 |
শিবকুঠির, বালি-দেওয়ানগঞ্জ
|
বালি-দেওয়ানগঞ্জ..... বাংলার টেরাকোটা
মন্দির স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায় এই গ্রামটিতে। হুগলী জেলার
আরামবাগ মহকুমার অন্তর্গত বালি-দেওয়ানগঞ্জ আদতে ‘বালি’ ও ‘দেওয়ানগঞ্জ’ নামে দু’টি পল্লীগ্রাম। হাওড়া থেকে প্রায়
৮৫ কিলোমিটার দূরে দ্বারকেশ্বর নদের পশ্চিম তীরে গড়ে উঠেছে এই গ্রাম। আর এখানেই
বালির রাউতপাড়ায় রয়েছে শতাব্দী প্রাচীন সেই দুর্গামন্দির, সর্বমঙ্গলা মন্দির, লক্ষ্মীজনার্দন
মন্দির, শিবকুঠির...... আরও অনেক স্থাপত্য। বাংলার টেরাকোটা শিল্পের অলংকরণ ও মন্দির স্থাপত্যের ভিন্নতার এক অপরূপ
মেলবন্ধন দেখা যায় এই গ্রামটিতে।
প্রথমেই বলে রাখি এই ‘বালি’ নামে আরও একটি শহর রয়েছে হাওড়া
জেলায়, যা ‘বালি-উত্তরপাড়া’ হিসাবে পরিচিত। তবে এই বালি ইংরাজিতে ‘Bally’ এবং দেওয়ানগঞ্জের বালি হল ‘Bali’। হাওড়ার বালি কিন্তু আগে হুগলী জেলারই অধীনে ছিল, তখন থেকেই এই ধন্দ দূর করার
জন্য দুই বালিকে পৃথক করা হয়। আরামবাগের বালি পরিচিতি পায় ‘বালি-দেওয়ানগঞ্জ’ হিসাবে, আর হাওড়ার বালি পরিচিতি
পায় বালি-উত্তরপাড়া হিসাবে। এখানে বলে রাখি গুগল ম্যাপে কিন্তু আরামবাগের বালি ‘Bali No. 2’ হিসাবে খুঁজে পাওয়া
যায়। আরামবাগ শহর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার ভিতরে আরামবাগ-ঘাটাল সড়কের বামপাশে অবস্থিত
বালি-দেওয়ানগঞ্জ। এবার প্রশ্ন হওয়া স্বাভাবিক, লোকালয় থেকে এত দূরে একটি ছোট্ট
গ্রামে কীভাবে এতগুলো মন্দির তৈরি হল?
আর এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই আজ আমরা
ঘুরে দেখব বালি-দেওয়ানগঞ্জ......
 |
অতীতের কোন মন্দির কিমবা অট্টালিকার ভগ্নাবশেষ
|
বালি-দেওয়ানগঞ্জের উত্থান ও পতন –
বালির ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে প্রাথমিক যে
তথ্য উঠে আসে তা হল বালির পূর্বনাম ছিল ‘মকদমনগর’। এই মকদমনগর নাম কীভাবে সৃষ্টি হল তার কিছুটা আভাস পাওয়া
যায় ক্ষেত্র সমীক্ষায়। বালি-দেওয়ানগঞ্জের পাশে রাধাবল্লভপুরে দেখতে পাওয়া যায় মকদম
পীরের আস্তানা, যা ‘বাবা মকদম পীরের আস্তানা’ হিসাবে পরিচিত। স্থানীয় সূত্রে এই মকদমপীরের নামানুসারেই জায়গাটির নাম হয়
মকদমনগর। অর্থাৎ মকদমনগর যে একসময়ে একটি প্রতিষ্ঠিত শহর ছিল তা তার নামানুসারেই
অনুমান করা যায়। তবে পরবর্তীকালে, সম্ভবত সপ্তদশ শতাব্দীর কোনো এক সময়ে এই জায়গার
নাম পরিবর্তন হয়ে বালি ও তার পার্শ্ববর্তী দেওয়ানগঞ্জ হিসাবে পরিচিতি পায়। আর এই নামকরণের
কারণ দ্বারকেশ্বর নদের ভয়ঙ্কর বন্যা। একবার দ্বারকেশ্বর নদের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে
প্রবল বন্যা দেখা দেয়। বন্যায় মকদমনগরের ঘরবাড়ি, বাজার-হাট এমনকি সমস্ত গ্রাম বালি
চাপা পড়ে যায়। সেই সময়ে স্থানীয় দেওয়ান জগৎসিংহ নিজ প্রচেষ্টায় গ্রামের সমস্ত বালি
সরিয়ে নগরটির পুনরুদ্ধার করেন এবং তার সঙ্গে নগরের দক্ষিণদিকে একটি গঞ্জ বা বাজার
প্রতিষ্ঠা করে দেন। আর এভাবেই বালি চাপা পড়া মকদমনগর হয়ে যায় ‘বালি’ এবং দেওয়ানের প্রতিষ্ঠিত গঞ্জ হয়ে
যায় ‘দেওয়ানগঞ্জ’। বর্তমানে যদিও
বালি-দেওয়ানগঞ্জ একই গ্রাম হিসাবেই পরিচালিত হয়। দেওয়ানগঞ্জের আরও দক্ষিণে রয়েছে
জগৎপুর গ্রাম, যা দেওয়ান জগৎসিংহের নামানুসারে রাখা হয়েছে বলে অনুমান করা হয়।
 |
সর্বমঙ্গলা মন্দির, বালি রাউতপাড়া
|
 |
শিবকুঠিরের ভিতরের অংশ
|
বালি-দেওয়ানগঞ্জ বিখ্যাত হওয়ার অন্যতম
কারণ রেশম ও বয়নশিল্প। একসময়ে এই অঞ্চলে গুটিপোকার চাষ হত। ব্রিটিশদের আসার আগেও
পর্তুগীজরা এই ব্যবসায় লিপ্ত ছিলেন। পরবর্তীকালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও এই
