সি ভই ইউন লিওং ফুথ চার্চ, কলকাতা ।। Sea Voi Yune Leong Futh Church, Kolkata

রুয়ান জিউ ও লিয়াং সিয়েং

কলকাতার টিরেটা বাজার চত্বরে গড়ে ওঠা চিনা চার্চগুলির মধ্যে অন্যতম চার্চ হল সি ভই ইউন লিওং ফুথ চার্চঠিকানা ১৭ ব্ল্যাক বার্ন লেন, কলকাতা - ৭০০০১২ চিনের গুয়াংডং প্রদেশের সিহুই শহর থেকে আসা চিনারা তৈরি করেন এই চার্চ বা মন্দিরকলকাতার এমনকি ভারতবর্ষের চিনাদের তৈরি করা মন্দিরগুলির মধ্যে এই মন্দির এক অন্য ইতিহাস বহন করে চলেছে ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি হওয়া চিনাদের এটি একমাত্র মন্দির যেখানে দেবতা রুয়ান জিউ ও লিয়াং সিয়েংকে একসাথে দেখতে পাওয়া যায়। চিনাদের, বিশেষ করে সিহুই সম্প্রদায়ের কাছে এরা উভয়েই বুদ্ধের অবতার হিসাবে পূজিত হয়ে আসছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে চিনা অভিবাসনের সময় চিনারা যখন একে একে নিজেদের দেশ ছেড়ে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় পাড়ি দিতে শুরু করে, সেইসময় সিহুই আদিবাসীরাও বেড়িয়ে পরে নিজেদের স্থানীয় দেবতা রুয়ান ও লিয়াং বুদ্ধকে সাথে নিয়েবিদেশের ভূমিতে সর্বপ্রথম মালয়েশিয়ায় কুয়ালালামপুরে রুয়ান ও লিয়াং বুদ্ধকে উৎসর্গ করে গড়ে তোলা হয় মন্দির, সম্ভবত ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দ। আর ভারতের মাটিতে সর্বপ্রথম ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার টিরেটা বাজার চত্বরে সিহুইবাসীরা স্থাপন করেন তাদের নিজস্ব মন্দির সি ভই ইউন লিওং ফুথ চার্চ, যেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় রুয়ান ও লিয়াং বুদ্ধ। রোমানাইজেসনের ফলে কলকাতা এবং মালয়েশিয়ায় ক্যান্টনিজ উচ্চারণে রুয়ান হয়ে যায় ইউন এবং লিয়াং হয়ে যায় লিওং, আর ফুথ অর্থাৎ বুদ্ধ। মালয়েশিয়া ও কলকাতার মন্দিরের মধ্যে মূল পার্থক্য হল, কলকাতার এই একমাত্র মন্দির যেখানে রুয়ান বুদ্ধ ও লিয়াং বুদ্ধকে পাশাপাশি দেখতে পাওয়া যায়।

ব্ল্যাক বার্ন লেন ( নিচে বামদিকে মন্দির ও ডানদিকে হুইগুয়ান)

