ডাকটিকিটে কালনার সর্বপ্রাচীন লালজী মন্দির । Lalji Temple, The Oldest Terracotta Temple of Kalna

ডাকটিকিটে কালনার সর্বপ্রাচীন লালজী মন্দির । Laljiu Temple, The Oldest Terracotta Temple of Kalna

কালনায় বর্ধমান রাজাদের তৈরি মন্দিরগুলির মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির হল লালজী মন্দির ১৬৬১ শকাব্দে প্রতিষ্ঠিত পঁচিশ রত্ন বিশিষ্ট এই লালজী মন্দির গড়ে উঠেছে কালনার রাজবাড়ী কমপ্লেক্সের মধ্যে। বাংলায় এই পঞ্চবিংশতি(পঁচিশ) রত্ন বিশিষ্ট মন্দিরের সংখ্যা পাঁচটি। যার মধ্যে আঠারো শতকে গড়ে ওঠা তিনটি মন্দিরই কালনায় অবস্থিত লালজী মন্দির, কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দির, গোপালজীর মন্দির। অন্যদিকে উনিশ শতকে গড়ে ওঠা বাকি দুটি পঁচিশরত্ন মন্দিরের একটি হুগলী জেলার সুখরিয়া গ্রামের আনন্দ ভৈরবি মন্দির ও অন্যটি বাঁকুড়া জেলার সোনামুখী গ্রামের শ্রীধর মন্দির

এককালে বর্ধমান রাজাদের বসবাস ছিল এই কালনায়। বর্গী হাঙ্গামার সময় মারাঠারা যখন বর্ধমান আক্রমণ করে তখন বর্ধমানের জমিদারেরা চলে আসে কালনায়। এখানেই নতুন ভাবে প্রতিষ্ঠা করে প্রাসাদ, গঙ্গাবাস, সমাজবাড়ি, মন্দির। এই কারণেই কালনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বর্ধমান রাজাদের তৈরি বিভিন্ন মন্দির স্থাপত্য। বাংলার বিভিন্ন মন্দির রীতির চালা, রেখা, রত্ন, মঞ্চ, সমতল ছাদ প্রভৃতি রীতির মন্দির গড়ে উঠেছে কালনায়। রাজবাড়ী চত্বরের প্রতাপেশ্বর মন্দির থেকে জগন্নাথ ঘাটের জোড়ামন্দির, নবকৈলাশ শিবমন্দির থেকে অম্বিকা সিদ্ধেশ্বরী মন্দির সবই বর্ধমান রাজাদের স্থাপত্যকীর্তি। তবে সম্প্রতি কালনার সবচেয়ে প্রাচীন পঁচিশ রত্ন বিশিষ্ট লালজী মন্দির বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে ৮ ই আগষ্ট ভারতীয় ডাকবিভাগ বাংলার টেরাকোটা মন্দিরের উপর ৭ টি ডাকটিকিট প্রকাশ করে। যার মধ্যে রয়েছে কালনার এই প্রাচীন লালজী মন্দির

লালজী মন্দির কে কবে প্রতিষ্ঠা করেছেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় মন্দিরের শিলালিপিতে

যৎ-পুত্রাঃ পৃথিবীতলে সুবিদিতাঃ সৎ কৃর্ত্তিচন্দ্রঃ কৃতী
সা শ্রীরাজকুমারিকাঃ ব্রজকিশোরী কৃষ্ণভক্তয়র্থিনী
শাকে বৈকষড়র্ক্তচন্দ্র গণিতে প্রাসাদমেতম্ দদৌ
রাধাকৃষ্ণ যুগায় সৎ-কবিসভামধ্যেসু তৎ প্রিতয়ে। শকাব্দঃ ১৬৬১।

অর্থাৎ ১৬৬১ শকাব্দে (১৭৩৯ খ্রিষ্টাব্দ) বর্ধমান রাজা কীর্তিচন্দ্রের রাজত্বকালে তাঁর মাতা ব্রজকিশোরী দেবী এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। 

