কলকাতার চিনাপাড়া | Kolkata Chinatown, Tiretta Bazaar

কলকাতার চিনাপাড়া গড়ে উঠেছে মূলত তিনটি জায়গা কেন্দ্র করে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার আছিপুরমধ্য কলকাতার টিরেটা বাজার ও সর্বশেষ পূর্ব কলকাতার ট্যাংরা (তপসিয়া)। সময়ের নিরিখে দেখতে গেলে বাংলার সঙ্গে চিনের প্রথম যোগসূত্র স্থাপন হয় যখন চিনা পরিব্রাজক ফা হিয়েং ও হিউয়েন সাং বাংলার তমলুক বন্দরে আসেন। পরবর্তীকালেও এদের পথ অনুসরণ করে চিন থেকে অনেক ভিক্ষু, ভ্রমণকারী, এমনকি বিভিন্ন ব্যবসায়ীরাও ভারতে আসতে থাকেন। কিন্তু সে ইতিহাস অনেক পুরনো, তারা বাংলায় আসলেও কখনোই এখানে তারা স্থায়ীভাবে বসবাস গড়ে তোলেননি। আর যদিও বা গড়ে তোলেন সে প্রমাণ কিন্তু ব্রিটিশ আর্কাইভে নেই। বাংলার এমনকি ভারতের ইসিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় হাতেকলমে ভারতের প্রথম চিনা নাগরিক হলেন ইয়াং দাইজাং বা ইয়াং দা ছাও, যিনি কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। কিন্তু ব্রিটিশ দস্তাবেজে (ব্রিটিশ আর্কাইভ) তিনি পরিচয় পান টং আছু হিসাবে। তবে তিনি ঠিক কোন সময়ে কলকাতায় পদার্পণ করেন তার নথি কিন্তু দলিল দস্তাবেজে পাওয়া যায় না। তবে অনুমান করা যায় সময়টা অষ্টাদশ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে তিনি কলকাতা বন্দরে আসেন। ব্যবসায়িক সূত্রে ব্রিটিশ সরকারের সাথে সম্পর্ক ভালো থাকায় প্রথমে তিনি অমুদপুরে আরাকের (দেশী মদের) ব্যবসা শুরু করেন। এদিকে বাংলার গভর্নর জেনারেল ওয়ারেং হেস্টিং অনেক দিন ধরেই চেষ্টা চালাচ্ছিলেন ভারতের সাথে চিনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তোলার। এ বিষয়ে নতুন রুট খোলার জন্য তিনি বিভিন্ন সময়ে কূটনৈতিক ভ্রমণকারী স্যামুয়েল টার্নার তো অন্যদিকে স্কটিশ অ্যাডভেঞ্চারার জর্জ বোগ্লে-কে তিব্বতে পাঠান। একদিকে আসাম জুড়ে ছড়িয়ে থাকা চা বাগানের স্বত্বাধিকারী তো অন্যদিকে তিব্বতের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা। লক্ষ্য একটাই তিব্বতের গিরিপথের মাধ্যমে চিনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য গঠন করা। বোগ্লের মারফত হেস্টিং তিব্বতের সাথে এক সন্ধিও করে বসেন, এই সন্ধির পরিপ্রেক্ষিতেই পাঞ্চেন লামার ইচ্ছায় হাওড়ার ঘুশুড়ীতে গড়ে ওঠে "ভোটবাগান মঠ", যা ভারতের সমভূমিতে স্থাপিত প্রথম বৌদ্ধমঠ। তবে সে ইতিহাস অন্য, ভোটবাগান মঠের বিষয়ে জানতে হলে ভোটবাগান মঠ ব্লগটিতে ঘুরে আসতে পারেন

