মেটক্যাফে হল.... ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরী থেকে কলকাতার অডিও ভিসুয়াল মিউজিয়াম । METCALFE HALL.... from IMPERIAL LIBRARY to KOLKATA MUSEUM

স্যার চার্লস থিওফিলাস মেটক্যাফে, গভর্নর জেনারেল থেকে ভারতীয় গণমাধ্যমের মুক্তিদাতা; যাকে উৎসর্গ করে ব্রিটিশ সরকার গঠন করে মেটক্যাফে হলযেখানে গড়ে উঠেছিল কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরী আবার এইসবেরও পরে দীর্ঘ ৫৯ বছর পর এই প্রাসাদতুল্য বাড়িটিতেই লর্ড কার্জন তৈরি করে ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরী যুগের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রায় ১৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে এই ব্রিটিশ স্থাপত্য। বর্তমান সময় দাঁড়িয়ে এই মেটক্যাফে হল কিন্তু কলকাতার অন্যতম দ্রষ্টব্য স্থান। আমি কলকাতা এই নাম নিয়েই ২০১৯ সালে কলকাতার মুকুটে যুক্ত হল আর এক নতুন মিউজিয়াম, অডিও ভিস্যুয়াল মিউজিয়াম। কিন্তু কীভাবে সময়ের সঙ্গে এই মেটক্যাফে হল লাইব্রেরী থেকে মিউজিয়ামে রূপান্তর হল সেই নিয়েই আজকের এই ব্লগ।

স্যার চার্লস থিওফিলাস মেটক্যাফেঃ-

১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার গভর্নর জেনারেল হিসাবে যখন লর্ড বেন্টিঙ্কের সময়কাল শেষ হয় তখন স্যার চার্লস মেটক্যাফে সেই পদে নিযুক্ত হন। ১৮৩৫ থেকে ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দ, এই স্বল্প মেয়াদের জন্যই চার্লস মেটক্যাফে ছিলেন ভারতের গভর্নর জেনারেল। কারণ পরবর্তীকালে ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দে গভর্নর জেনারেল হিসাবে ভারতে আসেন লর্ড অকল্যান্ড তবে শুধুমাত্র গভর্নর জেনারেল নয়, ভারতের সাংবাদিকতার ইতিহাসে স্যার চার্লস মেটক্যাফের নাম স্মরণীয় হয়ে আছে আর এক কারণেভারতীয় গণমাধ্যমের মুক্তিদাতা। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ভারতীয় প্রেসগুলির (সাংবাদিকতা) উপর তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন বিধিনিষেধ চাপাতে শুরু করে নির্দেশ অনুযায়ী যারা এই সমস্থ আদেশ মানতে অস্বীকার করবে তাদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে দেওয়া হবে। বোঝাই যাচ্ছে সময়টা কতটা ভয়ঙ্কর; একে ভারতের স্বাধীনতা ব্রিটিশদের হাতে, তার উপর সাংবাদিকতায় এই বিধিনিষেধ। যার ফলে ধীরে ধীরে ভারতীয় সাংবাদিকতার স্বাধীনতা হ্রাস পেতে থাকে। একটি দেশের পক্ষে তার সাংবাদিকতাকে স্বাধীনতা না দেওয়ার ফল কি হতে পারে তা ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা মিলবে। প্রেসের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের এই নিয়মনীতি প্রায় ত্রিশ বছর চলতে থাকে। এদিকে ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে যখন স্যার চার্লস মেটক্যাফে গভর্নর জেনারেল হিসাবে নিযুক্ত হন, তখন বিভিন্ন ভারতীয় ও ইউরোপীয় সাংবাদিকরা ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাদের বক্তব্য একটাই, সাংবাদিকতার প্রতি ব্রিটিশ সরকারের এই নিয়ম তুলে নিতে হবে। যার ভিত্তিতে মেটক্যাফের কাছে তারা দরখাস্তুও জানান।  এর পরিপেক্ষিতেই তখন চার্লস মেটক্যাফে বেশ কিছু বিধিনিষেধ বাতিল করেন। কারণ স্যার মেটক্যাফে বুঝেছিলেন এত নিয়মনীতি কোনো দেশেরই গণমাধ্যমের উপর চাপানো উচিত নয়। এই কাজের ভিত্তিতেই ভারতের ইতিহাসে তিনি গণমাধ্যমের মুক্তিদাতা রূপে প্রকাশ পান।

