![]() |
Gentoo Pagoda and House (1787) by Thomas Daniell |
বাংলার প্রথম কালো জমিদার হিসাবে পরিচিত গোবিন্দরাম মিত্র ১৭৩০ খ্রিষ্টাব্দে তখনকার চিতপুর রোডে তৈরি করেন পঞ্চরত্ন ও নবরত্ন মন্দির, যা ছিল সেই সময়কার বাংলার সবচেয়ে উচ্চতম মন্দির, যার উচ্চতা ছিল কলকাতার শহীদ মিনারের থেকেও বেশি। মন্দিরের শিখরের উচ্চতা ছিল এতটাই বেশি যে সেই সময়ে নাবিকেরা মন্দিরের চূড়া –কে দিক নির্ণয়ের প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করত।
কিন্তু কে এই গোবিন্দরাম? আর কেনই বা তিনি তৈরি করলেন এই মন্দির? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে ৩০০ বছর আগের কলকাতায়, যখন আমাদের কলকাতা পুরোপুরি কলকাতায় পরিণত হয়নি। গোবিন্দপুর, সুতানুটি ও কলিকাতা এই তিনটি গ্রাম গড়ে উঠেছিল হুগলী নদীর তীরে। ১৬৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সাবর্ণ রায়চৌধুরির কাছ থেকে এই তিনটি গ্রামের (গোবিন্দপুর, সুতানুটি ও কলিকাতা) জমিদারী-স্বত্ব কিনে নেয় এবং ১৬৯৯ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা রূপান্তরিত হয় প্রেসিডেন্সি শহরে। এরপর থেকেই শহর মোটামুটি দুটি ভাগে বিভক্ত হতে শুরু করে, একভাগ গড়ে ওঠে হোয়াইট টাউন হিসাবে যেখানে ছিল সাধারণত ইংরেজদের বসবাস আর অন্যটি ব্ল্যাক টাউন হিসাবে যেখানে বসবাস ছিল শুধুমাত্র এদেশীয়দের। জমিদারী-স্বত্ব কেনার স্বরূপ দেশীয় রাজস্ব আদায়ের জন্য ব্রিটিশ সরকার তৈরি করলেন এক কাউন্সিল যার মধ্যে ছিল প্রেসিডেন্ট, হিসাবরক্ষক, গুদামরক্ষক, খাজনা আদায়কারী। ১৭২০ খ্রিষ্টাব্দে এই কাউন্সিলের সদস্যে যুক্ত হল ‘জমিদার’ এবং এই জমিদারের অধীনে সৃষ্টি হল ‘ডেপুটি জেনারেল’ বা ‘কালো জমিদার’। এই ডেপুটি জেনারেলের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল রাজস্ব আদায়ের সময়েই, কারণ ব্রিটিশদের পক্ষে এই রাজস্ব আদায় ছিল দুস্কর। একে তো এদেশের ভাষা না জানা তার উপরে আবার শহরে নতুন; কে মানবে তাদের! তাই সরকার ঠিক করল জমিদার হতে হবে এমন একজনকে যে আদ্যপ্রান্ত এদেশীয়, এবং এভাবেই তৈরি হল ‘ডেপুটি জেনারেল’ যা পরিচিতি পেল ‘কালো জমিদার’ হিসাবে। এই কালো জমিদারের কাজই ছিল মূলত গ্রাউন্ড জিরোয় থেকে রাজস্ব আদায় করা, আর এই ‘কালো জমিদার’ পদেই নিযুক্ত করা হল গোবিন্দরাম মিত্র কে।
![]() |
A View of the Black Pagoda (1826), in the Chitpore Road Calcutta by James Baillie Fraser |
গোবিন্দরাম মিত্র ছিল কুমোরটুলির মিত্র বংশের পূর্বপুরুষ। ব্যারাকপুরে আদিবাসস্থান হলেও সপ্তদশ খ্রিষ্টাব্দের শেষে প্রথমে গোবিন্দপুরে এবং পরবর্তীকালে কুমোরটুলিতে এসে বসবাস শুরু করেন। ডেপুটি জেনারেল হিসাবে নিযুক্ত হওয়ার সময় গোবিন্দরামের মাইনে ছিল মাসিক ত্রিশ টাকা যা পরবর্তীকালে বেড়ে দাঁড়ায় মাসিক পঞ্চাশ টাকা। কিন্তু এই বেতনেও গোবিন্দরাম ঘাবড়ায়নি, কারণ তিনি জানতেন আসল ছড়ি তার হাতে আর তিনি হলেন এর সর্বেসর্বা। কারণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সেই সময় দেশীয় প্রজাদের পুরো শাসনভার তুলে দেয় ডেপুটি জেনেরেলের হাতে, ফলে খাজনা থেকে মোকদ্দমার অনেক অংশই ভরতে শুরু করে গোবিন্দরামের আড়তে। গড়পাড়ের লোক হলে কি হবে! হিসাব বুঝতেন তুখর। গ্রামের মানুষ সব ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকত তার দাপটে। এমনকি পরবর্তীকালে তরজা গানেও গোবিন্দরামকে নিয়ে দিব্যি ছড়া বানিয়ে ফেলে সেকালের মানুষ –
গোবিন্দরামের ছড়ি।
ঊর্মিচাঁদের দাড়ি,
হুজুরীমলের কড়ি।”
![]() |
Chitpore Road and Black Pagoda (1829), Calcutta by Thomas Prinsep |
