জাল প্রতাপচাঁদের প্রতাপেশ্বর মন্দির, বর্ধমান কালনা । Pratapeshwar Temple of Fake Pratapchand, Burdwan Kalna


জাল প্রতাপচাঁদের প্রতাপেশ্বর মন্দির, বর্ধমান কালনা । Pratapeshwar Temple of Fake Pratapchand, Burdwan Kalna

কালনার ১০৮ শিবমন্দির তো অনেকেই চেনেন, গেছেনও অনেকে; আর এই শিবমন্দিরের বিপরীতেই রয়েছে রাজবাড়ী কমপ্লেক্স, যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন সময়ের বর্ধমান রাজাদের তৈরি বিভিন্ন মন্দির। যার মধ্যে অন্যতম প্রতাপেশ্বর মন্দির রাজবাড়ি কমপ্লেক্সের সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেই বাম দিকের প্রথম মন্দিরটিই হল প্রতাপেশ্বর মন্দির। কালনার সবকটি মন্দিরের মধ্যে একদম অনন্য এই মন্দির। আর হবে নাই বা কেন যেখানে অন্যান্য মন্দিরগুলি চালা ও রত্ন প্রকৃতির সেখানে প্রতাপেশ্বর মন্দিরের গঠন দেউল রেখ প্রকৃতির, শুধু দেউল বলাও ভুল; কারণ দেউলের সাথে রয়েছে বাংলার অন্যতম শিল্পরীতি টেরাকোটার অলংকরণ। কিন্তু এই প্রতাপেশ্বর মন্দির যাকে উদ্দেশ্য করে গঠন করা সেই রাজা প্রতাপচন্দ্র বর্ধমানের ইতিহাসে এক অদ্ভুত রহস্য। জাল প্রতাপচাঁদ (প্রতাপচন্দ্র) হ্যাঁ! বর্ধমানের রাজা তাও নাকি আবার জাল রাজা এনিয়েই চলতে থাকে তদন্ত, নয় নয় করে দীর্ঘ ২ বছর চলেছিল জাল রাজার মামলা মোকদ্দমা। কে ছিল না সেই মামলা মোকদ্দমায়, কলকাতার প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর থেকে নবজাগরণের অন্যতম প্রদর্শক ডেভিড হেয়ার; বিষ্ণুপুরের রাজা ক্ষেত্রমোহন থেকে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী জর্জ চিনারী, সবাই উপস্থিত ছিল এই মামলায় জাল রাজার মামলা বর্ধমান রাজার একমাত্র রাজকুমার প্রতাপচাঁদ, পারিবারিক গোলযোগ থেকে শারীরিক অসুস্থতা, সেই থেকে রাজকুমারের মৃত্যু এবং চোদ্দ বছর পর সন্ন্যাসী বেশে প্রতাপচাঁদের আবার ফিরে আসা। কি হল সেই জাল রাজার? আর কেনই বা সেই রাজা জাল হতে গেল? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে চলে যেতে হবে প্রায় ২৫০ বছর আগের বর্ধমানে।

বর্ধমানের সিংহাসনে তখন মহারাজাধিরাজ তেজচন্দ্র রায় এদিকে দিল্লীর সিংহাসনে তখন সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম অন্যদিকে বাংলায় ব্রিটিশ কোম্পানির পক্ষে আছে ওয়ারেং হেস্টিংরাজা ত্রিলোকচাঁদের (১৭৭০-১৮৩২) মৃত্যুর পর যখন রাজকোষের অবস্থা একেবারে জরাজীর্ণ তখন রাজপাটে বসেন এই তেজচন্দ্র রায়। এদিকে ব্রিটিশ সরকারের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হওয়ায় যখন নাজেহাল বাংলার জমিদাররা তখন এই তেজচন্দ্র রায় পত্তনি প্রথার মাধ্যমে রাজস্বের পরিমাণ পুনরায় বাড়াতে শুরু করে। যার ফলে পুনরায় ফেঁপে ওঠে বর্ধমানের রাজকোষ। তো এই মহারাজা তেজচন্দ্রের আটটি বিবাহ, যার মধ্যে একমাত্র ষষ্ঠ পত্নী নানকীকুমারীর গর্ভে জন্মায় এক পুত্র সন্তান প্রতাপচাঁদ১৭৯১ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ শে অক্টোবর জন্ম হয় প্রতাপচাঁদের, আর তিনিই ছিলেন মহারাজের একমাত্র উত্তরাধিকারী। জন্মের কয়েক বছরের মধ্যেই মৃত্যু হয় নানকীকুমারীর; তাই ছোটো থেকেই মানুষ হন ঠাকুমা মহারানী বিষনকুমারী দেবীর কাছে। ঠাকুমার আদরে মানুষ হওয়ায় ছোট থেকেই প্রতাপচাঁদের লেখাপড়া আর তেমন হয়ে ওঠেনিউচ্চশিক্ষিত না হলেও তাঁর শারীরিক ক্ষমতা ও বুদ্ধি ছিল প্রখর। সাঁতার থেকে ঘোড়া দৌড় সবই ছিল তাঁর নখদর্পণে। পরবর্তীকালে তাঁর সাহস ও উপস্থিত বুদ্ধির প্রমাণ পেয়েছিলে রাজ্যের সমস্থ নাগরিক। 

