বিস্তীর্ণ মাঠের সম্মুখে পেল্লাই এক রাজপ্রাসাদ। যার সামনে দাঁড়ালে নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হবে। বাংলার ইতিহাসে হারিয়ে যেতে বসা এক নদী, সরস্বতী নদী। তারই পশ্চিম পাড়ে গড়ে ওঠা প্রায় ষাট ফুট উচ্চতার এই প্রাসাদ। যার সম্মুখে প্রায় পঞ্চাশ ফুট উচ্চতার ডোরিক স্থাপত্যে গড়ে ওঠা দশটি স্তম্ভ। যা সারা বাংলায় শুধুমাত্র এই প্রাসাদটিতেই দেখতে পাওয়া যাবে। অষ্টাদশ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে আন্দুল রাজ রাজা রাজনারায়ণ রায় প্রায় ২ কোটি ৮২ লক্ষ টাকা খরচ করে তৈরি করেন এই আন্দুল রাজবাড়ি, যার নাম ‘আনন্দমঠ’। কে এই রাজা রাজনারায়ণ? আর কেনই বা তৈরি করতে গেলেন এই রাজপ্রাসাদ? সেই নিয়েই আজকের এই ব্লগ।
আন্দুলঃ-
‘আনন্দধূলি’ থেকে অপভ্রংশ হয়ে বর্তমানে ‘আন্দুল’ (পূর্বে ‘আঁদুল’)। হাওড়া থেকে ২০
কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই আন্দুল। বর্তমানে আন্দুল হাওড়া জেলার অন্তর্গত হলেও আঠারো
শতকের আগে আন্দুল ছিল হুগলী জেলার অন্তর্গত এবং তারও আগে ছিল চব্বিশ পরগণার অধীন। কিন্তু একদম শুরুর দিক থেকে বিচার করলে আন্দুল যখন মুসলমান
রাজত্বের অধীন তখন মজফরপুর ও বোরোপরগণার অন্তর্গত ছিল। তখন আন্দুল ছিল এক
বর্ধিষ্ণু গ্রাম, যার পাশ দিয়ে বয়ে যেত বাংলার প্রাচীন সরস্বতী নদী (বর্তমানে এই
নদী থাকলেও তা পরিবর্তন হয়েছে খালে, এখন যা সরস্বতী খাল)। পরবর্তীকালে আন্দুলের
সীমানা বাড়তে থাকলে তার মধ্যে চলে আসে আরও অনেক গ্রাম, যার মধ্যে অন্যতম মহিয়াড়ী
গ্রাম।
সরস্বতী নদী (বর্তমানে যা সরস্বতী খাল) |
ব্রিটিশ আমলের শুরুর দিকে বাংলায় যে
সমস্থ ধনী জমিদার শ্রেণীর উদ্ভব হয়, তাঁদের মধ্যে আন্দুলে মোটামুটি চারটি বিখ্যাত
জমিদার পরিবারের বসবাস। আন্দুলের দত্ত-চৌধুরী পরিবার, কর-রায় পরিবার (যা
পরবর্তীকালে হস্তান্তর হয় মিত্র পরিবারে), মল্লিক পরিবার ও মহিয়াড়ীর কুণ্ডু-চৌধুরী
পরিবার। এদের মধ্যে সময়ের দিক থেকে বিচার করলে সবচেয়ে পুরনো দত্ত-চৌধুরী পরিবার,
যার সূত্র ধরেই বংশানুক্রমে অন্য পরিবারগুলির সৃষ্টি। এদিকে পরবর্তীকালে আন্দুলের
মল্লিক পরিবার হাওড়ার দশআনা জমিদারীর কিছু অংশ কিনে চলে আসেন। যেখানে তৈরি করেন
তাঁদের কাছারিবাড়ি, যার প্রবেশদ্বার(ফটক) থেকে নামকরণ হয় হাওড়ার মল্লিকফটক। কিন্তু
আজকের ব্লগ তাদেরকে নিয়ে নয়। আজকের ব্লগ আন্দুলের কর-রায় পরিবারদের নিয়ে। এই কর-রায়
পরিবারই ধীরে ধীরে পরিচিতি পায় আন্দুল রাজপরিবারে।
রাজবাড়ির তোরণ |
আন্দুল রাজপরিবারঃ-
