দুর্গেশ্বর-রামেশ্বর-বানেশ্বর শিবমন্দির -পর্ব ১ | DURGESWAR RAMESWAR BANESWAR TEMPLE - Part 1

প্রায় ২৫০ বছরের প্রাচীন শিবমন্দির দুর্গেশ্বর, রামেশ্বর বানেশ্বর গড়ে উঠেছে কলকাতার সবচেয়ে পুরানো নিমতলা শোভাবাজার ও কুমোরটুলি অঞ্চলে। হুগলী নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা এই মন্দিরগুলি শহরের বিভিন্ন পরিবর্তনের সাক্ষী। আর আজকে আমার ব্লগ এই তিনটি মন্দিরকেই কেন্দ্র করে।

প্রথমেই আলোচনা করা যাক কলকাতার মন্দির সম্পর্কে, কারণ প্রাচীনকাল থেকেই কলকাতায় কালী পুজোর সঙ্গে সঙ্গে শিব-দুর্গা এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক দেব দেবীরও পুজো হয়ে আসছে। স্থাপত্যের নিরিখে দেখতে গেলে কলকাতার বুকে এখনও এমন কিছু মন্দির আছে যা কলকাতা প্রতিষ্ঠা হওয়ারও আগে। নদীমাতৃক উপনিবেশ হওয়ায় প্রাচীন কলকাতায় বেশিরভাগ মন্দিরই গড়ে উঠছে নদীর (ভাগীরথী / হুগলী ও আদিগঙ্গা) তীরবর্তী অঞ্চলে। আর এই মন্দিরগুলির বেশিরভাগই কেন্দ্রীভূত ছিল তখনকার ধনীসম্প্রদায়ের মধ্যে। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের তথ্য অনুযায়ী কলকাতায় সেই সময় ২৪ টি শিব মন্দির ও ৫ টি কালীমন্দির পাওয়া যায়। মন্দির গঠনের দিক থেকে বাংলার মত কলকাতারও মন্দির গঠনের নিজস্বতা রয়েছে, কিন্তু অঞ্চল হিসাবে এখানেও বিভিন্ন ঘরানার মন্দির দেখতে পাওয়া যায়। তবে এই ব্লগ যে তিনটি মন্দিরকে নিয়ে সেগুলো সবই বাংলার আটচালা শিল্পের অনুকরণে ও টেরাকোটার অলংকরণে গঠিত। টেরাকোটা অর্থাৎ পোড়ামাটির এই শিল্পে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন মন্দিরই গড়ে উঠেছে, যেখানে টেরাকোটার ফলকে স্থান পেয়েছে বিভিন্ন হিন্দু দেবদেবী, পুরাণ, সামাজিক চিত্র। সাধারণত এই আটচালা মন্দির দেখতে পাওয়া যায় হাওড়া, হুগলী, বাঁকুড়া জেলায়। কিন্তু কলকাতার শহরতলিতেও যে এই মন্দির একসময়ে গড়ে উঠেছিল তার দৃষ্টান্ত এই মন্দিরগুলি। আজকের এই তিনটি মন্দির দুর্গেশ্বর, রামেশ্বর ও বানেশ্বর আসলে শিবমব্দির। প্রশ্ন হওয়া স্বাভাবিক এমন নাম করনের কারণ কি? আসলে নামগুলিকে ঠিকমতো আলাদা করলেই খুঁজে পাওয়া যাবে আসল মানে। যেমন- ‘দুর্গেশ্বর’ শব্দগুচ্ছের সন্ধিবিচ্ছেদ করলে দাঁড়ায় দুর্গা + ঈশ্বর অর্থাৎ দেবী দুর্গার স্বামী (ঈশ্বর) অর্থাৎ এখানে মহাদেব শিব। ‘রামেশ্বর’ শব্দগুচ্ছের সন্ধিবিচ্ছেদ করলে দাঁড়ায় রাম + ঈশ্বর অর্থাৎ রামের ঈশ্বর; হিন্দু পুরাণ মতে শ্রী রামচন্দ্রের দেবতা হলেন মহাদেব শিব। ‘বানেশ্বর’ শব্দগুচ্ছের সন্ধিবিচ্ছেদ করলে দাঁড়ায় বান + ঈশ্বর; হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী বাণ অথবা অসুরের রাজা বাণাসুর ছিলেন ঘোর শিবভক্ত। তার রাজধানী ছিল মোটামুটি নর্মদা নদীর তীরে, শিবকে মর্তে প্রতিষ্ঠার জন্য নর্মদার মাটি দিয়ে তৈরি করেন শিবলিঙ্গ যা বানেশ্বর শিবলিঙ্গ নামে পরিচিত।

