কোলেসওয়ার্দি গ্রান্ট ও এশিয়ার প্রাচীনতম পশুপীড়ন নিবারনী সংস্থা ।। Colesworthey Grant, and Asia’s Oldest Animal Cruelty Prevention Organization
পশু নির্যাতন। অনাদিকাল থেকে চলে আসা জীবজন্তুদের উপর মানুষের অত্যাচার, অপব্যবহার। এখনও শহরে এমনকি গ্রামের আনাচে কানাচে চলে আসছে পশুদের উপর নির্মম অত্যাচার। রিপোর্ট অনুযায়ী এইসব পশুদের মধ্যে গবাদি পশুদের সংখ্যাই বেশি। গৃহপালিত পশু মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাদের সুস্থভাবে বাঁচার যে অধিকারটুকু প্রয়োজন তা অনেকেই ভুলতে বসেছেন। এবার আপনারা বলবেন ‘যতসব আদিখ্যেতা, রবিবারের দুপুরে জমিয়ে খাসির মাংস খাওয়া বাঙালীর আবার পশুপ্রেম’। না ব্যাপারটা এক নয়। খাদ্য শৃঙ্খল ও জীবপ্রেম সম্পূর্ণ আলাদা। এই মাংস খাওয়া বা না খাওয়ার সাথে যে পশুপাখিদের প্রতি ভালোবাসার কোন সম্পর্ক নেই তা আজ থেকে প্রায় ১৬০ বছর আগে এক ইংরেজ সাহেব দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর নাম কোলেসওয়ার্দি গ্রান্ট...... কলকাতায় পশু নির্যাতন রুখতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সি.এস.পি.সি.এ অর্থাৎ ক্যালকাটা সোসাইটি ফর প্রিভেনশন অফ ক্রুএল্টি টু অ্যানিমেলস (Calcutta Society For The Prevention of Cruelty To Animals)। যা ভারতবর্ষের ইতিহাসে তথা এশিয়ার সর্বপ্রথম এমন সংস্থা যারা কিনা পশুদের উপর চলে আসা এই নির্যাতন বন্ধ করতে এবং তাদের সুস্থভাবে বাঁচার অধিকারের দিকগুলো খেয়াল রাখতে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কে এই কোলেসওয়ার্দি গ্রান্ট? আর কীভাবেই বা কলকাতার সাথে তার সম্পর্ক গড়ে উঠল সেই নিয়েই আজকেই এই গল্প।
১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে ২৫ শে অক্টোবর ইংল্যান্ডের এক স্কটিশ-আইরিস পরিবারে কোলেসওয়ার্দি গ্রান্ট জন্মগ্রহণ করেন। মা আইরিস (ওয়েলস) ও বাবা স্কটিশ। কর্মসূত্রে তাঁর বাবা একজন গাণিতিক যন্ত্রপাতি তৈরির কারিগর। ইংল্যান্ডে প্রাথমিক শিক্ষালাভের পর কর্মজীবনে গ্রান্ট ক্লার্ক হিসাবে তাঁর জীবনযাত্রা শুরু করলেন। কিন্তু সে সময়টা ক্ষণিকের জন্য, কারণ জীবনের প্রতি তাঁর স্নেহ আদর্শ ও লক্ষ্য সন্ধানের আশায় তিনি তাঁর জন্মভূমি ছেড়ে পাড়ি দিলেন ভারতে।
কোলেসওয়ার্দি গ্রান্ট ও তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ (সৌজন্যে প্যারীচাঁদ মিত্রের লেখা Life of Colesworthy Grant বইটি থেকে) |
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সুবাদে কলকাতা তখন অবিভক্ত ভারতের বাস্তব রাজধানী। বিদেশ থেকে অনেক সাহেবরাই আসছে কলকাতায়। ঠিক এই সময়েই ১৮৩২ সালে উনিশ বছর বয়সী কোলেসওয়ার্দি গ্রান্ট ইংল্যান্ড ছেড়ে চলে এলেন কলকাতায়। দাদা জর্জ গ্রান্ট কর্মসূত্রে অনেক আগেই চলে এসেছিলেন এ শহরে। লালদীঘি অঞ্চলে ছিল তাঁর ঘড়ি ও গাণিতিক যন্ত্রপাতির দোকান এবং ক্রীক রো এ তাঁর বাসভবন। কলকাতায় আসার পর কোলেসওয়ার্দি তাঁর দাদার সাথেই থাকতে শুরু করল। ছোট থেকেই শরীরচর্চায় নিযুক্ত থাকার ফলে এখানে এসেও গ্রান্টের কসরত থেমে থাকল না। কিন্ত এই কসরত চলাকালীন ঘটে গেল দুর্ঘটনা। পড়ে গিয়ে মারাত্মক চোট পেলেন শিরদাঁড়ায়। সোজা হয়ে হাঁটার শক্তি চিরতরে হারিয়ে ফেললেন গ্রান্ট। আর এখান থেকেই শুরু হল কোলেসওয়ার্দির নতুন জীবন।
