দুর্গেশ্বর-রামেশ্বর-বানেশ্বর শিবমন্দির -পর্ব ২ | DURGESWAR RAMESWAR BANESWAR TEMPLE - Part 2

 দুর্গেশ্বর-রামেশ্বর-বানেশ্বর  শিবমন্দির -পর্ব ২ | DURGESWAR RAMESWAR BANESWAR TEMPLE - Part 2

প্রায় ২৫০ বছরের প্রাচীন শিবমন্দির দুর্গেশ্বর, রামেশ্বর ও বানেশ্বর গড়ে উঠেছে কলকাতার সবচেয়ে পুরানো নিমতলা শোভাবাজার ও কুমোরটুলি অঞ্চলে। হুগলী নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা এই মন্দিরগুলি শহরের বিভিন্ন পরিবর্তনের সাক্ষী। আর আজকে আমার ব্লগ এই তিনটি মন্দিরকেই কেন্দ্র করে। যদিও আগের ব্লগে আলোচনা করেছি দুর্গেশ্বর মন্দির সম্পর্কে। তাই সেই বিষয়ে জানতে গেলে ঘুরে আসতে পারেন দুর্গেশ্বর মন্দির – পর্ব ১


আজকের এই তিনটি মন্দির দুর্গেশ্বর, রামেশ্বর ও বানেশ্বর আসলে শিবমব্দির। প্রশ্ন হওয়া স্বাভাবিক এমন নাম করনের কারণ কি? আসলে নামগুলিকে ঠিকমতো আলাদা করলেই খুঁজে পাওয়া যাবে আসল মানে। যেমন- ‘দুর্গেশ্বর’ শব্দগুচ্ছের সন্ধিবিচ্ছেদ করলে দাঁড়ায় দুর্গা + ঈশ্বর অর্থাৎ দেবী দুর্গার স্বামী (ঈশ্বর) অর্থাৎ এখানে মহাদেব শিব। ‘রামেশ্বর’ শব্দগুচ্ছের সন্ধিবিচ্ছেদ করলে দাঁড়ায় রাম + ঈশ্বর অর্থাৎ রামের ঈশ্বর; হিন্দু পুরাণ মতে শ্রী রামচন্দ্রের দেবতা হলেন মহাদেব শিব। ‘বানেশ্বর’ শব্দগুচ্ছের সন্ধিবিচ্ছেদ করলে দাঁড়ায় বান + ঈশ্বর; হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী বাণ অথবা অসুরের রাজা বাণাসুর ছিলেন ঘোর শিবভক্ত। তার রাজধানী ছিল মোটামুটি নর্মদা নদীর তীরে, শিবকে মর্তে প্রতিষ্ঠার জন্য নর্মদার মাটি দিয়ে তৈরি করেন শিবলিঙ্গ যা বানেশ্বর শিবলিঙ্গ নামে পরিচিত।

