মৃত চিঠিদের ডাকঘর... কলকাতার ওল্ড টেলিগ্রাফ অফিস ।। Dead Letter Office... Central Telegraph Office Calcutta

মৃত চিঠিদের ডাকঘর... কলকাতার ওল্ড টেলিগ্রাফ অফিস ।। Dead Letter Office... Central Telegraph Office Calcutta

আচ্ছা কখনও ভেবে দেখেছেন কি হয় সেই সমস্থ চিঠিপত্রের যেগুলি হারিয়ে যায় এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে?

...না না ডিজিটাল মেল-এর কথা বলছি না, বলছি হাতে কলমে লেখা বা ডাকে পাঠানো চিঠিযেমন ধরুন ভুল ঠিকানায় পাঠানো চিঠি কিমবা যেসব চিঠির প্রাপকেরা বর্তমানে জীবিত নেই, বা ধরুন যেগুলি পুনরায় প্রেরকের কাছে পাঠানো সম্ভব নয়। কি হয় সেইসব চিঠিপত্রের...? ডাক পরিভাষায় প্রচলিত নাম ডি.এল.. যার অর্থ ডেড লেটার অফিস। যেসব চিঠি কিমবা পার্সেল ডাকযোগে প্রাপকের কাছে পাঠানো সম্ভব হয়না সেই সব চিঠি এসে জমা হয় এই মৃত চিঠির মর্গে, যাকে বলা হয় ডেড লেটার অফিস। আর ঠিক এমনি কলকাতার বুকে রয়েছে এক ডেড লেটার অফিস। ব্রিটিশ স্থাপত্যের আর এক নিদর্শন কলকাতার ডালহৌসি চত্বরের দক্ষিণ পাড়ে ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রীট ও হেয়ার স্ট্রীটের সংযোগস্থলে কলোনিয়াল স্থাপত্যে গড়ে ওঠা এই অপরূপ লাল রঙের বাড়িতবে বাড়ি বলা ভুল, কারণ আসলে এটি একটি আস্ত ইমারত যা একসময় ছিল সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিস, যা পরিচিত কলকাতার ডেড লেটার অফিস নামেও

ডালহৌসি স্কোয়ার। ব্রিটিশ রাজত্বে গড়ে ওঠা এই অঞ্চলের চতুর্দিকে রয়েছে বিভিন্ন হেরিটেজ বিল্ডিং। যেমন কেন্দ্রে লাল দীঘি ও তার পূর্বদিকে কারেন্সি বিল্ডিং, পশ্চিমে জি.পি.ও.রয়াল ইনস্যুরেন্স বিল্ডিং ; উত্তরে রাইটার্স বিল্ডিং আর দক্ষিণে স্ট্যান্ডার্ড বিল্ডিং, হংকং হাউস এবং দ্যা সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিসের দুটি বিল্ডিং; একটি পুরনো ও অন্যটি নতুন। আর আজকের এই ব্লগ এই সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিস -কে নিয়েই।

Telegraph Office from the 'Walter Hawkins Nightingale (PWD) collection: Album of views of Calcutta (courtesy BRITISH LIBRARY)

ভারতের প্রথম টেলিযোগাযোগ ও ডাকযোগাযোগ ব্যবস্থাঃ

ভারতে টেলিকমিউনিকেশনস সার্ভিস বা টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা শুরু হয় ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে টেলিগ্রাফ -এর হাত ধরে। আর পরীক্ষামূলক ভাবে ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে অক্টোবরে সর্বপ্রথম বৈদ্যুতিক টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন হয় কলকাতাডায়মন্ড হারবার এর মধ্যে, যা মূলত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সুবিধার্থে। আর এদিকে ১৭২৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতে ডাক পরিষেবা শুরু হলেও, আধুনিক ডাক পরিষেবা শুরু হয় ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড ডালহৌসি -র হাত ধরে। আর এভাবেই ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে টেলিগ্রাফ যখন জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হল তখন থেকেই টেলিগ্রাফ ডিপার্টমেন্ট দেশের বিভিন্ন প্রদেশে তাদের পৃথক বিভাগ খুলতে শুরু করল। প্রথম টেলিগ্রাফ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কলকাতার সাথে যুক্ত হয় আগ্রা, বোম্বাই ও মাদ্রাস।