টেরাকোটার ফলকে জগন্নাথ ও অন্যান্য চিত্র

প্রতাপচাঁদের বয়স যখন সাত বছর তখন বিষনকুমারী দেবীরও মৃত্যু হয়। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে মহারানী বিষমকুমারী তাঁর পরিচালনাধীন জমিদারীর দায়িত্ব দিয়ে যান প্রতাপচাঁদকে। এদিকে তেজচন্দ্রের পঞ্চম পত্নী কমলকুমারী ও তাঁর ভাই পরানচাঁদ কাপুর ছোট থেকেই প্রতাপচন্দ্রকে সহ্য করতে পারত না ফলে জমিদারীর দায়িত্ব জানার পরই দুজনের চোখে ষড়যন্ত্রের আঁচ জ্বলে উঠল এর মধ্যে কয়েকবার প্রতাপচাঁদকে হত্যারও চেষ্টা করা হয়েছিল; যদিও সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি, তবুও এখানে বলে রাখা ভাল এই পরানচাঁদ কাপুর হলেন বর্ধমান রাজপরিবারের শকুনিমামা। তেজচাঁদের সঙ্গে তাঁর বোন কমলকুমারীর বিয়ের সূত্রেই পরবর্তীকালে বর্ধমানের দেওয়ান হিসাবে নিজের জায়গা করে নেয়আবার এই পরানচাঁদের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর কন্যা আনন্দকুমারীর সঙ্গে রাজকুমার প্রতাপচাঁদেরও বিয়ে হয়। প্রতাপচাঁদের দুটি বিবাহ এক প্যারীকুমারী আনন্দকুমারী। বর্ধমানের জনতার কাছে তিনি ছিলেন ছোট রাজা। জমিদারী দেখাশোনা ছাড়াও প্রতাপের জীবনে চলতে থাকে আমোদ প্রমোদ; সেকালের একমাত্র রাজপুত্র ফলে আয়োজনেরও কমতি ছিল না।

টেরাকোটার ফলকে কৃষ্ণ-রাধিকা

এইভাবেই কয়েকবছর চলার পর হঠাৎই তাঁর মানসিক অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়। কোন এক কারণে প্রতাপের মনে পাপবোধ জন্মাতে শুরু করে আর সেই থেকে শুরু হয় গভীর অসুখ ডাক্তার যখন রোগনির্ণয়ে অক্ষম তখন তিনি প্রায়শ্চিত্তির উদ্দশ্যে অন্তর্জলী যাত্রার তোড়জোড় শুরু করেনকবিরাজের আদেশ অনুযায়ী এই মহাপাপের প্রায়শ্চিত্ত একমাত্র আত্মশুদ্ধি। আর এইজন্যেই ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে প্রতাপ চলে এলেন তখনকার রাজবাটী বর্ধমানের কালনায়। কিন্তু কালনায় আসার পরেও তাঁর শরীরের অবস্থা আরও খারাপের পথে যেতে থাকে শেষে ১৮২১ খ্রিষ্টাব্দে ৫ ই জানুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয় এবং তড়িঘড়ি রাত দেড়টার মধ্যে তাঁর পিতা তেজচন্দ্রের অনুপস্থিতিতেই কালনার ঘাটে তাঁর দেহ পুড়িয়ে ফেলা হয় আর এখান থেকেই বর্ধমানের ইতিহাসে শুরু হয় জাল রাজা

টেরাকোটার অলংকরণে নকল দরজা

প্রতাপচাঁদের মৃত্যুর পরেও তাঁর সমাজ মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় না। কেন হয় না তা কিন্তু জানা যায় না। এদিকে মৃত্যুর পর তাঁর জমিদারী স্বত্বা একরকম বলপূর্বক হস্তান্তরিত হয় পিতা তেজচন্দ্র রায়ের কাছে পরবর্তীকালে সপ্তম বিবাহেও যখন পুত্রসন্তান না হয় তখন একপ্রকার বাধ্য হয়েই পরানচাঁদের ছোট ছেলে চুনীলালকে দত্তক নিলেন তেজচন্দ্র; নাম রাখলেন মহাতাবচাঁদদত্তক নেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বৃদ্ধ তেজচন্দ্র তাঁর অষ্টম ও সর্বশেষ বিবাহ করলেন পরানচাঁদের কন্যা বসন্তকুমারীকে। কিন্তু এক্ষেত্রেও তাঁর সে সুখ সইল না; বিবাহের পাঁচ বছরের মধ্যেই মারা গেলেন তেজচন্দ্র আর বর্ধমান রাজের সমস্থ ক্ষমতার উত্তরাধিকারী হলেন মহাতাবচাঁদ অর্থাৎ দত্তকপুত্র চুনীলাল কুমার ওরফে পরানচাঁদের সন্তান

টেরাকোটার ফলকে মহিষাসুরমর্দিনী (কালের প্রকপে ক্ষতিগ্রস্থ)