শিল্পীসত্তা গ্রান্ট –
স্কেচিং জীবন অর্থাৎ চিত্রাঙ্কন। কলকাতার এই মানুষজন, তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন, বেঁচে থাকার লড়াই এইসবকিছু কোলেসওয়ার্দির মনে প্রভাব ফেলতে লাগল। হাতে উঠে এলো পেন্সিল, আঁকতে শুরু করল তখনকার সামাজিক চিত্র। গ্রান্টের মূল বিষয় হল লিথোফ্রাফ স্কেচ। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সেই বিশেষ খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। সুখ্যাতির প্রভাবে গ্রান্টের স্কেচ সমসাময়িক পত্রিকাতে নিয়মিত প্রকাশিত পেতে থাকল। এদের মধ্যে ‘ইন্ডিয়া রিভিউ’, ‘ক্যালকাটা মান্থলি জার্নাল’, ‘ক্রিশ্চিয়ান অবসারভার অ্যান্ড দ্যা ইন্ডিয়া স্পোর্টিং রিভিউ’ এইসব পত্রিকাতে গ্রান্ট হয়ে উঠল নিয়মিত চিত্রশিল্পী। তথ্য অনুযায়ী ১৮৩৮ থেকে শুরু করে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত তিনি মোট ১৬৯ টি স্কেচ তৈরি করেছিলেন। পরবর্তীকালে এদেশীয় ব্যাক্তিদের নিয়ে বিশেষ করে জাতি এবং পেশাগত শ্রেণীর নৃতাত্ত্বিক অধ্যায়নের জন্য যে গবেষণা হয়েছিল সেখানেও গ্রান্ট তাঁর অবদান রাখলেন। গ্রান্টের আঁকা সেই ছবিগুলি গবেষণাসহ “ওরিয়েন্টাল হেড” (A series of miscellaneous rough sketches of Oriental heads. - Published by Colesworthey Grant) নামক একটি স্কেচবুক হিসাবে প্রকাশ পেল। এছাড়াও তাঁর ঝুলিতে ছিল বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পোট্রেট। উনিশ শতকের অধিকাংশ বিখ্যাত ব্যক্তিদের লিথোগ্রাফ স্কেচ করার কৃতিত্ব তাঁরই, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জেমস প্রিন্সেপ, চার্লস মেটক্যাফে, বিশপ উইলসন এবং আরও অনেক।
“ওরিয়েন্টাল হেড” |
একজন ভালো খ্যাতি সম্পন্ন চিত্রশিল্পী হওয়ায় গ্রান্ট চেয়েছিলেন স্থানীয়দের মধ্যে সেই শিক্ষার প্রসার ঘটাতে। তাই ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার মানুষদের আঁকার প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য যখন ‘দ্যা ক্যালকাটা মেকানিক্স ইন্সটিটিউশন’ প্রতিষ্ঠা হল তখন সেই প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে গ্রান্ট মুখ্য ভূমিকা পালন করলেন। শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া ছাড়াও গ্রান্ট এবং তাঁর দাদা ছিলেন সেই ইন্সটিটিউশনের সেক্রেটারি। কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণবশত সেই প্রতিষ্ঠান মাঝপথেই বন্ধ হয়ে যায়। তবে ক্যালকাটা মেকানিক্সের হাত ধরে আরও একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এই কলকাতায়, ‘বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ’, যা বর্তমানে হাওড়ার শিবপুরে অবস্থিত ‘দ্যা