মেটক্যাফে হলঃ-

গণমাধ্যমে এই যুগান্তকারী স্বাধীনতা ও গভর্নর জেনারেল হিসাবে চার্লস মেটক্যাফের স্মৃতিরক্ষার্থে ব্রিটিশ সরকার এক সাধারণ গ্রন্থাগার (লাইব্রেরী) প্রতিষ্ঠার উদ্যোগী হলেন এই কাজ সম্পন্ন করার জন্য ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে গঠন করা হল এক কমিটি গ্রন্থাগার তৈরির জন্য জায়গা হিসাবে নির্বাচিত হল হেয়ার স্ট্রীট ও স্ট্র্যান্ড রোডের সংযোগ স্থলের একটি জমি, যেখানে রয়েছে একটি বাড়ি। এই বাড়িটি অভিজাত বাঙালি হরিনারায়ণ শেঠের বাড়ি, যিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে দীর্ঘদিন ব্যবসা করে এসেছেনতাঁর এই বাসস্থানটি পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকার নাবিকদের বাড়ি হিসাবে ব্যবহৃত হত। যেখানে গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন নিঃস্ব নাবিকদের আশ্রমস্থল। কিন্তু সেই জায়গায় মেটক্যাফে হলের নির্মাণকার্য শুরু হওয়ায় সেই আশ্রম স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে যেখানে রেলিস ব্রাদার্স বিল্ডিং, সেই জায়াগতেই উঠে এসেছিল এই নাবিকদের আশ্রম

মেটক্যাফে হলের পূর্বদিকের অংশ

১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ শে ডিসেম্বর শুরু হল মেটক্যাফে হলের নির্মাণকার্য। প্রাচীন গ্রীক স্থাপত্য টাওয়ার অফ দ্যা উইন্ডস এর অনুকরণে বাড়িটির আর্কিটেকচার পরিকল্পনা করলেন স্যার চার্লস নলেস রবিনসন। প্রাসাদপ্রমাণ এই বাড়িটি নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন সেসময়কার বিখ্যাত নির্মাতা মেসার্স বার্ন এন্ড কোপানি। দীর্ঘ ৪ বছর পর ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে সম্পূর্ণ হল মেটক্যাফে হলের নির্মাণকার্য। মাটি থেকে প্রায় ৫০ ফুট উঁচু এই মেটক্যাফে হল গড়ে উঠল ১০ ফুট উঁচু এক শক্ত ভিত্তির উপর। যার উপরে প্রায় ৩৬ ফুট উচ্চতার ৩০ টি কোরিন্থিয়ান বৃহদায়তন স্তম্ভ ধরে রইল সমস্ত হল টিকে। 

মেটক্যাফে হলের দক্ষিণদিকের অংশ

মেটক্যাফে হলের পূর্বদিকের অংশের ঢাকা বারান্দা

পূর্বদিকের অংশে আটটি ও পশ্চিমদিকের অংশে দশটি স্তম্ভ এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকের অংশে ছয়টি করে মোট বারটি টি স্তম্ভ রয়েছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে প্রতিটি স্তম্ভের শীর্ষস্থানের গঠন অনেকটা একটি গুঁড়ি থেকে সারি সারি হিসাবে বের হওয়া অসংখ্য খেঁজুড় পাতা ছড়ানো এরকম শিল্পকলা উনিশের দশকের ইউরোপিয়ান ঘরগুলিতে প্রায়শই দেখতে পাওয়া যেত। মেটক্যাফে হলের প্রবেশপথ দুটি পূর্ব ও পশ্চিমদিকে। কিন্তু মেটাকাফে হল প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে প্রধান প্রবেশপথ হিসাবে ব্যবহার হত পশ্চিমদিকের অংশ। মাটি থেকে হলের প্রবেশপথ অনেকটা উপরে হওয়ায়, হলে প্রবেশের জন্য গঠন করা হয়েছে এক প্রকাণ্ড সিঁড়ি। কিন্তু পরবর্তীকালে প্রবেশের জন্য পশ্চিমদিকের পরিবর্তে হলের পূর্বদিকের বারান্দা দিয়ে প্রবেশ করা হয়যেখানে পশ্চিমদিকের মতোই তৈরি করা হয়েছে প্রকাণ্ড সিঁড়ি