পরবর্তী সময় ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দ, মহাতাবচাঁদের অভিভাবক হওয়ায় বর্ধমানের জমিদারীত্ব ভোগ করছিলেন পরানচাঁদ ও কমলকুমারী। এমন সময় হঠাৎই কালনায় আবির্ভাব ঘটল এক সন্ন্যাসীর, নাম অলোক শা। কিন্তু কালনায় আসার পরই সন্ন্যাসী দাবি করলেন তিনি প্রতাপচাঁদ। হ্যাঁ প্রতাপচাঁদ! বর্ধমানের রাজার একমাত্র উত্তরাধিকারী যে কিনা ১৪ বছর আগে মারা যায়। যার দেহ কালনার ঘাটেই পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে, সেই প্রতাপচাঁদ ফিরে আসা! কী করে এমন সম্ভব? সন্ন্যাসী বললেন- তিনি প্রতাপচাঁদ আর তিনি মারা যাননি, তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হলেও তিনি মারা যাননি শ্মশান থেকে পালিয়ে গেছিলেন, চিতা জ্বলার আগেই ঝাঁপ দেন নদীতে, সাঁতরে পাড় হয়ে ওঠেন নদীর ওপারে, সেখান থেকে নৌকোয় পাড়ি দেন মুর্শিদাবাদ এরপর বিভিন্ন সাধুসন্তদের উপদেশ অনুযায়ী তিনি ১৪ বছর অজ্ঞাতবাস জীবন কাটিয়েছেন। শেষে পাপের প্রায়শ্চিত্ত মিটে যাওয়ায় এখন তিনি আবার ফিরে এসেছেন বর্ধমানের এস্টেটের জমিদারী ও গদির স্বত্ব দাবি করতে

কিন্তু জমিদারী চাইলেই তো আর পাওয়া যায় না, কোম্পানির আদালতে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি আসলেই প্রতাপচাঁদ নাকি অন্য কেউ। মনে রাখতে হবে সে সময় বর্ধমানের জমিদারী পুরোটাই কূটনীতিবিদ হিসাবে পরিচিত পরানচাঁদের হাতেফলে তিনিও চেষ্টা করতে লাগলেন যাতে সন্ন্যাসী, প্রতাপচাঁদ হিসাবে পরিচিতি না পায়। কিন্তু চেষ্টা করলে কি হবে রাজ্যের অনেকেই তখন সন্ন্যাসীকে চিনে ফেলেছে, এই সন্ন্যাসী তাদের ছোট মহারাজ প্রতাপচাঁদ। এবিষয়ে সাক্ষীও দিলেন গোলাপবাগের গোপীনাথ ময়রা, রাজবাটীর মুহুরী কুঞ্জবিহারী ঘোষ আরও অনেকেই। চোদ্দ বছর আগে রাজ পরিবারে কী কী ঘটেছিল সে সব সন্ন্যাসী শোনাতে লাগলেনতাঁর কাহিনী হুবহু মিলে যাচ্ছে দেখে রাজ পরিবারেও সাড়া পড়ে গেল। সন্ন্যাসীকে তাড়াবার জন্য পরানচাঁদ পেয়াদা পাঠালেন। বিজয় ও রাম নামে দুটি লাঠিয়াল ও এক দেওয়ান গেল সন্ন্যাসীকে ধাওয়া করতেতাড়া খেয়ে সন্ন্যাসী আত্মগোপন করল বর্ধমান স্টেশনের কাছেই এক শিবমন্দিরে। যে জাগাটিতে তিনি লুকিয়েছিলেন সে অঞ্চলের এখন নাম বাজে প্রতাপপুরবাজে অর্থাৎ জাল। এদিকে সেই জাল প্রতাপকে ধরার জন্য দেওয়ান ও লাঠিয়ালরা স্টেশনের সামনেই এক দীঘির ধারে আস্তানা গাড়লেন। যে জায়গাটিতে দেওয়ান আস্তানা গেড়েছিল সে জায়গাটি এখন দেওয়ান দীঘি নামে পরিচিত আর দীঘির সামনেই যেখানে লাঠিয়ালদুটি আস্তানা গেড়েছিল এখন সে জায়গার নাম বিজয় রাম 

টেরাকোটার ফলকে বিভিন্ন মনিষী

স্টেশনের শিবমন্দিরে কয়েকমাস আত্মগোপনের পর সন্ন্যাসী যাত্রা শুরু করলেন বিষ্ণুপুরে। বিষ্ণুপুরের রাজা ক্ষেত্রমোহনও সন্ন্যাসীকে দেখামাত্রই চিনে গেলেন যে তিনিই প্রতাপচাঁদ, আর রাজার পরামর্শেই প্রতাপচাঁদ রওনা দিলেন বাঁকুড়া। এদিকে পরানচাঁদ এই সংবাদ পাওয়ার পরই কৌশলে ফন্দি আঁটতে শুরু করলেন১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দে জানুয়ারি মাসে প্রতাপচাঁদ ওরফে অলোক শা বাঁকুড়ার আদিবাসী মিছিলে যোগ দিলেন। বাংলায় তখন সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সময় বড়লাট ওয়ারেং হেস্টিং-ও এই বিদ্রোহ দমনে খেই হারাচ্ছেন তাঁরই আমলে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহআর এই বিদ্রোহে যখন আলোক শা যোগ দিলেন ঠিক সেই সময়েই বাঁকুড়ার ম্যাজিস্ট্রেট এলিয়েট সাহেব সন্নাসীকে গ্রেপ্তার করলেন। পরে যদিও জানা যায় এর পুরোটাই ছিল পরানচাঁদের চক্রান্ত। কেন গ্রেপ্তার করা হল তা জানানো না হলেও মূল উদ্দেশ্য ছিল একটাই, কোনভাবে প্রমাণ করা যে তিনি জাল প্রতাপচাঁদ। দীর্ঘ ৬ মাস জেল ও ৪০,০০০ টাকা মুক্তিপণ দেওয়ার পর সন্ন্যাসী ছাড়া পেলেন। 