পর্ব - ১

দুর্গেশ্বর মন্দির ও উত্তর দিকের প্রবেশপথ

দুর্গেশ্বর শিবমন্দিরঃ-

হুগলী নদীর তীরে কলকাতার নিমতলা অঞ্চলের ১৬ নং মহম্মদ রামজান লেন-এ অবস্থিত এই দুর্গেশ্বর মন্দির। প্রথমেই বলে রাখা দরকার কলকাতার এই ঘিঞ্জি জনবসতির   এই প্রাচীন বিশাল আটচালা মন্দির শহরবাসীকে একটু হলেও বিস্মিত করতে বাধ্য। ২২৫ বছরেরও অধিক সুবিশাল এই দুর্গেশ্বর মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন মদন মোহন দত্তের দুই পুত্র রসিকলাল দাস দত্তজহরলাল দাস দত্ত। এবার প্রশ্ন আসতেই পারে কে এই মদনমোহন দত্ত? আসলে মদনমোহন দত্ত হলেন সেই সময়কার হাটখোলা অঞ্চলের দত্ত পরিবারের পূর্বপুরুষ। এই দত্ত পরিবার যারা কিনা একদম প্রথমে হাওড়ার বালিতে ও পরবর্তীকালে হাওড়ার আন্দুলে এবং শেষমেশ এই হাটখোলা অঞ্চলে স্থায়ী বসবাস করে এসেছেন। তো এই মদনমোহন দত্ত হলেন হাটখোলা দত্ত পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। এই মদনমোহন দত্ত সেই সময়ে ব্রিটিশদের সাথে বিশাল ব্যবসা করেছিলেন, এমনকি শোনা যায় সেই সময়ে নিজেরও আলাদা জাহাজ ছিল। এছাড়াও তার হদিস পাওয়া যায় আরও একটি যায়গায়। ১৭৬৬ খ্রিষ্টাব্দে জালিয়াতির অভিযোগে বিলাতি আইন অনুসারে কলকাতার কালো জমিদার গোবিন্দরাম মিত্রের প্রপৌত্র রাধাচরন মিত্রের যখন ফাঁসির হুকুম জারি হয়, তখন কলকাতার ৯৫ জন নাগরিক কাউন্সিলের কাছে মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাহারের জন্য স্বাক্ষর করেন। আর এই ৯৫ জন আবেদনকারীর মধ্যে ছিল আমাদের মদনমোহন দত্তের নাম। 