তো এই টং আছু কবে কলকাতায় এলেন তার প্রমাণ পাওয়া না গেলেও তিনি যে সর্বপ্রথম সুগার মিল স্থাপন করেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন জেনারেল ওয়ারেং হেস্টিং এর কাছ থেকে টং আছু দক্ষিণ-চব্বিশ পরগণার অন্তর্গত বজবজ অঞ্চলে ৬৫০ বিঘা জমি বার্ষিক ৪৫ টাকা ভাড়ায় নিয়ে স্থাপন করেন ভারতের প্রথম রিফাইন্ড সুগার মিল। এই সাড়ে ছশো বিঘা জমি আসলে বর্ধমান রাজার। আর এই সুগার মিলে কাজের জন্যই আছু চিন থেকে প্রায় ১১০ জন চিনা শ্রমিককে নিয়ে এলেন বজবজের এই মিলে। ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসের তথ্য অনুযায়ী বজবজের এই সুগার মিলে প্রায় দুই হাজার মণ সুগার বাজারে বিক্রির জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। এখানে বলে রাখা ভালো আদি কাল থেকেই বাংলায় সুগার আসলে শর্করা হিসাবেই পরিচিত। কিন্তু আছুর এই মিল স্থাপনের প্রভাবেই বাংলায় সুগার (শর্করা) পরিচিতি পায় চিনি নামে, কারণ চিনারাই সর্বপ্রথম ভারতে তথাপি বাংলায় এই সাদা সুগার(শর্করা) এর প্রচলন শুরু করেন (অতীতে ভারতে যে সুগারের ব্যবহার হত তা ছিল ব্রাউন সুগার অর্থাৎ অপরিশোধিত চিনি)। মিলের কাজ আরও দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আছু গভর্নর জেনারেলের কাছ থেকে আরও শ্রমিক আনার আনুমতি চেয়ে আবেদন করেন, যার প্রমাণ আমরা পাই ব্রিটিশ আর্কাইভে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে টং আছু মারা যান। টং আছুর এই সুগার মিল স্থাপন ও পরবর্তীকালে এখানে চিনা মন্দির স্থাপনের ফলে জায়গাটি আছিপুর হিসাবে পরিচিত।

চিনা ক্লাব / 'হুইগুয়ান' 

ক্রমে তাঁর মৃত্যুর পর এই সুগার কারখানা চিন থেকে আসা শ্রমিকদের দৌলতেই ২০ বছর টিকে ছিল। তবে দীর্ঘ টালবাহানার পর ১৮০৪ খ্রিষ্টাব্দে কারখানার সমস্ত জমিজমা, যন্ত্রপাতির সমস্তই  নিলামে বিক্রি হয়ে যায়। এর অন্যতম প্রধান কারণ ভারতীয় চিনির দামের উপর কর চাপিয়ে যে পরিমাণ দামে বাজারে বিক্রি হত তাতে পুরো ব্যবস্থাটাই অলাভজনক হয়ে পরে। আর এই কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেশিরভাগ চিনা পরিযায়ী শ্রমিক আছিপুর ছেড়ে চলে আসে মূল শহর কলকাতায়। কারণ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সুবাদে কলকাতা তখন অবিভক্ত ভারতের বাস্তব রাজধানী। আছিপুর ছেড়ে চিনা শ্রমিকরা মূলত ধর্মতলার কসাইতোলা অঞ্চলে (বর্তমানে বেন্টিং স্ট্রীট) আশ্রয় নেয়, এবং এখান থেকেই তারা কলকাতার আরও উত্তর দিকে বসবাস স্থাপন করতে থাকে।

কলকাতায় চিনারা আসে মোটামুটি চারটি পর্যায়ে। এক চিং রাজত্বের সময়কালে (অষ্টাদশ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে), দুই চিনে গৃহযুদ্ধ চলাকালীন (তাইপিং সিভিল ওয়ার ১৮৫০-১৮৬৪), তিন চিন-জাপানের যুদ্ধ চলাকালীন (১৯৩৭-১৯৪৫), এবং শেষমেশ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর। কিন্তু ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে ভারত ও চিন এর সীমান্ত বিরোধের পর কলকাতায় চিনাদের অভিবাসন (মাইগ্রেসান) সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ হয়ে যায়। কলকাতায় চিনা বন্দোবস্তের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ইংলিশম্যান চেলোনার অ্যালাবাস্টার এর কাছ থেকে, যিনি ব্রিটিশ বিরোধী চিনা কর্মকর্তা ইয়ে মিংচেনের সাথে যৌথভাবে কলকাতার চিনা বসবাসকারীর তথ্য তুলে ধরেন। অ্যালাবাস্টারের রিপোর্ট অনুযায়ী কলকাতায় বসবাসকারী প্রায় ৫০০ ক্যান্টনিজ ও হাক্কা জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। পরবর্তীকালের জনগণনায় কিন্তু এদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দের আদমশুমারি অনুযায়ী কলকাতায় তখন ৭৬৬ চিনা সদস্যের বসবাস ছিল যা পরবর্তীকালে ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের আদমশুমারি অনুযায়ী দাঁড়ায় ১,৬৪০ ও ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের আদমশুমারি অনুযায়ী ৮,৩০০

