বহ্নি-মৈত্রগণিতে শ্রীমন্দিরং মন্দিরং।

মোক্ষদ্বার চতুর্দ্দশেশ্বর সমং হংসেশ্বরী রাজিতং।।

ভূপালেন নৃসিংহদেবকৃতিনারব্ধং তদাজ্ঞানুগা।

তৎপত্নী গুরুপাদপদ্মনিরতা শ্রীশঙ্করী নির্মমে।।

শকাব্দ ১৭৩৬।"

মর্মার্থঃ চতুর্দশ মোক্ষদ্বাররুপী শিবের সাথে বিরাজিত হংসেশ্বরীর নিমিত্ত ভুপাল নৃসিংহদেব কর্তৃক আরদ্ধ এই শ্রীমন্দির তাঁর আজ্ঞানুসারে পত্নী গুরুপাদপদ্মনিরতা শ্রীশঙ্করী ১৭৩৬ শকাব্দে নির্মাণ করলেন।

তিনটি খিলানযুক্ত মন্দিরের প্রধান ফটক (পাথরের তৈরি) ও মধ্যিখানে মন্দির প্রতিষ্ঠাফলক

মন্দিরের বৈশিষ্ট্য তাঁর মৌলিক গঠন, কারণ সারা ভারতে খুঁজলেও এমন শিল্পের নিদর্শন আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। হংসেশ্বরী মন্দির দক্ষিণমুখী, উচ্চতা ৭০ ফুট ও দৈর্ঘ্য আনুমানিক ৫০ ফুট। মন্দিরের চারিদিকে বারন্দা ও সামনে খোলা বাঁধানো প্রশস্ত চত্বর। সমগ্র মন্দিরটি ইঁট ও পাথর দিয়ে তৈরি। তান্ত্রিক মতে গড়ে ওঠা এই পাঁচতলা মন্দিরের আটকোণে ৮ টি, চারকোণে ৪ টি ও কেন্দ্রস্থলে ১টি মিলে মোট ১৩ টি শিখর বা চূড়া রয়েছে। এই চূড়াগুলি পদ্মকোরকাকৃতি, অর্থাৎ পদ্মকোরকের আদলে নির্মিত। মন্দিরের চূড়াগুলি দেখে David McCutcheon, Zulekha Haque জানাচ্ছেন এই হংসেশ্বরী মন্দির অনেকটা বাংলার রত্ন প্রকৃতির মন্দিরের পরিবর্তিত রূপ। এই চূড়াগুলির মধ্যে মাঝের চুড়াটির উপরে রয়েছে একটি ধাতুর সূর্য যেটি একটি কালীযন্ত্র এর মধ্যে অবস্থান করছে। এই কালীযন্ত্র হল একটি সহস্রার চক্রের চাক্ষুষ উপস্থাপনা। প্রতিষ্ঠালিপি অনুযায়ী মন্দিরে রয়েছে ১৪ টি শিবলিঙ্গ। প্রত্যেকটি শিবলিঙ্গ রয়েছে এক একটি ছোট ঘরে এবং এই ঘরগুলিকে একে অপরের সাথে যুক্ত করেছে একটি খোলা প্যাসেজ।

গর্ভগৃহের সামনে দরজার উপরে রংবেরঙের কারুকার্য

আগেই বলেছি যোগশাস্ত্র মতে সুষুম্নাকান্ডকে কেন্দ্র করে মানবদেহে যে পাঁচটি নাড়ী রয়েছে, সেই নাড়ীর রূপক হিসাবে হংসেশ্বরী মন্দিরের পাঁচটি সিঁড়ি উঠে গেছে। বর্তমানে যদিও মন্দিরের উপরে ওঠা ও এই সিঁড়ির ব্যবহার দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ। তবে এই সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলে রয়েছে এক বিচিত্র গোলকধাঁধা, যার মধ্যে একবার ঢুকে পড়লে পথপ্রদর্শকের সাহায্য ছাড়া বেড়িয়ে আসা সম্ভব নয় । আর এই গোলকধাঁধার মধ্যেই একস্থানে একটি নিভৃত প্রকোষ্ঠে বিরাজ করছেন শ্বেতপাথরের সদাশিব (যেটি হংসেশ্বরী মন্দিরের মধ্যস্থলের মিনারের নীচের তলার প্রকোষ্ঠে থাকা শিবলিঙ্গ) ষটচক্রভেদ অনুযায়ী, প্রকৃত গুরুর দেখানো পথ ধরেই মূলাধারের শক্তিকে নাড়ীর মাধ্যমে চালিত করে হৃদিপদ্মে অবস্থিত শিবের সঙ্গে মিলিত করা সম্ভব। তান্ত্রিক যোগসাধনায় তৈরি হংসেশ্বরী মন্দির সেই তথ্যই বহন করে চলেছে।