লালজী মন্দির প্রতিষ্ঠার ইতিহাস প্রসঙ্গে জানা যায় পৌষ সংক্রান্তির সময় একদিন রাজমাতা ব্রজকিশোরী দেবী কালনায় এসেছিলেন গঙ্গাস্নানে। সংক্রান্তির সময় হওয়ায় পশ্চিম থেকে অনেক সাধু সন্ন্যাসীরা পুণ্য অর্জনের জন্য কালনার ওপর দিয়ে নদীপথে পাড়ি দিত গঙ্গাসাগরে। যাওয়ার পথে এমনি কিছু সন্ন্যাসীর দল কালনার এই গঙ্গার ঘাটে আস্তানা গেড়েছিলএদিকে গঙ্গাস্নানে যাওয়ার পথে রাজমাতা এমনি এক তাঁবু থেকে হঠাৎ এক বালকের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন। ব্রজকিশোরী দেবীর সন্দেহ হয়, এই নাগাসাধুদের মধ্যে বালক কি করছে? কৌতূহল নিবারণের জন্য যখন তিনি তাঁবুতে প্রবেশ করলেন তখন এক সন্ন্যাসী ছাড়া আর কাউকে দেখতে পেলেন না। বালকের প্রসঙ্গ সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞেস করায় তিনি অস্বীকার করলেন। সন্ন্যাসী জানালেন তার সঙ্গে রয়েছে শুধুমাত্র তার উপাস্য দেবতা কানাই এর মূর্তি। এই শুনে ব্রজকিশোরী দেবী সেই মূর্তি নিতে চাইলেন। কিন্তু রাজমাতার অনুরোধেও সেই মূর্তি সন্ন্যাসী দিতে চাইলেন নাতখন রাজমাতা জানালেন তাঁর মেয়ের সাথে কানাই এর বিয়ে দিতে ইচ্ছুক তাই সাধু রাজি কি না? সন্ন্যাসী একথায় রাজি হলে ব্রজকিশোরী দেবী মাইজীর বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা রাধারানীর সঙ্গে বিয়ে দিলেন লালাজীর কানাই এর। এরপর ব্রজকিশোরী দেবী বহু অর্থ ব্যায় করে বিগ্রহদুটিকে প্রতিষ্ঠা করেন এবং গড়ে তোলেন লালজী মন্দির।

মন্দিরের প্রবেশের তোরণে ঘোড়ার প্রতিকৃতি

লালজী মন্দিরের বারান্দায় টেরাকোটার অলংকরণ

পঁচিশরত্ন বিশিষ্ট এই মন্দির দক্ষিণমুখী। এই লালজী মন্দিরের সঙ্গে রাজবাড়ী চত্বরের কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির ও গোপালবাড়ির গোপালজীর মন্দিরের হুবহু মিল পাওয়া যায়। যদিও এক্ষেত্রে লালজী মন্দিরের সঙ্গে প্রথম তলের সামান্য পার্থক্য রয়েছে তবুও এক্ষেত্রে লালজী মন্দির প্রতিষ্ঠার ১২ বছর পর কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির ও তারও ১৫ বছর পর গোপালজীর মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়।

প্রায় ১৫ ফুট প্রাচীর দিয়ে মন্দির প্রাঙ্গনটি ঘেরা। প্রাঙ্গনের মূল প্রবেশদ্বার পেরলেই লক্ষ্য করা যায় মন্দিরের দ্বিতীয় তোরণের উপরে রয়েছে তিনটি ঘোড়ার (প্রকৃতি)এপ্রসঙ্গে বলে রাখি বর্ধমান রাজাদের আদি বাসস্থান লাহোরের কোটালী মহল্লা, ক্ষেত্রীবংশোদ্ভুত পরিবারসেখান থেকে তাঁরা বাংলায় আসেন নিজেদের ভাগ্য অনুসন্ধানে। সেসময়ে বাংলায় সবেমাত্র ঘোড়ার সাহায্যে ডাকযোগ ব্যবস্থা শুরু হয়েছে। তো এই রাজবংশের পূর্বপুরুষ আবু রায় ও বাবু রায় শুরু করলের তাঁদের প্রথম ঘোড়া ও কম্বলের ব্যবসা। ব্যাস এই থেকেই শুরু হল তাঁদের প্রতিপত্তি লালজী মন্দিরের মূল অংশটি একটি উঁচু বেদীর ওপর অবস্থিত। মন্দিরের উত্তর দিকের দেওয়াল ২১ ফুট ও দক্ষিণ দিকের অংশ ১৮ ফুট উঁচু