ব্যবসায় যুক্ত হন। Hooghly Medical Gazeetters–এর লেখক D.G.Craford সাহেব লিখছেন – দ্বারকেশ্বর নদের পশ্চিমে গোঘাট থানার অন্তর্গত দেওয়ানগঞ্জ তখন রেশম ব্যবসার
প্রধান স্থান। দেওয়ানগঞ্জে প্রস্তুত হওয়া কাপড় দ্বারকেশ্বর নদ মারফৎ ঘাটাল হয়ে চলে
যেত কলকাতা এবং সেখান থেকে ইউরোপ। Bengal District Gazetters–এর O’Malley কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বয়নশিল্পে গুটি পোকার চাষ, সিল্ক মসলিন, সুতি,
তসর, ধুতি, শাড়ি তৈরি হত বালি-দেওয়ানগঞ্জে। হস্তচালিত তাঁতে রেশম সুতো ও সুতির কাপড় তৈরি হয়ে চলে যেত স্থানীয় বণিকদের
কাছে, নয়তো স্থানীয় বাজারে, আর নাহলে চলে যেত বড় বড় হাটে। এছাড়াও দেওয়ানগঞ্জে
এবং পার্শ্ববর্তী রাধাবল্লভপুর ও জগৎপুরে তৈরি হত দেশীয় কাগজ। সেই সমস্ত কাগজ আবার
চলে যেত কলকাতার ব্যবসায়ীদের কাছে। কাগজ শিল্পেও সুখ্যাতি ছিল এই অঞ্চল। গুটিপোকার
চাষ ছাড়াও পরবর্তীকালে ইংরেজদের হাত ধরে শুরু হয় নীলচাষ। কিন্তু খুব বেশিদিন সেই
ব্যবসা লাভজনক হয়নি। বাংলায় নীল বিদ্রোহের ফলে নীল চাষ আগেই বন্ধ হয়ে যায়, উপরন্তু
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে সিল্কের ব্যবসাও তলানিতে ঠেকতে থাকে। আর এইসবের অন্যতম কারণ
কোম্পানির নতুন আইন, যার প্রভাবে বিদেশে সিল্কের কাপড় রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। ইস্ট
ইন্ডিয়া কোম্পানি সিল্ক ব্যবসায় লাভ দেখে নিজেরাই সিল্কের কারখানা প্রতিষ্ঠা করতে
থাকলে ধীরে ধীরে এই ব্যবসা ধ্বংস হতে থাকে।
 |
বালি-দেওয়ানগঞ্জের লক্ষীজনার্দন মন্দিরের টেরাকোটার ফলক
|
 |
শিবকুঠিরের খিলানের অলংকরণ
|
আর এর পরেই বালি-দেওয়ানগঞ্জে শুরু হয়
পিতল সামগ্রীর উৎপাদন। বাঁশবেড়িয়া, বৈচি, জনাই, চাঁপাডাঙা, বালি বিভিন্ন গ্রাম
জুড়ে শুরু হয় পিতলের জিনিসপত্র। মূলত বাঙালি গৃহে ব্যবহৃত পুজোর সরঞ্জাম, দৈনন্দিন
জীবনে ব্যবহৃত পিতলের বাসন যেমন কলসি, থালা, গ্লাস-বাটি প্রভৃতির নকশা থেকে তৈরি
সমস্তটাই হত এখানে। তবে এই পিতলের জিনিস প্রস্তুতের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল যেমন
ধাতু থেকে শুরু করে কাঠকয়লা আমদানি হত বাইরে থেকে। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
সময় বিশ্ববাজারে অ্যালুমিনিয়ামের উৎপাদন সহজলভ্য হওয়ায় তামা ও পিতলের বাজারে ঘাটতি
দেখা দেয়। আর এথেকেই বাংলার ঘরে ঘরে অ্যালুমিনিয়ামের ব্যবহার শুরু হতে থাকে। ফলে পিতল
থেকে অ্যালুমিনিয়ামে পরিবর্তনের চাহিদা বালি-দেওয়ানগঞ্জের শিল্প ব্যবস্থার ধ্বংসের
সূচনা হয়ে দাঁড়ায়। পিতলের জিনিসপত্র তৈরির সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন গ্রামের কারিগরেরা অন্যান্য
পেশায় নিজেদের যুক্ত করে নিলেও বালি-দেওয়ানগঞ্জের লোকেরা তা করতে পারেননি।
বংশানুক্রমে জড়িয়ে থাকা এই শিল্পীরা নিজেদের এই কারিগরিবিদ্যা ছেড়ে অন্যকিছু রপ্ত
করতে পারেনি, হয়তো এর মূলে ছিল শারীরিক ক্ষমতা, হয়তো বা অন্য কিছু। তবে এখনও
দেওয়ানগঞ্জের কিছু জায়গায় পিতলের জিনিসপত্র তৈরি হয়, তবে তা বেশিরভাগই পুজোয়
ব্যবহৃত সামগ্রী; যেমনটা হয় হুগলীর চাঁপাডাঙা এলাকায়।
 |
ভাঙা ছাদ থেকে দেখতে পাওয়া নীল আকাশ
|
 |
শিবকুঠিরের স্থাপত্য ও কিছু লাল ভেষজ রঙ
|
শিবকুঠির –
আরামবাগ থেকে বালি-দেওয়ানগঞ্জ প্রবেশের শুরুতেই
দেখতে পাওয়া যায় শিবকুঠির। বাস অথবা গাড়ি নিয়ে গেলে বালি হাই স্কুলের ঠিক ২৫০
মিটার আগে বামদিকে দেখতে পাওয়া যাবে প্রাসাদোপম বিরাট অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ, আর
