১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি দুইতল বিশিষ্ট এই তুং অন চার্চ –এর ঠিকানা ২২ নম্বর ব্ল্যাকবার্ন রোড, কলকাতা - ৭০০০১২। বর্তমানে যেখানে বিএসএনএল কার্যালয় অথবা যোগাযোগ ভবন ঠিক তার সামনেই দেখতে পাওয়া যাবে এই চার্চকে। ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে দেশান্তর হওয়ার পর চিনারা বসবাস শুরু করে কলকাতার এই টিরেটা বাজার চত্বরে।বসবাস শুরু করার পর প্রথম থেকেই বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসা চিনাদের বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের নিজেদের জন্য তৈরি করে ক্লাব (হুইগুয়ান) ও চার্চ (প্যাগোডা)। সেইমতো চিনের গুয়াংদং প্রদেশ থেকে আসা ক্যন্টনিজ গোষ্ঠী ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার এই জায়গাটি কেনে এবং ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে ক্যান্টনিজ গোষ্ঠীরা তৈরি করে এই তুং অন চার্চ।
চার্চের প্রবেশদ্বারে চিনা ক্যালিগ্রাফি |
চার্চটি উৎসর্গ করা চিনা দেবতা কুয়ান তি বা গুয়ান ইউ কে, যিনি যুদ্ধের দেবতা নামে পরিচিত। কিন্তু পূর্বে এই গুয়ান ইউ ছিলেন রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। চিনে হান সাম্রাজ্যের সময় এই গুয়ান ইউ ছিলেন হান রাজবংশের জেনারেল, চিনা ঐতিহাসিক উপন্যাস “রোমান্স অফ দ্যা থ্রি কিংডম” অনুযায়ী সেনাপতি লিউ বেই –এর অধীনে ছিলেন গুয়ান ইউ। হান বংশের পত্তন ও চিনে তিনটি রাজ্যের সূত্রপাত, এমনকি ‘ব্যাটেল অফ রেড ক্লিফ’, ‘ব্যাটেল অফ বোমা’ –এও গুয়ান ইউ এর ভূমিকা পাওয়া যায়।
চিনা দেবতা কুয়ান তি |
চিনা দেবতা কুয়ান তি ও সঙ্গী লিউ বেই ও ঝাং বেই |
১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে অউ চিনা পরিবার এই চার্চেরই নিচের তলায় গড়ে তোলে ভারতের প্রথম চিনা রেস্টুরেন্ট – ‘নানকিং রেস্টুরেন্ট’। উনিশ দশকে এই নানকিং রেস্টুরেন্ট ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়, গান বাজনায় মেতে থাকত সমগ্র চিনাপাড়া এবং খাঁটি চিনা খাবারের স্বাদ কলকাতার মানুষের কাছে ছিল তখন স্বর্গ। বিভিন্ন পত্রিকা থেকে জানা যায় সেই সময়কার বলিউডের সুপারস্টার রাজ কাপুর, দিলীপ কুমার –এর মত অভিনেতাদের, এমনকি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়েরও পছন্দের জায়গা ছিল এই নানকিং রেস্টুরেন্ট। কিন্তু ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয় সিনো-ইন্ডিয়ান যুদ্ধ। ভারত ও চিনের মধ্যে যুদ্ধ চলাকালীন প্রভাব পরে এই চিনা পাড়ায়। দেশান্তর হওয়ার পর যারা এখানে বসবাস শুরু করেছিল, একে একে তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হল রাজস্থানের দেওলিতে। সেখানে বছরের পর পর আটকে রাখা হল তাদের। আর যারা থেকে গেছিল কলকাতায়, তারা কোনভাবে নিজেদের দিন কাটাতে শুরু করল। বোঝাই যাচ্ছে সেই পরিস্থিতিতে নানকিং রেস্টুরেন্ট চালানো ছিল কতটা দুস্কর। সুতরাং এখান থেকেই শুরু হল নানকিং রেস্টুরেন্টের পত্তন, শেষে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে সর্বসাধারণের জন্য বন্ধ হয়ে যায় নানকিং রেস্টুরেন্ট।
কাঠের অলংকরণ |
বিভিন্ন চিনা দেবতা |
রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেলেও চিনা পাড়ায় থাকা চিনারা কোনক্রমে চার্চটিকে ব্যবহার করতে থাকে। কিন্তু অউ পরিবার একে একে চার্চের সমস্ত দুর্লভ আসবাবপত্র বিক্রি করতে শুরু করল। কিছু আসবাবপত্র নিলামে গেল আর বাকি নিজের দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হল। এমনকি ২০০৮ সালে এই অউ পরিবার চার্চটিকে বিক্রির জন্যও উঠে পড়ে লাগল। কিন্তু এসময় কলকাতার চিনারা রুখে দাঁড়ালেন, মামলা গড়ালো কোর্ট পর্যন্ত। শেষমেশ কোর্ট রায় দিল কোনমতেই চার্চটিকে বিক্রি করা যাবে না। ফলে চার্চটি কোনোরকমে অক্ষত রয়ে গেল। সম্প্রতি বলিউড সিনেমা ডিটেকটিভ ব্যোমকেশবক্সী –তে এই নানকিং রেস্টুরেন্ট এর পুনর্গঠন করেও দেখানো হয়েছে।
চার্চের নিচের তলে অবস্থিত গৌতম বুদ্ধ |
চার্চের নিচের তল যেখানে গড়ে উঠেছিল নানকিং রেস্টুরেন্ট |
কিন্তু ক্রমশ কলকাতায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে শুরু হতে লাগল বড় বড় ইমারত। উঁচু উঁচু বাড়ির / ইমারতের ভিড়ে ধুকতে থাকা তুং অন চার্চের সামনে বসবাস শুরু করতে লাগল কিছু অবাঙালি পরিযায়ী পরিবার। চার্চের সামনেই গড়ে উঠল শহরের আবর্জনার ঠিকানা। শেষে দ্যা চা প্রোজেক্ট এর উদ্যোগে চিনা পাড়া নবীকরণের সময় তুং নাম চার্চ নতুন করে তার রূপ ফিরে পায়। বর্তমানে চার্চের নিচের তলায় বিরাজ করছে গৌতম বুদ্ধ, যা সাম্প্রতিক সিঙ্গাপুর থেকে কোন সংস্থা দান করেছে আর উপরের তলায় রয়েছে শুধুমাত্র কুয়ান তি। কিন্তু এতকিছুর পরেও এখনও রয়ে গেছে পরিযায়ী শ্রমিকের বসবাস আর শহরের জঞ্জাল, পৌরনিগম এব্যাপারে নতুন ভেন্ডিং মেশিন বসালেও সেরকম কোনো সুবিধা করতে পারেনি। চার্চের সদস্যরা বারংবার এব্যাপারে কলকাতা পৌরনিগমসংস্থাকে জানিয়েও কোনো ব্যবস্থা হয়নি। তাই এই জঞ্জালের মাঝে আজও শহরের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পরিচিত মেরুন রঙের তুং অন চার্চ, যেখানে আজও অস্ত্র হাতে বিরাজ করছে চিনা দেবতা কুয়ান তি ও সঙ্গী হিসাবে রয়েছে লিউ বেই ও ঝাং বেই।
প্রবেশদ্বারে কাঠের অলংকরণ ও চিনা দেবতা |
******************************************************
লেখা, গবেষণা ও ছবি - প্রীতম নস্কর
ই-মেল - pritamnaskar.pn@gmail.com
ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে ব্লগের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, তবে পূর্বানুমতি ছাড়া আমার তোলা
আলোকচিত্রগুলি এবং ব্লগের রচনাগুলি অন্য কোথাও কপি-পেস্ট বা বাণিজ্যিক ভাবে
ব্যবহার করা চলবে না।
******************************************************
কীভাবে যাবেনঃ-
হাওড়া থেকে যে কোন বাস / ট্যাক্সি ধরে নামতে হবে টি-বোর্ড সেখান থেকে মিনিট দশেক পায়ে হেঁটে পৌঁছাতে হবে টিরেটা বাজার অথবা কলকাতা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ। অথবা কলকাতার সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশনের গেট নং ৪ –এ উঠে পৌঁছাতে হবে কলকাতা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ / যোগাযোগ ভবন। ঠিক যোগাযোগ ভবনের পাশেই দেখতে পাবেন মেরুন রঙের এই তুং অন চার্চ।গুগল ম্যাপ / কোঅরডিনেটঃ-
আরও কিছু কলকাতার চিনা চার্চঃ-
- কলকাতার পুরানো চিনাপাড়া - টিরেটা বাজার
- সি ইপ চার্চ
- নাম সুন চার্চ
- তুং অন চার্চ ও নানকিং রেস্টুরেন্ট
- সি ভই ইউন লিওং ফুথ চার্চ
- আছিপুর চিনা মন্দির
তথ্যসূত্রঃ-
- Heritage Buried Under Garbage, The Times of India, 18th December, 2013
- Temple for sale - Members of the Chinese community are fighting to save a part of the city's heritage from realtors – Telegraph India Published, 1st June, 2008
- The Cha Project Report - 2014
- “Raising Byomkesh” by Surajeet Das Gupta - Business Standard New Paper, 20th December. 2014
Comments
Post a Comment