চিনা অভিবাসন / মাইগ্রেসান

        ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই চিনের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে তারা বেড়িয়ে পরে বিদেশের মাটিতে বসবাস স্থাপনের আসায়। ব্যবসায়িক সূত্র ছাড়াও, কখনো গৃহযুদ্ধ তো কখনো দেশীয় অর্থনৈতিক মন্দা, আবার কখনো কর্মসংস্থানের আশায় ভিটেমাটি ছেড়ে তারা যাত্রা শুরু করে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া এমনকি ভারতের মাটিতেও তারা চলে আসে নতুন কর্মসংস্থানের আশায়। ব্রিটিশ সরকারের সময় হাতেকলমে ভারতে প্রথম চিনা নাগরিক হিসাবে নাম উঠে আসে ইয়াং দাইজাং বা টং আছু, যিনি কলকাতার আছিপুরে সুগার মিল প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও চিনের গুয়াংডং প্রদেশ, হুবেই, শাংডং, দোংগাং, সিহুই প্রভৃতি প্রদেশ থেকে চিনারা এসে বসবাস করতে থাকে কলকাতায়। আছিপুর ছাড়াও প্রথমদিকে এইসব চিনারা আশ্রয় নেয় ধর্মতলার কসাইতলা অঞ্চলে, এবং এখান থেকেই তারা কলকাতার আরও উত্তরদিকে বসবাস স্থাপন করে। বর্তমানে লোকমুখে পরিচিত টেরিটি বাজার আসলে নাম টিরেটা বাজার। এই টিরেটা বাজার চত্বরই হল কলকাতার পুরনো চিনাপাড়া বা ওল্ড চায়নাটাউন। এই টিরেটা বাজারের পরিকল্পনা করেন এক ইতালিয়ান আর্কিটেকচার এদুয়ারদো টিরেটা, যার নাম থেকেই এই বাজারের নামকরণ। কর্মসংস্থানের লক্ষে বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসা চিনারা যুক্ত হয়ে যায় তাদের নিজস্ব পেশায়। দক্ষ শ্রমিকেরা ছুতোর মিস্ত্রি, জুতো তৈরি, দাঁতের ডাক্তার, চিনা রেস্টুরেন্ট এবং অদক্ষ শ্রমিকেরা শ্রমের বিনিময়ে যুক্ত করে নেয় বিভিন্ন কাজে। এদিকে বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসা চিনাগোষ্ঠীরা নিজেদের প্রয়োজনে গড়ে তোলেন ক্লাব (হুইগুয়ান) ও চার্চ (পাগোডা / মন্দির)। চিনাদের উপাসনা গৃহকে মন্দির বা প্যাগোডা হিসাবে সম্বোধন করা হলেও ব্রিটিশ শাসিত অঞ্চলগুলিতে সেগুলি চার্চ হিসাবেই পরিচিত পায়, তাই কলকাতায় তৈরি করা চিনা মন্দিরগুলি প্রকাশ পায় চার্চ হিসাবে। সাধারণত চিনাদের হুইগুয়ানগুলি ছিল একটি আড্ডার জায়গা, যেখানে চিনা অভিবাসীরা একত্রিত হত। দিনের শেষে কিমবা দিনের শুরুতে মিলিত হত তারা। আড্ডা, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সাম্প্রদায়িক সমাবেশ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে তারা ব্যবহার করত এই হুইগুয়ানগুলিকে। এই হুইগুয়ানগুলি ছিল একমাত্র মাধ্যম যেখানে তারা একত্রিত হয়ে মানুষের সেবায় নিযুক্ত হত। সেই সময় চিনের বিপ্লবকে সমর্থনের জন্য এই হুইগুয়ানগুলি থেকেই টাকাপয়সা পাঠাতেন চিনের সান ইয়েত-সেন (চীন প্রজাতন্ত্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি) -কে। কলকাতার টিরেটা বাজার চত্বরেই গড়ে উঠেছিল এইরকম ৬ টি হুইগুয়ান (হুই-কুয়ান) ইক্সিং হুইগুয়ান (ইয়ে হিং), নাঙ্কসুন হুইগুয়ান (নাম শুন), সিয়ি হুইগুয়ান (সি ইপ), ডংআন হুইগুয়ান (তুং অন), হুইনিং হুইগুয়ান (ওয়েই নিং), ঝোংইতাং / জিয়াইং হুইগুয়ান। সমাবেশ স্থান হিসাবে পরিচালনা হওয়া ছাড়াও হুইগুয়ানগুলির দায়িত্বে ছিল নিজেদের কবরস্থান (ট্যাংরা অঞ্চলে) ও একটি করে মন্দির। যেহেতু এই হুইগুয়ানগুলিই ছিল তাদের একমাত্র মিলনস্থল, তাই এখানেই তারা তৈরি করেছিল নিজেদের মন্দির। সাধারণত হুইগুয়ানগুলির নিচের তলা কিমবা পাশের ঘরে গড়ে উঠত এই মন্দির। আর এইসব হুইগুয়ানগুলির পরিচালনায় টিরেটা বাজার চত্বরে গড়ে উঠেছিল ৬ টি চার্চ / মন্দির। সি ইপ চার্চ, তুং অন চার্চ, নাম সুন চার্চ, গি হিং চার্চ, সি ভই ইউন লিওং ফুথ চার্চ এবং চুংঘি ডং থিয়েন হাওই চার্চ। কলকাতার বুকে এখনও চিনাদের এই ছয়টি মন্দির দেখতে পাওয়া যায় এবং প্রত্যেকটি এখনও সক্রিয়।