এরপরের ঘটনা কলকাতায়। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর প্রতাপ উঠলেন কলকাতার রাধাকৃষ্ণ বসাকের বাড়িতে। কারণ তিনি বুঝেছিলেন বর্ধমানে থেকে তাঁর আর কিছু করার নেই, ফলে এখন উপায় যতটা সম্ভব সাক্ষীসাবুদ যোগাড় করা। কলকাতার এমন অনেক ব্যাক্তিই পাওয়া গেল যারা সন্ন্যাসীর পক্ষে সায় দিতে রাজি কিন্তু উকিলের পরামর্শে তাঁকে বর্ধমানের সাক্ষীও যোগাড় করতে হবে ১৮৩৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস, ৫০ টি নৌবহর নিয়ে প্রতাপ শুরু করলেন গঙ্গা যাত্রাগন্তব্য বর্ধমান আর এই সুযোগেরই অপেক্ষা করছিল পরানচাঁদ। জেলাশাসককে আগে থেকে জানিয়ে রেখেছিলেন তাঁর আসার খবর। কালনায় যখন তিনি নৌকা থেকে নামলেন তখন ঘাট জুড়ে বিশাল জমায়েত। সবাই দেখতে এসেছে তাঁদের ছোট মহারাজকে আর এই জমায়েতের জন্যেই সন্ন্যাসীকে আবার গ্রেপ্তার করা হল বর্ধমান কোর্টে না গিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হল হুগলী কোর্টে হুগলীর ম্যাজিস্ট্রেট তখন মিস্টার স্যামুয়েল; পরানচাঁদের বন্ধু। আবার শুরু হল বিচার। এ প্রসঙ্গে বলি বর্ধমান কোর্টে না পাঠিয়ে হুগলী কোর্টে কেন পাঠানো হল তা কিন্তু জানা যায় না। হতে পারে পরানবাবু ভেবেছিলেন বর্ধমানে থাকলে সন্ন্যাসীর লোকবল ও অর্থবল জোগাড় করা অনেক সহজ। সে যাই হোক, হুগলী কোর্টে প্রতাপের (সন্ন্যাসীর) বিরুদ্ধে দুটি মামলা রুজু হল; এক ফৌজদারি ও দুই দেওয়ানী চার্জশীটে প্রতাপের নামে যে অভিযোগগুলি আনা হয়েছিল-

  1. অলোক শাহ মৃত রাজা প্রতাপচাঁদ বাহাদুরের নাম গ্রহণ করা।
  2. প্রতাপচাঁদের নাম ব্যবহার করে তেজরির দেওয়ান রাধাকৃষ্ণ বসাককে ঠকিয়ে টাকা আত্মসাৎ করা।
  3. বেআইনিরূপে কালনায় বিস্তর লোক জমায়েত করা।
টেরাকোটার ফলকে কীর্তনদল সহ গৌড়-নিতাই

শুরু হল মামলা। মামলার জন্য প্রতাপ যে সাক্ষী যোগাড় করেছিল, সেই সমস্থ সাক্ষীকে ডাকা হল আদালত চত্বরে সরকারের পক্ষে সাক্ষী ছিলেন জ্যামস প্যাটেল, জন বিচর, দ্বারকানাথ ঠাকুর, ডি..ওবারেক পরানচাঁদের তরফ থেকে সাক্ষী রাধামোহন সরকার, রাজা বৈদ্যনাথ রায়, ভৈরব বাবু, বসন্তলাল বাবু, নন্দলাল বাবু। আর আসামী ওরফে সন্ন্যাসীর তরফে সাক্ষী ছিলেন ময়রা গোপীনাথ প্রামাণিক, স্যার ডেভিড হেয়ার, রাজা ক্ষেত্রমোহন সিংহ, ডক্টর রবার্ট স্কট, জামকুড়ির রাজা জয়সিংহ, কুঞ্জবিহারি ঘোষ, জন রিডালে, মিসেস হেরিয়াট কিটিং, হাজী আবু তালেব, আমীরউদ্দিন আমেদ। একদিকে প্রতাপের সাক্ষী অন্যদিকে পরানচাঁদের অর্থ ও প্রতিপত্তি একের পর এক সাক্ষী আসছে আর প্রতাপের দল ভারী হচ্ছে। প্রমাণের জন্য আনা হল পুরনো প্রতাপের একটি চিত্র। ১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে প্রতাপ জীবিত থাকাকালীন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী জর্জ চিনারী প্রতাপের সমউচ্চতার একটি তৈলচিত্র এঁকেছিলেন, সেই চিত্রটিকেই আনা হলচিত্রের বৈশিষ্ট্য হল চিনারী যখন ছবি আঁকেন তখন যার ছবি আঁকছেন তার উচ্চতা ও গায়ের রঙ সেই মানুষের সঙ্গে মিলবেই। তাই দাড়ি গোঁফ কামিয়ে আনা হল সন্ন্যাসীকে। ফিতে দিয়ে মাপা হল তৈলচিত্রের প্রতাপ ও সন্ন্যাসীকে। আদালত চত্বরে সবাই অবাক, দেখলো চিত্রের প্রতাপ ও সন্ন্যাসীর উচ্চতা পুরো কাঁটায় কাঁটায় মিলে গেছে। কিন্তু আদালতে এই সাক্ষ্য মানতে নারাজ