সময়টা অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উকিল হিসাবে হুগলীতে নিযুক্ত হল আন্দুলের এক যুবক। মাইনে মাসিক ২০ টাকা, উপরন্তু পিওন বাবদ ৫ টাকা ও বাড়িভাড়া বাবদ ৩ টাকা। পরে অবশ্য কাজকর্মে যুবকের উন্নতি দেখে কোম্পানি পাঠিয়ে দিলেন মুর্শিদাবাদে। বদলি হওয়ায় মাইনে বেড়ে দাঁড়াল মাসিক ৭০ টাকা ও বাড়িভাড়া-পিওন বাবদ ২৮ টাকা। ইংরাজি, ফার্সি, পার্সি জানা এই যুবক কিছুদিনের মধ্যেই সাহেবদের মন জয় করে নিল। মনে রাখতে হবে সেই সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সর্বেসর্বা রবার্ট ক্লাইভ। তাঁর সুনজরে এলে যুবকের পদন্নোতি হয়। উকিল থেকে সোজা কোম্পানির দেওয়ান। আর এই যুবকটিই হল আন্দুলের রামচরণ রায়। যার পূর্বপুরুষ ভুবনেশ্বর কর মুসলিম শাসনকালে ‘রায়’ উপাধি লাভ করে এই ‘কর-রায়’ বংশের সূচনা করেন।
টিকে থাকা জীর্ণ প্রবেশপথের কারুকার্য |
১৭৫৭
খ্রিষ্টাব্দের ২৩ শে জুন, ব্রিটিশদের সাথে সিরাজের পলাশি যুদ্ধের শুরু ও কিছুক্ষণের
মধ্যেই সিরাজের পতন। আর এর সাথেই শুরু হল মুর্শিদাবাদে অরাজকতা। ক্রমে ইংরেজ
সৈন্যরা একে একে সিরাজের প্রাসাদ, অস্ত্রাগার, কোষাগার অধিগ্রহণ করল। সেসময়েও
মুর্শিদাবাদের দেওয়ান পদে রয়েছে আমাদের রামচরণ রায়। প্রবাদ আছে ব্রিটিশ সরকারের
বিশ্বস্ত কর্মী হওয়ায় সেই রাতেই বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজদৌল্লার কোষাগারের অগাধ
সম্পত্তি নিয়ে সরস্বতী নদী মারফৎ এসে পৌঁছালেন আন্দুলে।
পরবর্তী সময়
১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দ, ব্রিটিশদের হাতে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভের পর
দেশের রাজনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন হতে শুরু করল। কোম্পনির বিশ্বস্ত
কর্মচারীদের পদন্নোতি ও উপরি পাওনার পথ প্রশস্ত হল। এই সময়ে কলকাতায় দ্বিতীয় বারের
জন্য এলেন লর্ড ক্লাইভ। দিল্লীর সম্রাট তখন দ্বিতীয় শাহ আলম। সম্রাটের ইচ্ছা কোম্পানির কিছু বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে
উপাধি প্রদান করা হবে। সেইমতো লর্ড ক্লাইভ বয়স্ক রামচরণের নাম সুপারিশ করলে,
রামচরণ তাঁর পরিবর্তে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র রামলোচনের নাম পেশ করেন। শেষে লর্ড
ক্লাইভের সুপারিশ অনুসারে ১৭৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ২ জানুয়ারি, দিল্লীর সম্রাট দ্বিতীয়
শাহ আলম আন্দুলের রামলোচন রায় –কে “রাজা” উপাধিতে ভূষিত করেন এবং সঙ্গে একটি ঝালড় দেওয়া পালকি, রাস্তায় বেরুলে সামনে
কাড়া-নাকড়া বাজাবার অধিকার, ৪ ফুট ৭ ইঞ্চি দীর্ঘ ও ৩ ইঞ্চি ব্যাসযুক্ত একটি কামান
(যা এখন রয়েছে পাশেই অন্নপূর্ণা দেবীর মন্দিরে) এবং সর্বশেষ ৪,০০০ সৈনিকের