‘ব্ল্যাক জামিনদার’ পদে থাকাকালীন গোবিন্দরামের সম্পত্তির পরিমান এতটাই বেড়ে যায় যে সেই সময়কার ব্রিটিশ জেনারেল জন জিফানিস হলওয়েল; গোবিন্দরাম কে ব্রিটিশ সরকারের খাজনা আত্মসাৎ ও তছরুপির জন্য নজরবন্দীর নির্দেশ দেয় এবং এর সঙ্গেই শুরু হয় মামলা মোকদ্দমা। কিন্তু সেসময়েও গোবিন্দরামের প্রতিপত্তি এতটাই ছিল যে ইংরেজ সরকার না তাকে ফাঁসি না তাকে হাজত বাস কোনটাই করাতে ব্যর্থ হয়।
এছাড়াও তাঁর প্রতিপত্তির দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় আরও কিছু যায়গায়। যেমন – বাংলায় বর্গী আক্রমনের সময় ১৭৪২ খ্রিষ্টাব্দে যে মারাঠা ডিচ বা মারাঠা খাল খোঁড়া হয়, গোবিন্দরামের বাগানবাড়ি রক্ষার জন্য সেই খাল তার ও ঊর্মিচাঁদের বাগানবাড়ির তিনপাশ দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এমনকি সিরাজের কলকাতা আক্রমনের সময়ও নবাব নিজে গোবিন্দরামের বাড়িতে পাহাড়া বসিয়েছিল যাতে বাড়ির ধনসম্পদ কেউ না লুঠ করতে পারে।
গোবিন্দরামের পঞ্চরত্ন ও নবরত্ন মন্দিরঃ-
মন্দিরের গঠন প্রকৃতি -
![]() |
গোবিন্দরামের নবরত্ন মন্দিরের বর্তমান রূপ |
কিন্তু এসবই আজ মানুষ ভুলতে বসেছে , সময়ের সাথে সাথে গোবিন্দরামও হারিয়ে গেছে কলকাতার ইতিহাসে, পরবর্তীকালে মিত্র বংশের শাখাও দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে, একভাগ রয়েগেছে কুমোরটুলিতে আর একভাগ চলে গেছে বেনারসে; রয়ে গেছে শুধুমাত্র তার নবরত্ন মন্দির।
![]() |
মন্দিরের বর্তমান বিগ্রহ |
![]() |
মন্দিরের বিপরীতেই বাগবাজার সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির |
কীভাবে যাবেনঃ-
বাসে যেতে চাইলে-ধর্মতলা বাস স্ট্যান্ড থেকে বাস নং ৪৩ (ধর্মতলা – দক্ষিণেশ্বর) নামতে হবে কুমোরটুলি অথবা বাগবাজার সিদ্ধেশ্বরী মন্দির। অথবা হাওড়া বাস স্ট্যান্ড থেকে বাস নং ২১৫এ (হাওড়া – সল্টলেক) নামতে হবে শোভাবাজার। সেখান থেকে মিনিট দশেক হাঁটা পথে পৌঁছাতে হবে কুমোরটুলি।
মেট্রোয় যেতে চাইলে-
মেট্রোয় যেতে চাইলে যে কোনো মেট্রো স্টেশন থেকে পৌঁছাতে হবে শোভাবাজার মেট্রো স্টেশন। সেখান থেকে মিনিট দশেক হাঁটা পথে পৌঁছাতে হবে কুমোরটুলি।
**যে কোনো ভাবেই পৌঁছাতে হবে কুমোরটুলির বনমালী সরকার স্ট্রিট। আর ঠিক তার পাশেই অথবা বাগবাজার সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরের ঠিক বিপরীতেই দেখতে পাওয়া যাবে গোবিন্দরামের নবরত্ন মন্দির।
******************************************************
লেখা, গবেষণা ও ছবি - প্রীতম নস্কর
ই-মেল - pritamnaskar.pn@gmail.com
ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে ব্লগের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, তবে পূর্বানুমতি ছাড়া আমার তোলা
আলোকচিত্রগুলি এবং ব্লগের রচনাগুলি অন্য কোথাও কপি-পেস্ট বা বাণিজ্যিক ভাবে
ব্যবহার করা চলবে না।
******************************************************
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ-
মন্দির সাধারণত সকালের সমস্থ সময়টাই খোলা থাকে।
তথ্যসূত্রঃ-
- কলিকাতা দর্পণ – রাধারমণ মিত্র
- কলকাতার মন্দির স্থাপত্য - তারাপদ সাঁতরা (কলকাতার পুরাকথা)
- কলকাতা সংক্রান্ত – পূর্ণেন্দু পত্রী
- শ্রীপান্থের কলকাতা – শ্রীপান্থ
- কলিকাতা সেকালের ও একালের – হরিসাধন মুখোপাধ্যায়
- জন কোম্পানীর বাঙালি কর্মচারী – নারায়ণ দত্ত
- hurricanescience.org - The Hooghly River Cyclone of 1737
- The 1737 Calcutta earthquake and cyclone evaluated by Roger Bilham
Comments
Post a Comment