বেলভেডিয়ার প্রাসাদ... ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা ।। Belvedere House... National Library, Kolkata


কলকাতা আলিপুরের বেলভেডিয়ার হাউস, যা পরিচিত জাতীয় গ্রন্থাগার বা ন্যাশনাল লাইব্রেরি হিসেবে। টলি ক্যানেলের আলিপুর ব্রিজটি পেরিয়েই ডানহাতে চিড়িয়াখানা ও তার পরেই বেলভেডিয়ার এস্টেট সেখানেই ইতালির রেনেসাঁর স্থাপত্যরীতিতে গড়ে ওঠা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান প্রাসাদ, বলা ভালো রাজপ্রাসাদ বেলভেডিয়ার হাউস। ইতালিয়ান শব্দ বেলভেডিয়ার, যার অর্থ মনোরম দৃশ্য, সাধারণত আলো-বাতাস চলাচলের জন্য নির্মিত ছাদযুক্ত স্থাপত্য, যেখানে থাকবে উন্মুক্ত প্রাঙ্গন। আলিপুরের এই বেলভেডিয়ার হাউসও সেই ঘরানার স্থাপত্য। স্বাধীনতার পর আলিপুরের এই বেলভেডিয়ার হাউসেই গড়ে ওঠে জাতীয় গ্রন্থাগার। তবে গ্রন্থাগার হিসাবে পরিচয় পাওয়ার আগে কিন্তু এই বাড়িটি বিখ্যাত ছিল আরেকটি কারণে। বাংলার লাটভবন। হ্যাঁ! ঠিকই শুনেছেন। এসপ্ল্যানেডের রাজভবন তৈরি হওয়ার আগে বাংলার বড়লাট এমনকি তার আগে ছোটলাট থাকতেন এই বেলভেডিয়ার প্রাসাদে প্রায় তিনশতক ধরে অনেক হাত বদলের পর শেষমেশ বেলভেডিয়ার প্রাসাদে তৈরি হয়েছিল লাইব্রেরি। ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এর নাম জড়িয়ে রয়েছে এই বাড়িতে, এমনকি বাংলার নবাব মিরজাফরেরও। কীভাবে বেলভেডিয়ার এই প্রাসাদ লাটভবন থেকে শেষমেশ জাতীয় গ্রন্থাগারে পরিণত হল সেই নিয়েই আজকের এই ব্লগ.....