অধিনায়কত্ব করার অধিকার প্রদান করেন। পিতা রামচরণ রায় আন্দুল রাজবংশের সূচনা করলেও
মূলত রামলোচন-ই এই রাজবংশের ভিত্তি স্থাপন করেন।
টিকে থাকা জীর্ণ প্রবেশপথের কারুকার্য ২ |
১৭৭৪
খ্রিষ্টাব্দে বাংলার গভর্নর হিসাবে এলেন ওয়ারেন হেস্টিং। তিনিও রামলোচনের নিষ্ঠা ও
রাজভক্তিতে খুশি হয়ে তাঁকে মহিষাদল মৌজার জায়গীর দেন এবং ঝোড়হাট গ্রামটি নিষ্কর
দান করেন। যদিও পরবর্তীকালে রাণীর অনুরোধে মহিষাদল মৌজার জায়গীর মহিষাদলের পুরনো
অধিপতিকেই ফিরিয়ে দেন। তৎকালীন বঙ্গসমাজে রামলোচনের প্রতিপত্তির এতটাই প্রভাব
বিস্তার করেছিল যে সেই সময়ে “আন্দুলাব্দ” নামে একটি অব্দের (বৎসর/সাল) প্রচলন ঘটে। ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে যখন রামলোচনের
মৃত্যু হয় তখন আন্দুল রাজপরিবারে সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৭২ লক্ষ টাকা, হুন্ডি ও
জমিদারীতে ১৮ লক্ষ, অলংকারে ২৫ লক্ষ টাকা, আর ৩২০ টি রূপোর ও একটি সোনার কলসী।
রামলোচনের
মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র কাশীনাথ রায়। যিনি তৈরি করেন অন্নপূর্ণা দেবীর মন্দির, যা এখনও রাজবাড়ি
চত্বরের পাশেই দেখতে পাওয়া যায়। ১৮০৭ খ্রিষ্টাব্দে কাশীনাথ মারা যান তাঁর একমাত্র
পুত্রসন্তান রাজনারায়ণ-কে রেখে।
অন্নপূর্ণা দেবীর মন্দির |
চার বছরের নাবালক পুত্র রাজনারায়ণ আন্দুলরাজের উত্তরাধিকারী হন। স্বভাবতই রাজা সাবালক হওয়ার আগে অবধি রাজকার্য চালিত হত ‘কোর্ট অফ ওয়ার্ডস’ মেনে। রাজনারায়ণ ছিলেন তৎকালীন প্রসিদ্ধ হিন্দু কলেজের ছাত্র। মাতৃভাষা ছাড়াও সংস্কৃত, ইংরাজি, পার্শি, উর্দু ভাষায় ছিল অসাধারণ জ্ঞান। এছাড়াও তখনকার ‘ইয়ং-বেঙ্গল’ আন্দোলনের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। সংস্কৃত সাহিত্যে অসীম দক্ষতা থাকায় পরবর্তীকালে বিভিন্ন শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের নিয়ে রচনা করেন ‘কায়স্থ কৌস্তভ’ নামক গ্রন্থ।১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার গভর্নর লর্ড অকল্যান্ড রাজা রাজনারায়ণকে “রাজ বাহাদুর” উপাধিতে ভূষিত করেন এবং সেই উপলক্ষে সম্মানসূচক হিসাবে রত্নখচিত একটি তরবারি ও একটি ছুরি প্রদান করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ১২ ই জুন ৪৬ সংখ্যক দ্যা ক্যালকাটা গ্যাজেট পত্রিকায় যে খবরটি ছাপা হয়েছিল তা হল –
The Calcutta Gazette, June 10, 1835 |
Fort William, 18th of May, 1835
The
Honorable Governor General in council has been pleased to confer upon Baboo Raj
Narain Roy Zeemindar of Undol, the Dignity and Title of Rajah and Bahadoor.
W. H. Macnaghten
Secretary of the Government of India.