হুইনিং হুইগুয়ান

সি ভই ইউন লিওং ফুথ চার্চ

তবে চিনাদের এই অভিবাসন (মাইগ্রেসান) মোটেই সুখকর ছিল না। ১৯৬০ এর ভারত-চিনের যুদ্ধ শুরু হওয়ায় ধীরে ধীরে কলকাতার চিনা পরিবারের সংখ্যা কমতে থেকে। চিনাদের তৈরি করা একের পর এক রেস্টুরেন্ট (নানকিং রেস্টুরেন্ট), দোকানপাট বন্ধ হতে থাকে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার খাতিরে কলকাতায় বসবাসকারী চিনাদের গুপ্তচর হিসাবে সন্দেহ করা হয়। শুধুমাত্র কলকাতায় নয়, দেশের সমস্ত প্রান্তে শুরু হয় অভিযান। কোন কারণ ছাড়াই একের পর এক চিনাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় দেওলি (রাজস্থানের) ডিটেনশান ক্যাম্পেগ্রেফতারের পর তাদের যাবতীয় নথি, পাসপোর্ট নষ্ট করে ফেলা হল। এমনকি যুদ্ধ মিটে যাওয়ার পরেও চলতে থাকে অত্যাচার। যাদের সামর্থ্য ছিল তাঁরা পালিয়ে যায় অন্যান্য দেশে। আর যারা পারল না, তারা থেকে গেল এই কলকাতায়। কিন্তু তাদের জীবনযাপন হয়ে উঠল দুর্বিষহ, কারণ বেশিরভাগ জায়গাই হয় দখল করে নেওয়া হল আর নাহলে তাদের এক ঘরে করে দেওয়া হল। তাদের চলাচলের ব্যাপারেও শুরু হল সীমাবদ্ধতা। বিনা অনুমতিতে শহরের বাইরে এমনকি টিরেটা বাজারের বাইরে যাওয়া ছিল নিষেধ। আর এখান থেকেই কলকাতায় বসবাসকারী চিনাদের সংখ্যা কমতে শুরু করে। তথ্য অনুযায়ী ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের জনগণনায় চিনাদের নাম প্রকাশ করা না হলেও অনুমান করা যায় সংখ্যাটি ২০০০ -এর কমই হবে। আর বর্তমানে সংখ্যাটি ১০০০ হবে কিনা সন্দেহ।

সি ভই ইউন লিওং ফুথ চার্চ - উপাসনাগৃহ

সি ভই ইউন লিওং ফুথ চার্চ - উপাসনাগৃহ (চিত্র ২)