বেলভেডিয়ার হাউসের উত্তর দিক

বেলভেডিয়ার হাউসের ইতিহাস

মিরজাফর থেকে ওয়ারেন হেস্টিংস

বেলভেডিয়ার হাউস ঠিক কবে কোন সময়ে তৈরি হয়েছিল সেই তথ্য এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে কলকাতা অ্যালবাম বইয়ের লেখক অশোক কুমার মিত্র জানাচ্ছেন শোনা যায় এই ভবনটি তৈরি করেন বাদশা ঔরঙ্গজেবের নাতি শাহজাদা আজিম-উস-শ্বান। বাংলা-বিহার-ওড়িশার সুবেদার আজিম-উস-শ্বান নিজে থাকার জন্য ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দে বেলভেডিয়ার গার্ডেন হাউস তৈরি করেন। সুতানুটি-কোলকাতা-গোবিন্দপুর কেনার বাদশাহি পরোয়ানা তিনিই ইংরেজদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তবে আমি এই তথ্যের কোন প্রমাণ পায়নি। বেলভেডিয়ার হাউস নিয়ে লিখতে গিয়ে যে বইগুলোর রেফারেন্স পেয়েছি সেখানে কোথাও এই তথ্য লেখা নেই। বেলভেডিয়ার হাউসের ইতিহাস পাওয়া যায় নবাব মিরজাফরের সময় থেকে। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পরাজয়ের পর বাংলার সিংহাসনে বসেন মীর জাফর আলী খান বাহাদুর, যাকে আমরা চিনি মিরজাফর হিসাবে। ইতিহাস বলছে তিনি ছিলেন ইংরেজদের হাতের পুতুল১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশদের চাপে পড়ে মিরজাফর মুর্শিদাবাদের নবাবি মীর কাশিমকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। সিংহাসনের মায়া ত্যাগ করে মিরজাফর চলে আসেন কলকাতায়। ইতিহাসবিদদের মতে বেলভেডিয়ার সামনাসামনি কোন এক স্থানে ছিল মিরজাফরের বাসস্থান। অন্য মতে আলিপুর আদালতের সামনে। সে যাই হোক, নবাব মিরজাফর আলির বসবাসের জন্যই এই জায়গার নাম হয় আলিপুর (দ্বিমত রয়েছে)। ১৭৬৩ খ্রিষ্টাব্দে মিরজাফর পুনরায় মুর্শিদাবাদের নবাব হিসাবে স্বীকৃতি পেলে কলকাতা ছেড়ে চলে যান মুর্শিদাবাদে। যাবার সময় আলিপুরের তাঁর সমস্ত সম্পত্তি উপহার হিসাবে দিয়ে যান ওয়ারেন হেস্টিংস কে। অনেকেই বিশ্বাস করেন কলকাতায় থাকাকালীন মিরজাফর অনেক ভবন নির্মাণ করেছিলেন। তবে মিরজাফর আদৌ বেলভেডিয়ার প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন কি না, বা তিনি আদেও সেখানে ছিলেন কি না তার সঠিক খবর পাওয়া যায় না। 

Watercolour of Belvedere House in Alipur near Calcutta by William Prinsep courtesy British Library

Belvedere House from Walter Hawkins Nightingale collection, Album of views of Calcutta, was taken by an unknown photographer in the late 1870s (courtesy British Library)

তবে পরবর্তীকালে বেলভেডিয়া এস্টেটের নাম জড়িয়ে পড়ে ওয়ারেন হেস্টিংস এর সাথে। বিশ্বাস করা হয় যে মুর্শিদাবাদে যাওয়ার আগে মিরজাফর বেলভেডিয়ার হাউস ওয়ারেন হেস্টিংস কে দান করে যান। মুর্শিদাবাদের সিংহাসন পুনরায় ফিরে পেতে সাহায্য করেছিলেন হেস্টিংস, তাই হয়তো মিরজাফর এই জমিজমা উপহারস্বরূপ দিয়েছিলেন হেস্টিংস-কে। আর এভাবেই নাকি আলিপুর অঞ্চলের বিস্তীর্ণ জমিজমার মালিক হন ওয়ারেন হেস্টিংস। এই সম্পত্তি মূলত বাগানবাড়ি দেখাশোনার জন্যই আদিগঙ্গা (টলি নালা)-র উপর সেতু নির্মাণের প্রয়োজন অনুভব করেন। এদিকে ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে বক্সারের যুদ্ধের পর হেস্টিংস চলে যান ইংল্যান্ডে। এই সময়টায় বেলভেডিয়ার হাউস হয়ে ওঠে ইংরেজ গভর্নরের আবাসস্থলগভর্নর হ্যারি ভেরেলেস্ট (১৭৬৭-৬৯) ও পরে জন কার্টার (১৭৬৯-৭২) থাকতেন বেলভেডিয়ার হাউসে তবে তখনও বেলভেডিয়ার হাউস পুরোপুরি ভাবে সরকারি বাসভবনে পরিণত হয়নি। গভর্নর হ্যারি ভেরেলেস্টের কাছে এই বাড়িটি ছিল তাঁর কান্ট্রি সিটএরপর ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার গভর্নর জেনারেল হিসাবে হেস্টিংস পুনরায় ফিরে আসেন কলকাতায়। কলকাতায় আসার পর হেস্টিংস থাকতে শুরু করেন বেলভেডিয়ার হাউসে। এখানে থাকাকালীনই হেস্টিংস, মহারাজ নন্দকুমারের বিরুদ্ধে চলা চক্রান্তের প্রধান সাক্ষী কমলউদ্দীনের সাথে প্রায়ই দেখা করতেন। এই জাল মোকদ্দমার প্রধান বিচারপতি স্যার এলিজা ইম্পে ছিলেন হেস্টিংস-এর বন্ধু। এমনকি স্যার ইম্পেও পরবর্তীকালে হেস্টিংস-এর বাগানবাড়িতে কিছুদিন বসবাস করেছিলেন। তবে তিনি বেলভেডিয়ার হাউসে থেকেছিলেন কিনা সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে, কারণ সেই সময়ে হেস্টিংস-এর আর একটি ভবন তৈরি হয়ে গেছিল, আর এই বাড়িটি হল আলিপুরের হেস্টিংস হাউস। এখানে বলে রাখা ভালো ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ই আগস্ট, বেলভেডিয়ার এই বাগান চত্বরেই ঘটেছিল সেই ঐতিহাসিক ডুয়েল একদিকে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস আর অন্যদিকে তাঁর লিগ্যাল অফিসার ও সুপ্রিম কাউন্সিলের চার সদস্যের অন্যতম স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিস বর্তমানে বেলভেডিয়ার হাউসের উত্তর-পশ্চিম দিকে হয়েছিল সেই ডুয়েল লড়াই (দ্বন্দ্বযুদ্ধ)। ডুয়েলে হেস্টিংস ও ফ্রান্সিস দুজনেই বেঁচে গেলেও, হেস্টিংসের ছোঁড়া গুলিতে ঘায়েল হয়েছিল স্যার ফ্রান্সিস। তবে এই সময়টায় কিন্তু বেলভেডিয়ার হাউস হেস্টিংসের অধীনে নেই। 