বর্তমানে যা “আন্দুল রাজবাড়ি” নামে পরিচিত, যার আসল নাম “আনন্দধাম” তা আসলে এই রাজা রাজনারায়ণ রায় বাহাদুর –এর সৃষ্টি। যদিও এবিষয়ে পরে আলোচনা করেছি। ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে রাজনারায়ণ রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বিজয়কেশব রায় উত্তরাধিকারী হন। জমিদারীর ব্যাপারে বিজয়কেশব তেমনভাবে মনোযোগ দিতে পারেননি। শেষ বয়সে তিনি তন্ত্র সাধনার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করেন। বিজয়কেশবের দুই পত্নী দুর্গাসুন্দরী ও নবদুর্গা। কিন্তু তাঁদের কোন পুত্র সন্তান ছিল না। দুর্গাসুন্দরীর একটি কন্যা সন্তান হলেও, জন্মের দু’বছরের মধ্যে সন্তানটি মারা যায়। তাই নিঃসন্তান অবস্থায় ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে বিজয়কেশব মারা যান।
রাজবাড়ির পশ্চিম দিকের অংশ |
রাজার মৃত্যুর পর সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী
হন তাঁর দুই বিধবা রাণী। এই অবস্থায় পরবর্তী প্রজন্মের উত্তরাধিকারীর জন্য দুজনেই
আলাদা আলাদা ভাবে দত্তক নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এপ্রসঙ্গে বলে রাখি, রাজবাড়ির
এটর্নি নিমাইচরণ বসুর মারফৎ স্বামী বিবেকানন্দের বাবা বিশ্বনাথ দত্ত বিষয়টি জানতে
পারেন। তিনি তাঁর দুই পুত্র নরেন্দ্রনাথ (স্বামী বিবেকানন্দ) ও মহেন্দ্রনাথকে
দত্তক পুত্র হিসাবে গ্রহণ করার জন্য দুই রাণীর কাছে আবেদন জানান। রাণীর ইচ্ছা
থাকলেও বিবেকানন্দের মা ভুবনেশ্বরী দেবী এই প্রস্তাব মেনে নিতে পারেননি। এদিকে একই
রাজ স্টেটে দুই দত্তক নেওয়া আদালত মানতে পারলেন না। প্রিভি কাউন্সিলের স্পেশাল
বেঞ্চ এই দত্তক-গ্রহণ অবৈধ সাব্যস্ত করেন। এদিকে বিজয়কেশবের ঠাকুরদা রাজা কাশীনাথ
রায়ের কন্যা ত্রিপুরাসুন্দরীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে কৃষ্ণনগরবাসী কালীপদ মিত্রের। আদালত জানতে পারে সেই
বংশে রয়েছে পুত্রসন্তান, ত্রিপুরাসুন্দরীর পুত্র ক্ষেত্রকৃষ্ণ মিত্র। আদালতের আর
এক আদেশে এই ক্ষেত্রকৃষ্ণ মিত্র আন্দুলের সমস্ত জমিদারীর মালিকানা পান। আর এইভাবেই
আন্দুলের ‘রায়’ রাজপরিবারে ‘মিত্র’ পরিবারের আবির্ভাব ঘটে।
রাজবাড়ির পূর্বদিকের অংশে বসবাস |
রাজবাড়ির পশ্চিমদিকের অংশে বসবাস |
এরপর ক্ষেত্রকৃষ্ণ মিত্রের সময়কালে আন্দুলের জমিদারীর আরও উন্নতি হতে থাকে। আন্দুল ছাড়াও অন্যান্য অনেক স্থানে মন্দির, রাস্তাঘাট, বিদ্যালয়, সেতু, হাসপাতাল প্রভৃতি জনহিতকর কাজের জন্য সাধ্যমত দান করে গেছিলেন ক্ষেত্রকৃষ্ণ মিত্র। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মারা গেলে তাঁর জীবিত দুই পুত্র, জ্যেষ্ঠপুত্র উপেন্দ্রনাথ ও কনিষ্ঠপুত্র নগেন্দ্রনাথ সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হন (মেজো ছেলে দেবেন্দ্রনাথ ক্ষেত্রকৃষ্ণের জীবদ্দশায় মারা গিয়েছিলেন)। এরপর সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা হলে বড়তরফ ও ছোটতরফ নামে দুই ভাগ হয়ে যায়। বড়তরফ অর্থাৎ ঊপেন্দ্রনাথ ও ছোটতরফ অর্থাৎ নগেন্দ্রনাথ। ক্রমে রাজবাড়ির পূর্ব অংশে থাকতে শুরু করে বড় তরফের উপেন্দ্রনাথের পরিবার ও রাজবাড়ির পশ্চিম অংশে থাকতে শুরু করে ছোট তরফের নগেন্দ্রনাথের পরিবার। এপ্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, ছোট তরফের এক বংশধর চলে আসেন কলকাতার কালীঘাট অঞ্চলে যেখান তাঁদের নামানুসারে রয়েছে আন্দুল রাজ রোড, হাজরা কালীঘাট।
