জগন্নাথ বাড়ির জোড়া শিবমন্দির, কালনা | The Twin Temples of Jagannath Bari, Kalna

মন্দির নগরী বা মন্দির শহর হিসাবে প্রচলিত বিষ্ণুপুরের তুলনায় অধিক সংখ্যায় মন্দির রয়েছে বর্ধমানের কালনায়। বিষ্ণুপুরে যেমন রয়েছে মল্ল রাজাদের তৈরি বিভিন্ন মন্দির স্থাপত্য তেমনি কালনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বর্ধমান রাজাদের স্থাপত্যকীর্তিমন্দিরের নিরিখে দেখতে গেলে বিষ্ণুপুরের তুলনায় কালনায় সংখ্যাটি বেশি। এখানকার বেশিরভাগ মন্দিরই টেরাকোটার অলংকরণে সমৃদ্ধ; এছাড়াও এই মন্দিরনগরীতে চালা, রত্ন, রেখা, সমতল ছাদ, মঞ্চ প্রভৃতি রীতির প্রাচীন মন্দির স্থাপত্য রয়েছে। কালনার ১০৮ শিব মন্দির তো সকলেই চেনে এছাড়াও রয়েছে অম্বিকা সিদ্ধেশ্বরী মন্দির। কিন্তু স্থাপত্যের নিরিখে দেখতে গেলে কালনার রাজবাড়ি চত্বরে গড়ে ওঠা লালজী মন্দির, প্রতাপেশ্বর মন্দির, গোপালজীর মন্দির, রাসমঞ্চ, রূপেশ্বর মন্দির; বাংলার বিভিন্ন স্থাপত্যরীতির মন্দির তুলে ধরে। 

জগন্নাথ বাড়ির রাজেশ্বর ও ভুবনেশ্বর শিবমন্দির 

কালনার বেশিরভাগ মন্দিরই ভারত সরকারের পুরাতত্ত্ব দ্বারা সংরক্ষিত। কিন্তু এই সংরক্ষণ শুধুমাত্র রাজবাড়ি চত্বর ও তার আশেপাশের কিছু মন্দির। কারণ কালনা রাজবাড়ি চত্বর থেকে কিছু দূর এগোলেই কালনার ছোট দেউড়ি পাড়ায় অবস্থিত জগন্নাথ বাড়ির জোড়া শিবমন্দির দীর্ঘদিন অবহেলা আর অনাদরে নষ্ট হতে বসেছে। পুরাতত্ত্ব বিভাগ এই মন্দির পরিচর্যায় হস্তক্ষেপ না করায় দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে মন্দিরের চূড়া ও মন্দির চত্বরের সর্বত্রই আগাছা ভরে গেছে। বর্তমানে প্রায় ভগ্ন অবস্থায় রয়েছে মন্দিরগুলি  

রাজেশ্বর শিবমন্দির

জানা যায় পূর্বে ভাগীরথী (গঙ্গা) এই জায়গা দিয়েই বয়ে যেতযার প্রমাণ পাওয়া যায়- মন্দিরের পাশ থেকে সুদূর বিস্তৃত নদীর চড়া, যেখানে বর্তমানে চাষবাস করা হয়তাই গঙ্গার পাড়েই গড়ে উঠেছিল বর্ধমান রাজাদের তৈরি জগন্নাথ মন্দির, যার নাম থেকেই ঘাটের নামকরণ জগন্নাথ ঘাট। তো জগন্নাথ ঘাটের এই জায়গাটিতেও ছিল বর্ধমান রাজাদের তৈরি আর একটি মন্দির চত্বর, যা পরিচিত জগন্নাথ বাড়ি নামে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই চত্বরের বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। ক্রমে গঙ্গার পাড়ও ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেছে মন্দির চত্বর থেকে। বর্তমানে এই জগন্নাথ তলার জোড়া মন্দির ও সম্মুখে আর একটি মন্দির ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। 