মেটক্যাফে হলের পূর্বদিকের প্রবেশপথ (যা বর্তমানে বন্ধ)

টাওয়ার অফ দ্যা উইন্ডস এই গ্রীক স্থাপত্যের সঙ্গে মেটক্যাফে হলের স্থাপত্য নিয়ে রয়েছে এক ধন্দ। টাওয়ার অফ দ্যা উইন্ডস, এই বিষয়টির উপর যদি ইন্টারনেটে খোঁজা যায় তাহলে যে স্থাপত্যের ছবিটি সামনে আসবে তা কোনো অংশেই মেটাক্যাফে হলের স্থাপত্যের সঙ্গে মেলে না; বরং আর একটি গ্রীক স্থাপত্য টেম্পল অফ অলিম্পিয়ান জিউস এর স্তম্ভগুলির সঙ্গে কিছুটা মিল পাওয়া যায়। 

'টাওয়ার অফ দ্যা উইন্ডস' ও 'টেম্পল অফ অলিম্পিয়ান জিউস'

তাহলে? আসলে মেটাকাফে হলের স্থাপত্যের ব্যাপারে জানতে গেলে আমাদের জানতে হবে গ্রীক স্থাপত্যর একটি দিক। সাধারণত এই গ্রীক স্থাপত্য টাওয়ার অফ দ্যা উইন্ডস সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ২০৫০ বছর আগে গ্রীক কোরিন্থিয়ান শৃঙ্খল মেনে। অন্যদিকে টেম্পল অফ অলিম্পিয়ান জিউস সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ২৫০০ বছর আগে ওই একই শৃঙ্খল মেনে। এই গ্রীক কোরিন্থিয়ান শৃঙ্খলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল স্তম্ভের একদম শীর্ষস্থানের নির্মাণ কৌশল, যা পরবর্তীকালে গ্রীস এবং এথেন্সের সমস্ত স্থাপত্যেই দেখতে পাওয়া যায়। আর আমাদের এই মেটক্যাফে হল তৈরি হয়েছে শুধুমাত্র এই গ্রীক কোরিন্থিয়ান শৃঙ্খল অনুযায়ী।

গ্রীক কোরিন্থিয়ান শৃঙ্খলের অনুকরণে মেটক্যাফে হলের স্তম্ভ

ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরী থেকে ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরিঃ-

মেটক্যাফে হল প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য হল কলকাতার বুকে এক লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করা। মেটক্যাফে হল তৈরি হওয়ারও আগে ১৩ নং এসপ্ল্যানেড রোডে ডঃ এফ. পি. স্ট্রং নামে এক সাহেবের বাড়িতে কলকাতার প্রথম লাইব্রেরী ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরী গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে জুলাই মাসে সে লাইব্রেরী স্থানান্তরিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লিয়ন্স রেঞ্জে। দীর্ঘ ৩ বছর ধরে সেখান থেকেই লাইব্রেরী পরিচালনা হয়ে আসছিল। কলকাতার প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন এই লাইব্রেরীর প্রথম মুখ্যসচিব। কিন্তু ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে মেটক্যাফে হল তৈরি হওয়ায়, ফোর্ট উইলিয়াম থেকে সেই লাইব্রেরী উঠে আসে মেটক্যাফে হলে। স্যার চার্লস মেটক্যাফে স্বয়ং নিজে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে প্রায় ৪,৬৭৫ টি খণ্ড নিয়ে আসেন মেটক্যাফে হলে। তৈরি হওয়ার পর মেটক্যাফে হলে মোটামুটি দুটি কার্য চলতে থাকে, হলের নীচের অংশে অর্থাৎ গ্রাউন্ড ফ্লোরে গড়ে ওঠে অ্যাগ্রি-হরটিকালচারাল সোসাইটি ও উপরের অংশে ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরী। এভাবেই মেটক্যাফে হল রূপান্তর হয় ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরী তে। লাইব্রেরী পরিচালনার দায়িত্বে ছিল বিভিন্ন ট্রাস্ট। প্রায় ৫০ বছর ধরে চলেছিল এই পাবলিক লাইব্রেরী।