১০ ফুট উচ্চতার শিবলিঙ্গ
এবারে আসা যাক মন্দির প্রসঙ্গে। দুর্গেশ্বর (দুর্গা + ঈশ্বর) অর্থাৎ দেবী দুর্গার স্বামী (ঈশ্বর) অর্থাৎ এখানে মহাদেব শিব। দুর্গেশ্বর মন্দিরটি আটচালা প্রকৃতির, একসময়ে মন্দিরের দেওয়াল টেরাকোটার ফলক থাকলেও বর্তমানে আর সেসব নেই। সময়ের সাথে সাথে মন্দিরের চূড়াতে বট গাছ জন্ম নিয়েছে যার ঝুড়ি ক্রমশ বেয়ে এসেছে পূর্বের দেওয়ালে। প্রায় ৫০ ফুট উঁচু এই মন্দির দৈর্ঘ্যে ২৪ ফুট ও প্রস্থে ২৮ ফুট। মন্দিরের প্রবেশদ্বার তিনটি যথাক্রমে উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিমদিকে। পশ্চিমদিকের প্রবেশদ্বারের উপরেই রয়েছে একটি কালো ফলক যেখানে প্রাচীন বাংলায় লেখা আছে মন্দির প্রতিষ্ঠার শ্লোক, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ায় বর্তমানে তার পাঠোদ্ধার করা কষ্টকর। তবে শ্লোকটির যতটা পড়া সম্ভব তা থেকে জানা যায় যে দুর্গেশ্বর মন্দিরের এই শিবলিঙ্গ মদনমোহন দত্তের পুত্র দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। 
পশ্চিম দিকের প্রবেশদ্বারের উপর মন্দির প্রতিষ্ঠার ফলক
মন্দিরের একদম কেন্দ্রস্থলে রয়েছে প্রায় ১০ ফুট উচ্চতার শিবলিঙ্গ। সচরাচর এত বড় শিবলিঙ্গ দেখতে পাওয়া যায় না, আর মন্দিরের প্রবেশদ্বারের তুলনায়ও অনেক বড়। এথেকেই অনুমান করা যায় শিবলিঙ্গটি বাইরে থেকে না এনে মন্দিরের ভিতরেই তৈরি করা হয়। আর এই শিবলিঙ্গটি তৈরি করেন শ্রী গদাধর দাস; যার নাম আমরা পাই মন্দিরেরই শিবলিঙ্গের একদম নিচের দিকে (গোড়ার দিকে), সাথে ১২০১ বঙ্গাব্দে যে এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় তার তারিখও আমরা পাই। ১২০১ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ইংরাজির হিসাবমতো ১৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দে (১২০১ + ৫৯৩) প্রতিষ্ঠিত হয় এই মন্দির। 

মন্দির প্রতিষ্ঠা ও শিবলিঙ্গ প্রস্তুতকারকের নাম - সৌজন্যে Astoundingbengal

শিবলিঙ্গের আকার এত বড় হওয়ার কারনেই স্থানীয় বাসিন্দারা এটাকে মোটা শিবের মন্দির নামেই সম্বোধন করে। মন্দিরে প্রত্যেকদিনই সকাল সন্ধ্যে পুজো হয় তাই চাইলে আপনারা যে কোনো দিনই আসতে পারেন তবে সকালের দিকে ভোর ৫ টা থেকে ১০ টা পর্যন্ত ও বিকালে ৪ টে থেকে সন্ধ্যে ৭ টা পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে।

মন্দিরের গম্বুজের অংশ যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রঙ হারিয়েছে
মন্দিরের দেওয়ালের একটি ফলক (সম্ভবত পোড়ামাটির)
দুর্গেশ্বর মন্দিরের দক্ষিণদিকের প্রবেশপথ

রামেশ্বর ও বানেশ্বর মন্দির বিষয়ে জানতে হলে ঘুরে আসতে হবে দ্বিতীয় পর্বে

কীভাবে যাবেনঃ-

প্রথমে পৌঁছাতে হবে নিমতলা ঘাট স্ট্রীটের পুরনো জোড়াবাগান থানা। এরপর সেখান থেকেই নিমতলা ঘাট স্ট্রীট ধরে এগোতে হবে গঙ্গার দিকে। এই নিমতলা ঘাট রাস্তাটি মিশেছে স্ট্যান্ড রোডে। তাই খেয়াল রাখতে হবে রাস্তাটি শেষ হওয়ার কিছুটা আগেই ডানদিকে একটি গলি বেঁকে গেছে। এই গলি ধরে কিছুটা এগোলেই বামদিকে পড়বে দুর্গেশ্বর মন্দির। 

গুগল ম্যাপ / কোঅরডিনেটঃ-

তথ্যসুত্রঃ-

  • কলকাতার মন্দির স্থাপত্য – তারাপদ সাঁতরা (কলকাতার পুরাকথা – দেবাশিষ বসু সম্পাদিত)
  • এই কলকাতায় – বিদ্যুৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
  • কলিকাতা সেকালের ও একালের – হরিসাধন মুখোপাধ্যায়
  • Wanderlust Blog

দুর্গেশ্বর-রামেশ্বর-বানেশ্বর শিবমন্দির -পর্ব ২



Comments