টেরাকোটার প্যানেলে নৌকাবিলাস, সখী, বটবৃক্ষ ও নকশা

জগন্নাথ ঘাটের জোড়া শিবমন্দিরঃ-

রাজেশ্বর ভুবনেশ্বর এই দুই শিবমন্দির নিয়েই জগন্নাথ ঘাটের জোড়া শিবমন্দির। প্রায় ৪০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট আটচালা এই মন্দির দুটি প্রায় ৭ ফুট উঁচু পৃথক বেদীর ওপর গড়ে উঠেছে। মন্দির দুটির পৃথক আয়তন ১৬ ফুট x ১৬ ফুট। কিন্তু মন্দির দুটি পাশাপাশি হওয়ায় এবং একই সিঁড়ি ব্যবহারের জন্য এই দুটিকে জোড়া শিবমন্দির বলা হয়। অর্থাৎ মন্দির দুটিতে প্রবেশের জন্য শুধুমাত্র সিঁড়িপথ সংলগ্ন, কিন্তু মন্দির দুটির মধ্যেকার ব্যবধান প্রায় ৬ ফুট। দক্ষিণমুখী এই মন্দির দুটি একটি পূর্বদিকে ও অন্যটি পশ্চিমদিকে অবস্থান করছে। মন্দির দুটির সর্বত্রই বিভিন্ন টেরাকোটার অলংকরণে সমৃদ্ধ। মন্দির দুটি কে কবে তৈরি করেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় মন্দিরের প্রতিষ্ঠালিপিতে। 

পশ্চিমদিকের মন্দির অর্থাৎ রাজেশ্বর মন্দিরের প্রতিষ্ঠালিপিতে লেখা আছে

বাণাদ্রি মাতৃকামানে শাকে প্রসাদমৈষ্টকম্।

চিত্রসেনস্য মহিষী মহেশায় ন্যবেদয়ৎ।।

শকাব্দঃ ১৬৭৫

অর্থাৎ এই রাজেশ্বর মন্দির ১৭৫৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন বর্ধমান মহারাজা চিত্রসেনের পত্নী ছঙ্গকুমারী দেবী

অন্যদিকে ভুবনেশ্বর মন্দিরের প্রতিষ্ঠালিপি কালের নিয়মে অনেকটাই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে, যা বর্তমানে পাঠোদ্ধার করা অসম্ভব। তবুও ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে শিলালিপির যেটুকু পাঠোদ্ধার করা গেছে তা এইরূপ

****** শাকে রুদ্রায় মন্দিরং

****** রাজ্ঞী প্রাদাৎ কানীয়সী।।

প্রতিষ্ঠালিপিতে কনীয়সী শব্দটি থাকায় অনুমান করা যায় এই ভুবনেশ্বর মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন মহারাজা চিত্রসেনের আর এক কনিষ্ঠা পত্নী ইন্দ্রকুমারী দেবী।

অর্থাৎ দুটি মন্দিরই রাজা চিত্রসেনের মৃত্যুর (১৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দ) পর তাঁর দুই পত্নী ছঙ্গকুমারী দেবী ও ইন্দ্রকুমারী দেবী ১৭৫৩ খ্রিষ্টাব্দে রাজা ত্রিলোকচন্দ্রের রাজত্বকালে নির্মাণ করেন।  