ইন্ডিয়ান ইন্সটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারং সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলোজি’। তবে শুরুর দিকে জায়গার অভাবে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ প্রাঙ্গনে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট হিসাবে পরিচালিত হত, যেখানে গ্রান্ট ছিলেন সেই সিভিল ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক। এবং এই পদটিতে তিনি আজীবন অধ্যাপকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। পরবর্তীকালে গ্রান্টের মৃত্যুর পর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং চলে আসে হাওড়ার শিবপুরে, যেখানে এখনও গ্রান্টের স্মৃতিরক্ষার্থে রয়েছে একটি স্মারক।
গ্রান্টের শিল্পীসত্তার আরও এক নিদর্শন পাওয়া যায় চিকিৎসাক্ষেত্রে। মানব শরীরবিদ্যা শেখানোর জন্য বেঙ্গল আর্মির সার্জন ও ক্যালকাটা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডঃ ফ্রেডরিক জন মোয়াট –এর লেখা ‘অ্যান অ্যাটলাস অ্যানাটোমিক্যাল প্লেটস অফ দা হিউম্যান বডি’ (An Atlas of Anatomical Plates of the Human Body) বইটিতে। যেখানে গ্রান্ট মোয়াটের অনুরোধে সেই দ্বিভাষী বইটিতে তাঁর স্কেচের (ইলাস্ট্রেসন) মাধ্যমে মানবদেহের শারীরবৃত্তীয় অংশগুলি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলেন, যার মাধ্যমে আগামী প্রজন্মের কাছে এমনকি এখনও দেহের এই সূক্ষ্ম অংশগুলিকে বুঝতে সাহায্য করে।
ডঃ ফ্রেডরিক জন মোয়াট –এর লেখা ‘অ্যান অ্যাটলাস অ্যানাটোমিক্যাল প্লেটস অফ দা হিউম্যান বডি' বইটিতে গ্রান্টের অঙ্কন করা মানবদেহের শারীরবৃত্তীয় অংশ |
Lord White Elephant from 'A Series of Views in Burmah taken during Major Phayre’s Mission to the Court of Ava in 1855' by Colesworthy Grant (courtesy British Library) |
গ্রান্টের এই লিথোগ্রাফ স্কেচের
সুখ্যাতি শুধুমাত্র কলকাতা বা ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, লর্ড ডালহৌসির
সুনজরে আসায় তিনি ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে গ্রান্টকে দূত হিসাবে বার্মার (মায়ানমার) আভা
রাজ্যে ও রাঙ্গুন পাঠিয়েছিলেন। গ্রান্ট তাঁর স্কেচের মাধ্যমে সেখানকার রাজা ও
রাজ্যের পরিস্থিতি তুলে ধরেন এবং রাজাকে সেই চিত্র উপহার দেওয়ায় রাজাও গ্রান্টের
এই প্রতিভাকে সন্মান জানিয়ে একটি সোনার পেয়ালা ও রুবির আংটি উপহার দেন।
আগেই বলেছি আঁকা ছাড়াও গ্রান্টের লেখালেখি সাময়িক পত্রপত্রিকাতেও ছাপা হত। তবে এই লেখালেখি শুধুমাত্র সেখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না, কলকাতায় বসে তিনি নিয়মিত সুদূর ইংল্যান্ডে থাকা তাঁর মা এবং বোন-কে নিয়মিত চিঠি লিখতেন। চিঠির বিষয়বস্তু ছিল সেসময়কার গ্রামবাংলার জীবনযাপন, মানুষজন, দারিদ্রতা, এদেশের সরকারি ব্যবস্থা, নীল চাষ, শহরে থাকা বিভিন্ন ধর্মীয় মানুষদের পরিচয়, কলকাতার বাজার ইত্যাদি। গ্রান্ট নিজে সেইসমস্থ স্থান পরিদর্শন করে নিজের