চিনা চার্চ / প্যাগোডা (টিরেটা বাজার)

তবে ষাটের দশকে গোড়ার দিকে শুরু হল বিশাল পরিবর্তন। চিন তিব্বত দখল করার পর ভারতের সাথে শুরু হয় সীমান্ত বিরোধ, আর সেই থেকে যুদ্ধ যা ইতিহাসে সিনো-ইন্ডিয়ান (চীন-ভারত) যুদ্ধ হিসাবে পরিচিত। আর এই যুদ্ধের সময়েই কলকাতার এই চিনাপাড়ায় নেমে এল অন্ধকার। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার খাতিরে চিনা নাগরিকদের গুপ্তচর হিসাবে সন্দেহ করা শুরু হল। শুধুমাত্র কলকাতা নয়, দেশের সমস্ত প্রান্তে শুরু হল অভিযান। কোন কারণ ছাড়াই একে একে চিনাদের ধরে পাঠিয়ে দেওয়া হল রাজস্থানের দেওলি ডিটেনশন ক্যাম্পে। সেখানে দিনের পর দিন আটকে রাখা হল তাদের। গ্রেফতারের পর তাদের যাবতীয় নথি, পাসপোর্ট নষ্ট করে ফেলা হল। এমনকি যুদ্ধ মিটে যাওয়ার পরেও চলল অত্যাচার। যাদের সামর্থ্য ছিল তাঁরা পালিয়ে গেল অন্যান্য দেশে। আর যারা এই কলকাতায় থেকে গেল তাদের জীবনযাপন হয়ে উঠল দুর্বিষহ। কারণ বেশিরভাগ জায়গাই হয় দখল করে নেওয়া হল আর নাহলে তাদের এক ঘরে করে দেওয়া হল। তাদের চলাচলের ব্যাপারেও শুরু হল সীমাবদ্ধতা। বিনা অনুমতিতে শহরের বাইরে এমনকি টিরেটা বাজারের বাইরে যাওয়া ছিল নিষেধ। আর এখান থেকেই কলকাতায় বসবাসকারী চিনাদের সংখ্যা কমতে শুরু করে। তথ্য অনুযায়ী ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের জনগণনায় চিনাদের নাম প্রকাশ করা না হলেও অনুমান করা যায় সংখ্যাটি ২০০০ কমই হবে। আর বর্তমানে সংখ্যাটি ১০০০ হবে কিনা সন্দেহ।

চিনা দেবতা (টিরেটা বাজার)

বর্তমানে লোকমুখে পরিচিত টেরিটি বাজার আসলে নাম টিরেটা বাজার। এই টিরেটা বাজার চত্বরই হল কলকাতার পুরনো চিনাপাড়া বা ওল্ড চায়নাটাউন। এই টিরেটা বাজারের পরিকল্পনা করেন এক ইতালিয়ান আর্কিটেকচার এদুয়ারদো টিরেটা, যার নাম থেকেই এই বাজারের নামকরণ। কলকাতায় বসবাসকারী চিনাগোষ্ঠীদের মধ্যে ক্যান্টনিজ ও হাক্কা উপগোষ্ঠীদের সংখ্যা কিন্তু বেশিই লক্ষ্য করা যায়। তবে এদের সাথেও রয়েছে চিনের হুবেই, শানডং, ফুজিয়ান প্রদেশ থেকে আসা অভিবাসিরা। দ্যা চাইনিজ ইন সাউথ এশিয়া  লেখক তানসেনের তথ্য অনুযায়ী ১৯৫০ এর দশকে ভারতে ৮০% চিনা ছিল গুয়াংডং প্রদেশ থেকে, ৯% হুবেই প্রদেশ থেকে, ৮% শানডং প্রদেশ থেকে। আবার গুয়াংডং প্রদেশ থেকে চিনাদের মধ্যে ৪৩% সম্প্রদায় হল হাক্কা যারা মেক্সিকান বিভাগের ও ৩০% সম্প্রদায় ক্যান্টনিজ যারা সিয়ি এলাকার; এবং বাকিরা মানশুন, দোংগাং, হুইনিং এলাকার।

