অ্যালাইন্স ব্যাংক অফ সিমলা...... রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া মিউজিয়াম Alliance Bank of Simla….Reserve Bank of India Museum

আচ্ছা আপনি কি জানেন মুদ্রা আবিষ্কারের আগে মানুষ কীভাবে বেচাকেনা করত? 

হ্যাঁ! কীভাবে বেচাকেনা করত তা হয়তো জানেন কিন্তু বিনিময়য়ের জন্য কি কি ব্যবহার হত? বা ধরুন পৃথিবীর প্রথম মুদ্রা কি? এই যে এখন প্রতিনিয়ত টাকা-পয়সা ছাপা হচ্ছে এর পেছনে কি কি যন্ত্রপাতি কাজ করে চলেছে? আবার ধরুন আপনার দীর্ঘদিনের ইচ্ছা একটি সোনার বার কত ওজন হতে পারে তা নিজেই পরখ করে দেখতে চান... কিন্তু উপায়? - তাহলে এইসব প্রশ্ন আর কৌতূহল নিবারণের জন্য আপনাকে অবশ্যই ঘুরে আসতে হবে কলকাতার আর এক মিউজিয়াম আর.বি.আই. (রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া) মিউজিয়াম। ডালহৌসি স্কোয়ারের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে হংকং হাউসের পিছনদিকে কাউন্সিল হাউস স্ট্রীটে গড়ে ওঠা ব্রিটিশ স্থাপত্যের আর এক নিদর্শন, যেখানে গড়ে উঠেছিল অ্যালাইন্স ব্যাংক অফ সিমলা... ব্রিটিশ পরিচালিত ব্যাংক ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে গড়ে ওঠা অ্যালাইন্স ব্যাংক অফ সিমলা-র কলকাতার দপ্তর, যা পরবর্তীকালে হস্তান্তরিত হয় ইম্পেরিয়াল ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া-র কাছে, যা ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। আর এই ভবনই ছিল রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার প্রধান কার্যালয়। তবে স্বাধীনতার পর ডালহৌসি স্কোয়ারের উত্তর-পশ্চিম কোণে আর.বি.আই. তাদের প্রাসাদতুল্য ভবন নির্মাণ করলে ব্যাংক তাদের পুরনো ভবন ছেড়ে চলে আসে নতুন ভবনে। তবে সম্প্রতি ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে আর.বি.আই. তাদের ডালহৌসি স্কোয়ারের পুরনো ভবনের নিচের অংশে গড়ে তোলে মিউজিয়াম, যা পরিচিত আর.বি.আই. মিউজিয়াম নামে।

অ্যালাইন্স ব্যাংক অফ সিমলা...... রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া মিউজিয়াম Alliance Bank of Simla….Reserve Bank of India Museum

অ্যালাইন্স ব্যাংক অফ সিমলা

১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে ভারত নিবন্ধিত অ্যালাইন্স ব্যাংক অফ সিমলা প্রতিষ্ঠা করেন স্যার জেমস লুইস ওয়াকার। মূলত ব্রিটিশ পরিচালিত এই ব্যাংক প্রথম গড়ে ওঠে সিমলায়, তাই এই নামকরণ। ব্রিটিশ পরিচালিত হলেও অ্যালাইন্স ব্যাংক অফ সিমলা ছিল ভারত নিবন্ধিত, মূলত ১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ইউনাইটেড ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার ব্যবসা দখল করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এমনকি ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লি অ্যান্ড লন্ডন ব্যাংক লিমিটেড এবং দ্যা পাঞ্জাব ব্যাংকিং কোম্পানি একত্রীকরণ হয়ে যায় অ্যালাইন্স ব্যাংক অফ সিমলা-র সাথেএছাড়াও সময়ের সাথে সাথে অ্যালাইন্স ব্যাংক আরও কয়েকটি ব্যাংককে নিজের দখল করে নেয়, যেমন ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্যাংক অফ আপার ইন্ডিয়া ও ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্যাংক অফ রাঙ্গুন।

১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দের অ্যালাইন্স ব্যাংক অফ সিমলা বর্তমানে ৮ নং কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটে তাদের কলকাতা শাখা উদ্বোধন করে আর ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে সিমলা থেকে ব্যাংকের সদর দফতর চলে আসে কলকাতার এই ভবনটিতে। ব্যাংকের এই কলকাতার ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন স্যার রাজেন মুখার্জীর প্রতিষ্ঠান মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি (যেখানে স্যার টমাস অ্যাকুইন মার্টিন ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের অংশীদার)। আর এই মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি কলকাতার বিশেষ করে ডালহৌসি চত্বরের অধিকাংশ ঐতিহ্যবাহী (হেরিটেজ) ইমারতগুলি নির্মাণ করে, যার মধ্যে রয়েছে হংকং হাউস, চ্যাটার্ড ব্যাংকতবে কলকাতার বুকে মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি-র উল্লেখযোগ্য নির্মাণ হল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ও হাওড়ার বেলুড় মঠ মন্দির