এটি আমাদের শিবকুঠির। পূর্বে যে এই অঞ্চলে বয়নশিল্পের প্রসার ঘটেছিল তা আগেই
জানিয়েছি। ধনী ব্যবসায়ী থেকে ইংরেজরা চাষিদের দাদন দিয়ে বয়নশিল্পের মাধ্যমে লক্ষ
লক্ষ টাকা উপার্জন করত। আর এরকমই এক ধনী ব্যবসায়ী, তথ্য অনুযায়ী একজন প্রসিদ্ধ
কুঠিয়াল ছিলেন শিবনারায়ণ মিশ্র। সিল্কের ব্যবসায় তিনি প্রচুর টাকা উপার্জন
করেছিলেন। তাঁর এই ঐশ্বর্যের প্রতীক স্বরূপ তৈরি করেছিলেন প্রাসাদোপম এই অট্টালিকা
যা বর্তমানে শিবকুঠির নামে পরিচিত। শিববাবুর কুঠি থেকে শিবকুঠি। তবে বর্তমানে এটিকে
কুঠিরের ধ্বংসাবশেষ বলা যেতে পারে, কারণ ছাদ থেকে দেওয়াল অধিকাংশই প্রায় ধবংস হয়ে
গেছে। যতটুকু এখনও জীবিত আছে সেগুলি থেকে ভবনের স্থাপত্যের কিছুটা অনুমান করা যায়।
যেমন রাস্তার দিকের সামনের অংশে অর্থাৎ শিবকুটিরের পশ্চিম অংশের সম্মুখে রয়েছে
পাঁচটি বড় খিলান ও দু’পাশে একটি করে ছোট খিলান। সমগ্র ভবনটি দ্বিতলে বিভক্ত। পশ্চিম অংশের নিচের
তলের মতো উপরের তলাটিতেও রয়েছে মোট সাতটি খিলান। প্রত্যেকটি খিলানের দুপাশে রয়েছে দু’টি করে আয়নিক স্থাপত্যের কলাম বা
স্তম্ভ। তবে মনে হয়না সবগুলি স্তম্ভ ভবনের ছাদটিকে ধরে রেখেছিল, হয়তো এর মধ্যে
কয়েকটি আসল স্তম্ভ এবং বাকিগুলি শুধুমাত্র সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য কারুকার্য করা
হয়েছিল। একসময়ে শিবকুঠির দেওয়ালে যে স্টাকো শিল্পকলা ছিল তা এই সামনের অংশে ও
ভিতরের কিছু কৃত্রিম দরজা-জানলায় খানিকটা দেখা যায়। শিবকুঠির দক্ষিণদিকের অংশ
প্রায় ভেঙে গেছে, শুধুমাত্র দ্বিতীয় সারির দেওয়ালগুলি চোখে পড়ে। পূর্বে শিবকুঠিরে
কিরকম মাপের ঘর ছিল তা অনুমান করা দুষ্কর, লোহার বিম থেকে ছাদ কিছুই অবশিষ্ট নেই।
কুঠিরের মধ্যিখানে সম্ভবত একটি বড় হল ছিল, মধ্যিখানে কোন দেওয়াল না থাকায় এবং দেওয়ালের
চতুর্দিকে বিম আটকানোর জন্য অসংখ্য ছিদ্র থাকায় এরূপ অনুমান। তবে বর্তমানে ছাদের
কোনও চিহ্ন নেই। উত্তর-পশ্চিম দিকের অংশে এবং দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে উপরে ওঠার একটি
করে সিঁড়ি রয়েছে, যার মাধ্যমে অনায়াসেই শিবকুঠির উপরের তলায় যাওয়া যায়। তবে আগেই
বলে রাখি উপরের তলা বলতে আদতে কিছু নেই শুধুমাত্র সিঁড়ির উপরে চাতালটি কিছুটা
অক্ষত অবস্থায় থাকায় ততদূর পর্যন্ত যাওয়া যায়। কিন্তু নিজের ভার ও সাবধানতা মেনেই
উপরে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে। একে দীর্ঘদিন ধরে চুন-সুরকি ও মাটি জমে জমে
সিঁড়িগুলির ঢাল একেবারে নেমে গেছে, উপরন্তু জায়গাটিও অনেকটা অপরিষ্কার, বিষাক্ত
প্রাণীর বাস থাকতে পারে।
 |
শিবকুঠিরের অন্দরমহল
|
 |
শিবকুঠিরের দ্বিতলে যাওয়ার সিঁড়ি
|
 |
শিবকুঠিরের পিছনদিকে অষ্টকোণাকৃতি মন্দির
|
শিবকুঠিরের পিছন দিকেই বাগানের সরু
রাস্তা ধরে গেলে বামদিকে দেখতে পাওয়া যায় কিছু স্থাপত্যের ভগ্নাবশেষ। কয়েকটি ভগ্ন
খিলান এবং একটি মন্দিরের প্রবেশদ্বার দেখে অনুমান করা যায় অতীতে কোন দালান
প্রকৃতির বা অন্যান্য শ্রেণীর মন্দির ছিল। আর এইরকম অনুমানের কারণ, এইসব
ভগ্নাবশেষের মাঝে এখনও এই জায়গাটিতে একটি সম্পূর্ণ মন্দির দেখতে পাওয়া যায়।
মন্দিরের বিগ্রহ মাটির রাধাকৃষ্ণ যা কয়েক বছর আগে এনে রাখা হয়েছে এবং এখনও মন্দিরে
নিত্যপুজো হয়। মন্দিরের স্থাপত্যের ব্যাপারে বলতে গেলে মন্দিরটি অষ্টকোণাকৃতি ও
তিনটি সারিতে বিভক্ত। মন্দিরের স্থাপনকাল সম্বন্ধে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি, তবে
গ্রামবাসীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মন্দিরটি শিবকুঠিরের অংশ ছিল।
 |
লক্ষীজনার্দন মন্দির, দালাপাড়া
|