চিনা জুতোর দোকান (বেন্টিক্ট স্ট্রীট)

কলকাতায় আসার পর চিনাদের প্রত্যেকটা গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব পেশার সঙ্গে যুক্ত করে নেয়। মনে রাখতে হবে মাইগ্রেসানের সময় এমনকি ব্রিটিশরাও যে চিনা গোষ্ঠিদের নিয়ে আসত তাদের মধ্যে দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে ভাগ ছিল। দক্ষরা মূলত তাদের নিজস্ব পেশায় যুক্ত করে নিত, আর অদক্ষ শ্রমিকরা কঠোর পরিশ্রমী হওয়ায় যে কোন কর্মকাণ্ডেই নিজেদের শ্রম বিলিয়ে দিত। কলকাতায় তারা জুতো তৈরি (চর্ম শিল্পে), আফিম বিক্রি, কাঠের কাজে (ছুতোর শিল্পে) এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেদের যুক্ত করে ফেলে। এদের মধ্যে গুয়াংডং প্রদেশ থেকে আসা ক্যান্টনিজ গোষ্ঠীরা শুরু করে ছুতোর কাজ। জুতো তৈরি অর্থাৎ ট্যানারি ব্যবসা (চর্মশিল্প) ছিল চিনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পেশা। গুইঝু ও পূর্ব গুয়াংডং প্রদেশ থেকে আসা হাক্কা পরিযায়ীরা কিন্তু চর্মশিল্পে দক্ষ ছিল না। তবুও কলকাতায় আসার পর তারা সেই দক্ষতা অর্জন করে শুরু করে জুতো তৈরির কাজ। এর প্রধান কারণ সেইসময় ভারতীয়দের মধ্যে বিশেষ করে হিন্দুদের মধ্যে জুতো তৈরির কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিরা বর্ণ ব্যবস্থার প্রভাবে ছিল অস্পৃশ্য বা নিচু জাতি। ফলত সেসময় বেশিরভাগ ভারতীয়রাই এই কাজে নিযুক্ত হতে চাইত না। আর হাক্কাদের মধ্যে যেহেতু কোন ধর্মীয় নিয়ম বা বাধানিষেধ ছিল না তাই তারা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে জুতো তৈরির ব্যবসা আরম্ভ করল। আর এরকমই কিছু হাক্কা মালিক বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে তৈরি করল নিজেদের জুতোর দোকান। তথ্য অনুযায়ী হাক্কাগোষ্ঠীর এই প্রতিযোগিতার বাজারে কলকাতায় প্রায় ১০০ এরও বেশি জুতোর দোকান তৈরি হয়েগেছিল। তবে পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার এই পুরো লেদার শিল্পটিকেই শহর থেকে দূরে ট্যাংরায় স্থানান্তরিত করে দেয়, এর প্রধান কারণ চামড়া প্রক্রিয়াকরণের ফলে শহরের একেবারে কেন্দ্রে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি। আর এর ফলেই হাক্কাদের কিছু গোষ্ঠী ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ কলকাতার ট্যাংরা অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে, যা কলকাতার দ্বিতীয় চিনাপাড়া। তবে বর্তমানে এখনও বেন্টিং স্ট্রীটের বেশকিছু দোকান দেখতে পাওয়া যায় যার মালিক কোনও না কোন চিনা ব্যক্তি।

চিনা রেস্টুরেন্ট (টিরেটা বাজার)