আঁকা ছবিসহ লেখা পাঠাতেন ইংল্যান্ডে থাকা তাঁর মা-কে। আর এই চিঠিগুলোই ১৮৬১-৬২ নাগাদ ছবিসহ প্রকাশিত হয় ‘অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ডোমেস্টিক লাইফ’ (Anglo-Indian Domestic Life: A Letter from an Artist in India to His Mother in England) ও ‘রুরাল লাইফ ইন বেঙ্গল’ (Rural Life in Bengal: Illustrative of Anglo-Indian Suburban Life ... Letters from an Artist in India to His Sisters in England) নামে।
‘রুরাল লাইফ ইন বেঙ্গল’ |
পশুপ্রেমী গ্রান্ট –
গ্রান্টের এই শিল্পীস্বত্বা ছাড়াও আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল। তা হল পশুপ্রেম। কলকাতায় আসা থেকেই গ্রান্ট সারা জীবন তাঁর দাদার সঙ্গেই থাকত, আর সঙ্গে থাকত এক পার্সিয়ান বিড়াল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে হেয়ার স্ট্রীটের বাড়িতে থাকাকালীন আকস্মিক দুর্ঘটনায় বিড়ালটি মারা যায়। আর এর পর থেকেই গ্রান্ট ভেঙে পড়েন। কলকাতার রাস্তায় যখন ঘুরতে থাকেন লক্ষ্য করেন, যে সমস্থ জন্তুদের মালবাহী হিসাবে খাটানো হয় তাদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। একে তো তাদের তেষ্টা নিবারণের জন্য রাস্তাঘাটে কোনও পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই, অন্যদিকে যে পরিমাণে তাদেরকে দিয়ে খাটানো হয় তা একেবারেই অমানুষিক। এই যেমন ঘোড়া, গাধা, বলদ –এরা সকলেই গবাদি পশু, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে এদেরকে দিয়ে যে পরিমাণ পণ্য বোঝাই গাড়ি টানা হয় তা এদের সাধ্যের বাইরে। অথবা গাড়ি টানার জন্য যে জোয়াল (ইয়ক) এদের ঘাড়ে চাপানো হয় তার ওজন অনেকটাই বেশি। ফলে খুব অল্পসময়ের মধ্যেই সেইসমস্থ পশুর হয় ঘাড়ের শিরদাঁড়া বেঁকে যেত নয়তো অকালমৃত্যু ঘটত।
CSPCA পশু হাসপাতাল |
গ্রান্ট এই সমস্থ অবলা জীবজন্তুদের পরিস্থিতি দেখে বিচলিত হয়ে ওঠে। লালদীঘির পাশেই যেখানে তাদের ঘড়ির দোকান ছিল ঠিক তার বিপরীতেই পশুদের জল খাওয়ার জন্য একটি চৌবাচ্চা বানিয়ে দেন। কিন্তু শুধুমাত্র এই উদ্যোগে তিনি সন্তুষ্ট হলেন না। তাদের জন্য আরও কিছু করে যাওয়ার ভূত মাথায় চেপে বসল। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ঠা অক্টোবর হেয়ার স্ট্রীটের তাঁর বাড়িতেই প্রতিষ্ঠা করলেন “ক্যালকাটা সোসাইটি ফর প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েল্টি টু অ্যানিম্যালস” (CSPCA)। পশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধের জন্য এই সংস্থা, যা ভারতের এমনকি সমগ্র এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সর্বপ্রথম এমন সংস্থা। যদিও ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডে শুরু হয় ‘সোসাইটি ফর প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েল্টি টু অ্যানিম্যালস’, তবে তা মূলত পাশ্চাত্য দেশগুলিতে।