পর্ব – ২

রামেশ্বর শিবমন্দিরঃ-

সপ্তদশ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি রামেশ্বর শিবমন্দির কলকাতার আর একটি আটচালা বিশিষ্ট মন্দির যা গড়ে উঠেছে ৫১ নন্দরাম সেন স্ট্রিটে। দুর্গেশ্বর মন্দির পেরিয়ে রবীন্দ্রসরণি রোড ধরে কুমোরটুলি যাওয়ার আগেই বামদিকে পরবে নন্দরাম সেন স্ট্রিট, আর এই রাস্তার এক-দুটি দোকানের পরেই দেখতে পাওয়া যাবে রামেশ্বর মন্দিরের প্রবেশপথ। 
রবীন্দ্রসরণী রোড থেকে রামেশ্বর শিবমন্দির
কলকাতার হেরিটেজ স্বীকৃতি পাওয়া রামেশ্বর শিব মন্দির তৈরি করেন নন্দরাম সেন। হ্যাঁ! যার নামে এই রাস্তার নামকরণ। আর কে এই নন্দরাম সেন? তা জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে ৩০০ বছর আগের কলকাতায়, যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কলকাতার (সুতানুটি, কলিকাতা ও গোবিন্দপুর) জমিদারীস্বত্ব কিনে নেয়। এরপর ১৬৯৯ খিষ্টাব্দে কলকাতা রূপান্তরিত হয় প্রেসিডেন্সি শহরে আর ১৭০০ খিষ্টাব্দে এই শহর দেখাশোনার জন্য প্রতিষ্ঠা হয় এক কাউন্সিলের। এই কাউন্সিলের মধ্যে কলকাতার খাজনা আদায়কারী পদে নিযুক্ত হয় রালফ শেলডন। সাহেব মানুষ তাই যতই হিসেব বুঝুক না কেন রাজস্ব আদায় করতে হলে দরকার এদেশীয় বাংলা ভাষা জানা লোক। তাই ১৭০৫ খ্রিষ্টাব্দে এই শেলডন সাহেবের সহকারী (যা “ব্ল্যাক ডেপুটী” বা “ব্ল্যাক কালেক্টর” নামে পরিচিত) হিসাবে নিযুক্ত হন নন্দরাম সেন। এখানে বলে রাখা ভালো রাজস্ব আদায় পদে যুক্ত হলেও তিনি কিন্তু স্বাধীন জমিদার ছিলেন না, কারণ এই স্বাধীন জমিদার পদ শুরু হয় ১৭২০ খ্রিষ্টাব্দে যেখানে এই পদে প্রথম যোগদান করেন গোবিন্দরাম মিত্র। জানা যায় ব্ল্যাক কালেক্টর পদে থাকাকালীন নন্দরাম সেন অসৎ উপায়ে উপার্জন শুরু করে। পরবর্তীকালে ব্যাপারটা যখন ব্রিটিশ সরকারের নজরে আসে তখন নন্দরাম সেনের উপর হুকুম জারি হয়। কিন্তু এদিকে নন্দরাম বেগতিক দেখে পালিয়ে যায় তার পুরনো বসতবাড়ি হুগলীতে। শেষমেশ ব্রিটিশ সরকার তাকে “ব্ল্যাক কালেক্টর” পদ থেকে অপসারিত করেন। এরপরের ঘটনা আর সেভাবে জানা যায়নি। কিন্তু সে সময়কার শহরবাসী নন্দরামকে খুবই মান্য করে চলত, কালেক্টর পদে থাকাকালীন শহরবাসীরা নন্দরামকে এতটাই ভয় পেত যে পরবর্তীকালের তর্জাগানেও তাঁর নাম জায়গা করে নেয় –
বনমালি সরকারের বাড়ি,
নন্দরামের ছড়ি।
ঊর্মিচাঁদের দাড়ি।
হুজুরীমলের কড়ি।
যদিও ছড়টার রকমভেদ আছে, যেখানে নন্দরামের যায়গায় গোবিন্দরামের নামও শোনা যায়। 