ফোয়ারা

গর্ভগৃহের সামনে দরজার উপরে রংবেরঙের কারুকার্য ২

এবার একটা প্রশ্ন আসতেই পারে হংস শব্দের অর্থ কী? এখানেও রয়েছে তন্ত্রমত। হং কারেণ বর্হিযাতি স কারেণ বিশেৎ পুনঃ। / হংস-হংসেতি অমুং মন্ত্রং জীবো জপতি সর্বদা।। অর্থাৎ নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সময় হং শব্দের সঙ্গে বায়ু বাইরে আসা এবং  শব্দের সঙ্গে পুনরায় প্রবেশ করে। আর জীব স্বভাবত সর্বদাই হংস মন্ত্র জপ করছে। - এই হল হংস মন্ত্র বা অজপা গায়েত্রী মন্ত্র। আবার 'History of Tantric Religion' এর লেখক নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলছেন এটি হল এক প্রতিকি মন্ত্র, যার অর্থ জীবনের শ্বাস  হংসঃ (Hamsa)। নিঃশ্বাস নেওয়া (হং) ও প্রশ্বাস ছাড়া (সঃ) এর রূপ। হং হল বিন্দুর প্রতীক (পুরুষ, সৃষ্টির পুরুষ নীতি) সঃ এর বিসর্গ (প্রকৃতি, সৃষ্টির নারী নীতি)। আবার তন্ত্রমতে হংস স্বয়ং ভগবতী, মহাশক্তি কুলকুণ্ডলিনী। অহমিতি বীজম্। সঃ ইতি শক্তি। সোহহমিতি কীলকম্ -এই হংসোপনিষদ অনুসারে হং অর্থাৎ বীজস্বরূপ, সঃ অর্থাৎ শক্তিস্বরূপ এবং দোহং অর্থাৎ কীলক বা উপায়। আর এই সমস্ত মন্ত্র দ্বারাই হৃদয়ের অষ্টদল পদ্মের মধ্যে হংসাত্মাকে দেখা যায়। বাঁশবেড়িয়ার এই হংসেশ্বরী মন্দির সেই ভাবেরই প্রতিরূপ।

হংসেশ্বরী দেবী

মন্দিরের মূলাধারে অর্থাৎ গর্ভগৃহে রয়েছে হংসেশ্বরী দেবী। তবে দেবীর অবস্থান বা গঠনেও রয়েছে সেই তান্ত্রিক রূপ। প্রথমে পঞ্চমুণ্ডির আসনের উপর রয়েছে সহস্রদল নীলপদ্ম এবং তার উপরে অষ্টদল লালপদ্ম। তার উপরে একটি বড় কালীযন্ত্রের উপরে শায়িত অবস্থায় মহাকাল (মূর্তিটি পাথরের তৈরি)। এবং মহাকালের হৃদয় থেকে উত্থিত দ্বাদশদল পদ্মের উপরে বাম পা মুড়ে ও ডান পা ঝুলিয়ে অবস্থান করছেন রাজকীয় হংসেশ্বরী দেবী। নীলবর্ণের ও সম্পূর্ণ নিমকাঠের তৈরি হংসেশ্বরী দেবী ত্রিনয়নী, চতুর্ভুজা ও মাথায় ঘোমটা। দেবীর বামহাতে তরবারি ও নরমুণ্ড এবং ডানহাতে বর ও অভয়মুদ্রা। গলায় ঝুলছে মুণ্ডমালা। সারাবছরই দেবীর শান্ত মূর্তিরূপে অর্থাৎ দক্ষিণা কালী রূপে পুজো করা হয়, কেবল বাৎসরিক পুজোর দিন (কার্ত্তিক অমাবস্যার দীপান্বিতা তিথিতে অর্থাৎ কালী পুজো) শুধুমাত্র রাতের জন্য দেবীকে রুপোর মুখোশ ও সোনার জিভ পড়িয়ে এলোকেশী রূপে পুজো করা হয়। আর বছরের এই একটি দিনই তান্ত্রিক মতে পুজো হয়।