১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দের মেটক্যাফে হল - ('ভিউস অফ ক্যালকাটা অ্যান্ড সারাউন্ডিং ডিসট্রিক্ট' - ফ্রেড্রিক ফিবিক)

পরবর্তী ঘটনা ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দ, কলকাতার কিছু দপ্তরের অধীনে থাকা লাইব্রেরী গুলিকে নিয়ে জন্ম হল এক নতুন লাইব্রেরী ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরী। এদিকে দীর্ঘকাল ধরে মেটক্যাফে হল থেকে পরিচালনা হলেও শেষের দিকে ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরী সেরকমভাবে জনসাধারণকে আকৃষ্ট করতে পারল না। আর এখান থেকেই মেটক্যাফে হলে সূত্রপাত হল ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরীর যাত্রাপথ। আর এই উদ্যোগটি বাস্তবায়িত করলেন বড়লাট লর্ড কার্জন। কীভাবে ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরী থেকে ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরী গঠন হল তার সম্পূর্ণ ব্যখ্যা পাওয়া গেল তাঁর বক্তৃতায়। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ শে জানুয়ারি, ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরী উদ্বোধনের সময় তিনি যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তার সারাংশ এই চার বছর আগে আমি যখন কলকাতায় আসি, তখন আমার মনে সমস্ত সরকারী অফিস ও কার্যালয়ে ব্যবহৃত ভবন গুলি দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করি। আমি শুনেছিলাম এই কলকাতাতেই মেটক্যাফে হল নামে এক সুবৃহৎ ভবন রয়েছে, যার মধ্যে গড়ে উঠেছে ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরী। একদিন আমি সেই লাইব্রেরী দেখতে যাই। লাইব্রেরীর প্রথম তলায় আমার চোখে পড়ে অ্যাগ্রি-হরটি কালচারাল সোসাইটির কার্যালয়, যার অবস্থা মোটামুটি ভালোই। এরপর আমি যাই ভবনের উপরের তলায় যেখানে ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরী অবস্থিত। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে ওঠার পর যা দেখলাম তা অত্যন্তই শোচনীয়। লাইব্রেরীর পাঠকের সংখ্যা খুবই কম, বেশিরভাগ বই হয় বাঁধানো অবস্থায় নেই, না হলে ছিঁড়ে গেছে। ঘরের চারিদিকে পায়রার বসবাস এবং তার মলমূত্রাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সমস্ত ঘর জুড়ে। এরপর আমি একদিন যাই গভর্নমেন্টর হোম ডিপার্টমেন্টের লাইব্রেরীটিতে, যা ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরী নামে পরিচিত। এই লাইব্রেরী ভারত সারকারের নিজস্ব সম্পত্তি। কেবলমাত্র উচ্চপদস্থ কর্মী ছাড়া সাধারণ জনগণ এই লাইব্রেরী ব্যবহার করতে পারে না। এই সব দেখে আমার মনে হয় কলকাতার এই লাইব্রেরী গুলিকে সংযুক্ত করে এমন এক লাইব্রেরী তৈরি করা উচিত যা সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে হবে, যেখানে সবাই প্রবেশ করতে পারবে, যা ব্রিটিশ সরকারের তৈরি কলকাতার অন্যতম লাইব্রেরী হবে। এবিষয়ে আমি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে, বর্তমান মেটক্যাফে হলের অ্যাগ্রি-হরটি কালচারাল সোসাইটির পরিষদ ও পাবলিক লাইব্রেরীর বিভিন্ন শেয়ারহোল্ডারদের সাথে মেটক্যাফে হলটি ক্রয় করার প্রস্তাব রাখি। এই প্রস্তাবে দুই পক্ষই সম্মতি দিলে ভারত সরকার একটি আইন পাশ করে, যার দ্বারা এই মেটক্যাফে হল ভারত সরকারের সম্পত্তি হিসাবে ঘোষিত হয়।