শুরুর দিকে গ্রান্ট নিজে তাঁর বাড়িতে একটি সাধারণ সভার মাধ্যমে এই যুগান্তকারী প্রতিষ্ঠান গঠন করে। ৪ ঠা অক্টোবর সেই সভাতে উপস্থিত ছিলেন কলকাতার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। সভার মুখ্য সভাপতি ছিলেন জন হেনরি প্র্যাট যিনি একজন ব্রিটিশ পাদ্রী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ। আর ছিলেন ডাফ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অ্যালেকজান্ডার ডাফ, ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক ডঃ ফ্রেডরিক জন মোয়াট, প্রতাপগড়ের রাজা প্রতাপ বাহাদুর সিং, গ্রান্টের প্রিয়বন্ধু ও বেঙ্গল কাউন্সিলের সদস্য বাবু প্যারীচাঁদ মিত্র যিনি বাংলা সাহিত্যের সর্বপ্রথম উপন্যাস ‘আলালের ঘরে দুলাল’ উপন্যাসের রচয়িতা (ছদ্মনাম টেকচাঁদ ঠাকুর)। এখানে বলে রাখা ভালো প্রিয়বন্ধু হওয়ার সুবাদে এই প্যারিচাঁদ মিত্রই পরবর্তীকালে গ্রান্টের জীবনী “দ্যা লাইফ অফ কোলেসওয়ার্দি গ্রান্ট” বইটি লেখেন।
প্রবেশদ্বার |
আর এই প্যারিচাঁদ মিত্রের সহায়তায় গ্রান্ট ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে পশুদের উপর এই অত্যাচার কমানোর জন্য দুটি বিল ‘অ্যাক্ট ১ ও অ্যাক্ট ২’ পাশ করান। তবে কাজটা মোটেই সহজ ছিল না, বিল দুটি পাশ করাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। সেই ১৮৬১ সালে সংস্থা প্রতিষ্ঠা হওয়া থেকেই দীর্ঘদিন আইনের জটিলতায় একটার পর একটা বিল খারিজ হতে থাকে। আর এই বিষয়ে ব্রিটিশদেরই ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যক্তি মদত দিতে থাকে, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তৎকালীন কলকাতার পুলিশ কমিশনার স্যার স্টুয়ার্ট সন্ডার্স হগ, যার নামে কলকাতার নিউমার্কেট চত্বরে গড়ে ওঠা ‘হগ মার্কেট’।
সে যাই হোক, শেষে ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে পাশ হয় জীবজন্তুদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম আইন। এবং এর পর থেকেই সংস্থার চাপে জীবজন্তুদের উপর চলে আসা অত্যাচার বন্ধ হতে থাকে। ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে গ্রান্টের শেষ রিপোর্ট অনুযায়ী সংস্থা এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে দোষী সাব্যস্ত করে ২৪৬৫ জনকে এবং ২৯৫৬ টি জীবজন্তুর জীবন রক্ষা করা হয়, যাদের মধ্যে ৮১৯ টি ঘোড়া ও ১৫৯০ টি গবাদি পশু।
গ্রান্টের স্মৃতিফলক ও নির্মাণকারী ব্যক্তি |
গ্রান্টের মৃত্যু ও তাঁর স্মৃতিসৌধ –
শেষে ১৮৮০ সালের ৩১ শে আগষ্ট কোলেসওয়ার্দি গ্রান্টের মৃত্যুর পর CSPCA সংস্থা তাঁর বাড়ি থেকে উঠে আসে ২৭৬ নং বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রীটের বাড়িতে এবং আজও পর্যন্ত সেখান থেকেই CSPCA তার কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে এবং বর্তমানে তারা এই স্থানটি পশু হাসপাতাল হিসাবে পরিচালনা করে। মৃত্যুর পর গ্রান্টকে কলকাতার সাউথ পার্কস্ট্রীট গোরস্থানে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর এই অমর কীর্তিকে স্মরণ রাখতে ব্রিটিশ সরকার ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেন। সম্ভবত