লক্ষ্মীজনার্দন মন্দির, দালালপাড়া –
শিবকুঠির থেকে বেড়িয়ে দক্ষিণ দিকে বাসরাস্তা
ধরে প্রায় ২০০ মিটার গেলে রাস্তার বামপাশে বনজঙ্গলের আড়ালে দেখতে পাওয়া যাবে লক্ষ্মীজনার্দন
মন্দির। বর্তমান অবস্থায় মন্দিরটিকে দেখলে এটি একরত্ন বলেই বিবেচিত হবে। তবে অতীতে
এই মন্দির ছিল পঞ্চরত্ন। বাংলার মন্দির স্থাপত্যের প্রধান গবেষক ডেভিড ম্যাকাচ্চন
তাঁর Late Mediaeval Temples of Bengal বইটিতে সম্ভবত এই মন্দিরটিকেই বালি-দেওয়ানগঞ্জের
ধ্বংসপ্রাপ্ত পঞ্চরত্ন মন্দির বলে উল্লেখ করেছেন, যদিও তিনি এই মন্দিরের নামের
ব্যাপারে কিছু বলেননি। বর্তমান অবস্থাতেও ধ্বংসপ্রাপ্ত এই কারণে বলা, মন্দিরটি
অনেকবছর আগে থেকেই পরিত্যক্ত, মন্দিরের সামনে যাওয়ার কোন পথ নেই। রাস্তার দিক থেকে
মন্দিরের সামনের অংশে একটি ছোট্ট ডোবা মতো সৃষ্টি হওয়ায় সেখানেও নোংরা আবর্জনায়
পরিপূর্ণ। যদিও বাম পাশে গ্রামের রাস্তা ধরে মন্দিরের পিছনদিকের অংশে যাওয়া যেত,
কিন্তু সেখানেও আবর্জনার স্তূপ। বর্তমানে মন্দিরে বিগ্রহ নেই, তবে রাস্তার
উল্টোদিকে সাম্প্রতিক একটি আধুনিক মন্দির তৈরি হওয়ায় লক্ষ্মীজনার্দনের বিগ্রহ সেই
মন্দিরে ঠাঁই পেয়েছে। পুরনো লক্ষ্মীজনার্দন মন্দিরের স্থাপত্যের ব্যাপারে বলতে
গেলে – বর্তমানে মন্দিরটির রূপ একরত্ন ও দক্ষিণমুখী। তবে দক্ষিণদিকের অংশে যাওয়ার পথ
একেবারেই বন্ধ, বড় বড় গাছপালায় পুরোটাই ঢেকে ফেলেছে প্রবেশপথ এবং মন্দিরের
দক্ষিণ-পূর্ব অংশের অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। যতদূর দেখা যায় মন্দিরের দক্ষিণদিকের অংশে
রয়েছে তিনটি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ। তবে রাস্তার দিক থেকে মন্দিরের সামনের অংশে
অর্থাৎ পশ্চিমদিকের অংশে চেষ্টা করলে যাওয়া যায়। এই অংশে রয়েছে তিনটি খিলান, যার
মধ্যে মাঝের খিলানটি মন্দিরের প্রবেশপথ এবং বাকি দু’টি কৃত্রিম টেরাকোটার দরজা। অনুরূপভাবে
মন্দিরের পূর্বদিকেও রয়েছে তিনটি কৃত্রিম টেরাকোটার খিলান, তবে এদিকে কোনও
প্রবেশপথ নেই। কয়েকবছর আগে পর্যন্তও দক্ষিণদিকে মন্দিরের প্রতিষ্ঠাফলক কিছুটা হলেও
দেখা যেত তবে বর্তমানে তার কিছুই দেখা যায়না। প্রতিষ্ঠাফলকটি পোড়ামাটির তৈরি হওয়ায়
সময়ের সাথে সাথে তা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। কবে এবং কে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছেন সে
সম্বন্ধেও কোথাও কোন তথ্য নেই। মন্দিরের চতুর্দিকে বিশেষকরে দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকের
দেওয়ালগুলিতে অসংখ্য টেরাকোটার প্যানেল দেখা যায়। প্যানেলগুলিতে মূলত কৃষ্ণ-রাধিকা,
কৃষ্ণের সাথে গোপীগণ, বিভিন্ন মুখমণ্ডলের অব্যয়, ফুলসারির কাজ প্রভৃতি দেখা যায়।
 |
লক্ষীজনার্দন মন্দিরের খিলানের উপর টেরাকোটার ফলক
|
 |
লক্ষীজনার্দন মন্দিরে ফুলসারির কাজ
|
লক্ষ্মীজনার্দন মন্দির থেকে বেড়িয়ে
পুনরায় বাসরাস্তা ধরে প্রায় ১.৫ কিলোমিটার দক্ষিণে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে ঘোষপাড়ার
দামোদর মন্দির। প্রথমে ঘোষপাড়ায় যেতে পারেন, অথবা লক্ষ্মীজনার্দন মন্দিরের বাম
পাশের সরু মেঠো পথ ধরে পৌঁছে যেতে পারেন রাউতপাড়া। আমরা যেহেতু প্রথমে রাউতপাড়া
গিয়েছিলাম তাই ভ্রমণের সুবিধার্থে আগে রায়তপাড়ার মন্দির নিয়েই আলোচনা করা হল। তবে
এখানে বলে রাখি আমরা যেহেতু পায়ে হেঁটে ঘুরেছিলাম তাই লক্ষীজনার্দন মন্দির থেকে
রাউতপাড়ায় যাওয়ার এই মেঠোপথে কোন অসুবিধা হয়নি। দু’চাকা গাড়ি থাকলেও এই পথে তেমন কোন
অসুবিধা হবে না, তবে চার’চাকা গাড়ির ক্ষেত্রে এই পথ প্রবেশের অযোগ্য, সেক্ষেত্রে আপনাকে বাসরাস্তা ধরে