সি ভই ইউন লিওং ফুথ চার্চ

চিনা অভিবাসের সময় গুয়াংডং প্রদেশের সিহুই অঞ্চল ও কিছুটা গুয়ানিং অঞ্চল থেকে আসা চিনারা গড়ে তুলেছিলেন হুইনিং হুইগুয়ান। যেখানে হুই শব্দটি এসেছে সিহুই থেকে এবং নিং শব্দটি গুয়ানিং থেকে। কলকাতার চিনাদের মধ্যে সিহুই অঞ্চল থেকে আসা চিনাদের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে কম। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ও বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে এরা মূলত কলকাতায় আসে কর্মসংস্থানের সুযোগে। এশিয়ার বন্দরে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বিভিন্ন কাঠের / ছুতোর কাজে এরা যুক্ত ছিল। টিরেটা বাজার চত্বরের যোগাযোগ ভবন / বি.এস.এন.এল এর অফিসের ঠিক উল্টোদিকের রাস্তার নাম ব্ল্যাক বার্ন লেন। রাস্তাটিই ধরে কিছুটা এগোলেই সামনের মোড়ে দেখতে পাওয়া যাবে একটি ছোট্ট মন্দির। গাড় লাল রঙে রাঙানো বাড়িগুলির মধ্যে একদম কোণ ঘেঁষে রয়েছে একটি চিনা মন্দির সি ভই ইউন লিওং ফুথ চার্চ। মন্দিরের লাগোয়া পিছন দিকেই রয়েছে একটি ঘর যা একসময় ছিল হুইনিং হুইগুয়ান। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে সিহুই অঞ্চল থেকে আসা চিনারা তৈরি করেন এই হুইগুয়ান, মন্দির ও হুইনিং শাংঝুয়াং নামে কবরস্থান। কলকাতার আর পাঁচটি চিনা মন্দিরের থেকে এই মন্দিরটি সবথেকে ছোট। শুধুমাত্র একটি ঘরের মধ্যেই বিরাজ করছে চিনাদের বিভিন্ন দেবতা। মন্দিরটি মূলত উৎসর্গ করা হয়েছে রুয়ান জিউ ও লিয়াং সিয়েং বুদ্ধ কে, যারা চ্যান বৌদ্ধধর্মে সিহুই আদিবাসীদের কাছে বুদ্ধ হিসাবে পরিচিত।

পূর্বপুরুষদের কাছে প্রার্থনা জানানোর ফলক

চিনা বাদ্যযন্ত্র

রুয়ান জিউ ও লিয়াং সিয়েং

বৌদ্ধ শিক্ষা অনুসারে শাক্যমুনি ছিলেন বর্তমান যুগের বুদ্ধ, যিনি খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে বসবাস করতেন। বলা হয় পরবর্তী বুদ্ধ, যিনি মৈত্রেয় নামে পরিচিত, তিনি ভবিষ্যতে আবির্ভূত হবেন ত্রাণকর্তা হিসাবে যেখানে তিনি বিশ্বের এই চরম অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলতা থেকে মুক্তির পথ দেখাবেন। বৌদ্ধ ধর্মের এই বৈচিত্র্যময়ের জন্য ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দীতে চিনে চ্যান বা জেন প্রথা বুদ্ধের এই একাধিক অস্তিত্বের ধারণাকে প্রচার করতে থাকে। চ্যান (সংস্কৃত ধ্যান শব্দ থেকে আগত) মহাযান বৌদ্ধধর্মের একটি চিনা স্কুল / সম্প্রদায়, যা তাং এবং সং রাজবংশের সময় জনপ্রিয়তা লাভ করে। তারা বিশ্বাস করেন প্রতিটি মানুষ বুদ্ধ প্রকৃতির অধিকারী এবং সম্ভাব্য বুদ্ধ হতে পারেন।

