কলকাতা হাইকোর্ট ও ঐতিহাসিক টাউন হলের সম্মুখে এসপ্ল্যানেড রো রাস্তাটির বামদিকে লোহার রেলিং-এর মধ্যে আবদ্ধ রয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ। বর্তমানে এই জায়গাটি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভবনের প্রাঙ্গনের আওতায় পরায় এই রেলিং-এর নিরাপত্তা। সে যাই হোক, এই আকর্ষণীয় নব্য-গথিক স্মৃতিসৌধটি আসলে একটি পানীয় জলের ফোয়ারা (ফাউন্টেন)। সৌধটির নিচের দিকে সম্প্রসারিত একটি সিংহের মুখ ও আলংকারিক কলস সেই চিহ্নই বহন করে আসছে। সৌধটির একদম উপরের দিকে মুকুটযুক্ত স্থাপত্যের নীচে যে মার্বেল ফলক রয়েছে সেখানেই উল্লেখিত ছিল উৎসর্গীকৃত ব্যক্তির নাম, ছিল বলছি কারণ বর্তমানে খুঁজলেও ফলকে সেই নাম দেখতে পাওয়া যাবে না। কলকাতার আর পাঁচটা সৌধের মতো অনেকেই এই সৌধটিকেও ভুলতে বসেছে। সময়ের প্রকোপে তাই শিলালিপির লেখাগুলিও দীর্ঘদিন আগেই মুছে গেছে। তবে এই সৌধ বা ফাউন্টেন যার স্মৃতিতে তৈরি হওয়া তিনি কিন্তু কলকাতার ইতিহাসে বিশেষ করে বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস ও কলকাতা হাইকোর্টের বিচারকমণ্ডলীর মধ্যে স্মরণীয় ব্যক্তি। আর তিনি হলেন উইলিয়াম ফ্রেজার ম্যাকডোনেল (William Fraser McDonnell), যার স্মৃতিতেই নির্মিত এই ফোয়ারাটি ইতিহাস প্রেমীদের কাছে ম্যাকডোনেল ফাউন্টেন নামে পরিচিত।
কে এই উইলিয়াম ফ্রেজার ম্যাকডোনেল?
১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে ১৭ ই ডিসেম্বর উইলিয়াম ফ্রেজার ম্যাকডোনেল জন্মগ্রহণ করেন ইংল্যান্ডের গ্লৌচেস্টারশায়া দেশের চেল্টেনহ্যাম নামক শহরে। শিক্ষাজীবনের দিনগুলিতে ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চেল্টেনহ্যাম কলেজ এবং পরে ১৮৪৭-১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে হেইলিবারি অ্যান্ড ইম্পেরিয়াল সার্ভিস কলেজ থেকে সাফল্য অর্জন করেন। পরবর্তীকালে কর্মসূত্রে তিনি চলে আসেন ভারতে। ব্রিটিশ শাসন চলাকালীন ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন এবং দীর্ঘ ৩৬ বছর তিনি এই পদে নিযুক্ত ছিলেন। কর্মজীবনের এই সময়কালের প্রমাণ পাওয়া যায় ওই ফোয়ারার দুপাশের দেওয়ালের দুটি সালগুলিতে, একটি ১৮৫০ অন্যটি ১৮৮৬। বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে যোগদানের পর ম্যাকডোনেল সাহেব প্রথমে ১৮৫২-১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিহারের সারন জেলার (ছাপরা) সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর এবং ১৮৫৫-১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দ সারনের ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিযুক্ত ছিলেন। এদিকে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের সময় সারা দেশ যখন বিদ্রোহের আগুনে জ্বলছে তখন ম্যাকডোনেল সাহেবের পোস্টিং বিহারেই, ফলত বিহারে থাকাকালীন মধ্য ভারতে সিপাহী বিদ্রোহের প্রসারতার চাক্ষুষ সাক্ষী ছিলেন তিনি। তবে এই বিদ্রোহের সময়ই তাঁর অসামান্য সাহসিকতার জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে তিনি ভিক্টোরিয়া ক্রস সন্মান অর্জন করেন।
![]() |
স্মৃতিসৌধে অবস্থিত আলংকারিক সিংহের মুখ (অতীতে এখান থেকেই পানীয় জল সরবরাহ হত) |
সময়টা ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দ, বিহারের শাহরাবাদ জেলার সদর দপ্তর আরা আঞ্চলে অনেক দিন ধরেই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যসামন্তরা এমনকি কোম্পানির বিভিন্ন কর্মচারী-রাও বসবাস করে আসছিল। এদিকে কলকাতার ব্যারাকপুর থেকে সিপাহী বিদ্রোহের আঁচ যখন মধ্য ভারতে ঢুকে পরে তখন ২৭ শে জুলাই শাহরাবাদের জগদীশপুর এস্টেটের তালুকদার বাবু কুনওয়ার সিং (পরিচিত বীর কুনওয়ার সিং) বিশাল সৈন্য নিয়ে ব্রিটিশদের ঘাঁটি আরায় আক্রমণ করেন। কুনওয়ার সিং-এর এই অকস্মাৎ হামলা ব্রিটিশরা কিন্তু প্রতিরোধ করতে পারেনি। একপ্রকার কোণ ঠাসা হয়ে কিছুদিন পর তারা পিছু হাটতে শুরু করে। আর ঠিক এই সময়েই ম্যাকডোনেল সাহেব তাঁর সাহসিকতার পরিচয় দেন। ২৯ শে জুলাই ব্রিটিশ সৈন্যদের ফিরিয়ে