গুপ্তিপাড়ার ঐতিহ্য ও সমাজসংস্কৃতি । Tradition and Socio-Culture of Guptipara

গুপ্তিপাড়ার ঐতিহ্য ও সমাজসংস্কৃতি ।  Tradition and Socio-Culture of Guptipara

গুপ্তপল্লী থেকে গুপ্তিপাড়া। হুগলী নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা এই গুপ্তিপাড়া কিন্তু এক আস্ত ইতিহাসের খনিএকদিকে যেমন এই অঞ্চলে গড়ে উঠেছে দশনামী শৈবসম্প্রদায়ের মঠ অন্যদিকে আবার শিক্ষা সংস্কৃতির জন্য গড়ে উঠেছে একাধিক টোল। সেসময় হাতেগোনা কিছু পল্লী গড়ে উঠেছিল হুগলী নদীর তীরে; নবপল্লী (নবদ্বীপ), শান্তিপল্লী (শান্তিপুর), গুপ্তপল্লী (গুপ্তিপাড়া) ভট্টপল্লী (ভাটপাড়া)। আর এই গুপ্তিপাড়ার পণ্ডিতসমাজ দের নাম ছিল জগৎজোড়া। চট্টোশোভাকর বংশ থেকে গোপতি সম্প্রদায় মানুষদের আদিবাসস্থানও ছিল এই অঞ্চলে। এছাড়াও বাংলার রথযাত্রার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হল এই গুপ্তিপাড়া, এমনকি বিখ্যাত কবিয়ালি ভোলা ময়রা ও অন্যদিকে বাংলার নবাব সিরাজদৌলার অন্যতম সেনাপতি মোহনলাল এর জন্মস্থানও এই গুপ্তিপাড়াতেই। এমনকি বাংলার প্রথম বারোয়ারি পুজোর সূত্রপাত হয় এই গুপ্তিপাড়ায় গুপ্তিপাড়ার মঠ চত্বরে গড়ে ওঠা চৈতন্যদেব মন্দির, বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির, রামচন্দ্রের মন্দিরকৃষ্ণচন্দ্রের মন্দির এখনও সেই সব ইতিহাসের সাক্ষী।

গুপ্তিপাড়ার উত্থান ও গুপ্তিপাড়ার মঠ এবং মন্দির প্রসঙ্গ নিয়ে বিস্তারিতভাবে আগেই জানিয়েছি তাই এখানে আর আলোচনার দরকার নেই। এবিষয়ে জানতে হলে ঘুরে আসতে পারেন গুপ্তিপাড়ার গুপ্তমঠ এই ব্লগটিতে। তাই এই ব্লগে আলোচনা করছি গুপ্তিপাড়ার ঐতিহ্য ও সমাজসংস্কৃতি নিয়ে।

গুপ্তিপাড়ার বিদ্যাসমাজঃ-

এককালে তন্ত্রসাধনা হিসাবে প্রচার পেলেও গুপ্তিপাড়ার অহঙ্কার কিন্তু তার বিদ্যাসময়াজ।  প্রাচীনকালে গুপ্তিপাড়া ছিল সংস্কৃত শিক্ষার অন্যতম প্রধান কেন্দ্রএমনকি উনবিংশ শতাব্দীতেও গুপ্তিপাড়ায় ন্যায়শাস্ত্র শিক্ষার জন্য ছিল ১৫ টি টোল ও বিভিন্ন চতুষ্পাঠীগুপ্তিপাড়ার পন্ডিতসমাজদের মধ্যে বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার, মথুরেশ বিদ্যালঙ্কার, চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য -এর নাম বিশ্ব জুড়ে প্রচার পেয়েছিল। এই বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার ছিলেন শোভাকর বংশীয় যিনি একসময় তিন রাজ্যের রাজসভার (নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্রের, বর্ধমানের চিত্রসেনের ও পরবর্তীকালে শোভাবাজারের নবকৃষ্ণের রাজসভার) সভাকবি ছিলেন। অন্যদিকে ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে গুপ্তিপাড়ার প্রসিদ্ধ পণ্ডিত চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য দর্শনশাস্ত্রের উচ্চাঙ্গের গ্রন্থ বিদ্যোন্মাদ তরঙ্গিণী রচনা করে সারা ভারতের পণ্ডিত সমাজদের মধ্যে প্রসিদ্ধ লাভ করেন। আবার সংস্কৃত সাহিত্যে সুপণ্ডিত ও বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ কালিদাস চট্টোপাধ্যায় এর জন্মস্থানও গুপ্তিপাড়াতেই।