মন্দিরের দলান স্তম্ভে টেরাকোটার প্যানেল

টেরাকোটার প্যানেলে লোকলস্কর সহ জমিদার

সম্ভবত হনুমান ও তাঁর শিষ্য

এবার আলোচনা করা যাক মন্দিরের টেরাকোটা মোটিফের ব্যাপারেআগেই বলেছি কালনার ১০৮ শিবমন্দির, সিদ্ধেশ্বরী মন্দির ও রাজবাড়ি চত্বরের মন্দিরগুলি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব দ্বারা সংরক্ষণ করা হলেও, জগন্নাথ ঘাটের এই মন্দির গুলি সংরক্ষণ করা হয়নি। কেন জানিনা পুরাতত্ত্ব বিভাগ এবিষয়ে নজর এড়িয়ে গেছে, তাই দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না হওয়ায় নোনা ধরেছে মন্দিরের টেরাকোটার দেওয়াল গুলিতে। মন্দিরের চূড়াতেও জন্ম নিয়েছে বিভিন্ন আগাছা। দুটি মন্দিরেই শুধুমাত্র সামনের দিকে অর্থাৎ পশ্চিমদিকের দেওয়ালেই টেরাকোটার প্যানেল আছে। বাকি দেওয়ালগুলির টেরাকোটার কাজ সময়ের সাথে নষ্ট হয়েছে। সামনের দিকে আবার যেসব টেরাকোটার প্যানেল রয়ে গেছে তার বেশিরভাগ প্যানেলই সংস্কারের অভাবে ক্ষতিগ্রস্থ। কিন্তু এসবের মাঝেও যেটুকু টেরাকোটার অলংকরণ ফুটে উঠেছে, তার মধ্যে দুটি মন্দিরের প্রবেশদ্বারেই রয়েছে ফুল-লতাপাতার টেরাকোটা সাজ। এছাড়াও টেরাকোটার প্যানেলে রয়েছে জগদ্ধাত্রী মূর্তি, প্রবেশদ্বারের উপর হনুমান, অশ্বারোহী যোদ্ধা, হস্তিরোহী যোদ্ধা, নৌকাবিলাস, বাদ্যদল ও নর্তকী, খোলকরতাল সহ সংকীর্তন দল, সখীসহ কৃষ্ণ, লোকলশকর সহ জমিদারবাবু ইত্যাদি মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে টেরাকোটার প্যানেল থাকলেও, মন্দির দুটির বারান্দার দেওয়ালে সেরকম কোনো প্যানেল নেই এবং পূর্বেও তা ছিল না। দুটি মন্দিরেরই গর্ভগৃহে বিরাজ করছে প্রায় ৪ ফুট উচ্চতার শিবলিঙ্গ। মন্দিরের বিগ্রহ এখনও পূজিত হয়।

খোল করতাল সহ নর্তক-নর্তকী

টেরাকোটার প্যানেলে রমণী

টেরাকটার প্যানেলে ২

টেরাকোটা প্যানেল ৩

জগন্নাথ ঘাটের পরিত্যক্ত এক শিবমন্দিরঃ-

জগন্নাথ ঘাটের জোড়া মন্দিরের সামনেই, মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে রয়েছে আর একটি আটচালার শিবমন্দির। তবে এই মন্দিরের অবস্থা একেবারেই করুণ। 

জোড়াশিবমন্দিরের তুলনায় এই মন্দির প্রায় ভগ্ন ও পরিত্যক্তমন্দিরের সিঁড়ি ও পূর্বদিকের অংশের পুরোটাই ভেঙে পড়েছে প্রায় ১০ ফুট x ১০ ফুট আয়তন বিশিষ্ট এই মন্দিরের গায়ে কোনো টেরাকোটার প্যানেল নেই, পূর্বেও যে কোনোরূপ টেরাকোটার প্যানেল থাকতে পারে তা জানারও উপায় নেই। কারণ মন্দিরের দেওয়ালের পলেস্তার থেকে পোড়ামাটি সবই প্রায় খসে পড়েছে। মন্দিরটি যে একসময়ে খানিকটা বেদীর উপর গড়ে উঠেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় মন্দিরের চারপাশে বেদীর ধ্বংসাবশেষ দেখে। জরাজীর্ণ এই মন্দির বর্তমানে প্রায় প্রবেশের অযোগ্য বাইরে থেকে দেখা যায় মন্দিরের বিগ্রহ শিবলিঙ্গ, যা দীর্ঘদিন ধরেই পূজার্চনার অভাবে মলিন (সম্ভবত শিবলিঙ্গের নীচের অংশ ভগ্ন)। মন্দিরের দেওয়ালেও কোনো শিলালিপি না থাকায় মন্দিরটি কে কবে প্রতিষ্ঠা করেছে তাও জানা যায় না। তবে এইটুকু অনুমান করা যায় মন্দিরটি কোন বর্ধমান রাজাদের শাসনকালেই প্রতিষ্ঠিত। 

