নিমতলা ঘাট স্ট্রীট ধরে গঙ্গার দিকে যেতে গেলে ডানদিকে গাছের আস্তরণে ঢাকা জড়াগ্রস্থ এই অট্টালিকা অনেকেরেই চোখে পড়েছে, নামও সবার জানা, ‘জোড়াবাগান থানা’ যা আগে ছিল ‘ডাফ কলেজ’। বর্তমানে অনেকের মতে তা কলকাতার অন্যতম ভুতুড়ে স্থান, যা একেবারেই ভুল। কারণ ক্রমাগত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জায়গাটি পরিত্যক্ত হয়ে উঠেছে যার ফলে সাপ-বাদুরের আস্তানা হয়ে উঠেছে। কিন্তু কিভাবে সময়ের সাথে এই বাড়ি ক্রমাগত পরিবর্তন হতে হতে বর্তমানে এমন ভগ্নস্তূপের আকার নিল তাই নিয়ে আজকের এই ব্লগ।
অ্যালেকজান্ডার ডাফ ও তার কলেজঃ-
কলকাতার এই অংশের ইতিহাস জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে আঠারো শতকের কলকাতায়। ইংরেজরা জাঁকজমকভাবে কলকাতায় আধিপত্য বিস্তার করে ফেলেছে। শিক্ষা-সংস্কৃতির ব্যাপারে বাংলা মিডিয়াম স্কুলের সাথে সাথে ইংরেজি মিশনারি স্কুলও তাদের জায়গা করে নিচ্ছে। এদেশের মানুষও যাতে পাশ্চাত্য শিক্ষা রপ্ত করতে পারে তার প্রচেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে সেসময়কার সমাজ সংস্কারক ব্যক্তিরা। সময়টা ২৭ শে মে ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দ, সুদূর স্কটল্যান্ড থেকে সর্বপ্রথম ধর্মপ্রচারের জন্য কলকাতায় এসে পৌঁছালেন অ্যালেকজান্ডার ডাফ, পুরো নাম রেভারেন্ড অ্যালেকজান্ডার ডাফ। উদ্দেশ্য এদেশীয় মানুষদের মধ্যে স্কটিশ ধর্ম (স্কটিশ প্রেসবিটারিয়ানিজম) ছড়িয়ে দেওয়া।
অ্যালেকজান্ডার ডাফ |
কিন্তু নতুন করে স্কুল গঠন করতে হলে দরকার নতুন জায়গার, আর এ জায়গাও ডাফ অনায়াসেই পেয়ে গেলেন। সে সময়ে নিমতলা ঘাট স্ট্রীটের জোড়াবাগান অঞ্চলে ছিল মথুর সেনের বাগান বাড়ি (৬৮ নিমতলা ঘাট স্ট্রীট)। হ্যাঁ! তখনকার মথুর সেন যাকে বলা হত ‘ব্যাংকার মথুর সেন’ বা ‘বাবু মথুর মোহন সেন’। তো এই জোড়াবাগান অঞ্চলেই ছিল মথুর সেনের প্রায় প্রাসাদপ্রমান বাগানবাড়ি। আর এই বাড়িরই একটি অংশ মাসিক ২০০ টাকা ভাড়া নিয়ে ডাফ সাহেব তৈরি করলেন ‘দ্যা ফ্রী চার্চ ইন্সটিটিউশন’।
ডাফ কলেজের সম্মুখভাগ |
ভবনের সম্মুখভাগ |
ভবনের পশ্চিম দিকের অংশ |
জোড়াবাগান থানাঃ-
যেহেতু কলেজের কাছে এই নিমতলা ঘাট স্ট্রিটের বাড়িটা অতিরিক্ত সম্পত্তি তাই কলেজ কর্তৃপক্ষ বাড়িটি বিক্রির ব্যাপারে ফরমান জারি করে এবং ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে এই বাড়ি কিনে নেয় কলকাতা পুলিশ যা রূপান্তরিত হয় জোড়াবাগান থানায় (যদিও বর্তমানে এটি জোড়াবাগান থানা হিসাবেই পরিচিত)।
কলেজ থেকে থানায় পরিবর্তনের পরই শুরু হয় আর একটি ইতিহাসের। সেসময় জোড়াবাগান থানার দায়িত্বে ছিল কুখ্যাত পুলিশ অফিসার স্যার চার্লস টেগার্ট। বোঝাই যাছে তখনও ভারত স্বাধীনতা অর্জন করে নি, স্বাধীনতার লড়াইয়ে সারা ভারত তথা বাংলা ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়ছে। এদিকে টেগার্ট সাহেব জোড়াবাগান থানাটিকে পরিবর্তন করলেন টর্চার সেলে। যেখানে বিপ্লবীদের ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হত। নামেই জিজ্ঞাসাবাদ, আসলে হত একের পর এক অকথ্য অত্যাচার। যে প্রতিষ্ঠান এক সময়ে ভারতীয়দের মানুষ হতে, স্বাধীনভাবে বাঁচতে শেখাত এখন সেখানেই এই স্বাধীনতার কারণে শুরু হল অত্যাচার।
ভবনের দক্ষিণ পশ্চিম দিক |