এছাড়াও বাংলার শেষ নবাব সিরাজদৌলার অন্যতম সেনাপতি (প্রধানমন্ত্রী) মোহনলাল এর জন্ম এই গুপ্তিপাড়ায়। ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধে যখন সিরাজদৌল্লা পরাজিত হন এবং তাঁকে হত্যা করা হয়; তখন এই মোহনলাল আত্মগোপনের জন্য চলে আসে গুপ্তিপাড়ায়। যদিও এর পরের ইতিহাস আর জানা যায় নি। আর তেমন কোনো প্রমাণও পাওয়া যায় নি যে তিনি কোথায় গা ঢাকা দিয়েছিলেন এবং আদেও তিনি বাঁচতে পেরেছিলেন কিনা। কিন্তু ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে মোহনলালের স্মৃতি রক্ষার্থে মঠেই তার জন্য একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে। 

গুপ্তিপাড়ার রথ (টিনের আচ্ছাদনে সুরক্ষিত)

গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রাঃ-

বাংলার রথযাত্রার মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত রথযাত্রা হল এই গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা। সারা ভারতে রথযাত্রা উপলক্ষে রথের পরিক্রমণ পথের দৈর্ঘ্য বিচার করলে প্রথম স্থানে পুরীর রথ হলে দ্বিতীয় স্থানে থাকবে গুপ্তিপাড়ার রথ। লোকমতে আনুমানিক ১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে গুপ্তিপাড়ায় প্রথম রথযাত্রা উৎসব শুরু করেন মধুসুদানন্দ। রথযাত্রার দিন বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দিরের জগন্নাথ-বলরাম-শুভদ্রা রথে চেপে যায় মাসির বাড়ি। রথের দড়ি টানার ক্ষেত্রেও রয়েছে এক বিশেষত্ব; চারটি দড়ির মধ্যে একটি দড়ি সংরক্ষিত থাকে শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য আর বাকি দড়িগুলি থাকে জনসাধারণের জন্য আর ব্রেকের জন্য থাকে পিছনের দিকে একটি দড়ি রথযাত্রা উপলক্ষে যে মেলার আয়োজন হয় তাও দেখার মত। বাজার থেকে শুরু করে মঠ পর্যন্ত থাকে বিশাল মেলা আর এই মেলা চলতে থাকে পুরো এক মাস। জানা যায় মেলা থেকে প্রাপ্ত অর্থও চলে যায় মঠের তহবিলে, যা মঠের অন্যতম চালনাশক্তি তবে রথযাত্রা উপলক্ষে গুপ্তিপাড়ার অন্যতম আকর্ষণ থাকে উল্টোরথের আগের দিন। দেবতাদের ভোগ নিবেদনের পর খুলে দেওয়া হয় মাসির বাড়ির মন্দিরের দরজা। আর সেই ভোগ পাওয়ার আসায় শয়ে শয়ে গোপরা (গয়লা সম্প্রদায়) ঝাঁপিয়ে পড়ে; দেবতার উদ্দেশ্য অর্পণ করা বিভিন্ন ভোগের কলসি / মালসা লট করে নেন। এক কথায় চলতে থাকে শক্তি পরীক্ষা, আর এই অনুষ্ঠানটি প্রচলিত ভান্ডার লুঠ নামে। রথযাত্রার দিনগুলি ছাড়া গুপ্তিপাড়ার রথ সারা বছর সম্পূর্ণরূপে টিনের আচ্ছাদনে দাঁড়িয়ে থাকে মঠের পাশেই খোলা জায়গায়।

গুপ্তিপাড়ার সেনবাড়ি

বাংলার বারোয়ারি পুজোর সূত্রপাতঃ-

আজ যে চতুর্দিকে বারয়ারি পুজোর রমরমা তার কিন্তু সূত্রপাত এই গুপ্তিপাড়াতেই সতেরো শতকের আগেও গুপ্তিপাড়ায় দুর্গাপুজো হত বিখ্যাত সেন বাড়িতে। কোন এক কারনে গ্রামের মানুষ সেই পুজোয় অংশগ্রহণ করতে গেলে বাধার সম্মুখীন হয়। এরপর বাড়ি ফিরে তারা ঠিক করে আর সেন বাড়ির দুর্গাপুজোয় অংশগ্রহণ না করে নিজেদের প্রচেষ্টায় পুজো করবে। কিন্তু চাইলেই তো আর তৎক্ষণাৎ দুর্গাপুজো সম্ভব নয় তাই দুর্গাপুজোর কিছুদিন পরেই এল জগদ্ধাত্রী পুজো। আর গ্রামের মানুষেরা এই পুজো করার জন্যই ঝাঁপিয়ে পড়লবেঙ্গল গ্যাজেটের তথ্য অনুযায়ী ১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দে স্থানীয় বিন্ধ্যবাসিনী মন্দিরে শুরু হয় প্রথম সার্বজনীন পুজো, যা প্রচলন পায় বারোয়ারি পুজো হিসাবেবারো জন বন্ধু (অন্য মতে সেখানকার বারোটি গ্রাম) মিলে শুরু করে এই পুজো, আর সেথেকেই এ পুজোর নামকরণ হয় বারোয়ারি পুজো। এর পরের খবর তো সবারই জানা, আগে যে পুজোর প্রচলন ছিল শুধুমাত্র কিছু মুষ্টিমেয় অর্থবান ব্যাক্তির মধ্যে আজ সেই পুজোর রমরমা চতুর্দিকে; আর এভাবেই বারোয়ারি পুজো ছড়িয়ে পরে গ্রাম থেকে শহরে। বর্তমানে কিন্তু সেই বিন্ধ্যবাসিনী মন্দির চত্বরে পুরনো স্মৃতির কিছুই অবশিষ্ট নেই। ঝাঁ চকচকে ঠাকুরদালানে আজও বারোয়ারি জগদ্ধাত্রী পুজো যা এখানে বিন্ধ্যবাসিনী দেবী হিসাবে পুজো হয়ে আসছে।