- এই ছিল কালনার জগন্নাথ ঘাটের জোড়া শিবমন্দির। এছাড়াও এককালে এখানে ছিল জগন্নাথ মন্দির। প্রায় দেড় বিঘা জমির উপর বর্ধমান রাজাদের তৈরি এই জগন্নাথ মন্দির, যদিও বর্তমানে আর সেসব নেই। শুধুমাত্র রথযাত্রা উপলক্ষে এই জোড়া মন্দিরের সামনের মাঠে আয়োজন হয় মেলার। জোড়ামন্দির রক্ষার জন্য ২০১৯ সাল নাগাদ স্থানীয় বাসিন্দারা চাঁদা তুলে মন্দিরের সামনের অংশ সংস্কার করে। জানা যায় সম্প্রতি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব -এর পক্ষ থেকেও মন্দির সংরক্ষণের ব্যাপারে আগ্রহ জানানো হয়েছে। এব্যাপারে বর্ধমান রাজ পরিবারের বর্তমান সদস্য প্রনয়চাঁদ মহাতবকেও বিষয়টি জানানো হয়। আশার আলো এব্যাপারে দুপক্ষই সম্মতি দিয়েছে। অর্থাৎ এখন শুধুমাত্র অপেক্ষা......

******************************************************

লেখা, গবেষণা ও ছবি - প্রীতম নস্কর  

ই-মেল - pritamnaskar.pn@gmail.com

ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে ব্লগের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, তবে পূর্বানুমতি ছাড়া আমার তোলা আলোকচিত্রগুলি এবং ব্লগের রচনাগুলি অন্য কোথাও কপি-পেস্ট বা বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করা চলবে না।

******************************************************

কীভাবে যাবেনঃ -

কালনা যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় ট্রেন যাত্রা। হাওড়া-কাটোয়া লাইনেই অবস্থিত অম্বিকা কালনা স্টেশন। হাওড়া থেকে কাটোয়াগামি (মেনলাইন) / ব্যান্ডেল থেকে কাটোয়া / শিয়ালদহ থেকে কাটোয়া যাওয়ার যে কোন ট্রেনে উঠে নামতে হবে অম্বিকা কালনা স্টেশন। স্টেশন থেকে বাইরে বেরলেই দেখা মিলবে সারি সারি টোটো / রিকশার, তাতে করে অনায়াসেই পৌছে যাওয়া যাবে রাজবাড়ি কমপ্লেক্স, ১০৮ শিবমন্দির অথবা সিদ্ধেশ্বরী মন্দির। সেখান থেকে প্রায় ১০ মিনিট হাঁটা পথে জগন্নাথ বাড়ির জোড়া শিবমন্দির। অথবা, স্টেশন থেকেই টোটো / রিকশায় পৌঁছানো যায় জগন্নাথ বাড়ির জোড়া শিবমন্দির।

গুগল ম্যাপ / কোঅরডিনেট -

23.23116,88.35398

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ-

কালনার আরও কিছু মন্দির-

তথ্যসূত্রঃ-

  • বর্ধমান জেলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি (প্রথম খণ্ড) এককড়ি চট্টোপাধ্যায়
  • কালনা মহকুমার প্রত্নতত্ত্ব ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ইতিবৃত্ত বিবেকানন্দ দাস
  • রিসার্চ জার্নাল মন্দিরনগর অম্বিকা-কালনার টেরাকোটা মন্দির-স্থাপত্যঃ একটি পুরাতাত্ত্বিক নিরীক্ষণ সুজয়কুমার মন্ডল ও তনয়া মুখার্জি
  • এই সময় ডিজিটাল ই-পত্রিকা - ২ ই জুলাই ২০১৭
  • আনন্দবাজার ডিজিটাল ই-পত্রিকা - ৮ই সেপ্টেম্বর ২০২০

Comments