বেলভেডিয়ার হাউসের বলরুম, যা পরবর্তীকালে লাইব্রেরীর রিডিং রুম

বেলভেডিয়ার হাউসের বলরুম (চিত্র ২)


পরবর্তীকালে ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দের স্ত্রী মেরিয়ানকে লেখা হেস্টিংস-এর একটি চিঠি থেকে জানা যায় বেলভেডিয়ার এই বাড়ি তাঁর দখলে নেই। এর আগে ১৭৭৮ খ্রিষ্টাব্দে বেলভেডিয়ার এই বাড়ি সমেত গোপালনগর ও জিরাট গ্রাম ১২ বছরের জন্য লিজ দিয়েছিলেন কর্নেল উইলিয়াম টলি-কে (মেজর টলি, যার তত্ত্বাবধানেই খনন করা হয় টলি নালা/ক্যানেল; আর এই ক্যানেল মারফত আগত জাহাজদের থেকে নেওয়া হত টোল, যা থেকেই এই অঞ্চলের নাম টালিগঞ্জ) এদিকে হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল গ্রন্থের লেখক মিস্টার বাকল্যান্ড সাহেব জানাচ্ছেন ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে ৬০,০০০ টাকায় হেস্টিংস বেলভেডিয়ার হাউস বিক্রি করে দেন মেজর টলি-কে। হয়তো লিজ পরিবর্তন হয়েছিলে বিক্রয়চুক্তিতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে মাত্র ৪ বছর পর টলি সাহেব মারা যান। মেজর টলির মৃত্যুর পর বেলভেডিয়ার হাউস থেকে যায় টলির এটর্নি রিচার্ড জনসনের কাছে। বেশ কয়েকবছর বিজ্ঞপ্তির পর শেষে ১৮০২ খ্রিষ্টাব্দে বেলভেডিয়ার বাড়ি নিলামে চলে যায়। বেলভেডিয়ার হাউস সমেত জমির পরিমাণ পাওয়া যায় ৭২ বিঘা ৮ কাটা ৪ ছটাক। পরবর্তীকালে বেলভেডিয়ার হাউস বার্ষিক ৩৫০ ইউরোয় লিজ নেয় উইলিয়াম অগাস্টাস ব্রুকি। মিঃ ব্রুকির তত্ত্বাবধানেই বাড়িটির সংস্কার করা হয়। এরপর থেকে বেলভেডিয়ার হাউস বিভিন্ন সময়ে হাতবদল হতে থাকে, কখনও ভারতের প্রধান সেনাপতি এডওয়ার্ড প্যাগেট তো কখনও ব্রেরেটন বার্চ, জেমস ম্যাকিলপ, চার্লস রবার্ট প্রিন্সেপ। শেষে ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রিন্সেপ পরিবার বাড়িটি বিক্রি করে দেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি-কে।