আনার জন্য দুটি জাহাজ আরায় পৌঁছালে সৈন্যরা একে একে জাহাজের দিকে পালাতে শুরু করে। কিন্তু এই অভিযানের মধ্যেই একটি ছোট নৌকা নোঙ্গর এর কারণে তীরে আটকে যায়। প্রায় ৩৫ জন সৈন্য সেই নৌকাটিতে উঠে পড়লেও নৌকাটি খুঁটিতে বেঁধে থাকার ফলে তীরে আটকে যায়। এদিকে চারিদিক থেকে ধেয়ে আসা দেশীয় সিপাহীদের গুলি-বোমায় নদীর তীর একপ্রকার রণক্ষেত্র। চারিদিকে শুধু আগুন আর আগুন। আর এই পরিস্থিতিতেই ম্যাকডোনেল সাহেব নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে নৌকা থেকে লাফিয়ে গেলেন খুঁটির বাঁধন খুলতে। ম্যাকডোনেল সাহেব নৌকার বাঁধন কেটে ফেললে শেষমেশ সেই নৌকা জলে নামতে সক্ষম হয় এবং ৩০ শে জুলাই সেই নৌকা মোট ৩৫ জন ব্রিটিশ সৈন্য নিয়ে ফিরে আসে পাটনার দিনাপুরে। আর যুদ্ধক্ষেত্রের এই পরিবেশে ম্যাকডোনেল সাহেবের এই অসামান্য সাহসিকতার জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ভিক্টোরিয়া ক্রস (ভি.সি.) সন্মানে ভূষিত করেন, যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত উপনিবেশসমূহের প্রতিরক্ষা বাহিনীদেরকে দেওয়া সর্বোচ্চ সামরিক পদক। আর ম্যকডোনেল সাহেব হলেন দ্বিতীয় বেসামরিক (অসামরিক) ব্যক্তি যিনি এই সন্মান পান। ম্যাকডোনেল সাহেবের এই পদক বর্তমানে সংরক্ষিত আছে লন্ডনের ইম্পেরিয়াল ওয়ার মিউজিয়ামের লর্ড অ্যাশক্রফট গ্যালারীতে ।
পরবর্তীকালে ম্যাকডোনেল সাহেব কলকাতায় ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত হাইকোর্ট অফ জুডিকেচার অ্যাট ফোর্ট উইলিয়াম (যা বর্তমানে কলকাতা হাইকোর্ট) আদালতের বিচারকমণ্ডলীর মধ্যে অন্যতম বিচারপতি ছিলেন।
১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ শে জুলাই ম্যাকডোনেল সাহেব তাঁর নিজের শহর চেল্টেনহ্যামে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এবং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ব্রিটিশ বন্ধুরা কলকাতা হাইকোর্টের বিপরীতে এই স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করে দেন।
![]() |
ম্যাকডোনেল সাহেবের কর্মজীবন - স্মৃতিসৌধের দুই পাশে (১৮৫০ থেকে ১৮৮৬) |
ম্যাকডোনেল সাহেবের এই স্মৃতিসৌধটি মূলত একটি পানীয় জলের ফোয়ারা। নীচের দিকে যে আলংকারিক সিংহের মুখটি রয়েছে সেখান থেকেই সরবরাহ হত জল এবং সৌধের দুপাশে ছিল দুটি ধাতব পাত্র, যেখানে থাকত ঘোড়ার জন্য পানীয় জল। তবে বর্তমানে সৌধটির অবস্থা শোচনীয়। অতীতে এটি কি ছিল এবং কি কাজে ব্যবহৃত হত তা চেনারও কোন উপায় নেই। জল সরবরাহকারী সিংহের মুখের অনেকাংশই ভেঙে গেছে। আর জল! সে কবেই শুকিয়ে গেছে। ঘোড়ার জন্য ব্যবহৃত সেই ধাতব পাত্রগুলিও এখন আর নেই। সৌধের চারিদিক একপ্রকার বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ। সামনের লোহার রেলিং এখন স্থানীয়দের জামাকাপড় মেলার জায়গা। আর এসবের মধ্যেই গাছপালার আবরণে লোকচক্ষুর আড়ালে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে কলকাতার বিস্মৃত স্মৃতিসৌধ ম্যাকডোনেল ফাউন্টেন।
![]() |
সৌধের দুই পাশে এই জায়গাটিতেই ধাতবপাত্র থাকত জল, যা তৃষ্ণার্ত ঘোড়ার জন্য ব্যবহৃত হত |
******************************************************
লেখা, গবেষণা ও ছবি - প্রীতম নস্কর
ই-মেল - pritamnaskar.pn@gmail.com
ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে ব্লগের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, তবে পূর্বানুমতি ছাড়া আমার তোলা
আলোকচিত্রগুলি এবং ব্লগের রচনাগুলি অন্য কোথাও কপি-পেস্ট বা বাণিজ্যিক ভাবে
ব্যবহার করা চলবে না।
******************************************************
গুগল ম্যাপ / কোঅরডিনেটঃ -
তথ্যসূত্রঃ -
- The Book of the V.C. – by A. L. Haydon
- The Comprehensive Guide to The Victoria & Geroge Cross (http://www.vconline.org.uk)
- Allen's Indian mail and register of intelligence for British & foreign India
- Shahabad: By Lewis Sydney Steward O'Malley(1906)
- Blog of The Concrete Paparazzi (Deepanjan Ghosh)
Comments
Post a Comment