কিছুটা দক্ষিণে হালদারপাড়া মোড়ে নামতে হবে। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে বামদিকের গ্রমের
রাস্তায় প্রবেশকরে রাউতপাড়া।
 |
দুর্গামন্দির, রাউতপাড়া (সৌজন্যে By SuvadipSanyal - Own work, CC BY-SA 3.0, httpscommons.wikimedia.orgwindex.phpcurid=68388213)
|
রাউতপাড়া
লক্ষ্মীজনার্দন মন্দিরের বামদিকের
মেঠোপথ ধরে প্রায় ১ কিলোমিটার ভিতরে রাউতপাড়া। আর এখানে মূলত একই জায়গায় মোট ৪ টি
মন্দির দেখা যায়। দুর্গামন্দির, বিষ্ণুমন্দির, সর্বমঙ্গলা মন্দির ও মঙ্গলচণ্ডী
মন্দির। রাউতপাড়ার এই মন্দিরগুলি কে তৈরি করেছেন তার কোন তথ্য কোন বইতে লেখা নেই।
তবে ক্ষেত্র সমীক্ষায় গিয়ে জানা গেল এই মন্দির তৈরি করেন রঘুনাথ রাউত। এই রাউত
পরিবারের বংশধর এখনও এই গ্রামে বসবাস করেন। ‘রাউত’ যা মূলত কর্মকারদের বলা হয়ে থাকে।
বালি-দেওয়ানগঞ্জের রাউতরা মূলত পিতলের দ্রব্য নির্মাণ ও বিক্রয়ের কাজে যুক্ত ছিল।
আগেই জেনেছি সেই সময়ে পিতলের চাহিদা ও উৎপাদনে এইসব অঞ্চল বাংলার অন্যতম কেন্দ্র
ছিল। তাই রাউতদের পূর্বপুরুষ যে এইসব মন্দিরগুলি নির্মাণ করতে পারে সেবিষয়ে কোন
সন্দেহ নেই।
দুর্গামন্দির, রাউতপাড়া –
বালি-দেওয়ানগঞ্জের প্রধান আকর্ষণ হল
রাউতপাড়ার দুর্গামন্দির। সারা বাংলায় খুঁজলেও এই মন্দির স্থাপত্যের অনুরূপ আর
একটিও পাওয়া যাবে না। কারণ বাংলার মন্দির স্থাপত্যের দুটি ভিন্ন শিল্পরীতির সংমিশ্রণ
ঘটেছে এই দুর্গামন্দিরে। মন্দির রীতির দুটি ভিন্ন ধরন হল ‘চালা’ ও ‘রত্ন’। চালার সংক্ষিপ্ত রূপ হল একচালা,
তবে মন্দিরের রূপ কল্পনায় এর কোন জায়গা হয়নি, তাই দোচালা থেকেই মন্দির রীতির
সূত্রপাত। সাধারণত দুটি দোচালা একসঙ্গে জুড়ে তৈরি হয় চারচালা যা শিল্পরীতিতে ‘জোড়বাংলা’ হিসাবে পরিচয় পেয়েছে। যেমন
বিষ্ণুপুরের কেষ্ট-রাই মন্দির, গুপ্তিপাড়ার চৈতন্যদেব মন্দির। এদিকে চালা মন্দিরের
সঙ্গে পূর্বে প্রচলিত শিখর রীতির মিশ্রণ ঘটে তৈরি হয়েছে বাংলার আর এক মন্দির রীতি ‘রত্ন’। প্রথমে একরত্ন এবং ক্রমে
কার্নিশের সংযোগস্থলের কোণগুলিতে রত্ন বসিয়ে পঞ্চরত্ন, দ্বিতলে নবরত্ন.........
পঞ্চবিংশতি রত্ন। তবে বালি-দেওয়াগঞ্জের দুর্গা মন্দির হল ‘চালা’ ও ‘রত্ন’ শিল্পরীতির সংমিশ্রণ। জোড়বাংলা মন্দিরের উপর নবরত্ন সৃষ্টি করে তৈরি হয়েছে দুর্গা মন্দির, যা সারা বাংলায়
অদ্বিতীয়।
 |
টেরাকোটার প্যানেলে সপরিবারে দেবী দুর্গা (By SuvadipSanyal - Own work, CC BY-SA 3.0, httpscommons.wikimedia.orgwindex.phpcurid=68387506)
|
তবে আরও একটি কারণে এই দুর্গামন্দির
নিজের একক শিল্পকলার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে, আর সেটি মন্দিরের প্রবেশদ্বারের উপরে একটি
বৃহৎ মহিষাসুরমর্দিনীর প্যানেল। দেবী দুর্গা তার পরিবারের সদস্যদের (কার্তিক,
গণেশ, সরস্বতী, লক্ষী) নিয়ে টেরাকোটার এই বৃহৎ প্যানেল আর কোনও মন্দিরেই দেখতে
পাওয়া যায়নি। সাধারণত টেরাকোটার মন্দিরগুলিতে মহিষাসুরমর্দিনীর যে প্যানেল দেখতে
পাওয়া যায় তা আকারে যেমন ছোট তেমনই একই প্যানেলের মধ্যে দেবী দুর্গার সমস্ত
পরিবারকে দেখা যায়। কিন্তু বালি-দেওয়ানগঞ্জের এই দুর্গামন্দিরের প্যানেলটি
ব্যাতিক্রম, আসলে পোড়ামাটির প্যানেলটি আকারে যেমন বড় তেমনই প্রতিটি দেবদেবীর জন্য
রয়েছে পৃথক প্যানেল যা দেখতে এক একটি ক্ষুদ্র মন্দিরের মতো। দুর্গা মন্দিরটি পূর্বমুখী
এবং পশ্চিমদিকে প্রবেশের জন্য রয়েছে তিনটি খিলান। টেরাকোটার ফলকে মহিষাসুরমর্দিনী
ছাড়াও রয়েছে আরও অনেক প্যানেল। যেমন খিলানের বামদিকে ও ডানদিকের সারির উলম্ব অংশে