১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরী

এককালীন ২৮,০০০ টাকা ও বছরে ৬০০০ টাকা অনুদান হিসাবে অ্যাগ্রি-হরটি কালচারাল সোসাইটির শেয়ার কিনে নেওয়া হল। যার ফলে হলের সমগ্র অংশ জুড়েই তৈরি করা যাবে ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরী।মেটক্যাফে হলের পুরো দায়িত্ব পাওয়ার পর হলটি নতুন করে সাজিয়ে তোলা হল। হলের কোনরূপ পরিবর্তন না করেই তার পুরনো রূপই নতুন করে ফিরিয়ে দেওয়া হল। লাইব্রেরী দেখাশোনার জন্য লন্ডন থেকে আনা হল অধ্যক্ষ। গভর্নমেন্ট লাইব্রেরী থেকে সমস্ত বই নিয়ে আসা হল ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরীতে। এভাবেই মেটক্যাফে হলে সৃষ্টি হল ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরী। সেই সময়ের তথ্য অনুযায়ী ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরীতে প্রায় এক লক্ষেরও বেশি বই ছিল। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের তথ্য অনুযায়ী সেই সময়ে ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরীর পাঠক সংখ্যা ছিল ৩০,২৬৯ এবং এই সংখ্যাটি দিনে প্রায় একশো করে বাড়তে থাকে। এইভাবেই প্রায় পঞ্চাশ বছর মেটক্যাফে হলেই চলেছিল ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরী।

কিন্তু স্বাধীনতার পর ভারত সরকার ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরীর নাম পরিবর্তন করে রাখলেন ন্যাশনাল লাইব্রেরী এবং মেটক্যাফে হল থেকে সমস্ত বই স্থানান্তর করে আনা হল বর্তমান বেলভেদিয়ার এস্টেটে (আলিপুর),  যেখানে ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ১ লা ফেব্রুয়ারি জনসাধারণের জন্য প্রকাশ পেল ন্যাশনাল লাইব্রেরী

পরবর্তীকালে ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরী উঠে গেলে মেটক্যাফে হলের প্রথম তলায় গড়ে ওঠে এশিয়াটিক সোসাইটির বিভিন্ন ফরেন জার্নাল ও পাণ্ডুলিপির বিভাগ এবং হলের দ্বিতীয় তলায় গড়ে ওঠে বিভিন্ন প্রদর্শনী ও আরকিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার বিক্রয় কেন্দ্র।

আমি কলকাতা কলকাতার অডিও ভিজ্যুয়াল মিউজিয়ামঃ-

সম্প্রতি ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে ভারত সরকার এই মেটক্যাফে হলটিকে নতুনরূপে মিউজিয়ামে পরিবর্তন করে। আমি কলকাতা এই নাম নিয়েই মেটক্যাফে হলে সৃষ্টি হয় আধুনিক মিউজিয়াম, যা কলকাতার মধ্যে সর্বপ্রথম অডিও ভিজ্যুয়াল মিউজিয়াম। 