টেরাকোটার ফলকে রাধাকৃষ্ণ ও ললিতা-বিশাখা

পরবর্তী পরীক্ষা সন্ন্যাসীর শরীর। সবাই জানতো প্রতাপচাঁদ ছোটবেলায় খুব ঘুরি ওড়াত। আর এই ঘুড়ি ওড়ানোর চক্করেই একবার সুতোয় কানের কিছু অংশ কেটে যায়, এছাড়াও ছোটোবেলায় প্রতাপকে এক ঘোড়া তাঁর পিঠে কামড়ে দিয়েছিল; সন্ন্যাসী যদি আসলেই প্রতাপ হয় তাহলে সেই দাগ থাকা স্বাভাবিক। কী কান্ড সন্ন্যাসীর পিঠেও রয়েছে সেই দাগ এমনকি কানের লতিতেও রয়েছে সেই কাটা দাগ। এছাড়াও পায়ের হাঁটু থেকে আঙুলে ছ্যাঁকা হুবহু সব দাগ রয়েছে সন্ন্যাসীর শরীরে। এই সন্ন্যাসী প্রতাপ না হওয়ার কারণ আছে কি। এমনকি প্রতাপের বন্ধু ডাক্তার রবার্ট স্কটও বললেন এই সন্ন্যাসী আসলেই প্রতাপচাঁদ। কারণ তিনি জানতেন প্রতাপের মুখে একবার ঘা হয়েছিল যা তিনি সারিয়েছিলেন আর সেই থেকে তাঁর মাড়িতে একটা গর্ত থেকে যায়। সন্ন্যাসীরও তাই আছে। এমনকি সন্ন্যাসী রবার্টের বদ অভ্যাসের কথাও বললেন যেটা আসল প্রতাপ ছাড়া কখনই কারোর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। এরপরে এলেন নবজাগরণের অন্যতম স্তম্ভ স্যার ডেভিড হেয়ারতিনি চিনতেন প্রতাপচাঁদকেছোট থেকেই প্রতাপের যাওয়াআসা ছিল ডেভিড স্যারের বাড়িতিনিও সন্ন্যাসীকে প্রতাপচাঁদ রূপে সনাক্ত করলেন। বিষ্ণুপুরের রাজা ক্ষেত্রমোহন সিংহ সায় দিলেন সন্ন্যাসী আসল প্রতাপচাঁদ

টেরাকোটার ফলকে রাম-রাবণের যুদ্ধ ও তার মাঝে দেবী দুর্গার আবির্ভাব

এতক্ষণে সব ঠিকঠাকই চলছিল কিন্তু এবার পালা রাজার বিরুদ্ধে সাক্ষীএকে একে এলেন সি টি ট্রাওয়ার, এইচ টি প্রিন্সেপ, মিস্টার হ্যাচিনসন। তাঁরা কিন্তু জানালেন এ সন্ন্যাসী প্রতাপচাঁদ নয়এরপর সাক্ষী হিসাবে এলেন প্রতাপের দীর্ঘদিনের বন্ধু প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। বর্ধমান রাজপরিবারের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। তিনি কিন্তু বললেন- এ সন্ন্যাসী কোনমতেই প্রতাপচাঁদ হতে পারে না কারণ তিনি অনেকবারি প্রতাপের সাথে কলকাতায় রাজা গোপীমোহন ও রামমোহনের বাড়ি গেছেন তাই তিনি প্রতাপকে ভালমতো চেনেন। কিন্তু এই সন্ন্যাসী আমাকে চিনলেও আমি তাঁকে চিনি না। এরপর রাজা বৈদ্যনাথ রায়, রাধাকৃষ্ণ বসাক, রামমোহন সরকার, ভৈরবনাথ; সবাই বলল তারা দীর্ঘদিন ধরে রাজবাটীর কাজ করে আসছে কিন্তু এই সন্ন্যাসী কোনভাবেই প্রতাপচাঁদ নয়। শেষে প্রশ্ন উঠলো কে প্রতাপচাঁদের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া করেছিল নিয়ে আসা হোক তাকেও। কিন্তু প্রতাপচাঁদের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া করেছিল যে ব্যক্তি সেই ঘসিরাম তিন বছর আগেই ইহলোক ছেড়ে রওনা দিয়েছেন। ফলে আদালতের কাছে সে সাক্ষীর জোগাড় অস্মভব। 