মিউজিয়ামের প্রবেশদ্বার

সিমলায় থাকাকালীনই অ্যালাইন্স ব্যাংকের অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। অতিরিক্ত লোভ আর অব্যবস্থাপনার ফলে ব্যাংক একপ্রকার বন্ধের সম্মুখীন হয়। আর ঠিক এই জন্যেই ব্যাংকের ভবিষ্যৎ পুনর্জীবিত করতে ১৯২২ সালের ১৫ ই অক্টোবর সিমলা থেকে ব্যাংকের সদর দফতর চলে আসে কলকাতায়কিন্তু এখানে আসার পরও অ্যালাইন্স ব্যাংকের অবনতি ঘটতে থাকে। ব্যাংকের অন্যতম বিনিয়োগকারী বোল্টন ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড (যে কিনা সিমলা ব্যাংকের অন্যতম অর্থায়ন বা ফিন্যান্স) জালিয়াতি ও তছরুপের অভিযোগে ব্যবসার অর্থ ব্যাংক-কে ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়। যার প্রভাবে ব্যাংকের নগদ অর্থ শেষ হয়ে যাওয়ায়, উপরন্তু ব্যবস্থাপনার অভাবে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ শে এপ্রিল অ্যালাইন্স ব্যাংক অফ সিমলা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়

সারা বিশ্বে অর্থের সঞ্চালন পদ্ধতি এখানে প্রদর্শিত হয়েছে

ইম্পেরিয়াল ব্যাংক ও রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া

অ্যালাইন্স ব্যাংক ব্যর্থ হলে ইম্পেরিয়াল ব্যাংক তার সমস্থ সম্পদ দখল করে নেয় এবং গভর্নর জেনারেলের আদেশে ইম্পেরিয়াল ব্যাংক অ্যালাইন্স ব্যাংকের ৫০% পাওনাদারদের পাওনা অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়। আর এভাবেই অ্যালাইন্স ব্যাংকের ডালহৌসি চত্বরের বাড়িটি চলে আসে ইম্পেরিয়াল ব্যাংকের কাছে। ক্রমে ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসাবে রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া গড়ে উঠলে ভারত সরকারের ব্যাংকার হিসাবে ইম্পেরিয়াল ব্যাংক থেকে দায়িত্ব চলে আসে রিজার্ভ ব্যাংকের কাছে। এবং পুনরায় ডালহৌসির বাড়িটি ইম্পেরিয়াল ব্যাংকের কাছ থেকে চলে আসে রিজার্ভ ব্যাংকের কাছে। আর রিজার্ভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর কলকাতার এই ভবনটিই ছিল তাদের প্রধান কার্যালয় (সদর দপ্তর), যেখানে ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের প্রথম বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। তারপর ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্যাংকের সদর দপ্তর মুম্বাইতে পাকাপাকিভাবে স্থানান্তরিত হলে কলকাতার এই ভবনটি ব্যাংকের আঞ্চলিক কার্যালয় হিসাবে পরিচালিত হতে থাকে। কিন্তু স্বাধীনতার পর ডালহৌসি স্কোয়ারের এই ভবনটি রিজার্ভ ব্যাংকের কাছে খুবই ছোট মনে হলে, আর হবে নাই বা কেন? দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলে কথা... তাই ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে রিজার্ভ ব্যাংক লালদীঘির (ডলহৌসি স্কোয়ারের) উত্তর-পশ্চিম কোণে এক বিশাল দানবীয় সোভিয়েত ধাঁচের ভবন নির্মাণ করলে রিজার্ভ ব্যাংক অ্যালাইন্স ব্যাংক অফ সিমলা-র এই ভবনটি ছেড়ে সেখানে চলে যায়, যা বর্তমানে ব্যাংকের আঞ্চলিক কার্যালয়। কিন্তু রিজার্ভ ব্যাংক তার নতুন ভবনটিতে চলে গেলেও পুরনো ভবনটি রয়ে যায় তাদেরই দখলে।