বেলভেডিয়ার হাউসের ফায়ারপ্লেস

ফায়ারপ্লেসের স্থাপত্য

ফায়ারপ্লেসের স্থাপত্য (চিত্র - ২)

লাটভবন 

এদিকে ব্রিটিশ সরকারের প্রয়োজন পড়ল একটি স্বতন্ত্র আবাস-স্থান, যেখানে থাকবে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর। সেইসময় লর্ড ডালহৌসির সহায়তায় বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের জন্য নির্বাচিত হল আলিপুরের এই বেলভেডিয়ার হাউস। এরপর থেকেই বিভিন্ন সময়ে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর-রা থাকতেন বেলভেডিয়ার হাউসে।  ১৮৫৪ খ্রিষ্টাবে স্যার ফ্রেডরিক জেমস হ্যালিডে বাংলার প্রথম লেফটেন্যান্ট গভর্নর বা ছোটলাট হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর সর্বপ্রথম বেলভেডিয়ার হাউসে বসবাস গ্রহণ করেন। এরপর থেকে স্যার উইলিয়াম গ্রে, স্যার রিচার্ড টেম্পল হার্ট, স্যার অ্যাশলে ইডেন, স্যার স্টুয়ার্ট কলভিন বেইলি, স্যার চার্লস অ্যালফ্রেড এলিয়ট, স্যার অ্যালেকজান্ডার ম্যাকাঞ্জি প্রভৃতি লেফটেন্যান্ট গভর্নরের আমলে বেলভেডিয়ার হাউসের গঠনগত পরিবর্তন হতে থাকে। কখনও স্যার উইলিয়াম গ্রে-র আমলে প্রাসাদের পূর্বদিকের বারান্দা নির্মাণ, তো কখনও স্যার চার্লস এলিয়টের আমলে পশ্চিমদিকের দ্বিতলে কক্ষ নির্মাণ। এমনকি স্যার অ্যাশলে ইডেন-এর আমলে প্রাসাদের বলরুমে কাঠের মেঝেও নির্মাণ হয়েছিল। তবে বেলভেডিয়ার হাউসে প্রথম ইলেকট্রিক আসে স্যার অ্যালেকজান্ডার ম্যাকাঞ্জি-র আমলে। কেমন ছিল সেই সময়কার বেলভেডিয়ার হাউস প্রমাণ পাওয়া যায় ছোটলাট স্যার রিচার্ড টেম্পলের বর্ণনায় অফিসিয়ালভাবে এই প্রাসাদের নাম দেওয়া হয়েছে বেলভেডিয়ার এবং সত্যি এই ভবন এই নামেরই প্রাপ্য। চমৎকার বাঁশবন, কাঠের শহরতলী ও প্রচুর বৃক্ষে ঘেরা পার্কের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে বেলভেডিয়ার হাউস। গাছেদের মধ্যে থাকত বটগাছ, বাদাম, বাঁশ ও তুলো। বাগানের পুকুরে ফুটত পদ্মফুল ও জল লিলি (শাপলা)। ভবনের চওড়া সিঁড়ির দুপাশে সাজানো ছিল লতাপাতা। বাংলার শেষ ছোটলাট উইলিয়াম ডিউক-ও ছিলেন এই লাটভবনে। এরপর ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে স্থানন্তরিত হলে বেলভেডিয়ার হাউস পরিণত হয় ভারতের ভাইসরয়ের বাসভবনে। শেষে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতার পর ভাইসরয় উপাধির অবসান ঘটলে সরকারি বাসভবন হিসেবে বেলভেডিয়ার হাউসের অধ্যায় সমাপ্ত হয়।