মন্দিরের দক্ষিণ দিকের টেরাকটার অলংকরণ

মন্দিরের পূর্ব দিকের টেরাকটার অলংকরণ

এবার আসি মন্দিরের চূড়ার প্রসঙ্গে, মন্দিরের মোট ২৫ টি চূড়া বা রত্ন যা ৪ টি ধাপে বিভক্ত হয়েছে। প্রথম ধাপে অর্থাৎ মন্দিরের প্রথম তলার ছাদের চারকোণে যে খাঁজের সৃষ্টি হয়েছে সেখানে মোট ১২ টি চূড়া রয়েছে। এরপর বেড় কমিয়ে খানিকটা উপরের ধাপে ৮ টি চূড়া ও তৃতীয় তলার ছাদে ৪ কোণে ৪ টি চূড়া এবং সবশেষে একদম উপরে ১ টি চূড়া রয়েছে। অর্থাৎ ১২ + ৮ + ৪ + ১ সাজে মোট ২৫ টি চূড়া রয়েছে।    

লালজী মন্দিরের দক্ষিণ দিকের বাড়ানো অংশে রয়েছে জগমোহন ও নাটমন্দির। যদিও লালজী মন্দির একটি উঁচু বেদীর উপর অবস্থিত। তবুও এই মন্দিরের সামনেই সমতল ভূমির উপর নাটমন্দির তৈরি করা হয়েছে চারচালা এই নাটমন্দিরের আয়তন ৩০ ফুট / ১৪ ফুট। যার দুপাশে ৫ টি ও সামনে ৩ টি করে প্রবেশদ্বার রয়েছে।

টেরাকোটার ফলকে 'মৃত্যুলতা' ১

টেরাকোটার ফলকে 'মৃত্যুলতা'২
লালজী মন্দিরের পূর্ব ও পশ্চিমদিকে রয়েছে দলানযুক্ত ঢাকা বারান্দা। যার মধ্যে পশ্চিমদিকের ত্রিখিলান দালানটি অনেকটা ধনুকাকৃতির। মন্দিরের ভিতরে প্রবেশের জন্য পূর্বদিকে রয়েছে একটি কাঠের দরজা। এই দরজা দিয়েই গর্ভগৃহে প্রবেশের পরেই ডানদিকে রয়েছে সিঁড়ি, যার সাহায্যে মন্দিরের উপরে ওঠা যায়।

এবার আসি মন্দিরের টেরাকোটার প্রসঙ্গে, লালজি মন্দিরের দেওয়ালের সর্বত্রই রয়েছে টেরাকোটার ফলক। যেমন উওর দিকের দেওয়া্ল জুড়ে পুরোটাই শিবলিঙ্গ ও বিভিন্ন ফুলের কাজ। মন্দিরের দক্ষিণ দিকের ঢাকা বারান্দার দেওয়ালে রয়েছে লঙ্কাযুদ্ধ। এছাড়াও বারান্দার সামনের খিলানে রয়েছে স্বপরিবারে দেবী দুর্গা, দক্ষিণাকালী, বালগোপাল, জগদ্ধাত্রী দেবী। বর্তমানে বারান্দার এই মোটিফগুলির ওপর আবছা রঙের প্রলপ দেখে অনুমান করা যায় পূর্বে ফলকগুলিতে ফ্রেশকোর ছোঁয়া ছিল। তবে মন্দিরের দেওয়ালের কোনগুলিতে খাড়া করে লাগানো 'মৃত্যুলতা' র ফলক দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য। এছাড়াও টেরাকোটার ফলকে রয়েছে অশ্বারোহী সৈন্য, উঠের পিঠে সামরিক বাহিনী, মল্লযুদ্ধ, শিকারযাত্রা