এদিকে চিনের আর এক জনগোষ্ঠী হুবেইনিজ -রা দন্ত চিকিৎসক ও কাগজের ফুল প্রস্তুতকারী হিসাবে সুপরিচিত। কলকাতায় আসার পর তাঁরাও তাঁদের ক্লিনিক খুলে বসল। আর বেশকিছু হুবেইনিজ পরিবাররা শুরু করল কাগজের বল, রঙিন ফুল, বিভিন্ন নকশা বা লন্ঠন তৈরির কাজ, যেগুলো চিনা নববর্ষ, বড়দিন এমনকি হিন্দু উৎসবেও বাজারে বিক্রি হতে শুরু করল। অন্যদিকে সাংহাই প্রদেশ থেকে আসা চিনা উপগোষ্ঠীরা শুরু করল নিজেদের লন্ড্রি ব্যবসা (ধোপাখানা)। বর্তমানে টিরেটা বাজার চত্বরে না হলেও কলকাতার পার্ক স্ট্রীট এলাকায় রয়েছে এমনই দুই বিখ্যাত চিনা লন্ড্রি   চুংকিং লন্ড্রি ও সাংহাই লন্ড্রি। মাইগ্রেসানের ফলে চিনাদের অন্যান্য ব্যবসার মতো তাদের আর একটি ব্যবসা বিউটি পার্লার (সৌন্দর্যায়ন) কলকাতার এই এলাকাতেও গড়ে উঠতে দেখা যায়। সাধারণত এই ব্যবসার সাথে যুক্ত থাকত চিনা মহিলারা। আবার ক্যান্টনিজরা পরবর্তীকালে শুরু করে চিনা রেস্টুরেন্ট। আর উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে এই টিরেটা বাজারের চত্বরেই গড়ে উঠেছিল বিখ্যাত নানকিং রেস্টুরেট, যা কলকাতার সম্ভবত ভারতবর্ষে স্থাপিত সর্বপ্রথম চাইনিজ রেস্টুরেন্ট। যেখানে কলকাতার মানুষ অনায়াসেই চেখে দেখতে পারত খাঁটি চিনা খাবার। তবে এখনকার মতো কলকাতার ওলিতে-গলিতে গজিয়ে ওঠা চিনা রেস্টুরেন্ট নয়, যেখানে চাইনিজের নামে যে খাবার পরিবেশন হয় তা আদতে কতটা চাইনিজ তা কলকাতার মানুষ ঘুনাক্ষরেও বোঝে না। তবে দুঃখের বিষয় ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে নানকিং রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যায়। এই নানকিং রেস্টুরেন্ট এর বিষয়ে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন

চিনা সস প্রস্তুতকারক (টিরেটা বাজার)

তাহলে কি টিরেটা বাজারে আর চিনা খাবার পাওয়া যায় না...? না! পাওয়া যায়। এখনও এই অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু চিনা রেস্টুরেন্ট যা পরিচালনা করে চিনা ব্যক্তিরাই, যেমন- তুং নাম ইটিং হাউসসেই ভুই রেস্টুরেন্টডিলে চাইনিজ ইটিং হাউসপৌ হিং আর রবিবারের সকালে টিরেটা বাজারের চাইনিজ ব্রেকফাস্ট, যেখানে এখনও চাইনিজ বিক্রেতারা আসে তাদের নিজস্ব খাঁটি চিনা খাবার কলকাতাবাসীর সাথে ভাগ করে নিতে। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে চিনাদের আর একটি ব্যবসার কথা না বলেলেই নয় তা হল চিনা সস প্রস্তুতি। টিরেটা বাজারেই রয়েছে এরকম দুটি সস প্রস্তুতকারক সংস্থা যারা প্রায় ১৯৫০ থেকে সস প্রস্তুত করে চলেছে  এক 'পৌ চং ব্রাদার্স প্রাঃ লিঃ' ও দুই 'সিং চেং'

টিরেটা বাজার চত্বরের চাইনিজ ব্রেকফাস্ট

চিনা দন্ত চিকিৎসক (বেন্টিক্ট স্ট্রীট)

কলকাতায় আসার পর শিক্ষার প্রসারের জন্য চিনারা বেশ কিছু স্কুল প্রতিষ্ঠা করে তার মধ্যে টিরেটা বাজার চত্বরে রয়েছে এরকমই তিনটি স্কুল  চিয়েন কুও চাইনিজ স্কুলদ্যা মেই কুয়াং চাইনিজ হাই স্কুল ও লিয়াং লিয়াং হাই স্কুল। একসময়ে এই স্কুলগুলিতে চিনা (ম্যানডেরিয়ান) ভাষায় পড়ানো হলেও বর্তমানে শুধুমাত্র ইংলিশ ভাষাতেই শিক্ষা প্রদান করা হয়। এর প্রধান কারণ বর্তমান সময়ে চিনা ছাত্রের অভাব। আর দুঃখের বিষয় ছাত্রের এই ঘাটতির জন্য ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে দ্যা মেই কুয়াং চাইনিজ হাই স্কুল চিরতরের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ভারতে আসার পর তাদের নিজস্ব সংবাদপত্রের জন্য এই কলকাতাতেই তারা চিনা সংবাদপত্র প্রকাশ করতে থাকে দ্যা চাইনিজ জার্নাল অফ ইন্ডিয়া ও অন্যটি দ্যা ওভারসিস চাইনিজ কমার্স অফ ইন্ডিয়া। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে মার্চে প্রকাশ পাওয়া দ্যা ওভারসিস চাইনিজ কমার্স অফ ইন্ডিয়া পত্রিকাটি বর্তমানে একমাত্র চিনা পত্রিকা যেটি আজও ৬ নং ট্যাংরা রোড থেকে প্রকাশিত হয়ে আসছে