পরবর্তীকালে ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে ভারত
থেকে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হলে আন্দুলরাজ পরিবারও তাঁর জমিদারী হারায়। বিভিন্ন
পত্রিকা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হওয়ায় আন্দুল রাজবংশ
মাত্র বারো লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিল।
ডোরিক স্থাপত্যের অনুকরণে গঠন করা ১০ টি স্তম্ভ |
আনন্দধাম, আন্দুল রাজবাড়িঃ-
সরস্বতী নদীর (যা বর্তমানে পরিচিত সরস্বতী খাল) ধারে যে রাজপ্রাসাদটি “আন্দুল রাজবাড়ি”নামে পরিচিত তার আসল নাম “আনন্দধাম”। ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে এই রাজবাড়ি তৈরির কাজ শুরু করেন রাজা রাজনারায়ণ রায় বাহাদুর। রাজবাড়ি সম্পূর্ণ হয় ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দে। প্রায় ৬০ ফুট উঁচু এই রাজপ্রাসাদ বাংলার ইতিহাসে কিন্তু এক বিরল দৃষ্টান্ত। রাজবাড়ির সম্মুখে রয়েছে প্রায় ৫০ ফুট উচ্চতার ডোরিক স্থাপত্যের অনুকরণে গঠন করা ১০ টি প্রকাণ্ড স্তম্ভ, যা সারা বাংলায় শুধুমাত্র এই প্রাসাদটিতেই দেখতে পাওয়া যাবে। স্তম্ভগুলির পরিধি এতটাই বেশি, যে কমপক্ষে তিনজন মানুষ একে অপরের হাত ধরে দাঁড়ালে তবেই একটি স্তম্ভকে পুরোপুরি বেষ্টন করা যাবে। স্তম্ভগুলি পেরোলেই বাড়ির ভিতরের এই অংশটিতে গড়ে উঠেছে নাচঘর, যাকে ঘিরে রয়েছে প্রায় ১৬ টি উঁচু স্তম্ভ। নাচঘরের দুপাশে রয়েছে তিনতলা ভবন যার প্রতিটি তলা প্রায় ২০ ফুট উঁচু। আর এই অংশেই রাজবাড়ির সদস্যরা বসবাস করত। বর্তমানে এখনও তাঁদের উত্তরসূরিরা এখানে বসবাস করে আসছে।
প্রকাণ্ড স্তম্ভগুলির একটি |
কিন্ত বর্তমানে রাজবাড়ির অবস্থা খুবই শোচনীয়। হেরিটেজ বিল্ডিং হিসাবে মর্যাদা পেলেও বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণে তেমন কোন ভূমিকা নেই। রাজবাড়ির বাইরের প্রকাণ্ড থামগুলি থেকে কবেই পলেস্তার খসতে শুরু করেছে। বাড়ির সামনের অংশেও রয়েছে বিশাল আবর্জনা। রাজবাড়ির ভিতরের সে নাচঘর আর নেই। উপরের খোলা ছাদ দিয়ে বৃষ্টির জল ক্রমশ পড়তে থাকে। রাজবাড়ির বর্তমান মালিক অরুণাভ মিত্র (ছোট তরফের) জানিয়েছেন এব্যাপারে প্রশাসনিক অফিসারেরা কয়েক দফা পর্যবেক্ষণ করে গেছেন, কিন্তু তা ২০১৫ সালের ঘটনা।
রাজবাড়ির এই অংশ চলে গেছে এক ক্লাবের অধীনে |
সেসব এখন ইতিহাসের পাতায়। সেই রাজাও নেই আর তাদের রাজপাটও নেই। কিন্তু এখনও বাংলার ইতিহাস আঁকড়ে ধরে আছে হাওড়ার বিখ্যাত এই আন্দুল রাজবাড়িকে। আর রয়েছে রাজবাড়ির বিখ্যাত দুর্গাপুজো। যে দুর্গাপুজোর সূচনা করেন রাজা রামলোচন রায় আর এই দুর্গাপুজো উপলক্ষেই হাজির হয়েছিলেন তখনকার ব্রিটিশ সরকারের সর্বেসর্বা লর্ড ক্লাইভ...... তবে সে প্রসঙ্গ আজ থাক এরপরের ব্লগে থাকবে সেসব তথ্য যা দিয়ে শুরু হবে আন্দুলের দুর্গাপুজো।