রয়েছে বেশকিছু প্যানেল – দেবদেবীর মধ্যে দু’ধরনের গণেশ জননী, শিব-পার্বতী, ভাগীরথীর গঙ্গা আনয়ন। এদিকে সামাজিক দৃশ্যের
মধ্যে টুপি পরা সাহেব, হুঁকো সেবন। মন্দিরের তিনটি খিলানের স্তম্ভগুলির উপরে উলম্ব
আকারের চারসারির ‘মৃত্যুলতা’ দেখা যায়, ঠিক এরকমই মৃত্যুলতা দেখা যায় কালনার মন্দিরগুলিতে। দুর্গা মন্দিরের
উপরে যাওয়ার জন্য মন্দিরের ভিতরেই রয়েছে সিঁড়ি। তবে সিঁড়িগুলি এতটাই সরু যে
শুধুমাত্র একজনের পক্ষেই একদিক দিয়ে সিঁড়ি ব্যবহার করা যাবে। প্রথম তলাটি
জোড়বাংলার উপরে এবং দ্বিতীয় তলাটি প্রথম রত্নসারির উপরে।
 |
দু-ধরনের গণেশ জননী (ডানদিকে সম্ভবত দেবী চন্ডী রূপে জননী)
|
 |
টেরাকোটার প্যানেলে 'মৃত্যুলতা'
|
 |
ইউরোপিয়ান সাহেব, ভাগীরথীর গঙ্গা আনয়ন, হুঁকোসেবন |
এবারে আসি মন্দিরটির রক্ষণাবেক্ষণ
প্রসঙ্গ নিয়ে। সুত্র অনুযায়ী ১৯৯০ সাল থেকে দুর্গামন্দিরটি রাজ্য প্রত্নতাত্ত্বিক
বিভাগের আওতাধীন। ২০২১ সালের আগে পর্যন্ত মন্দিরের কোনরূপ সংস্কার করা হয়নি। বছরের
পর বছর অবহেলার কারণে মন্দিরের টেরাকোটার ফলক, মন্দিরের চাল ও চূড়া সমস্তটাই
ক্ষতিগ্রস্থ। দেবী দুর্গা ও তার পরিবারের টেরাকোটার প্যানেলগুলির ক্ষয় সবথেকে
বেশি। দেবী দুর্গার অস্ত্র, সিংহ, মহিষাসুর, বিভিন্ন দেবদেবীর পা অর্ধেক ভেঙে
গেছে। খিলানের উপরে স্টাকো শিল্পের কিছু নকশা ও বারান্দার দুটি স্টাকো শিল্পের
ঘোড়া ছিল তাও অর্ধেক নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। উপরে ওঠার প্রবেশপথও ছিল ক্ষতিগ্রস্থ। তবে
না! দীর্ঘদিনের অবসানের পর ২০২১-২২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও পূর্ত দপ্তর কর্তৃক
মন্দিরের সংস্কার হয়।
 |
রাউতপাড়ার দুর্গামন্দির - বামদিকে সংস্কারের পূর্বে (সৌজন্যে SuvadipSanyal), ডানদিকে সংস্কারের পর (ছবি নিজস্ব)
|
হায়! এই সংস্কার যদি সরকার এরূপে
মন্দিরগুলিতে করতে থাকে তবে আমি বলব এই সংস্কার না করাই ভালো। শুধুমাত্র
বালি-সিমেন্ট ও নতুন রঙের মারপ্যাঁচে যে প্রত্নতাত্ত্বিক বা ঐতিহাসিক মন্দির
সংস্কার করা যায় না তা এখন বালির এই দুর্গামন্দির তার উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
টেরাকোটার যে বস্তুগুলি নষ্ট হয়েছে সেগুলিকে সিমেন্টের প্রলেপ দিয়ে ঢেকে ফেলা
হয়েছে। পুরনো ভেষজ রঙেও পড়েছে পাইমার অথবা সিমেন্টের প্রলেপ। জোড়বাংলার চাল ও
নবরত্ন মন্দিরের পুরোটাই সিমেন্ট ও আধুনিক রঙ দিয়ে এমনভাবে সংস্কার করা হয়েছে, যে
বর্তমানে কোন নতুন ব্যাক্তি মন্দির ভ্রমণে এলে ঠাহর করতে পারবে না যে এটি একটি শতাব্দী
প্রাচীন দুর্গামন্দির। ক্ষেত্র সমীক্ষায় গিয়ে অনুসন্ধান করে জানা গেল গ্রামের
মানুষজনও এই সংস্কারের ব্যাপারে খুশি নয়। তাদের যেভাবে সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল
তার সিকিভাগও সেই সংস্কার হয়নি। কিন্ত কাজের চুক্তি পাওয়া ঠিকাদার এরকম ভাবেই
মন্দির সংস্কার করে চলে গেছে। মন্দিরের সামনেও পড়ে গেছে রাজ্য পুরাতত্ত্ব বিভাগের
বোর্ড। আর বালির ঐতিহ্যবাহী দুর্গামন্দির হয়ে গেছে আধুনিক দুর্গামন্দির।
 |
বিষ্ণুমন্দির, রাউতপাড়া
|
 |
বিষ্ণুমন্দিরের দেওয়ালে অবশিষ্ট কিছু ফলক
|
বিষ্ণুমন্দির –
দুর্গামন্দিরের পাশেই রয়েছে
বিষ্ণুমন্দির। প্রথমেই বলি অনেকই এই মন্দিরটিকে সর্বমঙ্গলা মন্দির হিসাবে পরিচয়
দিয়েছেন, কিন্তু আদতে এই মন্দিরটি বিষ্ণুমন্দির। স্থানীয় গ্রামবাসীদের কাছ থেকে
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এটি বিষ্ণুমন্দির এবং এর পিছনের দিকে রয়েছে সর্বমঙ্গলা
মন্দির। দুর্গামন্দির যদিও সময়ের সাথে টিকে থাকতে পেরেছে কিন্তু বিষ্ণুমন্দিরের সে