ছায়াবাজির চলচিত্র
কলকাতার ঐতিহ্য টানা রিকশা

সমগ্র মেটক্যাফে হল জুড়েই গড়ে উঠেছে এই মিউজিয়াম। হলের প্রতিটি ঘরেই তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন প্রদর্শনী। যেমন- হলের প্রথমেই প্রবেশের পর দেখতে পাওয়া যাবে বিভিন্ন ভারতীয় সিনেমা জগতের পোস্টার। এরপর ডানদিকের একটি ঘরে বিভিন্ন চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে মেটক্যাফে হলের বিবর্তন। এরপর থেকে হলের যত ভিতরে প্রবেশ করা যাবে ততই বিভিন্ন ধারার প্রদর্শনীর সম্মুখীন হবে।

দেয়য়ালে টাঙানো বিভিন্ন সিনেমার পোস্টার ১

দেয়য়ালে টাঙানো বিভিন্ন সিনেমার পোস্টার ২

কলকাতা হগ মার্কেট (এখন যা নিউ মার্কেট হিসাবে পরিচিত)

সিটি অফ সারপ্রাইসেস  হলের প্রথম তলায়, যেখানে অসম্ভব সুন্দর এক হাতের ছায়াবাজি চলচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে কলকাতাকে।

সিটি অফ মেমোরিস হলের উপরের তলায় যাওয়ার সিঁড়ি, যেখানে দেয়ালের গায়ে তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন সিনেমার পোস্টার যা শৈশবের স্মৃতিকে একবার নাড়াচাড়া করাতে বাধ্য। এছাড়াও সিঁড়িতে ওঠার মুখেই রয়েছে এক টানা রিকশা, যাতে কলকাতাকে উল্লেখ করে রয়েছে বিভিন্ন ভালোবাসার মন্তব্য। চাইলে আপনিও নিজের মন্তব্য লিখে রাখতে পারেন।

বাংলার নৌকা

প্রদর্শনী - কলকাতার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষজন

সিটি অফ স্টোরিস হলের উপরের তলার প্রথম অংশ, যেখানে রয়েছে এক বিরাট কাঠের নৌকা। বাংলার নৌকা, যা বাংলার প্রাচীন যোগাযোগ ব্যবস্থা। নৌকার উপরের অংশে রয়েছে ডিজিটাল স্ক্রীন, যার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে কলকাতার বিভিন্ন ইতিহাস; সঙ্গে রয়েছে ভেসে যাওয়া নৌকার জলের ঢেউয়ের শব্দ।

সিটি অফ ইনফ্লুয়েন্স পরবর্তী ঘরটিতে তুলে ধরা হয়েছে বাংলার বিভিন্ন মনিষীদের। রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু -র প্রবাদ ও প্রদর্শনী।

সিটি অফ কনফ্লুয়েন্স হলের এই ঘরটিতে মুলত বিভিন্ন ছবির প্রদর্শনী। যার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে কলকাতার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, চিনা, ইহুদি, আর্মেনিয়া এমনকি ভারতীয়। 

টোপর - বাংলার বিয়ের অন্যতম প্রতীক

পটচিত্রে কলকাতা ও বাঙালী

সিটি অফ সেলিব্রেশন হলের এই ঘরটিতে তুলে ধরা হয়েছে কলকাতার উৎসব। কলকাতার প্রধান উৎসব দুর্গাপুজো, সেই মুহূর্তকে সাক্ষী রেখেই এখানে রয়েছে মাটির তৈরি প্রায় আধাসমাপ্ত দেবী দুর্গার মূর্তি। এর ঠিক পাশের অংশে রয়েছে এক বিশাল টোপর যা বাঙালী বিবাহের অন্যতম প্রতীক। হলের এই অংশে রয়েছে আরও একটি তত্থ্যচিত্র, ঢাক যা বাংলার অন্যতম বাদ্যযন্ত্র, তার উপর ভিত্তি করেই তথ্যচিত্র।