টেরাকোটার মোটিফে স্বপরিবারে দেবী দুর্গা


লালজী ও রাধারানী (কৃষ্ণরাধিকা)

আগেই বলেছি মন্দিরের বিগ্রহ রাধাকৃষ্ণ। দারুনির্মিত এই রাধাকৃষ্ণের দুই পাশে রয়েছে বালগোপাল। এখানকার প্রধান উৎসব জন্মাষ্টমী। এছাড়াও এখানে রাসযাত্রাও অনুষ্ঠিত হয়।

তবে লালজী মন্দিরের সামনেই দেখতে পাওয়া যাবে আরও একটি মন্দির, যা শিল্পরীতিতে অন্যান্য মন্দিরের থেকে অনেকটাই আলাদা। ১৭৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি হওয়া এই মন্দির হল গিরিগোবর্ধন মন্দির, যা বাংলার মন্দির স্থাপনে আর এক শিল্পরীতির নিদর্শন। মন্দিরের উপরিভাগ অনেকটা পর্বতের আকারে সৃষ্টি করা যার মধ্যে তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন পশুপাখি ও মানুষের শিলারূপ।

******************************************************

লেখা, গবেষণা ও ছবি - প্রীতম নস্কর  

ই-মেল - pritamnaskar.pn@gmail.com

ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে ব্লগের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, তবে পূর্বানুমতি ছাড়া আমার তোলা আলোকচিত্রগুলি এবং ব্লগের রচনাগুলি অন্য কোথাও কপি-পেস্ট বা বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করা চলবে না।

******************************************************

টেরাকোটার ফলকে 'মৃত্যুলতা' ৩

টেরাকোটার ফলকে 'মৃত্যুলতা' ৪

দক্ষিণ দিকের দেওয়ালে ফুলকারির টেরাকোটার ফলক

দক্ষিণ দিকের দেওয়ালের টেরাকোটার ফলক


গিরি গোবর্ধন মন্দির, কালনা

টেরাকোটার মোটিফে রামসীতা

লালজী মন্দিরের পালকি

কীভাবে যাবেনঃ -

কালনা যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় ট্রেন যাত্রা। হাওড়া-কাটোয়া লাইনেই অবস্থিত অম্বিকা কালনা স্টেশন। হাওড়া থেকে কাটোয়াগামি (মেনলাইন) / ব্যান্ডেল থেকে কাটোয়া / শিয়ালদহ থেকে কাটোয়া যাওয়ার যে কোন ট্রেনে উঠে নামতে হবে অম্বিকা কালনা স্টেশন। স্টেশন থেকে বাইরে বেরলেই দেখা মিলবে সারি সারি টোটো / রিকশার, তাতে করে অনায়াসেই পৌছে যাওয়া যাবে রাজবাড়ি কমপ্লেক্স অথবা ১০৮ শিবমন্দির। রাজবাড়ি কমপ্লেক্সে প্রবেশের পর প্রথমে প্রতাপেশ্বর মন্দির, তারপর রাসমঞ্চ ও তার পরেই পরবে লালজী মন্দিরের প্রবেশপথ।

গুগল ম্যাপ / কোঅরডিনেট -

23.22202, 88.36522

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ-

কালনার আরও কিছু মন্দির-

তথ্যসূত্রঃ-

  • বর্ধমান পরিক্রমা সুধীরচন্দ্র দাঁ
  • কালনা মহকুমার প্রত্নতত্ত্ব ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ইতিবৃত্ত বিবেকানন্দ দাস
  • রিসার্চ জার্নাল মন্দিরনগর অম্বিকা-কালনার টেরাকোটা মন্দির-স্থাপত্যঃ একটি পুরাতাত্ত্বিক নিরীক্ষণ সুজয়কুমার মন্ডল ও তনয়া মুখার্জি
  • বর্ধমান জেলার ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি (প্রথম খন্ড) - এককড়ি চট্টোপাধ্যায়

Comments