কিন্তু এক্ষেত্রে সেসময়ে থানার পুলিশরা করে ফেলল মস্ত ভুল, তারা নিষ্ক্রিয় করার পরিবর্তে বোমের বাক্স রেখে দিল স্টোররুমে। এদিকে কোর্টে মামলা চলাকালীন প্রমাণস্বরূপ এই বোমগুলি কোর্টে হাজির করতে হয়। আর ঠিক এই সময়ে যখন এক পুলিশকর্মী বোমগুলিকে স্টোররুম থেকে বের করতে যায় ঘটে বিশাল বিস্ফোরণ। কোনোভাবে চাপ লেগে দুই বাক্স ভর্তি বোম একসঙ্গে ফেটে যায়। বিস্ফোরণের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে উত্তরদিকের ওই উপরিতল ছাদ সমেত পুরু ধসে পড়ে ও আশেপাশের প্রায় সমস্থ বাড়িগুলির দরজা-জানলার কাঁচ হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে। আর যে পুলিশকর্মীটি বোম গুলি বেড় করতে গেছিল তার শরীর পুরো ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। বোমগুলি যখন বিস্ফোরণ হয় তখনও থানা কার্যত অবস্থায় ছিল; ফলে থানায় থাকা অফিসার, পুলিশকর্মী, কন্সটেবেল অনেকেই আহত হয়। কলকাতার ইতিহাসে এই বিস্ফোরণ ছিল খুবই দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু এই দুর্ঘটনার পরেও জোড়াবাগান থানা চলতে থাকে সেই ডাফ কলেজের বাড়িতেই। এরপর ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে যখন এই বাড়িটি বিপজ্জনক হিসাবে চিহ্নিত হয় তখন জোড়াবাগান থানা উঠে আসে তার নতুন বাড়ি ১০২ শোভাবাজার স্ট্রিটে, যেখান থেকে আজও থানা পরিচালিত হয়ে আসছে।
২০২০ সালের আম্ফান ঝড়ে ভেঙে পড়েছে সামনের দিকের অংশ |
বর্তমানে ডাফ কলেজের এই বাড়িটি জোড়াবাগান থানার অধীনে হলেও তা আর ব্যবহার হয় না। সাধারণত দীর্ঘদিন ধরে থানা থেকে বাজেয়াপ্ত গাড়িগুলিকে রাখা হয়ে আসছে। কিন্তু বছরের পর বছর জায়গাটি ব্যবহার না হওয়ায় জায়গাটি আগাছায় পরিণত হয়েছে। বাড়িটির অবস্থাও শোচনীয় কারণ অনেক জায়গাতেই পলিস্তার খসে পড়েছে। সম্প্রতি ২০২০ এর আম্ফান ঝড়ের দরুন বাড়ির সামনের অনেকটা অংশও ভেঙে পড়ে। তাই শীঘ্রই বাড়িটির পুনরুদ্ধার না করা গেলে আগামী দিনে আরও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।
ডাফ কলেজ' যা পরবর্তীকালে হয়ে ওঠে 'জোড়াবাগান থানা' |
এব্যাপারে একটা ভালো খবরও পাওয়া গেছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা গেছে কলকাতা পুলিশের তরফ থেকে বাড়িটি পুনরুদ্ধার করা হবে। বাড়িটির পুরনো রূপ ফিরে পাওয়ার পর বাড়িটি মিউজিয়াম হিসাবে ব্যবহৃত হবে যা কলকাতার মানুষের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় টুরিস্ট স্পট হিসাবে চিহ্নিত হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তা কবে?
******************************************************
লেখা, গবেষণা ও ছবি - প্রীতম নস্কর
ই-মেল - pritamnaskar.pn@gmail.com
ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে ব্লগের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, তবে পূর্বানুমতি ছাড়া আমার তোলা
আলোকচিত্রগুলি এবং ব্লগের রচনাগুলি অন্য কোথাও কপি-পেস্ট বা বাণিজ্যিক ভাবে
ব্যবহার করা চলবে না।
******************************************************
তথ্যসুত্রঃ-
- কলিকাতা দর্পণ – রাধারমণ মিত্র
- এই সময় পত্রিকা – ১৪ই জুলাই ২০১৫
- History of Scottish Church Collage, Kolkata
- The Concrete Paparazzi Blog
Comments
Post a Comment