******************************************************
লেখা, গবেষণা ও ছবি - প্রীতম নস্কর
ই-মেল - pritamnaskar.pn@gmail.com
ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে ব্লগের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, তবে পূর্বানুমতি ছাড়া আমার তোলা
আলোকচিত্রগুলি এবং ব্লগের রচনাগুলি অন্য কোথাও কপি-পেস্ট বা বাণিজ্যিক ভাবে
ব্যবহার করা চলবে না।
******************************************************
ঠিকানাঃ-
আন্দুল রাজমঠ, আন্দুল-মৌড়ি বাজার, হাওড়া - ৭১১৩০২
কীভাবে যাবেনঃ-
বাসে যেতে চাইলে - রবীন্দ্রসদন থেকে অথবা হাওড়া থেকে আন্দুলগামী যেকোন বাসে উঠে নামতে হবে আন্দুল বাজার বাসস্টপ। বাসস্টপে নামার পর ঠিক রাস্তাটার বামদিকে পরবে এক সরু গলি। এই গলিতেও বর্তমানে বাজার বসে। সেই গলি ধরে কিছুটা এগোলে ডানপাশে একটি পুকুর পেরিয়ে সোজা হাঁটলেই বামদিকে পরবে রাজমঠে যাওয়ার রাস্তা। রাজমঠের সামনেই দেখতে পাওয়া যাবে এই আন্দুল রাজবাড়ি।
ট্রেনে যেতে চাইলে - হাওড়া থেকে মেদিনীপুর/পাঁশকুড়া/খড়গপুর -গামী যেকোন লোকাল ট্রেন ধরে নামতে হবে আন্দুল স্টেশন। সেখান থেকে টোটো অথবা রিকসা করে আন্দুল রাজবাড়ি / রাজমঠ।
গুগল ম্যাপ / কোঅরডিনেটঃ-
22°34'58.6"N 88°14'07.9"E
তথ্যসূত্রঃ-
- হাওড়া জেলার পুরাকীর্তি – তারাপদ সাঁতরা (পুরাতত্ত্ব বিভাগ -
পশ্চিমবঙ্গ সরকার)
- হাওড়া জেলার ইতিহাস (দ্বিতীয় খণ্ড) – অচল ভট্টাচার্য
- বাংলার খেতাবী রাজরাজরা – দত্ত বিমল চন্দ্র
- Bengal District Gazetteers 1909 – Howrah
- The Calcutta Gazette – 1835
- Zamindars of Andul – Hemotpaul Chowdhury
ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করব না ,শুধু বলতে চাই আপনার এই অক্লান্ত পরিশ্রম সত্যিই অনবদ্য, আপনার জন্য এই ইতিহাসটা জানতে পারলাম। আমি মৌরিগ্রাম বসবাস করি কিন্তু সত্যিই এত বড় ইতিহাস জানতাম না।
ReplyDeleteধন্যবাদ। ভবিষ্যতে আন্দুল নিয়ে, বিশেষ করে মহিয়াড়ী গ্রাম, জমিদারি ও আন্দুলের বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজো নিয়েও আরও কিছু ব্লগ করার ইচ্ছা আছে।
DeleteAmar bari andul a kintu
DeleteAndul a thekeo andul rajbari bepare kichui jantam
Aamr jene khub valo laglo
কেউ কি জানেন ওখানে গুরুবাড়ী কোথায় আছে ,যেখানে শ্রীচৈতন্য দেব এসেছিলেন ?
Deleteখুব ভালো লাগলো ❤🙏
ReplyDeleteধন্যবাদ।
Delete♥️ অসাধারণ।
ReplyDeleteধন্যবাদ
Deleteরাজার নাম জানতে এসে অনেক কিছু জানতে পারলাম ভালো লাগলো।
ReplyDeleteঅপূর্ব
ReplyDeleteNice write up and pics, Thanks.
ReplyDeleteগবেষণাভিত্তিক, সুন্দর লেখনী; ঋদ্ধ হলাম; আন্দুলের ইতিহাসে আরও অনেক পরিবার রয়েছেন; আশা রাখি তাদের সমৃদ্ধির ইতিহাস উঠে আসবে আপনার পরবর্তী কোনও লেখায়। শুভেচ্ছা রইলো।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো... একটা জিনিষ জানার রইল- আমি শুনেছি আন্দুল রাজবাড়ী টা খুবই লম্বা ছিল দৈর্ঘ্যে... যার শেষ অংশটা এখনও আন্দুল পোস্ট অফিসের উল্টোদিকে দেখা যায়... সেটা কি সঠিক?
ReplyDeleteখুব সুন্দর। অনেক কিছু জানলাম।😌
ReplyDelete