টেরাকোটার ফলকে রামসীতার অভিষেক ও নীচে বাদ্যবন্দনা

এইভাবে কিছুদিন চলার পর অনেক সাক্ষী-প্রমাণের উপর ভিত্তি করে ইংরেজ আদালত সন্ন্যাসীকে দোষী সাব্যস্ত করল। প্রতাপের পক্ষে অনেক সাক্ষী থাকলেও কোম্পানি আদালত সন্ন্যাসীকে আসল প্রতাপচাঁদ বলে মেনে নিলেন না। ১৮৩৮ এ মামলা শেষে কোম্পানির আদালত তাঁকে বর্ধমানের রাজকুমারের মান্যতা খারিজ করল। আদালত জানাল- তাঁর আসল নাম অলোক শাহ। আর তিনি বেআইনি ভাবে লোক জমায়েত করেছেন ও তাঁর আসল নাম গোপন করে অসৎ অভিপ্রায়ে প্রতারণার উদ্দেশ্যে মহারাজাধিরাজ প্রতাপচাঁদের নামও তিনি ব্যবহার করেছেন তাই এইসকল অপরাধে সন্ন্যাসীকে এক হাজার টাকা জরিমানা ও আনাদায়ে ছয় মাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে এবং ভবিষ্যতে প্রতাপের নামে কোন আর্জি গ্রহণ করা হবে না। এই নাম কারও পক্ষে গ্রহণ করাটাই হবে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ (নিজামত আদালত প্রেসিডেন্সি কোর্ট ১৮৩৯ সালের ১৯ শে জুলাই)

বাতায়নে মহিলা

দীর্ঘ ছয়মাস সন্ন্যাসী জেল খেটে কলকাতার চাঁপাতলাতে চলে আসেন, কিছুদিন থেকে চলে যান চন্দননগর সেখান থেকে আবার শ্রীরামপুরসেখানে তিনি সাত বছর সন্ন্যাস জীবন পালন করেছিল শ্রীরামপুরে থাকাকালীন সন্ন্যাসীর প্রচুর শিষ্য হয়েছিলে। শ্যামাসঙ্গীতে ছিল তাঁর অসীম ঞ্জান, এমনকি নিজেও কয়েকটি শ্যামাসঙ্গীত রচনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতার বরানগরের ময়রাডাঙা পল্লীতে আশ্রয় নেন। সেই বছরেই চরম দারিদ্রে, হতাশায় দেহত্যাগ করেন। সন্ন্যাসী ভণ্ড ছিলেন না বর্ধমানের সবাই জানতেন তিনিই আসল প্রতাপচাঁদ। পরানচাঁদের লোভ ও অর্থপিপাসার জেরে সব সাক্ষীই প্রতাপকে চিনেও না চেনার ভান করেছে। যার জেরে বর্ধমানের ইতিহাসে তিনি জাল প্রতাপচাঁদ হিসাবে চিহ্নিত হয়ে রইলেন। 

আদালতে দেওয়া জাল প্রতাপের জবাববন্দী ছিল এইরূপ বিমাতা কমলকুমারী ছিলেন আমার পরম শত্রু, আমার বয়স যখন ষোলো তখন তিনি দুবার আমার খাবারে বিষ দেন। কিন্তু আমি সে খাবার ফেলে দিই। এরপর থেকে আমি আমার খাবার নিজে রান্না করে খেতাম। পরানবাবু ও বসন্তলালবাবু আমার সবসময় ক্ষতি চাইত এবং ক্রমে আমার পিতার মনেও আমার সম্বন্ধে ভুল ধারণা প্রয়োগ করতে থাকে। এইসব দেখে ক্রমে বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ি। ক্রমে মদ খেতে আরম্ভ করলাম ও শেষে গুরুতর পাপগ্রস্ত হলাম। তখন কৃষ্ণকান্ত ভট্টাচার্যের কাছে এই পাপের প্রয়শ্চিত্ত কি? জানতে চাওয়ায় তিনি চোদ্দ বছরের অঞ্জাতবাস থাকার কথা বলেন। সেসঙ্গে আরও বলেন যে, এমনভাবে অঞ্জাতবাস করতে হবে যেন সকলেই অনুমান করে যে তুমি মরিয়াছ। প্রথমে আমি কাউকে কিছু না বলে পালিয়ে গেলাম। কিন্তু মুন্সী আমীরউদ্দিন আমার সন্ধান জানিয়ে দেওয়ায় আমার পিতা রাজমহল থেকে আমাকে ধরে আনে। আমার পিতা তখন পরানের অত্যাচারের কথা জানতে পেরে তাঁর উপর রেগে ফেটে পড়েন। আমাকেও অনেক বোঝালেন এরকম আর যেন কক্ষনো না করি। কিন্তু আমার মনে তখনও প্রায়শ্চিত্তের কথা ঘুরছে, যেভাবেই হোক আমাকে পালাতে হবে। অতএব আমি শরীর খারাপের ভান করে কালনায় গেলাম, কালনার ঘাটে কালীপ্রসাদ এক ভাউলিয়াকে বলে রেখেছিল। ঘাটে পৌঁছলেই ভাউলিয়া শাঁখ বাজাবে। আর সেই শাঁখের আওয়াজ শুনে আমি ক্রমশ রুগীর মতো ভুল বকতে থাকলাম। শেষে অন্তর্জলির পর প্রবল শীতে ঘাটের লোকেরা যখন তাঁবুর ভিতরে বিশ্রামে গেল সেইসময় আমি জলে ঝাঁপ দিলাম। নিঃশব্দে সাঁতার কেটে আমি এক বজরায় (নৌকো) উঠি এবং সেই রাত্রেই বজরায় করে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। 