সিটি অফ কালচার হলের সর্বশেষ এক বিরাট অংশে গড়ে উঠেছে এই প্রদর্শনী। যেখানে রয়েছে বিভিন্ন পটচিত্র। কলকাতার স্ট্রীট ফুড থেকে মাছের বাজার, বাঙালির মিষ্টি থেকে বাবুয়ানা, হাতে টানা রিকশা থেকে হলুদ ট্যাক্সি সমস্তটাই তুলে ধরা হয়েছে পটচিত্রের আদলে। এছাড়াও হলের চতুর্দিকে রয়েছে বিভিন্ন অডিও ভিজ্যুয়াল যন্ত্রপাতি, টাইপরাইটার, গ্রামোফোন, বায়স্কোপ আরও অনেক। হলের এই অংশটিতে রয়েছে এক আনুষ্ঠানিক মঞ্চ। সাধারণত কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রদর্শনীতে ব্যবহার করা হয় এই মঞ্চ।

বিভিন্ন ছবির প্রদর্শনী ১

বিভিন্ন ছবির প্রদর্শনী ২

বায়স্কোপ, টাইপরাইটার, গ্রামোফোন

এই হল মেটক্যাফে হলের বর্তমান মিউজিয়াম। এক কথায় যদি জিজ্ঞেস করা হয়, কি আছে এই মিউজিয়ামে? তাহলে বলব কলকাতার অতীত, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সাহিত্য, আড্ডা, উৎসব, বাঙালিয়ানা এমনকি বর্তমান সবকিছুকে নিয়ে গড়ে উঠেছে মেটক্যাফে হলের এই মিউজিয়াম আমি কলকাতা। এছাড়াও মেটক্যাফে হলের সামনেই গড়ে উঠেছে কলকাতার আর এক মিউজিয়াম কারেন্সি বিল্ডিং-এর ঘরে বাইরেমিউজিয়াম

******************************************************

লেখা, গবেষণা ও ছবি - প্রীতম নস্কর  

ই-মেল - pritamnaskar.pn@gmail.com

ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে ব্লগের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, তবে পূর্বানুমতি ছাড়া আমার তোলা আলোকচিত্রগুলি এবং ব্লগের রচনাগুলি অন্য কোথাও কপি-পেস্ট বা বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করা চলবে না।

******************************************************

মিউজিয়াম প্রবেশের সময়সূচী ও টিকিট মূল্যঃ- 

  • বছরের সমস্ত দিন, শুধুমাত্র সপ্তাহের সোমবার ও জাতীয় ছুটির দিন বাদ দিয়ে সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৫ টা (গ্রীষ্মকালে বিকাল ৬ টা) পর্যন্ত এই মিউজিয়াম খোলা থাকে।
  • প্রবেশমূল্য ২০/- টাকা। যা আপনি অনলাইনেও কাটতে পারেন। আরকিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ওয়েবসাইট থেকে অনলাইন টিকিট কাটার জন্য এখানে ক্লিক করন
  • মিউজিয়ামের ভিতরে ফটো তোলার ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।

কীভাবে যাবেনঃ-

মেটাক্যাফে হল গড়ে উঠেছে হেয়ার স্ট্রীট ও স্ট্র্যান্ড রোডের সংযোগস্থলে, অর্থাৎ দুটি রাস্তা যেখানে যুক্ত হয়েছে ঠিক সেই মোড়টিতেই দেখা যাবে প্রাসাদপ্রমাণ এই মেটক্যাফে হল। এই মিউজিয়াম খুঁজে পাওয়ার সবথেকে সোজা উপায় হল কলকাতার মিলিনিয়াম পার্ক। মিলিনিয়াম পার্কের ঠিক বিপরীতেই ডানদিকের মোড়ে অবস্থিত মেটক্যাফে হল।

গুগল ম্যাপ / কোঅরডিনেটঃ-

22.57169, 88.34451

কলকাতার আরও কিছু মিউজিয়ামঃ-

তথ্যসূত্রঃ-

  • Calcutta Old And New - by H.E.A. Cotton
  • Hand Book to Calcutta - by W. Newman & Co. (Third Edition)
  • কলিকাতা সেকালের ও একালের - হরিসাধন মুখোপাধ্যায়
  • Greek Architecture - by World History Encyclopedia

Comments