রামেশ্বর শিবমন্দির
এবারে আসা যাক রামেশ্বর মন্দির প্রসঙ্গে। তো এই নন্দরাম সেন তখনকার চিতপুর রোডের পাশেই তৈরি করেন আটচালা বিশিষ্ট রামেশ্বর মন্দির। সাধারণত এই আটচালা মন্দিরগুলি মাঝারি আকারের হয়ে থাকে, কিন্তু এই রামেশ্বর মন্দিরের আয়তন অনেকটাই বড় যা সে সময়কার আভিজাত্যের মাপকাঠি বিচার করে। রবীন্দ্র সরণী দিয়ে নন্দরাম সেন স্ট্রীটে ঢুকে দু-তিনটি ঘরের পরেই বামদিকে পরবে রামেশ্বর মন্দিরে যাওয়ার প্রবেশপথ। ভিতরে প্রবেশের সাথেই পৌঁছে যাওয়া যাবে মন্দির চত্বরে এবং চত্বরের ঠিক বাম দিকেই পড়বে রামেশ্বর শিবমন্দির। প্রায় দুই শতাব্দী প্রাচীন এই মন্দিরটি আজও ভালোভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। কিন্তু আটচালা বিশিষ্ট এই মন্দিরটিতে যে কোনোকালে টেরাকোটার অলংকরণ থাকতে পারে তা আর এখন বোঝার উপায় নেই। প্রায় ৮০ ফুট উঁচু এই মন্দির দৈর্ঘ্যে ৩৮ ফুট ও প্রস্থে ৩১ ফুট। উচ্চ লাল রঙ বিশিষ্ট এই মন্দিরের প্রবেশপথ তিনটি, আর এই তিনটি প্রবেশপথই পশ্চিমমুখী।
রামেশ্বর শিবমন্দিরের শিবলিঙ্গ
মন্দিরের প্রধান বিগ্রহ প্রায় ৫ ফুট উচ্চতার শিবলিঙ্গ, কিন্তু বর্তমানে তার সাথে রাধাকৃষ্ণ, অন্নপূর্ণা ও দেবী কালীর বিগ্রহও রয়েছে। মন্দিরটি কবে তৈরি হয়েছে তা নিয়ে রয়েছে এক দ্বন্দ্ব। কারণ মন্দিরের প্রবেশদ্বারের উপরেই রয়েছে চারটি ফলক যার মধ্যে দুটি প্রস্তর ফলকের তারিখ ১০৬১ সন (একটি মন্দির প্রতিষ্ঠার ও অন্যটি তুলসী মঞ্চ প্রতিষ্ঠার) যা অন্যান্য ফলকদুটির তুলনায় পুরনো। ১০৬১ সন অর্থাৎ ইংরেজিতে ১৬৫৪ খ্রিষ্টাব্দ (১০৬১+৫৯৩)। যদি ধরেই নেওয়া যায় ১৬৫৪ খ্রিষ্টাব্দে নন্দরাম সেন এই রামেশ্বর মন্দির নির্মাণ করেন তবে সেই সময় তার বয়স ২০-২৫ বছরের উপরে হওয়াই স্বাভাবিক। আবার ১৭০৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজস্ব আদায়ের জন্য শেলডন সাহেবের সহকারী পদে নিযুক্ত হন এই নন্দরাম সেন, তাহলে হিসাবমত তখন তাঁর বয়স দাঁড়ায় ৭০ বছর; কিন্তু এত বেশি বয়সে কি ইংরেজ সরকার কখনও কাউকে চাকরিতে নিতে পারে? অর্থাৎ মন্দির প্রতিষ্ঠার তারিখে যে কোনো ভুল আছে এটাই স্বাভাবিক। তবে বর্তমানে আমরা এটাই অনুমান করতে পারি যে এই মন্দির সপ্তদশ থেকে অষ্টাদশ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই নির্মাণ হয়। বর্তমানে যদিও মন্দিরটি “মানব বিকাশ ট্রাস্ট” সংস্থা দ্বারা পরিচালিত।