সেখান থেকে ঢাকা হয়ে চন্দ্রশেখর যাই। সেখানে এক বছর থাকি। তারপর ত্রিপুরেশ্বরী দর্শন করে বানেশনাথে এক বছর থাকি। সেখান থেকে চলে যাই পশ্চিমদিকে। কাশী, প্রয়াগ, চিত্রুকুট, অযোধ্যা, বৃন্দাবন, মথুরা, কুরুক্ষেত্র, পষ্কর, প্রভাস, বদ্রিকাশ্রম, হরিদ্বার, হিঙ্গুলাক্ষ, জ্বলামুখী প্রভৃতি তীর্থস্থান ঘুরে যাই পাঞ্জাব। সেখান থেকে লাহোর, অমৃতসর, হয়ে কাশ্মীর; তারপর দিল্লী হয়ে শেষে ১৪ বছর পূর্ণ হলে বর্ধমানে এসে উপস্থিত হই। এইসব আমি এক খাতায় লিখে রাখতাম। কিন্তু বাঁকুড়ায় যখন এলিয়েট সাহেব আমায় গ্রেপ্তার করেন তখন সেটি হারিয়ে যায়। হারানোর খবর মেজেস্টারকে জানালে তিনি ভ্রক্ষেপ করেন। আমি যদি সত্যি মারা যেতাম তাহলে কি আমার সম্পত্তির কোন বন্দোবস্ত করে যেতাম না। গঙ্গা যাত্রা করার আগেও তো আমি কিছুদিন কালনায় ছিলাম; যদি সত্যিই আমি মারা যাব এমন অবস্থা ঘটত তাহলে তার আগে আমি কি পোষ্যপুত্রের(দত্তকপুত্র) অনুমতি দিয়ে যেতাম না? অথবা একটা দানপত্র বা উইল করে যেতে পারতাম না? এসবের সময়তো যথেষ্ট ছিল?

সন্ন্যাসী প্রতাপচাঁদের শ্যামা সঙ্গীত

আর কারে ডাকবো মাগো ছাওয়াল কেবল
মাকে ডাকে।
আমি এ্যামন ছেলে নই মা তোমার
ডাকবো মাগো যাকে ডাকে।......

এবার আসা যাক মন্দির প্রসঙ্গে,

আগেই বলেছি কালনার রাজবাড়ি কমপ্লেক্সে প্রবেশ করলে বামদিকের প্রথম মন্দিরটি হল প্রতাপেশ্বর মন্দির। রাজবাড়ির অন্যান্য মন্দিরগুলির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এই মন্দির দেখতে অনেকটা দেউল রীতির রেখ মন্দির। কিন্তু সম্পূর্ণরূপে দেউল নয়, বলা যেতে পারে দেউল এর পরিবর্তিত ও সরলীকৃত রূপ, যেখানে মিশে আছে বাংলার টেরাকোটা শিল্পরীতি। ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে রাজা মহাতাবচাঁদের আমলে প্রতাপচাঁদের প্রথম পত্নী প্যারীকুমারী দেবী এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু মন্দিরের প্রতিষ্ঠালিপিতে প্যারীকুমারী যে প্রতাপচাঁদের স্ত্রী সে কথার উল্লেখ থাকলেও প্যারীকুমারী যে প্রতাপচাঁদের উদ্দেশ্যেই এই মন্দির তৈরি করেছেন এমন কিছুর কিন্তু উল্লেখ নেই। এমনকি বর্ধমান রাজার পারিবারিক ইতিহাসেও এবিষয়ে কোনো মন্তব্য নেই। আর হবে নাই বা কেন, যেখানে বর্ধমানের প্রত্যেকটি সমাজমন্দির কোনো রাজার মৃত্যুর পর তৈরি হয়, সেখানে প্রতাপচাঁদের মৃত্যুই রয়ে যায় রহস্যে ঘেরা। এবিষয়ে বর্ধমানবাসীর ভিন্ন মত রয়েছে তারা অনেকে বলেন কোর্টের নির্দেশে জাল প্রতাপ যখন জেলে গেলেন তখনও জনগনের মধ্যে বিশ্বাস ছিল একদিন রাজা ফিরবেন আর বর্ধমানের হাল ধরবেন। কিন্তু মহাতাবচাঁদ এই ভ্রম দূর করার জন্য এই মন্দির নির্মাণের আদেশ দেন। যদিও মন্দিরের কোথাও প্রতাপের স্মৃতির উদ্দেশ্যে কিছুই লেখা নেই। 