courtesy - Article of Indian Engineering August 4, 1988

সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিস ও তার পূর্বের ঘটনাঃ

তবে বর্তমানে যে জায়গায় এই জমকালো লাল বাড়িটি রয়েছে, ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের আগে কিন্তু সে জায়গায় ছিল এক পুষ্করিণী বা ট্যাঙ্ক। পরবর্তীকালে জায়গাটি মিঃ উইলিয়ম তুলহ নামক এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ানের দখলে চলে গেলে, মিঃ তুলহ সেই পুষ্করিণী ভরাট করে গড়ে তোলে তুলহ অ্যান্ড কোম্পনি (Tulloh & Co) নামক এক নিলাম সংস্থা। আচ্ছা এক্ষেত্রে বলে রাখি যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সেই সময় কিন্তু কলকাতার বুকে তুলহ অ্যান্ড কোম্পানির মতোই ছিল আরও অনেক নিলাম সংস্থা যেমন মেসার্স কিং, জনসন অ্যান্ড পিয়ারসে, স্টুয়ারট অ্যান্ড ব্রাউন, মৌয়াট অ্যান্ড ফরিয়া। এদের কাজই মূলত যা হাতের কাছে পাবে তাই বেচে দেওয়া। তো এই তুলহ অ্যান্ড কোম্পানিও ইন্ডিগো ফ্যাক্টরি থেকে শুরু করে লাইব্রেরির বইপত্র, সুরা, এমনকি ঘোড়া পর্যন্ত নিলামে বেচতে থাকত। তবে ইতিহাসের পাতায় এই উইলিয়াম তুলহ এর নাম পাওয়া যায় আরও একটি বিশেষ জায়গায়। জোহান জফ্ফানি র আঁকা দ্যা লাস্ট সাপার ছবিটিতে, যেখানে শিল্পী জফ্ফানি এই উইলিয়াম তুলহ কে অমর জুডাস এর ভূমিকায় অঙ্কন করেছেন এবং এই চিত্রটির অবিকল প্রতিরূপ দেখতে পাওয় যায় কলকাতার সেন্ট জন্স গির্জা গৃহে। পরবর্তীকালে ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে তুলহ কোম্পানির এই জমিতেই গঠন হয় হিন্দুস্থান ব্যাংক, যা ভারতের প্রথম ইউরোপিয়ান স্টাইল ব্যাংক

Calcutta Telegraph Office (courtesy Anstoch & Lin - stamps-auction.com)

পরবর্তীকালে ডালহৌসি স্কোয়ারের এই অংশটি যে অনেকবারই বিভিন্নভাবে হস্তান্তর ঘটেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় পরবর্তী ঘটনাগুলোতে। ১৮০৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৮-ই মে ও ১৯-শে মে চুক্তিপত্র ২২৫৭ অনুযায়ী ট্যাঙ্ক স্কোয়ারের দক্ষিণে ২ বিঘা জমিসহ একটি আবাসন বাড়ি মিঃ বেঞ্জামিন টার্নার এবং তাঁর স্ত্রী ফিনেল্লার ত্রিশ হাজার টাকায় ইউনাইটেড কোম্পানিকে বিক্রি করে। আর এই বারিটিতেই বিভিন্ন ভাড়াটিয়াদের মধ্যে ছিলেন মেরিন বোর্ডের সেক্রেটারি জন শোর এস্কোয়ার।

পরবর্তী সময় ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দ, মিউনিসিপাল রেকর্ড অনুযায়ী ডালহৌসি স্কোয়ারের এই অংশটির হদিস পাওয়া যায় বোরো নং ৩১ ১/৫ ও ৩২ হিসাবে যেটি সে সময়ে জি.সি.দে নামক এক ওয়াইন ব্যবসায়ী ও জন হেরোইট অ্যান্ড কোম্পানির দখলে পাওয়া যায়। তবে পরবর্তীকালে সরকার যখন জমিটি কিনতে যায় তখন দেখা যায় জায়গাটিতে রয়েছে সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিস। এছাড়াও বাড়িটির নিচের তলায় রয়েছে মেসার্স বারকিংইয়াং অ্যান্ড কোম্পানির বাদ্যযন্ত্রের দোকান। যেখানে বিক্রি হচ্ছে পিয়ানোর মতো বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, এমনকি বাড়িটিতে গড়ে উঠেছে এফ.সি.অসলার এর এক অপরূপ ঝাড়বাতির দোকান। এছাড়াও রয়েছে ম্যাকিলপ, স্টুয়ারট অ্যান্ড কোম্পানি নামক বিভিন্ন ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান।

Telegraph Office, Kolkata in 1910s from the Old Courthouse Street (Courtesy - canmore.org.uk)

স্থাপত্যশিল্পঃ

এবার আসা যাক বাড়িটির স্থাপত্যের ব্যাপারে। প্রথম বাড়িটির নকশা তৈরি হয় ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে, সরকারি স্থপতি মিঃ গ্র্যানভিলি এর সঙ্গে সাহায্য করলেন মিস্টার বেঞ্জামিন ক্লার্ক। ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে বাড়িটির ভিত্তি স্থাপন হলেও ১৮৭৩ এর আগে কিন্তু নির্মাণকার্য শুরু করা সম্ভব হয়নি। পরিকল্পনায় কোনো গলদ দেখতে পেয়ে পুনরায় বাড়িটির পরিকল্পনা সংশোধিত করলেন এক্সকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার উইলিয়াম বার্নফাদার, আর এবার নির্মাণকার্যে বার্নফাদারের সঙ্গে যুক্ত হলেন মিঃ জর্জ ভিভিয়ান, লিওনার্ড রবার্ট  ও মিঃ এফ. সিলিস। শুরু হল নির্মাণকার্য। তবে ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে বিহার-বাংলায় দুর্ভিক্ষের ফলে নির্মাণ কিছুদিন স্থগিত রাখা হল। শেষে ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে সম্পূর্ণ হল বাড়িটির নির্মাণ।