বামদিকে - দেবীর শান্ত রূপ, ডানদিকে - কালীপুজোর দিন দেবীর এলোকেশী রূপ (সৌজন্যে হুগলী হেরিটেজ)

বাঁশবেড়িয়ার এই হংসেশ্বরী মন্দির দেখে ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরীর অন্যতম লাইব্রেরিয়ান ও সাহিত্যিক জন অ্যালেকজান্ডার চ্যাপম্যান তাঁর Bansberia Temple” নিয়ে লিখেছেন এক কবিতা। নিচে সেই কবিতারই শেষের কিছু অংশ তুলে ধরা হল    

"What did he do? He built a temple. Still

It stands, and 1 have seen it; but too ill

Would words of mine describe it. lnside, out,

Silent on earth, in a pinnacled air a shout,

lt doth reveal what to the initiate

Figures pure thought. So unto them a gate

ls opened to deliverance. 1 outside,

Alien but not unmoved, untouched, abide"

                                                           -------  John Alexander Chapman

বাঁশবেড়িয়ার শেষ জমিদার ছিলেন রাজা ক্ষিতীন্দ্রদেব রায় মহাশয়। রাজা ক্ষিতীন্দ্রদেব প্রধানত থাকতেন কলকাতার রাণী শঙ্করী লেনে তাঁর বাসভবনে। শিক্ষার প্রতি ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর তাদের পারিবারিক পদবি উত্তরাধিকারসূত্রে ও উপাধিসূত্রে পাওয়া পদবি একত্রিত হয়ে হয় দেবরায়। মহাশয় পদবি এরপর থেকে বাদ দেওয়া হয়। রাজা ক্ষিতীন্দ্রদেবের ভাই কুমার মুনীন্দ্রদেব রায় ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। সারা বাংলায় গ্রন্থাগার আন্দোলনের (লাইব্রেরী মুভমেন্ট) সময়, যে আন্দোলনে জড়িয়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, খালিফা মোহম্মদ আসাদুল্লাহ; সেই আন্দোলনে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিলেন কুমার মুনীন্দ্রদেব। তিনি ছিলেন বেঙ্গল লাইব্রেরী অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং সেই সূত্র ধরেই তিনি ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে বাঁশবেড়িয়াতে গঠন করেন বাঁশবেড়িয়া পাবলিক লাইব্রেরী।

রাজবাড়ি চত্বরের বর্তমান অবস্থা ১

রাজবাড়ি চত্বরের বর্তমান অবস্থা ২

রাজবাড়ি চত্বরের বর্তমান অবস্থা ৩

রাণী শঙ্করী দেবীর মৃত্যুর পরই বাঁশবেড়িয়া এস্টেট ভাগ হয়ে যায় তাঁর তিন নাতির মধ্যে। ক্রমে বড় তরফমেজো তরফ ও ছোট তরফ। তবে বাঁশবেড়িয়ায় বর্তমান যে বাড়িটি দেখতে পাওয়া যায় তা ছোট তরফের। বাঁশবেড়িয়ার মূল প্রাসাদটি অনেক আগেই ভেঙে পড়েছে, বড়ো তরফ ও মেজো তরফের বাড়িগুলিও বর্তমানে আর নেই। স্বাধীনতার পর থেকেই পরিবারের বিশাল সম্পত্তি ধিরে ধিরে বিলুপ্ত হতে থাকে। বর্তমানে যারা রয়ে গেছে তাঁদের আর্থিক অবস্থাও যথেষ্ট শোচনীয়। রানী শঙ্করী দেবী মৃত্যুর আগেই মন্দির ও তৎসংলগ্ন জমি দেবোত্তর সম্পত্তি হিসাবে ঘোষণা করে যান, ফলে মন্দির থাকলেও তা আর এখন পারিবারিক সম্পত্তি নয়। পরবর্তীকালে বাঁশবেড়িয়ার এই দুটি মন্দিরই চলে আসে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে। তবে মন্দিরের বিগ্রহ ও অলঙ্কার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব এখনও রয়েছে রাজবাড়ি সদস্যদের তত্ত্বাবধানে।