প্রাচীন মিশরে পণ্য বিনিময় ব্যবস্থা

প্রাচীন মুদ্রা

আর.বি.আই. মিউজিয়াম

২০১৯ সালে আর.বি.আই. কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটের এই পুরনো ভবনটির নিচের অংশে গড়ে তোলে মিউজিয়াম। মূলত অর্থ (টাকাপয়সা), সোনা ও আর.বি.আই. এর ইতিহাস, এইসবের উপরই ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে মিউজিয়াম। মিশরীয় সভ্যতায় কীভাবে লেনদেন হত আর কীভাবেই বা ধাতু থেকে বর্তমানে কাগজের অর্থ এমনকি ডেবিট কার্ড / ক্রেডিট কার্ড এর রূপান্তর ঘটে চলেছে তার সম্পূর্ণ ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। প্রদর্শনীতে রয়েছে প্রাচীন সভ্যতায় ব্যবহৃত বিভিন্ন মুদ্রা থেকে বর্তমান প্রজন্মে ব্যবহৃত বিভিন্ন দেশের উচ্চ মানের মুদ্রা। আর এসবেরই মধ্যে আকর্ষণীয় একটি শিল্পকর্ম হল ইয়াপস স্টোন এর প্রতিরূপ। প্রায় পাঁচ ফুট ব্যাস বিশিষ্ট দানবীয় এই পাথরটি মাইক্রোনেশিয়া দেশের ইয়াপ দ্বীপে ব্যবহৃত অর্থ। এছাড়াও দেখতে পাওয়া যায় কিছু উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি নোট, যেমন- ইরাকের সাদ্দাম হুসেনের শেষ নোট ১০,০০০ দিনার যার বর্তমান ভারতীয় মুদ্রায় দাঁড়ায় ২৪,৬৫,৯৯৪ টাকা ও অন্যদিকে আর্জেন্টিনার ১০,০০০ আর্জেন্টিনা পেসোস নোট যার বর্তমান ভারতীয় রুপি দাঁড়ায় ৭,৬৯৪। প্রদর্শনীর মধ্যে আরও একটি আকর্ষণীয় অংশ হল পুনর্নির্মিত একটি ভল্ট, যেখানে কীভাবে সোনার বার সুরক্ষিত থাকে তা তুলে ধরা হয়েছে। একটি মজার বিষয় হল আপনি চাইলে একটি ডেমো(নকল) সোনার বার-কে হাতে করে তোলার চেষ্টাও করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে মজার বিষয়টি হল একটি সোনার বার যা আকারে একটি ৫ কেজি লোহার বারের সমান, তাকে হাতে করে তুলতে গেলে বুঝতে পারবেন সেই সোনার বার ওজনে তার থেকেও দ্বিগুণ বেশি। এর প্রধান কারণ সোনা লোহার চেয়ে ২.৫ গুণ ভারী। যেখানে লোহার বারের ওজন ৫ কেজি সেখানে সোনার বারটির ওজন ১২.৫ কেজি। ভল্টে কিছু ডামি সোনার বার ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির তালার প্রদর্শনী।

কিছু ঐতিহাসিক মুদ্রা (ধাতু)

ব্যাংকের  মূল ভল্ট, যা স্বর্ণ সঞ্চয়ের ভল্ট হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে

এছাড়াও মিউজিয়ামে সব বয়সের দর্শকদের বিনোদনের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ইন্টারেক্টিভ গেম, কুইজ ও অডিও ভিস্যুয়াল মাধ্যম। সর্বশেষ অংশে রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার ইতিহাস ও লোগোর ক্রমবিবর্তনের সাথে রয়েছে বিভিন্ন যন্ত্রপাতির প্রদর্শনী। যার মধ্যে রয়েছে নোট সেলাই, নোট পাঞ্চিং, সীল করার মেশিন; বিভিন্ন বন্ড বা সার্টিফিকেট ছাপানোর মেশিন, কারেন্সি বক্স সীল করার বিভিন্ন সরঞ্জাম এছাড়াও মুদ্রা সংক্রান্ত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি।

কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে যেখানে স্বভাবতই মানুষ মিউজিয়াম বললে শুধুমাত্র কলকাতা জাদুঘর (ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম) এর নাম মাথায় আসে, সেখানে ঘরেবাইরে মিউজিয়ামআমি কলকাতা মিউজিয়াম এর সঙ্গে কলকাতার মুকুটে যুক্ত হওয়া আর একটি মিউজিয়াম আর বি আই / রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া মিউজিয়াম

******************************************************

লেখা, গবেষণা ও ছবি - প্রীতম নস্কর  

ই-মেল - pritamnaskar.pn@gmail.com

ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে ব্লগের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, তবে পূর্বানুমতি ছাড়া আমার তোলা আলোকচিত্রগুলি এবং ব্লগের রচনাগুলি অন্য কোথাও কপি-পেস্ট বা বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করা চলবে না।

******************************************************

নোট সংক্রান্ত বিভিন্ন মেশিন

নোট সংক্রান্ত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি

Comments