সুযোগ হয়ে ওঠেনি। দীর্ঘদিন অবহেলার ফলে মন্দিরের অর্ধেক প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। স্থাপত্যের
গঠনে এককালে পঞ্চরত্ন মন্দির হলেও বর্তমানে তা একরত্ন আকার ধারন করেছে। চারদিকের
চারটি চূড়াই কোন একসময়ে ভেঙে গেছে। মন্দিরের প্রবেশপথ পূর্বদিকে। তবে এই দিকের বারান্দার
সম্পূর্ণ ধসে পড়েছে, শুধুমাত্র গর্ভগৃহ কোনমতে টিকে রয়েছে। মন্দিরের টেরাকোটার ফলক
নেই বললেই চলে, শুধুমাত্র উত্তর দিকের দেওয়ালে কয়েকটি ফলক দেখা যায়।
 |
সর্বমঙ্গলা মন্দির, রাউতপাড়া
|
 |
সর্বমঙ্গলা মন্দিরের দক্ষিণদিকের দেওয়াল
|
সর্বমঙ্গলা মন্দির –
বিষ্ণু মন্দিরের ঠিক পিছনেই রয়েছে সর্বমঙ্গলা
মন্দিরের ভগ্নাবশেষ। এখানেও বলি অনেকই এই মন্দিরটিকে মঙ্গলচণ্ডী মন্দির হিসাবে
পরিচয় দিয়েছেন, কিন্তু আদতে এই মন্দিরটি সর্বমঙ্গলা মন্দির। তবে এটিও একসময়ে
দুর্গামন্দির হিসেবে পরিচিত ছিল। অতীতের গঠনশৈল এখন প্রায় বিলুপ্ত। শুধুমাত্র
মন্দিরের মাঝখানের রত্নটি দেখতে পাওয়া যায়, তাও অর্ধেক অংশ ভেঙে গেছে। সম্ভবত এটিও
পঞ্চরত্ন মন্দির ছিল। পশ্চিমমুখী সর্বমঙ্গলা মন্দিরের কোন দেওয়ালেই টেরাকোটার
চিহ্ন নেই। বর্তমানে মন্দিরের প্রায় সমস্তটাই ভেঙে গেছে বলা চলে, মন্দিরের চুড়ায়
জন্মেছে আগাছা।
 |
মঙ্গলচন্ডী মন্দির, রাউতপাড়া
|
 |
মঙ্গলচন্ডী মন্দিরের দেওয়ালে থাকা অবশিষ্ট টেরাকোটার ফলক
|
 |
মঙ্গলচন্ডী মন্দির (এখনও নিত্য পুজো হয়)
|
মঙ্গলচন্ডী মন্দির –
সর্বমঙ্গলা মন্দিরের বিপরীতে রয়েছে আরও
এক মন্দিরের ভগ্নাবশেষ, এটি মঙ্গলচণ্ডী মন্দির। বর্তমানে মন্দিরের চুড়ার কিছুই
অবশিষ্ট নেই। গবেষক ডেভিড ম্যাকাচ্চন তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন – হুগলী-গোঘাটের বালি অঞ্চলে যে
টেরাকোটা সজ্জিত মঙ্গলচণ্ডী মন্দিরের ভগ্নাবশেষ রয়েছে অতীতে তার ১৩ টি রত্ন ছিল
বলে কথিত আছে। অর্থাৎ, অতীতে মঙ্গলচন্ডী মন্দির যে বাংলার ত্রয়োদশ রত্ন শ্রেণির এক
অন্যতম উদাহরণ ছিল তা স্বয়ং ডেভিড সাহেবও দেখে যেতে পারেননি। মন্দিরটি পূর্বমুখী।
ত্রিখিলান যুক্ত পূর্বদিকের বারান্দা ভেঙে যাওয়ায় বর্তমানে একটি টিনের আস্তরণ দিয়ে
ঢেকে ফেলা হয়েছে। মন্দিরের উত্তরদিকের দেওয়ালটি ছাড়া আর কোন দেওয়ালে টেরাকোটার
চিহ্ন নেই। মন্দিরের চূড়া না থাকলেও গর্ভগৃহ এখনও অক্ষত অবস্থায় রয়েছে এবং এখনও
মঙ্গলচণ্ডী মন্দিরে নিত্যপুজো হয়ে আসছে।
 |
দামোদর মন্দির, ঘোষপাড়া
|
 |
টেরাকোটার ফলকে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি (দেবীদুর্গা, ক্রিশ্ন
|
দামোদর মন্দির, ঘোষপাড়া –
রাউতপাড়ার এই চারটি মন্দির দেখার পর
পরের গন্তব্য ঘোষপাড়া। এখানে বলে রাখি এই যাওয়ার পথেই গ্রামের আনাচে কানাচে দেখতে
পাওয়া গেল আরও কয়েকটি মন্দির। কোনটা দালানরীতির তো কোনটা চালা রীতির, বেশিরভাগ
ক্ষেত্রেই আটচালা। রাউতপাড়া থেকে বেড়িয়ে পুনরায় গ্রামের রাস্তা ধরে বাসরাস্তায় উঠে
দক্ষিণদিকে ঘোষপাড়া। রাউতপাড়া থেকে ঘোষপাড়ার দূরত্ব প্রায় ১.৫ কিলোমিটার। বাসরাস্তার
ডানদিকে দেখতে পাওয়া যাবে কয়েকটি মন্দির। এই স্থানটি পরিচিত রাসবাড়ী হিসাবে, পাশেই
ঘোষেদের পৈতৃক বাড়ি। রাসবাড়ির মধ্যে মূল যে মন্দিরটি দৃষ্টি আকর্ষণ করবে তা হল
দামোদর মন্দির। আটচালা বিশিষ্ট এই মন্দিরের প্রবেশপথ পূর্বদিকে। ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দে
এই দামোদর মন্দির তৈরি করেন রামহরি ঘোষ। প্রতিষ্ঠাকাল নিয়ে এতটা নিশ্চিত হওয়ার
কারণ মন্দিরের খিলানের উপর থাকা প্রতিষ্ঠালিপি এখনও অতি সহজেই পাঠোদ্ধার করা যায়।
বালি-দেওয়ানগঞ্জের একমাত্র এই দামোদর মন্দিরটির প্রতিষ্ঠালিপি অক্ষত অবস্থায়