চ্যান বৌদ্ধধর্মে ষষ্ঠ এবং অন্যতম পূর্বপুরুষ হলেন দাজিয়াং হুইনেং রুয়ান জিউ ও লিয়াং সিয়েং চ্যান সম্প্রদায়ের এই ষষ্ঠ পিতৃপুরুষ হুইনেং এর অনুগামী ছিলেন। হুইনেংএর মতোই রুয়ান এবং লিয়াং-এর কাহিনীগুলি রূপ নেয় তাঁদের মৃত্যুর প্রায় সাত শতাব্দী পর। রুয়ান এবং লিয়াং সিহুই অদিবাসী হলেও তাঁরা কেউই চ্যান সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। শৈশব থেকেই রুয়ান অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। ছোট বেলায় বাবা-মা মারা যাওয়ায় রুয়ান জিউ হুইনেং এর কাছ থেকে শিক্ষার্জন করতে থাকে গল্পের এই সংস্করণ অনুসারে হুইনেং নিজে রুয়ান-এ প্রাকাশিত করে বৌদ্ধ শিক্ষা প্রেরণ করেন এবং এরপরেই ধ্যানরত্ন অবস্থায় রুয়ান মারা যান। পরে তাঁর বোন একটি চিত্রশিল্পীকে দিয়ে রুয়ানের ছবি আঁকিয়ে নেন, যা বর্তমানে চিনের বাওলিন মন্দিরে স্থাপন করা হয়েছে। গ্রামবাসীরা যখনই খরার সম্মুখীন হন তখন সকলেই বৃষ্টির জন্য রুয়ান-কে স্মরণ করেন। তবে গল্পের আর এক সংস্করণে রুয়ান-কে তাওইস্ট মাস্টার রুয়ান বলে সম্বোধন করা হয়েছে। রুয়ানের মত লিয়াং সিয়েং এর গল্প সময়ের সাথে সাথে সিহুই আদিবাসীদের থেকে সমগ্র চিনে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। চিনের বাওশেং মন্দিরের একটি শিলালিপি থেকে জানা যায়, লিয়াং খুব অল্প বয়স থেকেই সন্ন্যাসী হয়ে ওঠেন এবং তাঁর গুরুর সাথে বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। লিয়াং-এর কাহিনী থেকে জানা যায় যে, লিয়ানের শরীরে চর্মরোগ ছিল, তবে এর কারণে তাঁর উদারতার কোন খামতি দেখা যায়নি। চর্মরোগের এই যন্ত্রণা ভুলে তিনি দরিদ্র ও বৃদ্ধদের সেবা করে আসতেন। আর এভাবেই শান্তিপূর্ণভাবে থাকা লিয়াং একদিন ধ্যান অবস্থায় মারা যান। এবং এরপর থেকেই লিয়ান (বুদ্ধকে) খরা ও বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের জন্য পূজিত হয়ে থাকেন। 

কাঠে খোদাই করা চিনের সামাজিক চিত্র

বামদিকের পাত্রটি কাউ চিম ও কাঠে খোদাই করা চিনের সামাজিক চিত্র

কাঠে খোদাই করা চিনের সামাজিক চিত্র - ২

সিহুই আদিবাসীরা বিশ্বাস করেন সং রাজবংশের সময় তাঁরা জ্ঞান অর্জন করেছিলেন এবং বুদ্ধ হিসাবে রুপান্তর হয়েছিলেন। রুয়ান জিউ অর্থাৎ রুয়ান বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১০৭৯ খ্রিষ্টাব্দে এবং মারা যান ১১০২ খ্রিষ্টাব্দে। অন্যদিকে লিয়াং সিয়েং অর্থাৎ লিয়াং বুদ্ধ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১০৯৮ খ্রিষ্টাব্দে এবং মারা যান ১১১৬ খ্রিষ্টাব্দে। পরবর্তীকালে চিনাদের বিভিন্ন স্থানীয় সংস্করণ থেকে জানা যায় লিয়াং রুয়ানের কাছ থেকে বৌদ্ধধর্মের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন এবং এর হিসাবেই মোটামুটি একটি বংশতালিকা উঠে আসে, যেখানে রুয়ান ও লিয়াং-এর যোগসূত্র দেখতে পাওয়া যায় (হুইনেং  রুয়ান জিউ লিয়াং সিয়েং)। এরপর ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে সিহুইয়ে শুরু হয় যুদ্ধ, বলা চলে বিদ্রোহ ও অর্থনৈতিক মন্দাপ্রায় ১০০ দিনেরও বেশি সময় ধরে শহরকে পুরো ঘিরে ফেলা হয়। শেষে চিনের কিং সেনাবাহিনীর কাছে রিবেলিয়ানরা তাদের হার স্বীকার করলে বিদ্রোহের সমাপ্তি হয় তবে এই শান্তির জন্য সিহুই আদিবাসীরা সমগ্র কৃতিত্ব দেয় রুয়ান ও লিয়াং বুদ্ধকে। তাই যুদ্ধের সমাপ্তির পরেই সিহুই আদিবাসীরা একে একে দেশ ছেড়ে আসতে থাকে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায়। তাদের মনে হয়, রুয়ান এবং লিয়াং-এর এই অলৌকিক ক্ষমতা বিদেশের ভূমিতে তাদের শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে এবং নিজেদের জন্মভূমির সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করতে সাহায্য করবে।