ডেড লেটার অফিসের উত্তরদিক

ডালহৌসি স্কোয়ারের দক্ষিণ-পূর্ব দিক করে ৪ ফুট ৬ ইঞ্চি এক ভিত্তির উপর তৈরি হয়েছে এই বিল্ডিং। ভিত্তি নিয়ে প্রায় ৬৬ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এই বিল্ডিং, চত্বরের অন্যান্য কলোনিয়াল স্থাপত্যে গড়ে ওঠা বিল্ডিং এর থেকে একদমই আলাদা। আর এর প্রধান কারণ বিল্ডিং এর উপরেই উত্তর-পূর্ব কোণে গড়ে ওঠা এক টাওয়ার, যা তৈরি করা হয়েছিল মূলত গির্জার ঘণ্টাঘর অনুকরণে, যা নিয়ে ভবনের মোট উচ্চতা দাঁড়ায় ১২০ ফুট। কিন্তু ঘণ্টাঘর হিসাবে তৈরি হলেও ভবিষ্যতে কখনোই সেটিতে কোনো ঘণ্টা বসানো হয়নি। ভবনের মূল প্রবেশদ্বার উত্তরদিকে (বি.বা.দি. বাগ সরণী) ডালহৌসি স্কোয়ারের সম্মুখে। এছাড়াও বর্তমানে বিল্ডিং এর পূর্বদিকে (ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রীট) রয়েছে প্রবেশপথ।  

টেলিগ্রাফ অফিসের নতুন ভবন (পশ্চিম দিক)

সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিস হল সেই সমস্থ গভর্নমেন্ট অফিসের একজন যারা বছরের ৩৬৫ দিনই ক্রমাগত কাজ করে চলেছে এমনকি সরকারী ছুটির দিনেও। তবে ডালহৌসি স্কোয়ারের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে যে ভবনটি রয়েছে সেটি সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিসের প্রথম এবং পুরনো বিল্ডিং। আর ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিসের নতুন বিল্ডিং তৈরি হয় এর ঠিক পাশেই, যার প্রবেশপথ পশ্চিমদিকের ওয়েলেস্লি প্লেসে যা বর্তমানে রেড ক্রস প্লেস। তবে ডেড লেটার অফিস বর্তমানে পরিচিত রিটার্ন লেটার অফিস (আর.এল.ও) নামে, যার প্রবেশদ্বার ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিটে। অর্থাৎ সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিস ডালহৌসি স্কোয়ারের মোটামুটি তিনটি প্রাঙ্গন দখল করে রয়েছে, পূর্বের ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিট (হেমন্ত বসু সরণী), পশ্চিমে ওয়েলেস্লি প্লেস (রেড ক্রস প্লেস) ও উত্তরে বি.বা.দি. বাগ সরণী।

টেলিগ্রাফ অফিসের নতুন ভবন (উত্তর দিক), বামদিকে পুরনো ভবন

তবে বর্তমানে ই-মেল এর যুগে এখনও হারিয়ে যায়নি এই তারে পাঠানো চিঠি। তাই আজও খুব কম সংখ্যক হলেও, এখনও সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিসের নতুন ভবনের নিচের তলাটি ব্যবহৃত হয় চিঠিপত্র মজুত ও বাছাইয়ের কাজে, আর এদিকে উপরের তলাটি ব্যবহৃত হয় গেস্টরুম হিসাবে, যা পরিবর্তন করা হয়েছে অতিথিশালায়।

******************************************************

লেখা, গবেষণা ও ছবি - প্রীতম নস্কর  

ই-মেল - pritamnaskar.pn@gmail.com

ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে ব্লগের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, তবে পূর্বানুমতি ছাড়া আমার তোলা আলোকচিত্রগুলি এবং ব্লগের রচনাগুলি অন্য কোথাও কপি-পেস্ট বা বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করা চলবে না।

******************************************************

গুগল ম্যাপ / কোঅরডিনেটঃ -

তথ্যসুত্রঃ

  • Calcutta, Old and New: A Historical & Descriptive Handbook to the City - by Cotton, Sir Harry Evan Auguste
  • Hand Book to Calcutta - by W. Newman & Co. (Third Edition)
  • Heritage Building in Dalhousie Square Heritage Zone, Calcutta
  • General Article of Indian Engineering (Telegraph Office Calcutta) August 4, 1988

Comments