******************************************************

লেখা, গবেষণা ও ছবি - প্রীতম নস্কর  

ই-মেল - pritamnaskar.pn@gmail.com

ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে ব্লগের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, তবে পূর্বানুমতি ছাড়া আমার তোলা আলোকচিত্রগুলি এবং ব্লগের রচনাগুলি অন্য কোথাও কপি-পেস্ট বা বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করা চলবে না।

******************************************************

পূর্বে রাজবাড়ি চত্বর  (সৈজন্যে - দ্যা বাঁশবেড়িয়া রাজ বইয়ের লেখক)


বাঁশবেড়িয়া রাজবাড়ির দুর্গাপ্রতিমা তৈরির সময়

মন্দিরের সময়সূচী- 

দুই মন্দিরই খোলা থাকে সকাল ৬ টা থেকে দুপুর ১২ টা ৩০ মিনিট ও বিকাল ৪ টা থেকে ৬ টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত। মন্দিরের পুজো শুরু হয় সকাল ১০ টায়, সে সময়েই সর্বসাধারণ মন্দিরে পুজো দিতে পারবে। প্রত্যেকদিন সর্বসাধারণের জন্য মন্দিরে অন্নভোগপ্রসাদের ব্যবস্থাও করা হয়, তবে তার জন্য সকাল ১০ টার মধ্যে দক্ষিণার বিনময়ে কুপন সংগ্রহ করতে হবে। অন্নভোগ বিতরণ শুরু হয় ১২ টা ৩০ মিনিটের পর থেকে।

গুগল ম্যাপ / কোঅরডিনেট - 

কীভাবে যাবেন - 

ট্রেনযাত্রা - হাওড়া থেকে মেনলাইনগামী কাটোয়া লোকালে চেপে নামতে হবে বাঁশবেড়িয়া স্টেশন। স্টেশন থেকেই অটো / টোটো -র মাধ্যমে পৌঁছে যাওয়া যাবে হংসেশ্বরী মন্দির।

সড়কপথে প্রথমে হাওড়া থেকে বালি। সেখান থেকে দিল্লী রোড ধরে প্রথমে মগরা। মগরা ফ্লাইওভার ধরে বাঁশবেড়িয়ার ঝুলনিয়া মোড়। সেখান থেকে কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে রাস্তা ধরে ঈশ্বর গুপ্ত সেতুতে ওঠার আগে ডানদিকে পাবেন হংসেশ্বরী মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা।

তথ্যসূত্র 

  • The Bansberia Raj – Shumboo Chunder Dey
  • The Family History of the Bansberia Raj - A. G. Bower
  • Bengal District Gazetters Hooghly
  • Statistical Account of  Bengal – Vol III – W W Hunter
  • Monumentalizing Tantra: The Multiple Identities of the Hamses'varl Devi Temple and the Bansberia Zamlndari – by Mohini Datta-Ray    
  • হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ (দ্বিতীয় খন্ড)  সুধীরকুমার মিত্র
  • পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি  বিনয় ঘোষ
  • পশ্চিমবঙ্গের মন্দির  শম্ভু ভট্টাচার্য

মন্দিরের আরও কিছু ছবি - 






Comments

  1. অত্যন্ত মনোজ্ঞ ও তথ্যবহুল লেখা। আমি কিছুদিন আগে এই মন্দির চত্বরে ঘুরে এসেছি। সেই কারনে এই মন্দির সম্পর্কে কিছু খোঁজখবর করেছিলাম। আপনার লেখা তাকে বিস্তৃততর করল।

    ReplyDelete

Post a Comment