দক্ষিণদিকের বারান্দা

দক্ষিণদিকের স্থাপত্যরীতি

দক্ষিণদিকের স্থাপত্যরীতি (চিত্র ২)

লাটভবন থেকে জাতীয় গ্রন্থাগার

এদিকে স্বাধীনতা ও দেশভাগের পর ভারত সরকার ঠিক করে বেলভেডিয়ার হাউস হবে ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরীর নতুন ঠিকানা। শুধু তাই নয় নতুন আইন অনুসারে ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরীর নামও বদলে ফেলা হল, নতুন নাম হল জাতীয় গ্রন্থাগার (ন্যাশনাল লাইব্রেরী)। তবে ঘোষণা ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে হলেও বাস্তব রুপায়নে সময় লাগল ৪ বছর। ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরীর আগের ঠিকানা মেটক্যাফে হল থেকে একে একে বই আনা হল বেলভেডিয়ার হাউসে। তারপর ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে ১লা ফেব্রুয়ারি স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ জাতীয় গ্রন্থাগারএর দরজা খুলে দিলেন সাধারণ মানুষের জন্য। ভারতের বিভিন্ন ভাষার বই ছাড়াও রয়েছে চিনা, আরবি, ফার্সি ভাষার বই। এছাড়াও রয়েছে অনেক দুষ্প্রাপ্য পুঁথি, পাণ্ডুলিপি, মানচিত্র, অ্যাটলাস। ভারতের প্রথম সংবাদপত্র হিকিস গেজেট রয়েছে এখানে।

তবে এই ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরী থেকে ন্যাশনাল লাইব্রেরী হয়ে ওঠার পথ এত সোজা ছিল না। (ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরী ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরী ন্যাশনাল লাইব্রেরী, এই নিয়ে রয়েছে আরও একটি বিস্তারিত ব্লগ। মেটক্যাফে হল বা ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরীর বিষয়েজানতে হলে এখানে ক্লিক করুন)। মেটক্যাফে হল থেকে উঠে আসার পর প্রায় ৬০ বছর ধরে ন্যাশনাল লাইব্রেরি ছিল বেলভেডিয়ার হাউসে। ভবনের বলরুম ব্যবহৃত হয়েছে লাইব্রেরীর রিডিং রুম (পাঠকক্ষ) হিসেবে। এই সময়টায় বেলভেডিয়ার হাউসে ঘটেছে একাধিকবার পরিবর্তন। শেষে ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় গ্রন্থাগার উঠে আসে বেলভেডিয়ার হাউসের সামনেই এস্টেট চত্বরের নবনির্মিত ভাষা-ভবনে। আর তখন থেকেই জাতীয় গ্রন্থাগার হিসাবে পরিচয় লাভ করে ভাষা-ভবন।

প্রাসাদের অন্দরমহলের স্থাপত্যরীতি

প্রাসাদের অন্দরমহলের স্থাপত্যরীতি (চিত্র ২)