আর এভাবেই চিনা অভিবাসনের সময় সিহুইবাসীরাও চলে আসে কলকাতায়। যেখানে রুয়ান ও লিয়াং বুদ্ধকে উৎসর্গ করে গড়ে তোলে মন্দির।

পূর্বপুরুষদের কাছে প্রার্থনা জানানোর ফলক (চিত্র ২)

পূর্বপুরুষদের কাছে প্রার্থনা জানানোর ফলক (চিত্র ২)

চার্চ / মন্দিরের গঠন প্রকৃতি

আগেই বলেছি টিরেটা বাজার চত্বরে গড়ে ওঠা চিনাদের আর পাঁচটি মন্দিরের থেকে এই মন্দিরটি অনেকটাই ছোট। শুধুমাত্র একটি ঘরের মধ্যেই গড়ে উঠেছে উপাসনালয়। রাস্তা থেকে দেখলে মন্দিরের উপরে অর্থাৎ দ্বিতলে হুপে অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সাইন বোর্ড দেখতে পাওয়া যায়, এর নিচেই হল সি ভই ইউন লিওং ফুথ চার্চ। সম্প্রতি দ্যা চা প্রোজেক্ট এর উদ্যোগে সমগ্র চিনাপাড়া সংস্কারের সময় এই মন্দিরেরও সংস্কার করা হয়। বর্তমানে মন্দিরের ভিতরে আধুনিকতার ছাপ স্পষ্ট, যেমন মন্দিরের দেওয়ালে বসানো মার্বেল। মন্দিরের মূল দেবতা রুয়ান বুদ্ধ ও লিয়াং বুদ্ধ ছাড়াও রয়েছে চিনাদের আরও দেবতা। লু বান চিনা পুরাণ অনুযায়ী তিনি কারিগর, প্রযুক্তি বিষয়ক বা শিল্পকলার দেবতা; যাকে গড অফ কারপেন্টার হিসাবে সম্বোধন করা হয়। এই লু বান দেবতাই ব্যাখ্যা করে কলকাতায় আসার পর সিহুই গোষ্ঠীরা কাঠের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এছাড়াও মন্দিরে আরও দুটি দেবদেবী দেখতে পাওয়া যায় টুডি গংটুডি পো। পৃথিবীর অর্থাৎ ভূমির দেবতা হলেন টুডি গং এবং তাঁর সহধর্মিণী হলেন টুডি পো। কলকাতার প্রায় বেশিরভাগ চিনাদের বাড়িতেই এদের মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। এই টুডি গং ও টুডি পো র সাথে জুড়ে রয়েছে কলকাতার চিনাদের এক গভীর সম্পর্ক। টং আছু, যাকে ভারতের প্রথম চিনা নাগরিক হিসাবে মেনে নেওয়া হয়েছে, তাঁকে কলকাতার চিনারা তাদের পূর্বপুরুষ হিসাবে পুজো করেন। এই টং আছু সর্বপ্রথম কলকাতার আছিপুরে চিনা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এবং ভূমির দেবতা টুডি গং ও টুডি পো -কে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। তাই আছিপুরের মন্দির চিনাদের কাছে এক প্রধান তীর্থস্থান।  আছিপুর ছাড়া সম্ভবত টিরেটা বাজারের এই মন্দিরেই টুডি গং ও টুডি পো-র বিগ্রহ দেখতে পাওয়া যায়।

*** এখানে বলে রাখি, চিনাদের এটি একমাত্র মন্দির যেখানে মন্দিরের ভিতরে ছবি তুলতে হলে আপনাকে অনুমতি নিতে হবে।

টুডি গং ও টুডি পো

উপাসনাগৃহের বেদির সামনে থাকা 'টোক ওয়াই' (কাপড়ের মধ্যে সুন্দর শিল্পকলা)