গুঁপোসন্দেশ

গুপ্তিপাড়ার গুঁপোসন্দেশঃ-

ভোলা ময়রার নাম তো সকলেরই জানা। সেই বিখ্যাত কবিয়ালি ভোলা ময়রা ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দে এই গুপ্তিপাড়াতেই জন্মগ্রহণ করেন, যদিও তার বেড়ে ওঠা ও কার্যকলাপ যখন বিশ্ববিখ্যাত তখন তাঁর বাসস্থান কলকাতার বাগবাজারে। মিষ্টি নিয়ে যখন কথা হচ্ছে তাহলে বলি- ইতিহাসের পাতায় শুধুমাত্র ভোলা ময়রার জন্মস্থান হিসাবে রয়ে যাওয়া গুপ্তিপাড়া কিন্তু উনিশের দশক থেকেই প্রসিদ্ধ তার গুঁপোসন্দেশ এর জন্য। একপ্রকার মাখাসন্দেশ কে বিশেষ আকার দিয়ে তৈরি এই গুঁপোসন্দেশ। কে কবে এই সন্দেশ আবিষ্কার করে তা কিন্তু জানা যায় না। সারা বছর এই সন্দেশ পাওয়া গেলেও শীতকালে খেঁজুড়ের গুড়ের সাথে ছানা মিশিয়ে এক প্রকার পাক বানিয়ে তৈরি হয় গুঁপোসন্দেশমাখা সন্দেশের মতো তৈরি হলেও গুঁপোসন্দেশের পাক কিন্তু আলাদা গুপ্তিপাড়া থেকেই লোকমুখে পরিবর্তিত নাম গুঁপো আর সেই থেকেই মিষ্টির নামকরণ। মূলত দুটি সন্দেশ জুড়ে তৈরি হয় এই সন্দেশ তাই অনেকে জোড়াসন্দেশও বলে থাকে।

প্রথম পর্ব - গুপ্তিপাড়ার গুপ্তমঠ

******************************************************

লেখা, গবেষণা ও ছবি - প্রীতম নস্কর  

ই-মেল - pritamnaskar.pn@gmail.com

ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে ব্লগের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, তবে পূর্বানুমতি ছাড়া আমার তোলা আলোকচিত্রগুলি এবং ব্লগের রচনাগুলি অন্য কোথাও কপি-পেস্ট বা বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করা চলবে না।

******************************************************

কীভাবে যাবেন গুপ্তিপাড়া -

গুপ্তিপাড়া যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় ট্রেনে করে। হাওড়া-কাটোয়া লাইনেই অবস্থিত গুপ্তিপাড়া স্টেশন। হাওড়া থেকে কাটোয়াগামি (মেনলাইন) / ব্যান্ডেল থেকে কাটোয়া / শিয়ালদহ থেকে কাটোয়া যাওয়ার যে কোন ট্রেনে উঠে নামতে হবে গুপ্তিপাড়া স্টেশন। স্টেশন থেকে বাইরে বেরলেই দেখা মিলবে সারি সারি টোটো / রিকশার, তাতে করে অনায়াসেই পৌছে যাওয়া যাবে বৃন্দাবনচন্দ্র মঠ অথবা গুপ্তিপাড়ার মঠ।

গুগল ম্যাপ / কোঅরডিনেট -

23.196993, 88.440984

তথ্যসুত্রঃ-

  • হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ (দ্বিতীয় খণ্ড)  সুধীরকুমার মিত্র
  • পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি  বিনয় ঘোষ
  • পশ্চিমবঙ্গের মন্দির  শম্ভু ভট্টাচার্য
  • Bengal District Gazetteers - Hooghly

Comments

Post a Comment