চিনা চার্চের অভ্যন্তরে পৌরাণিক অস্ত্রসামগ্রী ও কাঠের কারুকার্য

কলকাতায় বসবাস শুরু করার পর থেকেই চিনাদের প্রত্যেকটি গোষ্ঠী তাদের নিজেদের জন্য তৈরি করে ক্লাব (হুইগুয়ান) ও চার্চ (প্যাগোডা)। কলকাতার এই টিরেটা বাজার চত্বরেই গড়ে তোলে ৬ টি (ছয়টি) চার্চ - 

প্রতিটি চার্চেরই রয়েছে আলাদা আলাদা ইতিহাস। চিনাদের বেড়ে ওঠা, সুখদুঃখের ভাগ বাঁটোয়ারা, একত্রিত হওয়া সবকিছুরই সাক্ষী এই চার্চ। চার্চগুলির বিষয়ে বিস্তারিত জানতে প্রতিটি চার্চের নামে ক্লিক করতে পারেন যেখানে রয়েছে সেইসব চার্চ সম্বন্ধিত ব্লগ।

কলকাতার পুরনো চিনাপাড়া থাকছে এই পর্যন্তই। কলকাতার দ্বিতীয় চিনাপাড়া টাংরা থাকবে অন্য ব্লগে। ভবিষ্যতে হয়তো কলকাতায় চিনাদের বসবাস আরও কমে যাবে কারণ বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই কর্মসংস্থানের সুযোগে অস্ট্রেলিয়া, ক্যানাডা, নিউইয়র্ক বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিচ্ছে। আর যারা থেকে যাচ্ছে এই কলকাতায় তারা তাদের পুরনো সংস্কৃতি, আদব কায়দা নিয়ে বেঁচে থাকছে। তাই এখনও বছরের চিনা নববর্ষগুলিতে মেতে ওঠে তারা, পুরনো থেকে নতুন প্রজন্ম সবাই অংশ নেয় এই উৎসবে। লায়ন ডান্স, বাজি ফাটানো, বিভিন্ন দেবদেবীদের পূজার্চনা মাধ্যমে সাপ্তাহিকব্যাপী চলতে থাকে এই অনুষ্ঠান। তবে সে ইতিহাস অন্য আর একদিন...... কলকাতার চিনাপাড়া নিয়ে দ্বিতীয় ব্লগে......

******************************************************

লেখা, গবেষণা ও ছবি - প্রীতম নস্কর  

ই-মেল - pritamnaskar.pn@gmail.com

ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে ব্লগের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, তবে পূর্বানুমতি ছাড়া আমার তোলা আলোকচিত্রগুলি এবং ব্লগের রচনাগুলি অন্য কোথাও কপি-পেস্ট বা বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করা চলবে না।

******************************************************

কলকাতার চিনাদের নিয়ে আরও কিছু ব্লগ -

তথ্যসূত্র 

  • Home, city and diaspora: Anglo–Indian and Chinese attachments to Calcutta - ALISON BLUNT AND JAYANI BONNERJEE
  • ICOA1994: Revival Of Kolkata’s Chinatown: Democracy And Its Role In Safeguarding The Heritage Of Ethnic Minorities In INDIA by Kamalika Bose
  • Urban Ethnic Space: A Discourse on Chinese Community in Kolkata, West Bengal
  • The Chinese in South Asia – by Zhang Xing and Tansen Sen
  • THE CHINESE OF CALCUTTA - Jawhar Sircar
  • Revival of Kolkata’s Chinatown: Democracy and Its Role in Safeguarding the Heritage of Ethnic Minorities in India – by Kamalika Bose
  • The Chinese in Calcutta: A Study on Settlement and Demographical Patterns – by Arpita Bose
  • The Chinese Community of Kolkata: A Case Study on Social Geography – by Debarchana Biswas

Comments