পশুদের তেষ্টা নিবারণের জন্য গ্রান্ট যে চৌবাচ্চাটি তৈরি করেছিল তার সামনেই অর্থাৎ রাইটার্স ব্লিডিং এর দক্ষিণদিকে ঠিক ফুটপাথের ধারেই দেখতে পাওয়া যায় এই স্মৃতিস্তম্ভ। গঠনে ওবেলিস্ক ধাঁচের এই স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করেন কৃত্রিম পাথর প্রস্তুতকারক এইচ. ফরনারো। স্মৃতিসৌধটির দুপাশে রয়েছে দুটি সিংহের মুখ। একসময়ে সিংহের মুখ দুটি থেকে জল পড়ত দুপাশে থাকা দুটি টব-এ। গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে কিমবা পথচলতি তৃষ্ণার্ত জীবজন্তুরা আসত তাদের তেষ্টা মেটাতে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে কখন যেন সেই পাত্রদুটি উধাও হয়ে যায়। স্মৃতিসৌধের দুপাশে যে দুটি হ্যাজাক বাতি ছিল, তাও যেন সময়ের প্রকোপে হারিয়ে গেছে। সিংহের মুখ থেকে জল পড়া কবেই বন্ধ হয়ে গেছে। আধুনিকরনের চাপে সাদা চুনকামে মোড়া স্মৃতিফলকটি গাছের ঝোপঝাড় ও রেলিঙের ঘেরাটোপের মধ্যে আড়ালে থেকে যায়।
স্মৃতিসৌধের দুপাশে গড়ে ওঠা দুটি সিংহের মুখ, একসময় এই মুখদুটি থেকেই জল পড়ত নীচে রাখা দুটি পাত্রে |
কলকাতার আর এক স্মৃতিস্তম্ভ ‘ম্যকডোনেল ফাউন্টেন’ –এর মতোই এই স্মৃতিস্তম্ভটিও কলকাতার মানুষ ভুলতে বসেছে। গ্রান্টের সেই স্থাপন করা CSPCA সংস্থা যা বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রীটে পশু হাসপাতাল হিসাবে পরিচালিত হত, তাও সম্প্রতি বন্ধ হয়ে যায়। জীবজন্তুদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে গ্রান্টের এই লড়াইয়ের একমাত্র সাক্ষী হিসাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে ফুটপাথের ধারে ওই ওবেলিস্কটি আর বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রীটের বাড়িটি।
ভাবতেও অবাক লাগে আজ থেকে প্রায় ১৬০ বছর আগে খোদ কলকাতায় থেকে এক সাহেব শহরের এমনকি সমগ্র দেশবাসীদেরকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন ভালোবাসা ও মানসিকতার বিনিময়ে কীভাবে জীবজন্তুদের তাঁদের প্রাপ্য অধিকারটুকু দেওয়া যায়...
******************************************************
লেখা, গবেষণা ও ছবি - প্রীতম নস্কর
ই-মেল - pritamnaskar.pn@gmail.com
ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে ব্লগের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, তবে পূর্বানুমতি ছাড়া আমার তোলা
আলোকচিত্রগুলি এবং ব্লগের রচনাগুলি অন্য কোথাও কপি-পেস্ট বা বাণিজ্যিক ভাবে
ব্যবহার করা চলবে না।
******************************************************
গুগল ম্যাপ / জি.পি.আর.এস. –
গ্রান্টের স্মৃতিস্তম্ভ - 22°34'23.3"N 88°21'00.1"E
CSPCA সংস্থা / হাসপাতাল - 22°34'17.7"N 88°21'16.7"E
তথ্যসূত্র –
- Life of Colesworthy Grant – by Peary Chand Mitra
- Cruelty Contested: The British, Bengalis, and Animals in Colonial Bengal, 1850-1920 – by Samiparna Samanta
- কলকাতার ‘সাত’কাহন – সোহম চন্দ্র
Comments
Post a Comment