প্রায় ৪৫ ফুট উঁচু প্রতাপেশ্বর মন্দিরের দৈর্ঘ্য প্রস্থে ১৫ ফুট x ১৫ ফুট। মন্দিরটি উঁচু দালানের (বারান্দার) উপর অবস্থিত। মন্দিরের বিগ্রহ কৃষ্ণকায় শিবলিঙ্গ উচ্চতা প্রায় ৪.৫ ফুট। মন্দিরের প্রবেশপথ পূর্বদিকেএছাড়াও মন্দিরের তিনদিকে রয়েছে তিনটি কৃত্রিম দরজা, যার পুরোটাই টেরাকোটার অলংকরণ। বর্ধমানের অন্যান্য মন্দিরের তুলনায় টেরাকোটার অলংকরণে সবচেয়ে সমৃদ্ধ এই প্রতাপেশ্বর মন্দির। মন্দিরের পূর্বদিকের প্রবেশদ্বারের উপরে টেরাকোটার ফলকে চিত্রিত হয়েছে রামসীতার অভিষেক। উত্তরদিকের কৃত্রিম প্রবেশদ্বারের উপরে ফুটে উঠেছে রাম রাবণের যুদ্ধ (লঙ্কাযুদ্ধ), আর সেই যুদ্ধে সিংহবাহিনী দেবী দুর্গার আবির্ভাব। অন্যদিকে বানর সৈন্য ও নীচে রণবাদ্যপশ্চিমদিকের কৃত্রিম দরজার উপরে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে কীর্তনদলসহ গৌর-নিতাইআর দক্ষিণ দিকের কৃত্রিম প্রবেশদ্বারের উপরে রয়েছে রাধাকৃষ্ণ ও ললিতা-বিশাখা। এছাড়াও মন্দিরের টেরাকোটার ফলকের মধ্যে রয়েছে অশ্বারোহী যোদ্ধা, বেহালাবাদিকা, দলবদ্ধ বিদেশিনী, বাতায়নে মহিলা, সখীদ্বয়ের মাঝে শ্রীকৃষ্ণ, মহিষমর্দিনী (ভগ্নপ্রায়) তীরন্দাজ, তলোয়ারবাজ, ঢাল ঘোড়সওয়ার ইত্যাদি। এছাড়াও মন্দিরের কিছু টেরাকোটার ফলকে উঠে এসেছে তখনকার সামাজিক দিক।

টেরাকোটার ফলকে বীণাবাদক ও অন্যান্য চিত্র

এপ্রসঙ্গে বলি এই ব্লগটি লিখতে গিয়ে অনেক বইয়েরই সাহায্য নিয়েছি যেখানে রয়েছে বর্ধমান রাজার ইতিহাস, কোর্টের রায় থেকে জাল প্রতাপচাঁদের জবানবন্দী; যেখানে সমস্থ দিক থেকেই অনেক প্রমাণ পাওয়া যায় যে 'আলোক শা' সন্ন্যাসী আসলেই 'প্রতাপচাঁদ'। কিন্তু ওই সময়ের নিরিখে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি না থাকায় শুধুমাত্র সাক্ষের ভিত্তিতে এটাও প্রমাণ হয় না যে তিনি সত্যিই আসল প্রতাপচাঁদ কিন্তু এখন সে সবই ইতিহাস...

******************************************************

লেখা, গবেষণা ও ছবি - প্রীতম নস্কর  

ই-মেল - pritamnaskar.pn@gmail.com

ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে ব্লগের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, তবে পূর্বানুমতি ছাড়া আমার তোলা আলোকচিত্রগুলি এবং ব্লগের রচনাগুলি অন্য কোথাও কপি-পেস্ট বা বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করা চলবে না।

******************************************************

কীভাবে যাবেনঃ -

কালনা যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় ট্রেন যাত্রা। হাওড়া-কাটোয়া লাইনেই অবস্থিত অম্বিকা কালনা স্টেশন। হাওড়া থেকে কাটোয়াগামি (মেনলাইন) / ব্যান্ডেল থেকে কাটোয়া / শিয়ালদহ থেকে কাটোয়া যাওয়ার যে কোন ট্রেনে উঠে নামতে হবে অম্বিকা কালনা স্টেশন। স্টেশন থেকে বাইরে বেরলেই দেখা মিলবে সারি সারি টোটো / রিকশার, তাতে করে অনায়াসেই পৌছে যাওয়া যাবে রাজবাড়ি কমপ্লেক্স অথবা ১০৮ শিবমন্দির।

গুগল ম্যাপ / কোঅরডিনেট -

23.221019, 88.364893

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ-

কালনার আরও কিছু মন্দির-

তথ্যসূত্রঃ-

  • জাল প্রতাপচাঁদ সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (যজ্ঞেশ্বর বসু সম্পাদিত)
  • বর্ধমান জেলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি (প্রথম খণ্ড) এককড়ি চট্টোপাধ্যায়
  • বর্ধমান পরিক্রমা সুধীরচন্দ্র দাঁ
  • বর্ধমান শহরের স্থান নাম বৃত্তান্ত ডঃ সর্বজিৎ যশ
  • কালনা মহকুমার প্রত্নতত্ত্ব ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ইতিবৃত্ত বিবেকানন্দ দাস
  • রিসার্চ জার্নাল মন্দিরনগর অম্বিকা-কালনার টেরাকোটা মন্দির-স্থাপত্যঃ একটি পুরাতাত্ত্বিক নিরীক্ষণ সুজয়কুমার মন্ডল ও তনয়া মুখার্জি
  • Hooghly Past and Present - Shumbhoo Chunder Dey
  • Bengal District Gazetteers - Burdwan 

Comments