বানেশ্বর শিবমন্দিরঃ-


উত্তর কলকাতার কুমোরটুলি অঞ্চলের ২/৫ বনমালী সরকার ষ্ট্রীটে অবস্থিত বানেশ্বর শিবমন্দির সম্ভবত কলকাতার একমাত্র টেরাকোটা মন্দির বর্তমানে যেখানে কিছুটা হলেও টেরাকোটার ফলক খুঁজে পাওয়া যাবে। তবে দুঃখের বিষয় এই যে বর্তমানে মন্দিরের অবস্থা এতটাই খারাপ যে শীঘ্রই তা সংস্কার না করা হলে মন্দিরের কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না।
বানেশ্বর শিবমন্দির
বানেশ্বর শিবমন্দির তৈরি করেন বনমালী সরকার। কিন্তু কবে এই মন্দির তৈরি হয় সে বিষয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায় নি, এমনকি মন্দিরের দেওয়ালেও মন্দির প্রতিষ্ঠার কোনো ফলক নেই। মন্দিরটি আছেও এক অদ্ভুত যায়গায় পথচলতি লোকজনের চোখের আড়ালে। তবে অদ্ভুত বলা ভুল কারণ মন্দিরটি তৈরি হয়েছে অনেককাল আগেই, কিন্তু পরবর্তীকালে ঘরবাড়ি-দোকানপাট এমনভাবে তৈরি হয় যা মন্দিরকে চোখের আড়াল করে দেয়। সম্প্রতি কলকাতা পৌর সংস্থা মন্দিরের সামনেই  প্রসাধন (ওপেন টয়লেট) তৈরি করে। ফলে এতকিছুর মাঝেও কোনক্রমে মাথা তুলে আছে জীর্ণ এই শিবমন্দির। 
ঘরবাড়ি ও গাছের আড়ালে বানেশ্বর শিবমন্দির
আমাদের দুই মন্দিরের মত বানেশ্বর মন্দিরও আটচালা বিশিষ্ট। প্রায় ৩৫ ফুট উঁচু এই মন্দির দৈর্ঘ্যে ২২ ফুট ও প্রস্থে ১৯.৫ ফুট। মন্দিরের প্রবেশপথ তিনটি উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে, কিন্তু বহুকাল আগেই দক্ষিণ দিকের প্রবেশপথ ছাড়া উত্তর ও পূর্বদিকের প্রবেশপথগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করা প্রায় অসম্ভব, কারণ বেশিরভাগ সময়ই তা বন্ধ থাকে। যদিও দরজা বলতে শধুমাত্র লোহার গ্রিল, তাই মন্দিরের ভিতরের চিত্র অনায়াসেই দেখতে পাওয়া যায়। মন্দিরের অবস্থা এতটাই সংকটজনক তার অন্যতম সাক্ষী ভিতরের নোনা ও ড্যাম্প ধরা দেওয়াল। পূর্বে মন্দিরের দেওয়ালে যে কি রঙ ব্যবহার হয়েছিল তাও আর এখন জানা যায় না। ক্রমাগত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মন্দিরের চাতালও ভিজে (ড্যাম্প) এমনকি কিছু কিছু জায়গায় শ্যাওলাও সৃষ্টি হয়েছে। তবে এসবের মাঝেই বিরাজ করছে প্রায় তিনফুট উচ্চতা বিশিষ্ট কষ্টিপাথরের তৈরি শিবলিঙ্গ। তবে শিবলিঙ্গের নিচেই  রয়েছে এক ভাঙা ইটের খণ্ড যা সম্ভবত শিবলিঙ্গকে ভেঙে পড়া থেকে রক্ষা করে। আমাদের তিন মন্দিরের মধ্যে একমাত্র এই মন্দিরে কিছুটা হলেও টেরাকোটার ফলক দেখতে পাওয়া যায়, তবে তা এতটাই সামান্য যে খুঁজে পেতে অসুবিধে হবেই। কারণ মন্দিরের উপরের অংশে বিভিন্ন গাছপালা সৃষ্টি হওয়ার ফলে তার ঝুড়ি ও শাখাপ্রশাখা পুরো মন্দিরটাকেই ঢেকে ফেলেছে। 
বানেশ্বর শিবমন্দিরের কষ্টিপাথরের তৈরি শিবলিঙ্গ
বনমালী সরকার, যার নামে এই রাস্তার নামকরণ। এই বনমালী সরকার ছিলেন বিহারের পাটনার দেওয়ান যিনি পরবর্তীকালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডেপুটি ট্রেডার পদে নিযুক্ত হন। বর্তমানে আমরা যেটা কুমোরটুলি বলে জানি ঠিক সেখানেই তিনি তৈরি করেন প্রাসাদ প্রমান বাড়ি। যার উল্লেখ পাই উপরের ওই ছড়াটাতেই – ‘বনমালি সরকারের বাড়ি, / নন্দরামের ছড়ি......’ । শোনা যায় এই বাড়ি তৈরি করতে সময় লেগেছিল প্রায় ১০ বছর। কিন্তু পরবর্তীকালে সময়ের সাথে সাথে বনমালী সরকার ও তার দুই ভাইয়ের উত্তরাধিকার না থাকায় হারিয়ে যায় সে সব সম্পত্তি। তবে বর্তমানে শুধুমাত্র থেকে গেছে তাঁর তৈরি এই বানেশ্বর মন্দির ও তাঁর নামে কুমোরটুলির রাস্তা বনমালী সরকার স্ট্রীট।
বানেশ্বর শিবমন্দিরের দেওয়ালে বেঁচে থাকা কিছু টেরাকোটার ফলক

কীভাবে যাবেনঃ-

রামেশ্বর শিবমন্দির পেড়িয়ে রবীন্দ্র সরণী দিয়ে বনমালী সরকার স্ট্রিটে (কুমোরটুলি) প্রবেশ করলে শেষপ্রান্তে এই রাস্তাটি বামদিকে বেঁকেছে, কিছুটা যাওয়ার পর রাস্তাটি আবার যখন দুভাগে বিভক্ত হচ্ছে ঠিক সেই মোড়ে ডানদিকে লক্ষ্য করলে দেখতে পাওয়া যাবে এই বানেশ্বর শিবমন্দির।

তথ্যসুত্রঃ-

  • কলকাতার মন্দির স্থাপত্য – তারাপদ সাঁতরা (কলকাতার পুরাকথা – দেবাশিষ বসু সম্পাদিত)
  • এই কলকাতায় – বিদ্যুৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
  • কলিকাতা সেকালের ও একালের – হরিসাধন মুখোপাধ্যায়
  • Wanderlust Blog

Comments