রয়েছে। প্রতিষ্ঠালিপি মতে ১৭৪৪ শকাব্দ / ১২২৯ বঙ্গাব্দে শ্রী শ্রী দামোদর মন্দির
নির্মাণ করেন শ্রী রামহরি ঘোষ। দামোদর মন্দিরের শুধুমাত্র পূর্বদিকের অংশেই
টেরাকোটার ফলক দেখতে পাওয়া যায়। খিলানের উপরে যে টেরাকোটার প্যানেল দেখা যায় তা
সম্পূর্ণ তিনটি অংশে বিভক্ত। মধ্যিখানের প্যানেলটি মূলত রামসীতার অভিষেক, ডানদিকের
প্যানেলটিতে দেখা যায় কৃষ্ণলীলা ও বামদিকের প্যানেলে কৃষ্ণের মথুরা বিদায়। এছাড়াও
কার্নিশের নিচে ও খিলানের দুপাশে উলম্ব আকারের টেরাকোটা ফলক দেখা যায়, এগুলি
বেশিরভাগই বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি। গবেষক ডেভিড ম্যাকাচ্চন তাঁর গ্রন্থে বালির এই দামোদর মন্দিরকে উনবিংশ
শতাব্দীর মেদিনীপুর ধাঁচের বলে উল্লেখ করেছেন। পূর্বে এখানে বড় করে প্রায় এক
সপ্তাহব্যাপী রাস উৎসব পালিত হত। দামোদর মন্দিরের পাশেই তিনটি আটচালা মন্দির দেখতে
পাওয়া যায়। মন্দিরগুলি আধুনিক নাহলেও স্থাপত্যের দিক দিয়ে কিন্তু সেরকম কোন
বৈচিত্র্য নেই।
 |
টেরাকোটার ফলকে রামসীতা
|
 |
ডানদিকের টেরাকোটার
প্যানেলে কৃষ্ণলীলা |
 |
বামদিকের প্যানেলে কৃষ্ণের মথুরা বিদায় |
ভ্রমণ হিসাবে বালি-দেওয়ানগঞ্জ কেন এতটা
প্রচারের আলোয় আসেনি সে বিষয়ে কোন তথ্য দিতে পারব না। আরামবাগ শহর থেকে মাত্র ১২
কিলোমিটার ভিতরে বালি-দেওয়ানগঞ্জ। যাওয়া আসার রাস্তার ব্যাপারে এখন সবটাই পাকা রাস্তা,
ফলত যাতায়াতের তেমন কোন অসুবিধা নেই। মেদিনীপুরের পাথরার মতো সরকারকেও বালি-দেওয়ানগঞ্জকে
প্রচারের আলোয় আনতে হবে। এক্ষেত্রে শুধু সরকার নয়, বরং আমাদেরকেই বাঁধাধরা ছক থেকে
বেড়িয়ে এসে একটু অন্যান্য জায়গাগুলি ঘুরে দেখতে হবে। মনে রাখতে হবে আমরাই পারি
এইসমস্ত স্থাপত্যগুলিকে বাঁচিয়ে তুলতে। সামাজিক স্তরে যখন কোন জায়গা ভ্রমণপিপাসুদের
কাছে আগ্রহী হয়ে ওঠে তখনই সেইসমস্ত জায়গা সরকারের পক্ষ থেকে সবরকম সুবিধা পেয়ে থাকে।
******************************************************
লেখা, গবেষণা ও ছবি - প্রীতম নস্কর
ই-মেল - pritamnaskar.pn@gmail.com
ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে ব্লগের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, তবে পূর্বানুমতি ছাড়া আমার তোলা
আলোকচিত্রগুলি এবং ব্লগের রচনাগুলি অন্য কোথাও কপি-পেস্ট বা বাণিজ্যিক ভাবে
ব্যবহার করা চলবে না।
******************************************************
 |
টেরাকোটার ফলকে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি - ২
|
গুগলম্যাপ / কোঅরডিনেট –
*** ধন্যবাদ জানাই আমার বন্ধু অভিষেক-কে (ওরফে কাকা) বালি-দেওয়ানগঞ্জের এই ক্ষেত্র সমীক্ষায় আমার সঙ্গে থাকার জন্য।
কীভাবে যাবেন –
- ট্রেনযাত্রা – বালি-দেওয়ানগঞ্জের নিকটবর্তী
স্টেশন আরামবাগ। হাওড়া থেকে আরামবাগ লোকাল / গোঘাট লোকালে উঠে নামতে হবে আরামবাগ
স্টেশন। সময় লাগবে ২ ঘন্টা। আরামবাগ স্টেশন থেকে টোটো বা অটোয় করে আরামবাগ
বাসস্ট্যান্ড। স্টেশন থেকে হেঁটে বাসস্ট্যান্ড ১৫ মিনিট। আরামবাগ বাসস্ট্যান্ড
থেকেই বালি-দেওয়ানগঞ্জ যাওয়ার বাস ছাড়ে। বাসে উঠে আপনাকে নামতে হবে শিবকুঠির / বালি
হাই স্কুল মাঠ। সময় লাগবে প্রায় ৩০ মিনিট।
তথ্যসূত্র –
- হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ (তৃতীয়
খন্ড) – সুধীরকুমার মিত্র
- Bengal
District Gazetters, Hooghly – O’Malley
- Hooghly
Medical Gazeetters – D.G. Crawford
- Late
Mediaeval Temples of Bengal – Origin and Classifications by David John
McCutchion
- The
Concrete Paparazzi
Perfect write up.
ReplyDeleteExtremely detailed... Excellent effort
ReplyDelete