কাঠের বেদির আলংকারিক নকশা

সেই ভুই রেস্টুরেন্ট ও বেঁচে থাকার লড়াই

কলকাতায় বসবাসকারী চিনাদের মধ্যে এই সিহুইবাসী চিনাদের সংখ্যাই সবচেয়ে কম। ভবিষ্যতে হয়তো সেই সংখ্যা আরও কমে যাবে। চিনাদের ক্ষেত্রে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই কর্মসংস্থানের সুযোগে পাড়ি দিচ্ছে বিভিন্ন দেশে। কলকাতার চিনাপাড়ায় যেকজন চিনারা বসবাস করছে তাদের মধ্যে হাক্কা এবং ক্যান্টনিজদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। তবে অন্যান্য গোষ্ঠীদের মতো হাতে গোনা সিহুইবাসীরাও যুক্ত হয়েছে অন্যান্য কর্মকাণ্ডে। খাঁটি চিনা খাবার, যার সঙ্গে অনেক আগে থেকেই জড়িয়ে গেছে খাদ্যরসিক বাঙালি। আর কলকাতার মানুষদের এই খাঁটি চিনা খাবার উপহার দেওয়ার জন্য সিহুই সম্প্রদায়ের কিছু চিনারা মিলে তৈরি করেছেন সেই ভুই রেস্টুরেন্ট। সি ভই ইউন লিওং ফুথ চার্চের পিছনদিকেই রয়েছে তাদের কমিউনিটি হল, আর এর ঠিক পিছনেই তৈরি হয়েছে এই চিনা রেস্টুরেন্ট। তবে রেস্টুরেন্ট যে জায়গায় গড়ে উঠেছে, আগে ১৯৩০ এর দিকে এই জায়গাটি ছিল চিনাদের ছাত্রাবাস, যেখানে চিন-জাপানের যুদ্ধ চলাকালীন ক্যান্টন থেকে আসা শরণার্থীদের এখানে থাকতে দেওয়া হত। কিন্তু ভারত-চিনের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে চিনাদের বসতি কমতে শুরু করলে এই ছাত্রাবাসও ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। আর সম্প্রতি সেই জায়গাটিতেই সিহুই কমিউনিটির দৌলতে গড়ে উঠেছে সেই ভুই রেস্টুরেন্ট। যাদের লক্ষ্য কলকাতার মানুষদের কাছে খাঁটি চিনা খাবারের পরিচয় ঘটানো। আর রেস্টুরেন্ট থেকে আসা লভ্যাংশের অনেকটাই তারা ব্যবহার করছে তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে; যেখানে সি ভই ইউন লিওং ফুথ চার্চ ও তাদের কমিউনিটি হল (হুইগুয়ান) পরিচালিত হয়ে আসছে। 

******************************************************

লেখা, গবেষণা ও ছবি - প্রীতম নস্কর  

ই-মেল - pritamnaskar.pn@gmail.com

ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে ব্লগের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, তবে পূর্বানুমতি ছাড়া আমার তোলা আলোকচিত্রগুলি এবং ব্লগের রচনাগুলি অন্য কোথাও কপি-পেস্ট বা বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করা চলবে না।

******************************************************

ডানদিকে - সেই ভুই রেস্টুরেন্ট

গুগল ম্যাপ / কোঅরডিনেট -

কলকাতার চিনাদের নিয়ে আরও কিছু ব্লগ -

তথ্যসূত্র

  • The Bowbazar Chinatown – by Zhang Xing
  • Travelling Pasts: The Politics of Cultural Heritage in the Indian Ocean World – by Burkhard Schnepel and Tansen Sen
  • The Chinese in South Asia – by Zhang Xing and Tansen Sen
  • ICOA1994: Revival Of Kolkata’s Chinatown: Democracy And Its Role In Safeguarding The Heritage Of Ethnic Minorities In INDIA by Kamalika Bose
  • The Chinese in Calcutta: A Study on Settlement and Demographical Patterns – by Arpita Bose 

Comments