প্রাসাদের অন্দরমহলে করিন্থিয়ান স্থাপত্যরীতির স্তম্ভ

বেলভেডিয়ার হাউস অনেক আগে থেকেই ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধীন (ASI)। গ্রন্থাগার পরিবর্তনের পর থেকেই শুরু হল ভবন সংস্কারের কাজ। বইয়ের আলমারির আড়াল থেকে বেড়িয়ে এল ফায়ারপ্লেস। জানা যায় এই সংস্কারের সময়ই বেলভেডিয়ার হাউসে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল গুপ্তঘর। আর হবে নাই বা কেন, অতীতের লাটভবন বলে কথা। তবে এই সংস্কারের ফলেই বেলভেডিয়ার হাউস ফিরে পেল তার আগের চেহারা। বলরুমের কাঠের মেঝে, উপর তলায় ওঠার জন্য ঘোরানো কাঠের সিঁড়ি, ফায়ারপ্লেস, এমনকি কয়েকটি জায়গায় রয়ে গেছে সেই পুরনো দিনের টাইলস। এরই মধ্যে অর্থাৎ বেলভেডিয়ার হাউসে লাইব্রেরী থাকাকালীন সাক্ষী হয়েছিল কিছু বিখ্যাত মুহূর্তের। এরই মধ্যে বলে রাখা ভালো ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে এই বেলভেডিয়ার হাউসের সিঁড়িতেই সত্যজিৎ রায় পেয়েছিলেন ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সন্মান লেজিওঁ দনর। ২০১১ সালে এখানেই ঘটেছিল ভারতে চিনা সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী। এদিকে সংস্কারের পর থেকেই কিন্তু বেলভেডিয়ার হাউসে ঘটে চলেছে বিভিন্ন প্রদর্শনী। কখনও পুরনো দিনের চিত্র প্রদর্শনী তো কখনও ডিজিটাল প্রদর্শনীর মাধ্যমে বাংলাকে তুলে ধরা। কলকাতা জাদুঘরের পক্ষ থেকেও বেলভেডিয়ার হাউস কে মিউজিয়ামে পরিণত করার কথা চলছে। ভারত সরকারও ঠিক করেছে এখানেই গড়ে উঠবে কলকাতার আরও একটি মিউজিয়াম, বলা চলে সংগ্রহশালা। যেমন মেটক্যাফে হলের আমি কলকাতা, কিমবা ওল্ড কারেন্সি বিল্ডিং এর ঘরে বাইরে মিউজিয়াম, ঠিক তেমনই হতে চলেছে বেলভেডিয়ার হাউসের সংগ্রহশালা।

******************************************************

লেখা, গবেষণা ও ছবি - প্রীতম নস্কর  

ই-মেল - pritamnaskar.pn@gmail.com

ব্লগটি ভালো লেগে থাকলে ব্লগের লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন, তবে পূর্বানুমতি ছাড়া আমার তোলা আলোকচিত্রগুলি এবং ব্লগের রচনাগুলি অন্য কোথাও কপি-পেস্ট বা বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করা চলবে না।

******************************************************


উত্তরদিকের অংশের স্থাপত্য ও আয়নিক রীতিতে গড়ে ওঠা স্তম্ভ

উত্তরদিকের প্রবেশদ্বারে আয়নিক কলাম

গুগল ম্যাপ / কোঅরডিনেট -

প্রবেশমূল্য ও সময়সূচী -

বেলভেডিয়ার হাউস বছরের প্রায় সব দিনই (শুধুমাত্র সরকারি ছুটি বাদ দিয়ে) সকাল ১০ টা থেকে বিকাল ৫:৩০ পর্যন্ত খোলা থাকে। প্রবেশমূল্য নেই, তবে প্রবেশের ক্ষেত্রে যেকোন পরিচয়পত্র আনা আবশ্যিক।

তথ্যসূত্র -

  • কলিকাতা সেকালের ও একালের হরিসাধন মুখোপাধ্যায়
  • বনেদি কলকাতার ঘরবাড়ি দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায়
  • কলকাতা সংক্রান্ত পূর্ণেন্দু পত্রী
  • কলকাতা অ্যালবাম অশোক কুমার মিত্র
  • Calcutta Old and New –by H.E.A. Cotton
  • The Story of Government House – by N.V.H. Symons
  • Calcutta Past and Present – by Cathleen Blechynden




দ্বিতলে ওঠার কাঠের সিঁড়ি

বেলভেডিয়ার এস্টেট চত্বরেই পড়ে থাকা ঐতিহাসিক নিদর্শন

Comments

Post a Comment